সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

খ্যাতির চেয়ে উত্তম কিছু

খ্যাতির চেয়ে উত্তম কিছু

খ্যাতির চেয়ে উত্তম কিছু

বলেছেন চার্ল স সিনাটকো

আমাকে ১৯৫৭ সালে, সপ্তাহে এক হাজার ডলার শর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নেভাদার লাস ভিগাসে গান গাইতে ১৩ সপ্তাহের জন্য একটা চুক্তি করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তারা এও প্রস্তাব দেয় যে, যদি আমার অনুষ্ঠান ভাল হয়, তা হলে আরও ৫০ সপ্তাহের জন্য আমি চুক্তিবদ্ধ হতে পারব। তার মানে অতিরিক্ত ৫০,০০০ মার্কিন ডলার—সেই সময়ের জন্য বেশ বড় অঙ্কের টাকা। আসুন আপনাদের বলি যে, কীভাবে আমি এই লোভনীয় প্রস্তাবটা পেয়েছিলাম আর এটা গ্রহণ করব কি করব না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া কেন এতটা কঠিন হয়ে পড়েছিল।

বাবা ইউক্রেনের লোক ছিলেন, যিনি ১৯১০ সালে পূর্ব ইউরোপে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালে তার মা তাকে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে এসেছিলেন, যেখানে তিনি তার স্বামীর সঙ্গে পুনর্মিলিত হন। বাবা ১৯৩৫ সালে বিয়ে করেন আর এক বছর পর পেনসিলভানিয়ার আ্যমব্রিজে আমার জন্ম হয়। সেই সময়ের দিকে বাবার দুই দাদা যিহোবার সাক্ষি হয়েছিল।

আমার তিন ভাই ও আমি যখন ছোট ছিলাম ও আমাদের পরিবার যখন পেনসিলভানিয়ার নিউ ক্যাসেলের কাছে থাকত, তখন মা সাক্ষিদের সঙ্গে অল্প কিছুদিন বাইবেল অধ্যয়ন করেছিলেন। সেই সময় আমার বাবামা কেউই সাক্ষি হয়নি কিন্তু বাবা বিশ্বাস করতেন যে, তার দাদাদের নিজের পছন্দমতো ধর্ম পালন করার অধিকার রয়েছে। যদিও বাবা আমাদের দেশপ্রেমিক হিসেবে বড় করে তুলেছিলেন কিন্তু তিনি সবসময় প্রত্যেকের নিজের পছন্দমতো ধর্ম পালন করার অধিকারের পক্ষে ছিলেন।

গানের এক কেরিয়ার

আমার বাবামা মনে করত যে আমি জন্মগতভাবে গানের গলা পেয়েছি, তাই আমি যাতে এই ক্ষেত্রে উন্নতি করতে পারি সেইজন্য তারা তাদের যথাসাধ্য করেছিল। আমার বয়স যখন ছয় কি সাত, তখন বাবা আমাকে গিটার বাজিয়ে গান গাওয়ার জন্য একটা নাইটক্লাবের বারে নিয়ে যেতেন। আমি “মাদার” নামের গানটা গাইতাম। সেই গানটা একজন প্রেমময় মায়ের গুণাবলি বর্ণনা করে এবং অত্যন্ত মর্মস্পর্শী চড়া সুর দিয়ে শেষ হয়। সেই বারে উপস্থিত পুরুষরা যারা প্রায়ই অতিরিক্ত মদ খেয়ে মাতাল হয়ে যেত, তারা কেঁদে উঠত ও বাবার টুপির মধ্যে পয়সা রাখত।

