সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরকে ভালবাসতে শিখেছি

ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরকে ভালবাসতে শিখেছি

ছেলেবেলা থেকেই ঈশ্বরকে ভালবাসতে শিখেছি

বলেছেন এনাটলি মেলনিক

অনেকে ভালবেসে আমাকে দাদু বলে ডাকে। এই শব্দটি আমার হৃদয় ছুঁয়ে যায়, কারণ এটি আমাকে আমার নিজের দাদুর কথা মনে করিয়ে দেয়, যাকে আমি গভীরভাবে ভালবাসতাম ও যার কাছে আমি অনেক ঋণী। আসুন আপনাদের বলি যে, তিনি ও দিদিমা কীভাবে তাদের পরিবার আর সেইসঙ্গে আরও অনেকের জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন।

আমার জন্ম হয়েছিল হ্লিনা গ্রামে, যেটার উত্তরে বর্তমান মলডোভা * অবস্থিত। ১৯২০র দশকে, ভ্রমণকারী হিসেবে পরিচিত ভ্রমণ পরিচারকরা রোমানিয়ার সীমান্ত থেকে আমাদের অপূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে এসেছিল। আমার দাদু-দিদিমা বাইবেল থেকে প্রচারিত সুসমাচার শুনেই সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিয়েছিল। ১৯২৭ সালে তারা বাইবেল ছাত্র হয়ে ওঠে, যিহোবার সাক্ষিদের তখন এভাবেই ডাকা হতো। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে আমাদের ছোট্ট গ্রামে ইতিমধ্যেই যিহোবার সাক্ষিদের একটা মণ্ডলী ছিল।

যে-বছর আমার জন্ম হয়, সেই ১৯৩৬ সালে শুধুমাত্র আমার বাবা ছাড়া আর সকলেই যিহোবার সাক্ষি হয়। বাবা তখনও অর্থোডক্স গির্জায় যেতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি জীবনের উদ্দেশ্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করেন এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের সৃষ্টিকর্তা যিহোবা ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নেন। আমার দাদু আমাদের পরিবারের আধ্যাত্মিক উন্নতিতে বিরাট অবদান রেখেছিলেন। বাইবেলের প্রতি তার গভীর ভালবাসা ছিল আর তিনি অনেক অনেক পদ মুখস্থ বলতে পারতেন। তিনি যেকোনো আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে বাইবেলের দিকে নিয়ে যেতে পারতেন।

আমি প্রায়ই দাদুর কোলে বসে তার কাছ থেকে বাইবেলের বিভিন্ন গল্প শুনতাম। তিনি আমার মধ্যে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা গেঁথে দিয়েছিলেন। সেইজন্য আমি তার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ! আট বছর বয়সে আমি দাদুর সঙ্গে প্রথমবার প্রচারে গিয়েছিলাম। বাইবেল ব্যবহার করে আমরা আমাদের গ্রামের লোকেদের দেখিয়েছিলাম যে, যিহোবা কে এবং কীভাবে তাঁর নিকটবর্তী হওয়া যায়।

সাম্যবাদীদের দ্বারা অত্যাচারিত

১৯৪৭ সালে, সাম্যবাদী কর্মপন্থা এবং অর্থোডক্স গির্জার প্ররোচনায় কর্তৃপক্ষরা মলডোভায় যিহোবার সাক্ষিদের তাড়না করতে শুরু করে। পরবর্তী সময়ে যেটাকে কেজিবি বলা হতো, সেটার প্রতিনিধিরা ও সেইসঙ্গে স্থানীয় পুলিশ আমাদের ঘরে আসত এবং জিজ্ঞেস করত যে, আমাদের প্রচার কাজে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছিল, সাহিত্য কোথা থেকে আসছিল এবং উপাসনার জন্য আমরা কোথায় মিলিত হই। তাদের দাবি অনুযায়ী, যিহোবার সাক্ষিরা, যারা “দেশে সাম্যবাদ ধারণার সম্প্রসারণে বাধা দেয়” তাদের কাজকর্মকে তারা বন্ধ করতে যাচ্ছে।

