সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

কুসংস্কারের শেষ

কুসংস্কারের শেষ

কুসংস্কারের শেষ

আমরা কি নিজেদের মধ্যে কুসংস্কারের প্রতি প্রবণতা বুঝতে পারি? উদাহরণস্বরূপ, আমরা কি একজন ব্যক্তির গায়ের রং, জাতিয়তা, সাম্প্রদায়িক দল অথবা উপজাতির ওপর ভিত্তি করে সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে উপসংহারে আসি—যদিও আমরা সেই ব্যক্তিকে জানি না? অথবা আমরা কি প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার অদ্বিতীয় গুণাবলির জন্য মূল্যায়ন করতে পারি?

যিশুর দিনে, যে-লোকেরা যিহূদিয়া এবং গালীলে বাস করত, তাদের সাধারণত “শমরীয়দের সহিত . . . ব্যবহার” ছিল না। (যোহন ৪:৯) তালমুডে লিপিবদ্ধ একটা প্রবাদ নিঃসন্দেহে অনেক যিহুদির অনুভূতি প্রকাশ করেছিল: “আমি যেন কখনও কোনো শমরীয়ের দিকে না তাকাই।”

এমনকি যিশুর প্রেরিতরাও হয়তো শমরীয়দের বিরুদ্ধে কিছুটা কুসংস্কার পোষণ করত। একবার তাদেরকে শমরীয়দের একটা গ্রামে সদয়ভাবে গ্রহণ করা হয়নি। যাকোব এবং যোহন জিজ্ঞেস করেছিল যে, অসংবেদনশীল লোকেদের ওপর আগুন নেমে আসতে বলা তাদের উচিত কি না। তিরস্কার করার মাধ্যমে যিশু দেখিয়েছিলেন যে, তাদের মনোভাব সঠিক ছিল না।—লূক ৯:৫২-৫৬.

পরবর্তী সময়ে, যিশু এমন একজন ব্যক্তির নীতিগল্প বলেছিলেন, যিনি যিরূশালেম থেকে যিরীহোতে যাওয়ার পথে দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। পাশ দিয়ে যাওয়া দুজন ধার্মিক যিহুদি সেই ব্যক্তিকে সাহায্য করার তাগিদ অনুভব করেনি। কিন্তু, একজন শমরীয় থেমেছিলেন এবং সেই ব্যক্তির ক্ষতস্থান বেঁধে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি সেই ব্যক্তির যত্নের ব্যবস্থা করেছিলেন, যাতে তিনি আঘাত থেকে সুস্থ হতে পারেন। সেই শমরীয় নিজেকে একজন প্রকৃত প্রতিবেশী হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন। (লূক ১০:২৯-৩৭) যিশুর নীতিগল্প হয়তো তাঁর শ্রোতাদের এটা বুঝতে সাহায্য করেছিল যে, তাদের কুসংস্কার তাদেরকে অন্যদের উত্তম গুণাবলি দেখার ক্ষেত্রে অন্ধ করে রেখেছে। কয়েক বছর পর, যোহন শমরীয়ায় ফিরে এসেছিলেন এবং এর বিভিন্ন গ্রামের অনেকের কাছে প্রচার করেছিলেন—সম্ভবত সেই গ্রামটাও ছিল, যেটা ধ্বংস হোক বলে তিনি একবার চেয়েছিলেন।—প্রেরিত ৮:১৪-১৭, ২৫.

