সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

একজন মায়ের সম্মানীয় ভূমিকা

একজন মায়ের সম্মানীয় ভূমিকা

একজন মায়ের সম্মানীয় ভূমিকা

একজন মায়ের ভূমিকাকে প্রায়ই উপলব্ধি করা তো দূরের কথা, এমনকি এটাকে ছোট করে দেখা হয়। কয়েক দশক আগে, কিছু লোক বাচ্চাদের দেখাশোনা করার কাজকে মর্যাদাহীন কাজ বলে মনে করতে শুরু করেছিল। তারা মনে করত যে, এটা কোনো কেরিয়ারের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল আর এটা এমনকি এক ধরনের উৎপীড়ন। যদিও বেশির ভাগ লোকই ওই মনোভাবকে চরমপন্থী বলে মনে করত, তবুও মায়েরা সাধারণত এটা মনে করতে বাধ্য হতো যে, ঘর পরিচালনাকারী হওয়া ও সন্তানদের দেখাশোনা করা দ্বিতীয় শ্রেণীর কাজ। কেউ কেউ এমনকি মনে করে যে, একজন নারীর ঘরের বাইরে একটা কেরিয়ার থাকা দরকার, যাতে তিনি তার পূর্ণ কর্মদক্ষতাকে জানতে পারেন।

তবে, অনেক স্বামী ও সন্তানেরা পরিবারে মায়ের ভূমিকাকে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কার্লো যিনি ফিলিপিনসে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসে সেবা করেন তিনি বলেন: “আমি আজকে এখানে কারণ আমার মা আমাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আমার বাবা কড়াভাবে শাসন করতেন এবং খুব তাড়াতাড়ি শাস্তি দিতেন কিন্তু মা আমাদের বোঝানো এবং যুক্তি দেখানোর মাধ্যমে সাহায্য করতেন। তার শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিকে আমি সত্যিই উপলব্ধি করি।”

দক্ষিণ আফ্রিকার পিটার হল ছয় সন্তানের মধ্যে একজন, যে এমন একজন মায়ের দ্বারা মানুষ হয়েছিল যার শিক্ষাগত যোগ্যতা সীমিত ছিল। তার বাবা পরিবারকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। পিটার স্মৃতিচারণ করে বলে: “অন্যদের বাড়িতে কাজ করে এবং ঘরবাড়ি ও অফিস পরিষ্কারের কাজ করে মা খুব বেশি একটা আয় করতে পারতেন না। তার পক্ষে আমাদের সকলের স্কুলের বেতন দেওয়া খুবই মুশকিল ছিল। প্রায়ই আমরা খিদে নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। শুধুমাত্র ঘরের ভাড়া দেওয়াই তার জন্য এক বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। এই সমস্ত কঠিন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও, মা কখনো হাল ছেড়ে দেননি। তিনি আমাদের কখনো অন্যদের সঙ্গে তুলনা না করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি যদি সাহসের সঙ্গে তার দায়িত্ব গ্রহণ না করতেন, তা হলে আমরা কখনো যেভাবে আমাদের জীবনকে পরিচালনা করেছিলাম সেভাবে করতে পারতাম না।”

আখ্‌মেদ নামে নাইজেরিয়ার একজন স্বামী তাদের সন্তানদের লালনপালনে তার স্ত্রীর সহযোগিতা সম্বন্ধে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন: “আমি আমার স্ত্রীর ভূমিকাকে উপলব্ধি করি। আমি যখন ঘরে থাকতাম না, তখন আমি নিশ্চিত থাকতাম যে, সন্তানদের ভাল যত্ন নেওয়া হবে। আমার স্ত্রীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার পরিবর্তে, আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই এবং সন্তানদের এটা জানাই যে তারা আমাকে যেভাবে সম্মান করে ঠিক সেভাবে তাকেও করতে হবে।”

একজন ফিলিস্তিনী ব্যক্তি, মা হিসেবে তার স্ত্রীর সাফল্যের বিষয়ে নির্দ্বিধায় প্রশংসা করেন: “লিনা আমাদের মেয়ের জন্য অনেক করেছে এবং আমাদের পরিবারের আধ্যাত্মিকতায় অবদান রেখেছে। আমি মনে করি তার ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য সে সফল হয়েছে।” লিনা যিহোবার একজন সাক্ষি আর তার মেয়েকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি বাইবেলের নীতিগুলো অনুসরণ করেন।

এই নীতিগুলোর কয়েকটা কী? মায়েদের বিষয়ে বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে কী বলা যেতে পারে? প্রাচীনকালের মায়েদের কীভাবে তাদের সন্তানদের শিক্ষিকা হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানীয় স্থান দেওয়া হয়েছিল?