এই সময়ের মধ্যে আমার বাবা, যিনি যথেষ্ট শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন, তিনিও বাইবেলের সত্যগুলোকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেলেন। তিনি ও দাদু দুজনে জানতেন যে, কীভাবে জেরাকারীদের উত্তর দিতে হয় যাতে আমাদের খ্রিস্টান ভাইবোনদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা না হয়। তারা দুজনেই সাহসী ও প্রেমময় ব্যক্তি ছিল আর একই সময়ে সহবিশ্বাসীদের মঙ্গলের ব্যাপারে চিন্তা করত। তাদের মতো মা-ও সবসময় শান্ত ও স্থির থেকেছিলেন।

১৯৪৮ সালে বাবাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ ছিল, তা আমাদের কখনোই জানানো হয়নি। সর্বাধিক নিরাপত্তাযুক্ত কারাগারে তাকে সাত বছরের শাস্তি দেওয়া হয় ও আরও দুই বছরের জন্য নির্বাসিত করা হয়। অবশেষে তাকে রাশিয়ার একেবারে উত্তর-পূর্ব দিকে মাগাদান অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যে-জায়গাটা আমাদের বাড়ি থেকে ৭,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে ছিল। আমরা নয় বছর কেউ কাউকে দেখিনি। বাবা ছাড়া থাকা খুবই কঠিন ছিল কিন্তু দাদু আমার জন্য প্রকৃতই এক সহযোগী ছিলেন।

নির্বাসনে পাঠানো

১৯৪৯ সালের ৬ই জুন রাতে দুজন সৈনিক ও একজন কর্মকর্তা আমাদের বাড়িতে হানা দেয়। তারা জানায় যে, আমাদের ঘর ছাড়ার ও তাদের গাড়িতে ওঠার জন্য দুঘন্টা সময় দেওয়া হচ্ছে। আমাদের আর কোনোকিছুই জানানো হয়নি। তারা শুধু আমাদের বলেছিল যে, আমাদের নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে এবং আমরা আর কখনোই ফিরে আসব না। তাই মা, দাদু, দিদিমা ও সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে আমাকে সাইবেরিয়াতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেইসময় আমার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। কয়েক সপ্তাহ পর, আমরা অভেদ্য জঙ্গলের ভিতরে টাইগা জলাভূমিতে এসে পৌঁছাই। এটা আমার নিজের পরিবেশ থেকে কতই না আলাদা ছিল, যেটাকে আমি খুবই ভালবাসতাম! মাঝে মাঝে আমরা কাঁদতাম। তা সত্ত্বেও আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, যিহোবা আমাদের কখনও পরিত্যাগ করবেন না।

যে-ছোট্ট গ্রামে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেখানে দশটা ছোট ছোট কাঠের বাড়ি ছিল। অন্যান্য সাক্ষিকে টাইগার সর্বত্র বিভিন্ন গ্রামগুলোতে নির্বাসিত করা হয়েছিল। স্থানীয় লোকেদের ভয় দেখাতে ও আমাদের বিরুদ্ধে ভুল ধারণা গড়ে তুলতে কর্তৃপক্ষরা বলেছিল যে, সাক্ষিরা নরখাদক। কিন্তু, শীঘ্রই লোকেরা বুঝতে পারে যে, এটা ছিল মিথ্যা কথা আর আমাদেরকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণই নেই।

আমরা এখানে এসে প্রথম দুমাস একটা পুরনো ছোট্ট কাঠের বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা আবহাওয়া আসার আগে আমাদের আরও উপযুক্ত ঘর তৈরি করার প্রয়োজন ছিল। মা ও আমাকে অতি সাধারণ একটা আশ্রয় তৈরি করতে দাদু-দিদিমা সাহায্য করেছিল, যেটার অর্ধেক ছিল মাটির ওপর ও অর্ধেক মাটির নিচে। আমরা সেখানে তিন বছরেরও বেশি সময় থেকেছি। অনুমতি ছাড়া আমাদের গ্রাম ছেড়ে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল এবং অনুমতি কখনোই দেওয়া হয়নি।

কিছুদিন পর, আমাকে স্কুলে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যেহেতু আমার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অন্যদের চেয়ে আলাদা ছিল, তাই সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহছাত্রছাত্রীরা প্রায়ই আমাকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত। আমি যখন বাড়িতে এসে বলতাম যে কীভাবে আমি আমাদের বিশ্বাস সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে পেরেছি, তখন আনন্দে দাদুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