১৯৪৫ সালে, নিউ ক্যাসেলের ডাব্‌লিউকেএসটি রেডিও স্টেশনে আমার প্রথম রেডিও অনুষ্ঠান হয় আর আমি লোকসংগীত গেয়েছিলাম। পরে আমি সাপ্তাহিক নেটওয়ার্ক রেডিও অনুষ্ঠান হিট প্যারেড, যেটাতে সপ্তাহের সবচেয়ে জনপ্রিয় দশটা গান সম্প্রচার হতো, সেখানে জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে আমার গানের ভুবনকে বাড়িয়েছিলাম। ১৯৫০ সালে পল হোয়াইটম্যানের অনুষ্ঠানে আমাকে টেলিভিশনে প্রথম দেখা যায়। তার বিন্যাসে জর্জ গার্শউইনের “র্‌যাপ্‌সডি ইন ব্লু” এখনও বিখ্যাত। এর কিছু পরই বাবা আমাদের পেনসিলভানিয়ার বাড়িটা বিক্রি করে দেন আর গায়ক হিসেবে আমার কেরিয়ারকে সম্প্রসারিত করার আশায় আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস এলাকায় চলে যাই।

বাবার একনিষ্ঠ চেষ্টার ফলে আমি শীঘ্রই পাসাডিনাতে আমার নিজের এক সাপ্তাহিক রেডিও অনুষ্ঠান এবং হলিউডে আধঘন্টার এক সাপ্তাহিক টেলিভিশন অনুষ্ঠান শুরু করি। আমি টেড ডেলের একশো জনের এক অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে ক্যাপিটল রেকর্ডস-এ অনেক রেকর্ডিং করি আর সিবিএস রেডিও নেটওয়ার্কে একজন গায়ক হয়ে উঠি। ১৯৫৫ সালে, আমি গীতি-নৃত্য-নাট্যের এক দলকে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার লেক টাহোতে নিয়ে যাই। সেখানে থাকাকালীন আমার জীবনের অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো লক্ষণীয়ভাবে বদলে যায়।

অগ্রাধিকারের নতুন বিষয়গুলো গড়ে তোলা

সেই সময়ের দিকে, জন জ্যাঠা—বাবার বড় দাদা, তিনিও পেনসিলভানিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যান—আমাকে “ঈশ্বর যেন সত্য হোন” (ইংরেজি) বইটি দেন। * * আমি বইটিকে সঙ্গে করে লেক টাহোতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের শেষ অনুষ্ঠানের পর, যা মধ্যরাতের প্রায় অনেক পরে শেষ হয়েছিল, আমি ঘুমোতে যাওয়ার আগে নিজেকে একটু হালকা করতে বইটি পড়তে শুরু করি। দীর্ঘদিন ধরে যে-প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল, বাইবেল থেকে সেগুলোর উত্তর পেয়ে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।

সেই রাতের ঘটনার কিছুদিন পর থেকেই আমি কাজের পর নাইটক্লাবের কাছাকাছি বসে সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করতে থাকি, যে-আলোচনা প্রায়ই ভোরবেলা পর্যন্ত চলত। মৃত্যুর পরে জীবন, কেন ঈশ্বর দুষ্টতা থাকতে দিয়েছেন এবং মানুষ কি শেষ পর্যন্ত নিজেকে ও পৃথিবীকে ধ্বংস করবে, এই ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতাম। কয়েক মাস পর, ১৯৫৫ সালের ৯ই জুলাই লস এঞ্জেলসের রিগলি ফিল্ডে অনুষ্ঠিত যিহোবার সাক্ষিদের এক জেলা সম্মেলনে আমি যিহোবা ঈশ্বরকে সেবা করার উদ্দেশ্যে আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিই।

ছয় মাসেরও কম সময় পর, ১৯৫৫ সালে বড়দিনের এক সকালে হেনরি রাসেল নামে একজন সহসাক্ষি, তার সঙ্গে জ্যাক ম্যাকয় নামে বিনোদন জগতের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানান। হেনরি নিজে এনবিসি কোম্পানির সংগীত পরিচালক ছিলেন। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছিলাম, তখন জ্যাকসহ তার তিন ছেলেমেয়ে ও তার স্ত্রী বসে আমাদের কথা শোনে, যদিও তখন তারা সবেমাত্র তাদের বড়দিনের উপহারগুলো খুলছিল। তিনি ও তার পরিবার শীঘ্রই সাক্ষি হন।