মায়েদের সম্বন্ধে এক ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি

সৃষ্টির সময়ে পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীদের এক সম্মানীয় ভূমিকা দেওয়া হয়েছিল। বাইবেলের প্রথম বই বলে: “সদাপ্রভু ঈশ্বর কহিলেন, মনুষ্যের একাকী থাকা ভাল নয়, আমি তাহার জন্য তাহার অনুরূপ [“পরিপূরক,” NW] সহকারিণী নির্ম্মাণ করি।” (আদিপুস্তক ২:১৮) তাই প্রথম নারী হবাকে আদমের পরিপূরক বা প্রতিরূপ হিসেবে দেওয়া হয়েছিল। হবাকে একেবারে নিখুঁতভাবে আদমের সহকারিণী হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছিল। ঈশ্বর তাদের জন্য সন্তান জন্মদান ও তাদের যত্ন নেওয়া আর সেই সঙ্গে এই পৃথিবী ও এর পশুদের দেখাশোনা করার যে-উদ্দেশ্য স্থির করেছিলেন, তাতে তার অংশ নেওয়ার কথা ছিল। তার একজন প্রকৃত সঙ্গীর মতো বুদ্ধিগত উদ্দীপনা ও সমর্থন দিতে হতো। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে এই সুন্দর উপহার পেয়ে আদম কতই না খুশি হয়েছিল!—আদিপুস্তক ১:২৬-২৮, ২:২৩.

পরে, নারীদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হবে সেই বিষয়ে ঈশ্বর বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ইস্রায়েলীয় মায়েদের সম্মান দেখাতে হতো, তাদের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করা যেত না। যদি একটা ছেলে ‘আপন পিতাকে কিম্বা মাতাকে শাপ দিত,’ তা হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো। খ্রিস্টান তরুণ-তরুণীদের “[তাহাদের] পিতামাতার আজ্ঞাবহ” হতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।—লেবীয় পুস্তক ১৯:৩; ২০:৯; ইফিষীয় ৬:১; দ্বিতীয় বিবরণ ৫:১৬; ২৭:১৬; হিতোপদেশ ৩০:১৭.

স্বামীর পরিচালনাধীনে, মাকে ছেলেমেয়ে উভয়ের শিক্ষিকা হতে হতো। ছেলেকে ‘আপন মাতার ব্যবস্থা ত্যাগ না করিবার’ আদেশ দেওয়া হয়েছিল। (হিতোপদেশ ৬:২০) এ ছাড়া, হিতোপদেশ ৩১ অধ্যায়ে “[রাজা লমূয়েলের] মা তাঁহাকে এক ভারবাণী শিক্ষা দিয়েছিলেন।” তিনি প্রজ্ঞার সঙ্গে তার ছেলেকে মদ্যজাতীয় পানীয়ের অনুপযুক্ত ব্যবহার এড়িয়ে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন, এই বলে: “রাজগণের জন্য মদ্যপান উপযুক্ত নয়, ‘সুরা কোথায়?’ [বলা] শাসনকর্ত্তাদের অনুচিত। পাছে পান করিয়া তাঁহারা বিধি বিস্মৃত হন, এবং কোন দুঃখীর বিচার বিপরীত করেন।”—হিতোপদেশ ৩১:১, ৪, ৫.