প্রেরিত পিতরকেও পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করতে হয়েছিল, যখন একজন দূত তাকে কর্ণীলীয় নামে একজন রোমীয় সেনাপতির কাছে যিশুর বিষয়ে কথা বলার জন্য পরিচালনা দিয়েছিলেন। ন-যিহুদি ব্যক্তিদের সঙ্গে পিতরের ওঠাবসা ছিল না এবং বেশির ভাগ যিহুদি রোমীয় সৈন্যদের ভালবাসত না। (প্রেরিত ১০:২৮) কিন্তু, পিতর যখন এই বিষয়ে ঈশ্বরের নির্দেশনা দেখেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন: “আমি সত্যই বুঝিলাম, ঈশ্বর মুখাপেক্ষা [“পক্ষপাতিত্ব,” NW] করেন না; কিন্তু প্রত্যেক জাতির মধ্যে যে কেহ তাঁহাকে ভয় করে ও ধর্ম্মাচরণ করে, সে তাঁহার গ্রাহ্য হয়।”—প্রেরিত ১০:৩৪, ৩৫.

কুসংস্কারের সঙ্গে লড়াই করার প্রেরণা

কুসংস্কার এক মৌলিক নীতিকে লঙ্ঘন করে, যেটা যিশু শিখিয়েছিলেন: “অতএব সর্ব্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি সেইরূপ করিও।” (মথি ৭:১২) কে শুধুমাত্র তার জন্মস্থান, গায়ের রং অথবা পটভূমির জন্য অবজ্ঞাত হতে চায়? এ ছাড়া, কুসংস্কার পক্ষপাতহীনতার বিষয়ে ঈশ্বরের মানগুলোকেও লঙ্ঘন করে। বাইবেল শিক্ষা দেয় যে, যিহোবা “এক ব্যক্তি হইতে মনুষ্যদের সকল জাতিকে উৎপন্ন করিয়াছেন, যেন তাহারা সমস্ত ভূতলে বাস করে।” (প্রেরিত ১৭:২৬) তাই, সমস্ত মানুষ একে অপরের ভাই।

এ ছাড়া, ঈশ্বর প্রত্যেক ব্যক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে বিচার করেন। তিনি একজন ব্যক্তিকে তার বাবামা অথবা পূর্বপুরুষ যা করেছে, সেটার জন্য নিন্দা করেন না। (যিহিষ্কেল ১৮:২০; রোমীয় ২:৬) এমনকি অন্য জাতির কাছ থেকে আসা অত্যাচারও সেই জাতির লোকেদের ঘৃণা করার কোনো বৈধ কারণ নয়, যাদের হয়তো ব্যক্তিগতভাবে অবিচারের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। যিশু তাঁর অনুসারীদের ‘আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিতে, এবং যাহারা তাহাদিগকে তাড়না করে তাহাদের জন্য প্রার্থনা করিতে’ শিক্ষা দিয়েছিলেন।—মথি ৫:৪৪, ৪৫.

এই ধরনের শিক্ষাগুলোর কারণে, প্রথম শতাব্দীর খ্রিস্টানদের তাদের কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠার জন্য সাহায্য করা হয়েছিল এবং তারা এক অদ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজে পরিণত হয়েছিল। তারা একে অপরকে ভাই ও বোন বলে ডাকত এবং নিজেদেরকে তা-ই মনে করত, এমনকি যদিও তারা ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি থেকে এসেছিল। (কলসীয় ৩:৯-১১; যাকোব ২:৫; ৪:১১) যে-নীতি এই রূপান্তরে সহায়তা করেছিল, তা আজকেও একই উপকারগুলো নিয়ে আসতে পারে।

আজকে কুসংস্কারের সঙ্গে লড়াই করা

বাস্তবিকপক্ষে, আমাদের সকলেরই বিভিন্ন বিষয়ে পূর্বধারণা রয়েছে কিন্তু সেগুলো কুসংস্কারের দিকে পরিচালিত করবে এমন নয়। “পূর্বনিষ্পত্তি কেবলমাত্র তখনই কুসংস্কারে পরিণত হয়, যদি সেগুলোকে নতুন জ্ঞানের প্রেক্ষাপটে বাতিল করা না যায়,” কুসংস্কারের প্রকৃতি (ইংরেজি) বই বলে। প্রায়ই, কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে, যখন লোকেরা একে অপরকে ভালভাবে জানে। কিন্তু, সেই একই উৎস মন্তব্য করে, “একমাত্র যেধরনের সম্পর্ক লোকেদের একত্রে কাজ করতে পরিচালিত করে, সেটা সম্ভবত পরিবর্তিত মনোভাবের ফলে আসে।”