আরেকটু স্বাধীনতা

১৯৫৩ সালে একনায়ক স্টালিনের মৃত্যুর পর আমাদের জীবনযাত্রা কিছুটা উন্নত হয়েছিল। আমাদের গ্রাম থেকে অন্যত্র যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ফলে আমরা সহবিশ্বাসীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে পেরেছিলাম ও সেই গ্রামগুলোর সভাতে যোগ দিতে পেরেছিলাম, যেখানে অন্য সাক্ষিদের নির্বাসিত করা হয়েছিল। অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ এড়িয়ে চলার জন্য আমরা ছোট ছোট দলে মিলিত হতাম। সেখানে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে হাঁটুসমান তুষারপাত ও হিমাংকের নিচে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে দিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হতো। পরদিন বাড়ি ফিরে আসার জন্য আমরা আবার দীর্ঘপথ যাত্রা করতাম। পথে আমরা শশার আচার ও মিছরি খেয়ে নিতাম। তা সত্ত্বেও, প্রাচীনকালের দায়ূদের মতো আমরা কতই না আনন্দিত ছিলাম!—গীতসংহিতা ১২২:১.

আমি ১৯৫৫ সালে যিহোবার কাছে আমার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। এর অল্প কিছুদিন আগে, পাশের গ্রামের মণ্ডলীর একটা সভাতে গিয়ে লিডিয়া নামে কালো কেশী এক বিনয়ী মেয়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। আমাদের মতো সে এবং তার পরিবারও সাক্ষি ছিল আর তাদেরকেও মলডোভা থেকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। তার চমৎকার গানের গলা ছিল আর তখন আমরা যে-গানবইটি ব্যবহার করতাম সেখানকার ৩৩৭টা গানের প্রায় সব গানই তার মুখস্থ ছিল। এই বিষয়টা আমার ওপর খুবই ছাপ ফেলেছিল কারণ আমাদের যন্ত্রসংগীত ও গানগুলো আমার খুবই ভাল লাগত। ১৯৫৬ সালে আমরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই।

আমি বাবাকে লিখেছিলাম—আমরা জানতে পেরেছি যে, বাবাকে মাগাদানে নির্বাসিত করা হয়েছে—আর তাই আমরা তার সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত বিয়ের তারিখ বিলম্বিত করেছিলাম। এর অল্প কিছুদিন পরই বাবা মুক্তি পেয়েছিলেন এবং আমরা যেখানে নির্বাসিত হয়েছিলাম, সেখানে আসতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের বলেছিলেন যে, কীভাবে ঈশ্বরের সাহায্যে তিনি এবং অন্য সহখ্রিস্টানরা বন্দি শিবিরে শোচনীয় অবস্থার মধ্যেও রক্ষা পেয়েছিলেন। এই বিবরণগুলো আমাদের বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল।

বাবা ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পর, মা রং ও বার্নিশে ব্যবহার করার জন্য কিছু তেল প্রস্তুত করার সময় এক মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটে। ফুটন্ত তেলের বড় পাত্রটা কেমন করে যেন পড়ে যায় এবং তেল তার গায়ের ওপর পড়ে। তিনি হাসপাতালে মারা যান। আমরা গভীর শোকে ভেঙে পড়েছিলাম। বাবার শোক কিছুটা লাঘব হয় আর পরে তিনি তাতিয়ানা নামে পাশের গ্রামের এক সাক্ষি বোনকে বিয়ে করেন।