সেই সময়ের দিকে আমি মার সঙ্গে অধ্যয়ন করেছিলাম আর তিনি বাইবেলের সত্যকে গ্রহণ করে নেন। শেষ পর্যন্ত তিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন ও পূর্ণসময়ের একজন সুসমাচার প্রচারক অর্থাৎ অগ্রগামী হন। পরে, আমার তিন ভাইও বাপ্তিস্ম নিয়েছিল এবং কিছু সময়ের জন্য অগ্রগামী পরিচর্যায় অংশ নিয়েছিল। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, ২০ বছর বয়সে আমি একজন অগ্রগামী হয়েছিলাম।

চাকরি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো

এই সময়ের দিকে আমার সংস্থার ব্যক্তিগত বন্ধু জর্জ মারফি আমার উন্নতির প্রতি আগ্রহ দেখান। জর্জ ১৯৩০ ও ১৯৪০ এর দশকে অসংখ্য ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। মারফির সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে, ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি নিউ ইয়র্ক সিটির সিবিএস টিভিতে জ্যাকি গ্লিসন শোতে অভিনয় করি। আমার কেরিয়ারে এটা এক বিরাট প্রেরণা জুগিয়েছিল কারণ সেই অনুষ্ঠান প্রায় ২,০০,০০,০০০ দর্শক দেখেছিল। নিউ ইয়র্কে থাকার সময় আমি প্রথমবার ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শন করি।

গ্লিসন শোতে অভিনয় করার পর আমি এমজিএম স্টুডিওর সঙ্গে সিনেমা করার জন্য সাত বছরের একটা চুক্তিতে সাক্ষর করি। আমি টিভি ওয়েস্টার্ন নামে এক ধারাবাহিক নাটকের একটা চরিত্রে নিয়মিত অভিনয় করার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। কিন্তু, কিছু সময় পর আমার বিবেক আমাকে দংশন করতে শুরু করে কারণ আমাকে জুয়াড়ি এবং বন্দুকবাজের চরিত্রে অভিনয় করতে হতো—যে-চরিত্রগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল অনৈতিকতাপূর্ণ প্রেমের দৃশ্য ও অন্যান্য অখ্রিস্টীয় আচরণ। তাই, আমি সেই পেশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন বিনোদন ব্যবসায় জড়িত লোকেরা ভেবেছিল আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।

ঠিক এই সময়ে আমি লাস ভিগাসে এক লোভনীয় প্রস্তাব পাই, যেবিষয়ে শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের মণ্ডলীতে ভ্রমণ অধ্যক্ষের পরিদর্শনের সপ্তাহেই আমার সেই কাজ শুরু করার কথা ছিল। আমি যদি তখন চাকরিটা না নিই, তা হলে আমি সবকিছুই হারাব। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিলাম কারণ বাবা সেই দিনের অপেক্ষায় ছিলেন যেদিন আমি প্রচুর টাকাপয়সা রোজগার করব! আমি মনে করেছিলাম যে, তিনি এই প্রতিদান পাওয়ার যোগ্য কারণ আমার কেরিয়ারের উন্নতির জন্য তিনি অনেক কিছু করেছিলেন।

তাই, আমি আমাদের পরিচালক অধ্যক্ষ কার্ল পার্কের কাছে যাই, যিনি নিজে একজন সুরকার ছিলেন ও ১৯২০ এর দশকে নিউ ইয়র্কের রেডিও স্টেশন ডাব্‌লিউবিবিআর-এ একজন বেহালাবাদক ছিলেন। আমি তাকে বলি যে আমি যদি এই চুক্তিতে রাজি হই, তা হলে আমি সারাজীবন কোনোরকম অর্থনৈতিক উদ্বেগ ছাড়াই নির্দ্বিধায় অগ্রগামীর কাজ করতে পারব। “কী করবে, সেটা আমি তোমাকে বলতে পারব না,” তিনি বলেন, “তবে আমি তোমাকে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারি।” তিনি জিজ্ঞেস করেন, “প্রেরিত পৌল যদি এই সপ্তাহে আমাদের মণ্ডলী পরিদর্শন করতেন, তা হলে তুমি কি অন্যত্র যেতে?” তিনি আরও বলেন, “তুমি কী করবে, সেই সম্বন্ধে যিশু কী চান বলে তোমার মনে হয়?”