জন নামে নাইজেরিয়ার ইবো লোকেদের একজন, হাউসা লোকেদের বিরুদ্ধে তার কুসংস্কার কাটিয়ে উঠেছিলেন। “বিশ্ববিদ্যালয়ে,” তিনি বলেন, “কিছু হাউসা ছাত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, যারা আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিল আর আমি আবিষ্কার করেছিলাম যে, তাদের নীতিগুলো উত্তম। আমি একজন হাউসা ছাত্রের সঙ্গে যৌথ প্রকল্পে কাজ করেছিলাম আর আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল; অথচ আমার আগের সঙ্গী, যে ছিল একজন ইবো, সে তার পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে কাজ করেনি।”

কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠার এক হাতিয়ার

জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ইউনেস্কো রিপোর্ট অনুসারে “নতুন ধরনের জাতিবিদ্বেষ, বৈষম্য এবং বহিষ্করণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শিক্ষা এক মূল্যবান হাতিয়ার হতে পারে।” যিহোবার সাক্ষিরা বিশ্বাস করে যে, এই ক্ষেত্রে বাইবেলের শিক্ষা প্রকৃতই সবচেয়ে উত্তম সাহায্য। (যিশাইয় ৪৮:১৭, ১৮) লোকেরা যখন এর শিক্ষাগুলো প্রয়োগ করে, তখন সন্দেহের জায়গায় সম্মান আসে এবং ঘৃণা প্রেমের দ্বারা ম্লান হয়ে যায়।

যিহোবার সাক্ষিরা দেখেছে যে, বাইবেল তাদেরকে তাদের কুসংস্কার কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করছে। বস্তুত, বাইবেল ভিন্ন সংস্কৃতি এবং সম্প্রদায়ের লোকেদের সঙ্গে কাজ করতে তাদের প্রেরণা এবং সুযোগ দুটোই দেয়। এই ধারাবাহিক প্রবন্ধের প্রথম প্রবন্ধে উল্লেখিত ক্রিস্টিনা যিহোবার সাক্ষিদের একজন। “কিংডম হলে আমাদের সভাগুলো আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে,” সে বলে। “আমি সেখানে নিরাপদ বোধ করি কারণ আমি মনে করি না যে, সেখানে আমার প্রতি কারও কুসংস্কার রয়েছে।”

জেসমিনও যিহোবার সাক্ষিদের একজন আর তিনি নয় বছর বয়সে প্রথম জাতিবিদ্বেষের শিকার হওয়ার কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন: “বৃহস্পতিবারগুলো আমার জন্য সবসময়ই সপ্তাহের সবচেয়ে সহজ দিন কারণ সেই দিন আমি কিংডম হলে যাই। সেখানে লোকেরা আমার প্রতি ভালবাসা দেখায়। তাদের জন্য নিজেকে অবজ্ঞাত মনে করার চেয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।”

যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা স্বেচ্ছাসেবকের প্রকল্পগুলোও বিভিন্ন পটভূমির লোকেদের একত্রিত করে। সাইমন ব্রিটেনে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যদিও তার পরিবার ক্যারিবিয়ান থেকে এসেছে। তাকে অনেক কুসংস্কারের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, যখন তিনি জগতের নির্মাণ কোম্পানিগুলোতে রাজমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু, সেই বছরগুলোতে এমন ঘটনা ঘটেনি যখন তিনি তার বিশ্বাসী ভাইবোনদের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক প্রকল্পে সেবা করেছিলেন। “আমি বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সহসাক্ষিদের সঙ্গে কাজ করেছি,” সাইমন বলেন, “কিন্তু আমরা একে অপরকে ভালভাবে জানতে শিখেছি। আমার যে-ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা ছিল তাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্য দেশ এবং পটভূমি থেকে এসেছিল।”

অবশ্য, যিহোবার সাক্ষিরা অসিদ্ধ লোক। তাই, তাদেরও হয়তো কুসংস্কারের প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলতে হয়। কিন্তু, ঈশ্বর পক্ষপাতহীন তা জানা তাদেরকে তা করতে জোরালো প্রেরণা জোগায়।—ইফিষীয় ৫:১, ২.