আমাদের পরিচর্যাকে সম্প্রসারণ করা

লিডিয়া ও আমি যে-গ্রামে থাকতাম, সেই কিজাক থেকে ১৯৫৮ সালে আমরা ১০০ কিলোমিটার দূরে বেশ বড় লিবাইয়ে গ্রামে চলে এসেছিলাম। আমরা পড়েছিলাম যে, অন্যান্য দেশের সাক্ষিরা ঘরে ঘরে প্রচার করত। তাই আমরা আমাদের নতুন জায়গায় তা করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। অবশ্য, প্রহরীদুর্গ এবং সচেতন থাক! পত্রিকা তখন নিষিদ্ধ ছিল কিন্তু আমরা অন্য জায়গা থেকে গোপনে আসা কপিগুলো পেয়েছিলাম। সেইসময় আমাদের জানানো হয়েছিল যে, এখন থেকে এই পত্রিকাগুলো আমরা শুধুমাত্র রুশ ভাষায় পাব। এর আগে পর্যন্ত আমরা মলডোভীয় ভাষায়ও পত্রিকা পেতাম। তাই আমরা রুশ ভাষা আরও ভাল করে শেখার জন্য মন দিয়ে অধ্যয়ন করেছিলাম। এমনকি আজ পর্যন্ত আমি সেই প্রবন্ধগুলোর শুধুমাত্র শিরোনামই নয় কিন্তু সেখানে যে-ধারণাগুলো প্রকাশ করা হয়েছিল, তা-ও মনে করতে পারি।

আমাদের নিজেদের ভরণপোষণের জন্য লিডিয়া গোলাঘরে কাজ করত আর আমি মালগাড়ি থেকে কাঠ নামাতাম। এটা খুবই খাটুনির কাজ ছিল অথচ বেতন ছিল খুবই কম। যদিও সাক্ষিদের খুবই সতর্ক কর্মী হিসেবে গণ্য করা হতো কিন্তু আমরা কখনও কোনো সুযোগসুবিধা পেতাম না বা বেতন ছাড়া অতিরিক্ত কোনো অর্থ পেতাম না। কর্মকর্তারা খোলাখুলিভাবেই বলত: “সাম্যবাদী সমাজে যিহোবার সাক্ষিদের কোনো স্থান নেই।” তা সত্ত্বেও, আমরা আনন্দিত ছিলাম যে, তাঁর অনুসারীদের সম্বন্ধে যিশুর এই কথাগুলো আমাদের প্রতি সত্য হয়েছিল: “তাহারা জগতের নয়, যেমন আমিও জগতের নই।”—যোহন ১৭:১৬.

নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো

১৯৫৯ সালে আমাদের মেয়ে ভ্যালেনটিনার জন্ম হয়। এর অল্প সময় পরই তাড়নার এক নতুন ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। দি এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বলে: “প্রধানমন্ত্রী নিকিটা খ্রুশফের দ্বারা ১৯৫৯-৬৪ সালের মধ্যে ধর্মবিরোধী এক নতুন আন্দোলন শুরু হয়েছিল।” রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগ আমাদের বলেছিল যে, সোভিয়েত সরকারের লক্ষ্য ছিল, সমস্ত ধর্মকে এবং বিশেষভাবে যিহোবার সাক্ষিদের নির্মূল করে দেওয়া।

ভ্যালেনটিনার বয়স যখন প্রায় এক বছর, তখন আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। আমি যাইনি বলে নিরপেক্ষ থাকার কারণে আমার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। একবার লিডিয়া যখন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, তখন একজন কেজিবি কর্মকর্তা তাকে বলেছিলেন: “আমরা ক্রেমলিন সরকারের কাছ থেকে সংবাদ পেয়েছি যে, দুই বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আর একজন যিহোবার সাক্ষিও অবশিষ্ট থাকবে না।” এরপর তিনি সাবধান করেছিলেন: “তোমার বিশ্বাস অস্বীকার করতে হবে নতুবা তোমাকে কারাগারে পাঠানো হবে।” সেই কর্মকর্তা ভেবেছিলেন যে, এইরকম হুমকিগুলো এইসব মহিলাদের চুপ করিয়ে দেবে আর তাই জোরের সঙ্গে বলেছিলেন: “এরা হচ্ছে অতি দুর্বল দল।”

অল্প সময়ের মধ্যে, অধিকাংশ পুরুষ সাক্ষিকে কারাগার ও শ্রমশিবিরগুলোতে পাঠানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, সাহসী খ্রিস্টান মহিলারা প্রচার কাজ চালিয়ে গিয়েছিল। আর প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে তারা কারাগার ও শ্রমশিবিরগুলোতে গোপনে সাহিত্য নিয়ে এসেছিল। লিডিয়া এই ধরনের পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখি হয়েছিল এবং সেইসব পুরুষদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল, যারা আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিতে চেয়েছিল। এ ছাড়া, তাকে বলা হয়েছিল যে, আমি আর কখনোই মুক্তি পাবো না। কিন্তু আমি মুক্তি পেয়েছিলাম!