এ ছাড়া, বিয়ে করার কথা ভাবছে এমন প্রত্যেক যুবকের প্রজ্ঞা প্রকাশ পাবে, যদি তারা রাজা লমূয়েলের মায়ের দেওয়া ‘গুণবতী স্ত্রীর’ বর্ণনাকে বিবেচনা করে, যিনি বলেছিলেন: “মুক্তা হইতেও তাঁহার মূল্য অনেক অধিক।” এইরকম একজন স্ত্রী একটা পরিবারে যে-গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তা বর্ণনা করার পর, রাজার মা বলেছিলেন: “লাবণ্য মিথ্যা, সৌন্দর্য্য অসার, কিন্তু যে স্ত্রী সদাপ্রভুকে ভয় করেন, তিনিই প্রশংসনীয়া।” (হিতোপদেশ ৩১:১০-৩১) এটা স্পষ্ট যে, আমাদের সৃষ্টিকর্তা পরিবারে এক সম্মানীয় ও দায়িত্বপূর্ণ স্থান লাভ করার জন্য নারীদের সৃষ্টি করেছিলেন।

খ্রিস্টীয় মণ্ডলীতেও, স্ত্রী ও মায়েদের সম্মান ও উপলব্ধি দেখানো হয়। ইফিষীয় ৫:২৫ পদ বলে: “স্বামীরা, তোমরা আপন আপন স্ত্রীকে . . . প্রেম কর।” যুবক তীমথিয় যার মা ও দিদিমা তাকে এমনভাবে লালনপালন করেছিল যাতে তিনি “পবিত্র শাস্ত্রকলাপ” সম্মান করেন, তাকে এই অনুপ্রাণিত পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল: “প্রাচীনাদিগকে মাতার ন্যায় . . . অনুনয় কর।” (২ তীমথিয় ৩:১৫; ১ তীমথিয় ৫:১, ২) অতএব, একজন পুরুষের এক বয়স্ক নারীর প্রতি এমন সম্মান থাকতে হবে যেন তিনি তার মা। সত্যিই, ঈশ্বর নারীদের মূল্য দেন এবং তাদের এক মর্যাদাপূর্ণ স্থান দান করেন।

আপনার উপলব্ধি প্রকাশ করুন

একজন পুরুষ এমন এক সংস্কৃতিতে বড় হয়েছিলেন যেখানে নারীদের নিচু চোখে দেখা হতো, তিনি বলেন: “আমি এমন শিক্ষা লাভ করেছিলাম যেখানে পুরুষদের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে আর আমি নারীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতে ও তাদের অসম্মান করতে দেখেছি। তাই সৃষ্টিকর্তা যেভাবে নারীদের দেখেন—একজন পরিপূরক বা সহকারিণী হিসেবে—সেভাবে তাদেরকে ঘরে ও সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে দলের এক অংশ হিসেবে দেখার জন্য আমাকে লড়াই করতে হয়েছিল। আমার স্ত্রীর প্রতি প্রশংসার বাক্য প্রকাশ করা যদিও আমার জন্য খুবই কঠিন কাজ, তবুও আমি স্বীকার করি যে আমার সন্তানদের মধ্যে যা কিছু ভাল বিষয় রয়েছে, তা তার পরিশ্রমের কারণেই হয়েছে।”

বাস্তবিকই, যে-মায়েরা শিক্ষিকা হিসেবে তাদের দায়িত্ব গ্রহণ করে তারা তাদের ভূমিকার জন্য গর্ব বোধ করতে পারে। এটা এক পুরস্কারদায়ক কেরিয়ার। উপযুক্ত কারণেই তারা প্রশংসা এবং মন থেকে উপলব্ধি পাওয়ার যোগ্য। আমরা মায়েদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখি—অভ্যাসগুলো যা আমাদের সারা জীবন উপকারে আসে, উত্তম আচার-আচরণ যা উত্তম সম্পর্কগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক এবং অনেক ক্ষেত্রে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক লালনপালন যা তরুণ-তরুণীদের সঠিক পথে রাখে। আপনার মা আপনার জন্য যা করেছেন তার জন্য আপনি কি সম্প্রতি তার প্রতি উপলব্ধি প্রকাশ করেছেন?

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

পিটারের মা তাকে হাল ছেড়ে না দিতে শিখিয়েছিলেন

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

আখ্‌মেদ তাদের সন্তানদের লালনপালনে তার স্ত্রীর সাহায্যকে অনেক উপলব্ধি করেন

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

লিনার স্বামী তাদের মেয়ের উত্তম আচরণের জন্য তার স্ত্রীর ধর্মীয় বিশ্বাসকে কৃতিত্ব দেন