কুসংস্কারের সঙ্গে লড়াই করার পুরস্কার অনেক। আমরা যখন অন্যান্য পটভূমির লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করি, তখন আমাদের জীবন সমৃদ্ধ হয়। এ ছাড়া, তাঁর রাজ্যের মাধ্যমে ঈশ্বর শীঘ্রই এমন এক মানবসমাজ প্রতিষ্ঠা করবেন, যেখানে ধার্মিকতা বসতি করবে। (২ পিতর ৩:১৩) সেই সময় কুসংস্কারকে চিরকালের জন্য জয় করা হবে। (g০৪ ৯/৮)

[১১ পৃষ্ঠার বাক্স]

আমি কি কুসংস্কার পুষে রাখি?

অসতর্কভাবে কোনো কুসংস্কার পুষে রাখছেন কি না, তা বিশ্লেষণ করার জন্য নিজেকে নিচের প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করুন:

১. আমি কি এইরকম মনে করি যে, কোনো সাম্প্রদায়িক পটভূমি, অঞ্চল, অথবা জাতি থেকে আসা লোকেদের অবাঞ্ছিত বৈশিষ্ট্য যেমন মূর্খতা, অলসতা অথবা কৃপণতা রয়েছে? (অনেক রসিকতা এই ধরনের কুসংস্কারকে পুষে রাখে।)

২. আমার অর্থনৈতিক অথবা সামাজিক সমস্যার জন্য আমি কি অভিবাসী অথবা অন্য সাম্প্রদায়িক দলের লোকেদের দোষ দিই?

৩. অন্য কোনো জাতির প্রতি আমার এলাকার ঐতিহাসিক শত্রুতার জন্য আমি কি সেই জাতি থেকে আসা লোকেদের প্রতি বিদ্বেষ অনুভব করি?

৪. যাদের সঙ্গে আমার দেখা হয় তাদের প্রত্যেককে কি আমি একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখতে সক্ষম—তার গায়ের রং, সংস্কৃতি অথবা সাম্প্রদায়িক পটভূমি যা-ই হোক না কেন?

৫. আমার নিজের সাংস্কৃতিক পটভূমি থেকে আলাদা লোকেদের জানার সুযোগকে কি আমি গ্রহণ করি? তা করার জন্য আমি কি প্রচেষ্টা করি?

[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

উত্তম শমরীয়ের নীতিগল্পে, যিশু আমাদের শিখিয়েছিলেন যে, কীভাবে কুসংস্কার কাটিয়ে ওঠা যায়

[৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

কর্ণীলীয়ের বাড়িতে পিতর বলেছিলেন: “আমি সত্যই বুঝিলাম, ঈশ্বর পক্ষপাতিত্ব করেন না”

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাইবেলের শিক্ষা বিভিন্ন পটভূমির লোকেদের একত্রিত করে

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

যিহোবার সাক্ষিরা যা শেখে তা কাজে লাগায়

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

ক্রিস্টিনা—“কিংডম হলে সভাগুলো আমার আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলেছে”

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

জেসমিন—“লোকেরা আমার প্রতি ভালবাসা দেখায়। তাদের জন্য নিজেকে অবজ্ঞাত মনে করার চেয়ে বরং গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি”

[১০ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

সাইমন, নির্মাণপ্রকল্পের একজন স্বেচ্ছাসেবক—“আমরা একে অপরকে ভালভাবে জানতে শিখেছি”