মুক্তি লাভ ও কাজাকস্তানে চলে যাওয়া

আমার মামলাটা ১৯৬৩ সালে পুনরায় বিবেচনা করা হয়েছিল আর তিন বছর জেল খাটার পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, আমরা কোনো জায়গায় স্থায়ীভাবে বাস করার অনুমতি পাইনি, তাই আমি কোনো কাজও পাইনি। রাষ্ট্রীয় একটা আইন ছিল: “স্থায়ী নাগরিকত্ব ছাড়া কোনো কাজ পাওয়া যাবে না।” ঐকান্তিক প্রার্থনায় আমরা যিহোবার কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম। এরপর আমরা কাজাকস্তানের উত্তরে পিট্রোপেভলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু, স্থানীয় কর্তৃপক্ষরা ইতিমধ্যেই আমাদের সম্বন্ধে সংবাদ পেয়েছিল এবং তারা আমাদেরকে সেখানে থাকার বা কাজ করার অনুমতি দেয়নি। এই শহরের প্রায় ৫০ জন সাক্ষি একইরকম তাড়না ভোগ করেছিল।

আরেক সাক্ষি দম্পতির সঙ্গে আমরা আরও দক্ষিণে শ্চুচিন্‌স্কের একটা ছোট্ট শহরে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে আর কোনো সাক্ষি থাকত না আর কর্তৃপক্ষরাও আমাদের প্রচার কাজ সম্বন্ধে কিছু জানত না। পুরো এক সপ্তাহ ইভান ও আমি—পরিবারের দুই স্বামী—কাজের খোঁজ করি আর সেইসময় আমাদের স্ত্রীরা ট্রেন স্টেশনে থাকত, যেখানে আমরা রাতের বেলা ঘুমাতাম। শেষ পর্যন্ত আমরা গ্লাস কারখানায় কাজ পেয়েছিলাম। আমরা আমাদের পরিবারের জন্য ছোট্ট একটা ঘর ভাড়া করেছিলাম যেখানে দুটো খাট ও আরও অল্প কিছু আসবাবপত্র রাখার জায়গা ছিল, তবুও আমরা পরিতৃপ্ত ছিলাম।

ইভান ও আমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম আর আমাদের নিয়োগকর্তারা খুবই সন্তুষ্ট ছিল। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার জন্য আমার আবারও ডাক আসে আর কারখানার ম্যানেজার জানতে পেরেছিলেন যে, আমার বাইবেল-শিক্ষিত বিবেক আমাকে সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিতে অনুমতি দেবে না। অবাক হওয়ার মতো বিষয়টা হচ্ছে, তিনি সামরিক বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাকে বলেছিলেন যে, ইভান ও আমি দক্ষ কর্মী আর আমাদের ছাড়া কারখানা চালানো যাবে না। তাই আমাদের সেখানেই থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলা এবং অন্যদের সেবা করা

১৯৬৬ সালে আমাদের মেজো মেয়ে লিলিয়ার জন্ম হয়। এক বছর পর আমরা কাজাকস্তানের দক্ষিণে উজবেকিস্তান সীমান্তের কাছে বাইয়িলিই ভডিতে চলে গিয়েছিলাম, যেখানে সাক্ষিদের এক ছোট্ট দল ছিল। শীঘ্রই সেখানে মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল এবং আমাকে পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৬৯ সালে আমাদের এক ছেলে হয়, যার নাম অলিয়েক আর তার দুবছর পর আমাদের সবচেয়ে ছোট মেয়ে নাতাশার জন্ম হয়। লিডিয়া ও আমি কখনোই ভুলে যাইনি যে, ছেলেমেয়েরা হচ্ছে যিহোবার কাছ থেকে এক অধিকার। (গীতসংহিতা ১২৭:৩) তারা যেন বড় হয়ে যিহোবাকে ভালবাসে তা শেখানোর জন্য যা যা দরকার, সেই বিষয় নিয়ে আমরা একত্রে আলোচনা করেছিলাম।