আমার মনে হয়েছিল যে, বিষয়টা খুবই স্পষ্ট। বাবাকে যখন বলি যে, আমি লাস ভিগাসের চাকরিটা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন তিনি বলেন যে আমি তার জীবনকে নষ্ট করে দিয়েছি। সেই রাতে তিনি .৩৮ ক্যালিবার বন্দুক হাতে নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তিনি আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিলেন—সম্ভবত খুব বেশি মদ খাওয়ার কারণে। এরপর তিনি গ্যারেজে মোটরগাড়ি থেকে বের হওয়া বাষ্প দ্বারা আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। আমি উদ্ধারকর্মীদের ফোন করি আর তারা তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

বাবার কড়া মেজাজ সম্বন্ধে জানায় আমাদের মণ্ডলীর অনেকে তাকে ভয় পেত কিন্তু আমাদের সীমা অধ্যক্ষ রয় ডেউয়েল তাকে ভয় পাননি। রয় যখন তাকে দেখতে যান, তখন বাবা তাকে বলেছিলেন যে, আমার জন্মের সময় বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বলতে গেলে ছিলই না। তখন বাবা ঈশ্বরের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, আমি যদি বেঁচে যাই, তা হলে তিনি তাঁর সেবায় আমাকে উৎসর্গ করবেন। রয় বাবাকে জিজ্ঞেস করেন যে, তিনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, ঈশ্বর হয়তো আশা করছেন যে তিনি তার প্রতিজ্ঞাটা পূরণ করবেন। সেটা বাবাকে অবাক করেছিল। এরপর রয় জিজ্ঞেস করেন, “পূর্ণসময়ের পরিচর্যা যদি ঈশ্বরের পুত্রের জন্য উপযুক্ত হয়, তা হলে আপনার ছেলের জন্য কেন উপযুক্ত হবে না?” সেই কথা শোনার পর মনে হয়েছিল বাবা আমার ইচ্ছাকেই মেনে নিয়েছেন।

এর মধ্যে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে শার্লি লার্জ তার অগ্রগামী সঙ্গীর সঙ্গে কানাডা থেকে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। আমি যখন শার্লি ও তার সঙ্গীর সঙ্গে ঘরে ঘরে পরিচর্যায় গিয়েছিলাম, তখন আমরা পরিচিত হয়ে উঠি। এর অল্প কিছু পরেই, শার্লিকে সঙ্গে নিয়ে আমি হলিউড বোলে গিয়েছিলাম, যেখানে আমি পার্ল বেইলির সঙ্গে গান গাই।

সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা

১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আমি আইয়া প্রদেশে একজন বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করার কার্যভার পাই। আমি যখন বাবাকে বলি যে আমি এই কার্যভারটা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন তিনি শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। আমার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি যা প্রকৃতই মূল্যবান ছিল, সেটাকে তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন না। আমি গাড়ি চালিয়ে হলিউডে গিয়েছিলাম এবং আমার সমস্ত চুক্তি বাতিল করেছিলাম। বিখ্যাত অর্কেস্ট্রা ও গায়কদলের প্রধান নায়ক ফ্রেড ওয়ারিং তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যাদের সঙ্গে আমি চুক্তি করেছি। তিনি আমাকে বলেন যে, আমি যদি আমার চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করি, তা হলে একজন গায়ক হিসেবে আর কখনোই কাজ করতে পারব না। তাই আমি তাকে বুঝিয়ে বলি যে, আমি যিহোবা ঈশ্বরের সেবায় আমার পরিচর্যাকে বাড়াতে আমার গানের কেরিয়ার ছেড়ে দিচ্ছি।