এমনকি ১৯৭০ এর দশকেও বেশির ভাগ পুরুষ সাক্ষিরা তখনও শ্রমশিবিরগুলোতে কাজ করছিল। অনেক মণ্ডলীতে পরিপক্ব তত্ত্বাবধান ও নির্দেশনার প্রয়োজন ছিল। তাই, লিডিয়া ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলায় এক বিরাট ভূমিকা রেখেছিল, কখনও কখনও মা ও বাবা দুজনের ভূমিকা পালন করছিল আর আমি একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করেছিলাম। আমি কাজাকস্তানের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করেছিলাম ও সেইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী সোভিয়েত রিপাবলিকের তাজিকিস্তান, তুর্কমিনিস্তান ও উজবেকিস্তানের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করেছিলাম। একই সময়ে আমি পরিবারের ভরণপোষণ জোগানোর জন্যও কাজ করেছিলাম আর লিডিয়া ও ছেলেমেয়েরা ইচ্ছুক মনে সহযোগিতা করেছিল।

যদিও মাঝে মাঝে আমি কয়েক সপ্তাহের জন্য দূরে থাকতাম কিন্তু আমি ছেলেমেয়েদের প্রতি বাবার ভালবাসা প্রকাশের চেষ্টা করেছিলাম এবং তাদের আধ্যাত্মিক অগ্রগতিতে সাহায্য করেছিলাম। লিডিয়া ও আমি দুজনে ঐকান্তিকভাবে প্রার্থনা করেছিলাম যেন যিহোবা আমাদের ছেলেমেয়েদের সাহায্য করেন আর আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম যে, কীভাবে লোকভয় কাটিয়ে ওঠা ও ঈশ্বরের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর নিঃস্বার্থ সহযোগিতা ছাড়া, আমি ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে আমার দায়িত্বগুলো পালন করতে পারতাম না। লিডিয়া ও আমাদের অন্যান্য সাক্ষি বোনেরা কেউই “অতি দুর্বল দল” ছিল না, যা সেনা কর্মকর্তা তাদের সম্বন্ধে জোরের সঙ্গে বলেছিলেন। তারা ছিল বলবান—প্রকৃতই অতি শক্তিশালী আধ্যাত্মিকমনা ব্যক্তি।—ফিলিপীয় ৪:১৩.

১৯৮৮ সালে, যখন সব ছেলেমেয়ে বড় হয়ে যায়, তখন আমাকে একজন নিয়মিত ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। আমার সীমার মধ্যে ছিল মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ দেশ। ১৯৯১ সালে প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে যিহোবার সাক্ষিদের প্রচার কাজ আইনত নিবন্ধীকৃত হওয়ার পর, অন্যান্য যোগ্য, আধ্যাত্মিকভাবে পরিপক্ব পুরুষরা প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের এশিয়ান রিপাবলিকগুলোতে সেবা করতে শুরু করেছিল। বর্তমানে ১৪ জন ভ্রমণ অধ্যক্ষ এই দেশগুলোতে সেবা করছে, যেখানে গত বছর খ্রিস্টের মৃত্যুর স্মরণার্থ সভায় ৫০,০০০রও বেশি লোক যোগ দিয়েছিল!

এক অপ্রত্যাশিত আমন্ত্রণ

১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে, আমি যিহোবার সাক্ষিদের রাশিয়া শাখা অফিস থেকে এক অপ্রত্যাশিত ফোন পাই। “এনাটলি, আপনি ও লিডিয়া কি পূর্ণসময়ের পরিচর্যার বিষয় চিন্তা করেছেন?” আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়। অবশ্যই, আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের বিষয়ে এই ধরনের বিশেষ সুযোগের কথা বিবেচনা করেছিলাম। সত্যি বলতে কী, আমাদের ছেলে অলিয়েক প্রায় পাঁচ বছর ধরে রাশিয়া শাখা অফিসে সেবা করছিল।