আমি যখন বিস্তারিতভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে বলি, তখন মি. ওয়ারিং সম্মানপূর্বক আমার কথা শুনেছিলেন আর এরপর তিনি বেশ মৃদুভাবে উত্তর দিয়ে আমাকে অবাক করে দিয়েছিলেন: “দেখো বাবা, তুমি এত ভাল একটা কেরিয়ার ছেড়ে দিচ্ছ বলে আমার দুঃখ হচ্ছে কিন্তু আমি সারাজীবন গান নিয়ে থাকায় এই বিষয়টা জেনেছি যে, জীবনে গানের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। তোমার সমস্ত কাজে ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন।” আমার এখনও মনে আছে যে, আমি আনন্দাশ্রু নিয়ে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরি, বুঝতে পারি যে যিহোবার সেবায় আমার জীবন বিলিয়ে দেওয়ার জন্য আমি এখন স্বাধীন।

“তোমার বিশ্বাস কোথায়?”

আমি আমার অগ্রগামী সঙ্গী জো ট্রিফের সঙ্গে আইয়ার স্ট্রবেরি পয়েন্ট শহরে সেবা করতে শুরু করি, যেখানকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০০ জন। শার্লি আমাদের এখানে বেড়াতে আসে আর আমরা নিজেদের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করি। আমার বা তার কারোরই কোনো সঞ্চয় ছিল না। আমি যে-টাকাপয়সা রোজগার করেছিলাম, সবই আমার বাবাকে দিয়ে দিয়েছিলাম। তাই আমি তাকে বলি: “আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু আমাদের জীবন চলবে কীভাবে? আমার সর্বসাকুল্যে যা রয়েছে তা হল, আমার বিশেষ অগ্রগামী ভাতা, মাসে ৪০ মার্কিন ডলার।” শার্লি তার যথারীতি শান্ত, সরাসরি, সোজাসাপটা ভঙ্গিতে বলেছিল: “কিন্তু চার্লস, তোমার বিশ্বাস কোথায়? যিশু বলেছিলেন যে, আমরা যদি প্রথমে তাঁর রাজ্য ও ধার্মিকতার বিষয়ে চেষ্টা করি, তা হলে তিনি আমাদের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো জোগাবেন।” (মথি ৬:৩৩) সেই কথাই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। আর আমরা ১৯৫৭ সালের ১৬ই নভেম্বর বিয়ে করি।

স্ট্রবেরি পয়েন্ট শহরের বাইরে একজন কৃষককে আমি বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম, যার জঙ্গলের মধ্যে নিজের জমিতে দৈর্ঘ্য প্রস্থে ৩.৬ মিটার একটা কাঠের বাড়ি ছিল। এখানে বিদ্যুৎ বা জলের কোনো ব্যবস্থা এবং কোনো শৌচাগারও ছিল না। কিন্তু আমরা চাইলে সেখানে বিনামূল্যেই থাকতে পারতাম। এটা খুবই পুরনো ঘর ছিল কিন্তু আমরা ভেবে দেখি যে, যেহেতু আমরা সারাদিন পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকব তাই ঘুমানোর জন্য আমাদের শুধুমাত্র একটা জায়গার দরকার।

আমি কাছের একটা ঝরণা থেকে জল নিয়ে আসতাম। আমরা কাঠের চুলো দিয়ে ঘরটাকে গরম রাখতাম ও রাতে কেরোসিনের বাতিতে পড়তাম; শার্লি কেরোসিনের চুলোতে রান্না করত। স্নান করার জন্য আমরা পুরনো একটা গামলা ব্যবহার করতাম। আমরা রাতে নেকড়ের হুংকার শুনতে পেতাম আর একে অন্যকে কাছে পেয়ে এবং যেখানে খ্রিস্টান পরিচারকদের বেশি প্রয়োজন সেখানে একসঙ্গে যিহোবাকে সেবা করতে পেরে আনন্দিত ছিলাম। বিল ম্যালিনফন্ট ও তার স্ত্রী স্যান্ড্রা, যারা এখন ব্রুকলিন বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে সেবা করছে, তারা ১০০ কিলোমিটার দূরে আইয়ার ডিকোরায় বিশেষ অগ্রগামী ছিল। তারা মাঝে মাঝে আমাদের এখানে আসত ও পুরো দিন ক্ষেত্রের পরিচর্যায় আমাদের সঙ্গে কাটাত। ধীরে ধীরে স্ট্রবেরি পয়েন্টে প্রায় ২৫ জন সদস্যের একটা ছোট্ট মণ্ডলী গড়ে ওঠে।

ভ্রমণ কাজে

১৯৬০ সালের মে মাসে আমাদের সীমার কাজে অর্থাৎ ভ্রমণ পরিচর্যায় আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাদের প্রথম সীমা ছিল নর্থ ক্যারোলাইনাতে আর এটার মধ্যে ছিল রলি, গ্রিনজ্‌বোরো, ডুরাম ও সেইসঙ্গে আরও ছোট ছোট গ্রাম্য শহর। আমাদের জীবনযাপনের মান উন্নত হয়েছিল, যখন আমরা এমন অনেক পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করি, যাদের বিদ্যুৎ ছিল ও এমনকি ঘরের ভিতরেই শৌচাগার ছিল। কিন্তু, যে-পরিবারগুলোর শৌচাগার ঘরের বাইরে ছিল তাদের দেওয়া সতর্কবাণী খুব সান্ত্বনাজনক ছিল না। তারা আমাদেরকে কপারহেড ও র্‌যাটেল নামের বিষাক্ত সাপের ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিল!

১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে আমাদের ফ্লোরিডার এক সীমায় বদলি করা হয়, যেখানে গুরুতরভাবে আমার হৃদাবরণের স্ফীতি ঘটেছিল অর্থাৎ পেরিকারডাইটিস হয়েছিল আর আমি প্রায় মরেই গিয়েছিলাম। টেমপা শহরের বব ও জিনি ম্যাকি যদি আমাদের সাহায্য না করত, তা হলে আমি হয়তো মরেই যেতাম। * তারা আমাকে তাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল ও সেইসঙ্গে ডাক্তারের সমস্ত খরচ দিয়েছিল।

আমার প্রাথমিক প্রশিক্ষণকে কাজে লাগানো

১৯৬৩ সালের গরমের সময়, আমাকে নিউ ইয়র্কে যিহোবার সাক্ষিদের এক বড় সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কিছু কাজের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, যা সেখানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আমি যিহোবার সাক্ষিদের একজন মুখপাত্র মিলটন হেনশেলের সঙ্গে রেডিওর একটা টকশোতে যোগ দিয়েছিলাম, যেটার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ল্যারি কিং। মি. কিং এখনও টেলিভিশন টকশোর পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিখ্যাত। তিনি আমাদের সঙ্গে বেশ সম্মানপূর্বক কথা বলেছিলেন এবং সেই অনুষ্ঠানের পর প্রায় এক ঘন্টা আমাদের কাজ সম্বন্ধে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন।

সেই বছর গরমের সময় হ্যারল্ড কিং, যিনি একজন মিশনারি ছিলেন ও সাম্যবাদী চিনের কারাগার থেকে সবেমাত্র মুক্তি পেয়েছিলেন, তিনি সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ের একজন অতিথি হয়ে আসেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি প্রায় ৭০০ জন শ্রোতার সামনে তার কিছু অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন এবং ব্যাখ্যা করেন যে, চার বছরেরও বেশি সময় নির্জন কারাবাস তার বিশ্বাসকে কীভাবে শক্তিশালী করেছে। কারাগারে থাকার সময় তিনি সেই মূলভাবের ওপর গানগুলো লিখেছিলেন, যা বাইবেল ও খ্রিস্টীয় পরিচর্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