আমি যখন লিডিয়াকে সেই আমন্ত্রণের বিষয় বলেছিলাম, তখন সে বলেছিল: “কিন্তু আমাদের বাড়ি, বাগান ও জিনিসপত্রের কী হবে?” প্রার্থনা ও আলোচনার পর আমরা তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত আমাদের আলমা আটার বড় শহরের কাছে কাজাকস্তানের ইসেক শহরে যিহোবার সাক্ষিদের ধর্মীয় কেন্দ্রে সেবা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এখানে আমাদের বাইবেলভিত্তিক সাহিত্যগুলো এই এলাকা জুড়ে যে-স্থানীয় ভাষাগুলো বলা হয়, সেই ভাষাগুলোতে অনুবাদের কাজ হয়।

আজকে আমাদের পরিবার

ঈশ্বরের কাছে আমরা কতই না কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাদের ছেলেমেয়েদের বাইবেলের সত্য শেখাতে আমাদের সাহায্য করেছেন! আমাদের সবচেয়ে বড় মেয়ে ভ্যালেনটিনা বিয়ে করে তার স্বামীর সঙ্গে ১৯৯৩ সাল থেকে জার্মানির ইংগেলহিমে আছে। তাদের তিন সন্তান রয়েছে, যারা সকলে যিহোবার বাপ্তাইজিত সাক্ষি।

আমাদের মেজো মেয়ে লিলিয়ারও পরিবার রয়েছে। সে ও তার স্বামী, যে বাইয়িলিই ভডি মণ্ডলীর একজন প্রাচীন, তারা তাদের দুই সন্তানকে এমনভাবে বড় করে তুলছে, যাতে তারা ঈশ্বরকে ভালবাসে। আমাদের ছেলে অলিয়েক, নাতাশা নামে মস্কোর এক খ্রিস্টান বোনকে বিয়ে করেছে এবং তারা দুজনে একত্রে সেন্ট পিটার্সবার্গের কাছে রাশিয়ার শাখা অফিসে সেবা করে। ১৯৯৫ সালে আমাদের ছোট মেয়ে নাতাশা বিয়ে করেছে এবং সে তার স্বামীর সঙ্গে জার্মানিতে একটা রাশিয়ান মণ্ডলীতে সেবা করছে।

মাঝে মাঝে আমরা আমাদের বড় পরিবারের সকলে একত্রে মিলিত হই। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের কাছে বর্ণনা করে যে, কীভাবে “মামা” ও “পাপা” যিহোবার কথা শুনেছিল ও তাদের সন্তানদের এমনভাবে বড় করে তুলেছিল যেন তারা সত্য ঈশ্বর যিহোবাকে ভালবাসে ও সেবা করে। আমি দেখতে পাই যে, এই আলোচনাগুলো আমাদের নাতি-নাতনিদের আধ্যাত্মিকভাবে বৃদ্ধি পেতে সাহায্য করছে। আমাদের সবচেয়ে ছোট নাতি, তার বয়সে আমি দেখতে যেমন ছিলাম, ঠিক সেইরকম হয়েছে। মাঝে মাঝে সে আমার কোলে বসে ও আমাকে বাইবেলের গল্প বলতে বলে। আমার দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, যখন আমি আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করি যে, কীভাবে আমিও প্রায়ই দাদুর কোলে বসতাম ও কীভাবে তিনি আমাকে আমাদের সর্বমহান সৃষ্টিকর্তাকে ভালবাসতে ও সেবা করতে শিখিয়েছিলেন।

[পাদটীকা]

^ এই প্রবন্ধের সব জায়গায় পূর্বের নাম মলডোভিয়া বা সোভিয়েত রিপাবলিক অফ মলডোভিয়ার পরিবর্তে বর্তমান নাম মলডোভা ব্যবহৃত হবে।

[১১ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাবা কারাগারে যাওয়ার অল্প কিছুদিন আগে আমার বাবামার সঙ্গে মলডোভাতে আমাদের ঘরের বাইরে

[১২ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৯ সালে লিডিয়ার সঙ্গে, তখনও নির্বাসনে

[১৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমি কারাগারে থাকার সময় লিডিয়া আমাদের মেয়ে ভ্যালেনটিনার সঙ্গে

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আজকে লিডিয়ার সঙ্গে

[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনিদের সঙ্গে, যারা সকলে যিহোবাকে সেবা করছে!