সেই স্মরণীয় সন্ধ্যায় আমি অড্রি নর, কার্ল ক্লাইন এবং ফ্রেড ফ্রাঞ্জের—চড়া কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য প্রশিক্ষিত দীর্ঘদিনের সাক্ষির—সঙ্গে “ঘরে ঘরে” এই গানটা গাওয়ায় অংশ নিয়েছিলাম, যে-গানটা পরে যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা ব্যবহৃত গানবইয়ে যুক্ত করা হয়। নেথেন নর, যিনি তখন সাক্ষিদের কাজে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি আমাকে পরের সপ্তাহে ইয়াংকি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিতব্য “অনন্তকালীন সুসমাচার” সম্মেলনে গান গাওয়ার জন্য বলেন ও আমি গান গাই।

ভ্রমণ কাজের অভিজ্ঞতাগুলো

আমরা যখন ইলিনোয়ার শিকাগোতে সেবা করছিলাম, তখন দুটো স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমটা হচ্ছে, একটা সীমা সম্মেলনে ভিরা স্টুয়ার্ট নামে এক বোনকে শার্লি দেখেছিল, যিনি কানাডায় ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝিতে শার্লি ও তার মার কাছে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। শার্লির বয়স সেই সময় ১১ বছর ছিল আর বাইবেলে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা শুনে সে রোমাঞ্চিত হয়েছিল। ভিরাকে শার্লি জিজ্ঞেস করে, “আপনার কি মনে হয় যে, আমি সেই নতুন জগতে বাস করতে পারব?” ভিরা উত্তর দিয়েছিলেন, “না পারার তো কোনো কারণই আমি দেখছি না, শার্লি।” দুজনের কেউই সেই কথাগুলো একটুও ভোলেনি। ভিরার সঙ্গে সেই প্রথম সাক্ষাৎ হওয়ার পর থেকে শার্লি বুঝতে পেরেছিল যে, যিহোবাকে সেবা করাই ছিল তার ইচ্ছা।

দ্বিতীয় ঘটনাটা হচ্ছে, একদিন একজন সাক্ষি জিজ্ঞেস করেন যে, ১৯৫৮ সালের শীতের সময় আমি আমাদের বারান্দায় ২৫ কিলোগ্রামের একটা আলুর বস্তা পেয়েছিলাম বলে কিছু মনে পড়ে কি না। আমার মনে পড়ে যায়। একদিন সন্ধ্যায় প্রচণ্ড তুষার ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কষ্ট করে বাড়ি ফিরে আসার পর সেটা আমরা দেখেছিলাম! যদিও আমরা জানতাম না যে, এগুলো কোথা থেকে এসেছে, তবে এটা জোগানোর জন্য আমরা যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। তুষারপাতের কারণে আমরা পাঁচ দিন বাইরে যেতে পারিনি কিন্তু আমরা আলুর প্যানকেক, সেঁকা আলু, আলু ভাজা, আলু ভর্তা এবং আলুর সুপ খাওয়ার আনন্দ উপভোগ করেছিলাম! আমাদের অন্য আর কোনো খাবার ছিল না। সেই সাক্ষি আমাদের বা আমরা কোথায় থাকি তা জানতেন না কিন্তু তিনি শুনেছিলেন যে, কিছু অগ্রগামী কাছেই থাকে ও অনেক কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন যে, কোনো একটা বিষয় তাকে এই অল্পবয়সী দম্পতি কোথায় থাকে, সেই সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে পরিচালিত করেছিল। কৃষকরা তাদের প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে সমস্তকিছু জানে, তাই তাকে শীঘ্রই আমাদের ঘরটা দেখিয়ে দেওয়া হয় আর তিনি তুষারপাতের মধ্যে দিয়ে আলুগুলো বয়ে নিয়ে আসেন।

আমার নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ

ভ্রমণের কাজে ৩৩ বছর কাটানোর পর ১৯৯৩ সালের মধ্যে আমার স্বাস্থ্যের এতটা অবনতি ঘটে যে আমাকে পরিচর্যার সেই বিশেষ সুযোগটাকে ছেড়ে দিতে হয়। শার্লি ও আমি অসুস্থতার কারণে দুর্বল বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি আর এখনও তা-ই করে যাচ্ছি। আমার এখন আর ভ্রমণের কাজ করার শক্তি নেই বলে যদিও আমি দুঃখ করি কিন্তু আমি আমার শক্তিকে যেভাবে কাজে লাগিয়েছি তাতে আমি আনন্দিত।

আমার তিন ভাই আলাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রত্যেকে শেষ পর্যন্ত বস্তুগত সম্পদের পিছনে ছোটার সংকল্প নিয়েছে এবং বর্তমানে তাদের একজনও আর যিহোবাকে সেবা করছে না। ১৯৫৮ সালে বাবা বাপ্তিস্ম নেন। তিনি এবং মা অনেক লোককে যিহোবাকে জানতে, তাদের জীবন যিহোবার কাছে উৎসর্গ করতে ও বাপ্তিস্ম নিতে সাহায্য করেছিলেন। তারা দুজনেই ১৯৯৯ সালে মারা গিয়েছে। তাই, জাগতিক খ্যাতি ও ধনসম্পদকে প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত হয়তো আমার বাবা ও সেইসঙ্গে তিনি ও মা যাদের কাছে বাইবেলের সত্য জানিয়েছিলেন, তাদের জন্য জীবন এনে দিয়েছিল। আমি প্রায়ই ভাবি, ‘আমি যে-সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি, সেগুলো না নিলে আমি কি এখনও যিহোবাকে সেবা করে যেতাম?’

সীমার কাজ ছেড়ে দেওয়ার প্রায় পাঁচ বছর পর আমার স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছিল আর আমি আমার পরিচর্যাকে বাড়াতে পেরেছিলাম। আমি এখন ক্যালিফোর্নিয়ার ডেসার্ট হট স্প্রিংসের একটা মণ্ডলীতে একজন পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করছি। এ ছাড়া আমার বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার, বিশেষ কমিটিগুলোতে সেবা করার ও মাঝে মধ্যে অগ্রগামী পরিচর্যা বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়ার বিশেষ সুযোগ হয়।

এখন পর্যন্ত শার্লি আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু হিসেবে রয়েছে। তার সাহচর্যই আমি সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো নিয়ে আমরা নিয়মিতভাবে উদ্দীপনামূলক আলোচনা করে থাকি, দুজনে একসঙ্গে বাইবেলের সত্য আলোচনা করে আমরা রোমাঞ্চিত হই। আমি এখনও অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ৪৭ বছর আগে করা তার শান্ত প্রশ্নটা স্মরণ করি, “কিন্তু চার্লস, তোমার বিশ্বাস কোথায়?” অল্পবয়সী খ্রিস্টান দম্পতিরা যদি একে অন্যকে শুধুমাত্র এই ধরনের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, তা হলে আমি মনে করি যে, তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো আমাদের মতো পূর্ণসময়ের পরিচর্যার আনন্দ ও আশীর্বাদগুলো লাভ করবে। (g০৪ ৮/২২)

[পাদটীকাগুলো]

^ জন সিনাটকো ১৯৯৬ সালে ৯২ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত যিহোবার একজন বিশ্বস্ত সাক্ষি ছিলেন।

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

^ ১৯৭৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারির সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ১২-১৬ পৃষ্ঠায় পক্ষাঘাতের সঙ্গে বব ম্যাকির লড়াই সম্বন্ধে নিজের মুখে বলা কাহিনী রয়েছে।

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

জন জ্যাঠা ১৯৩৫ সালে, যে-বছর তিনি বাপ্তিস্ম নিয়েছেন

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের কাঠের বাড়ি

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৭৫ সালের আমার বাবামার ছবি যারা মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

বর্তমানে শার্লির সঙ্গে