সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবঘটিত কারণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবঘটিত কারণ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবঘটিত কারণ

একটা গাড়িকে যখন ভালভাবে যত্ন নেওয়া হয়, তখন সেটা নিরাপদে বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু, সেই যানবাহনকে যদি সঠিকভাবে যত্ন নেওয়া না হয় এবং হেলাফেলা করা হয়, তা হলে তা বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। কিছু কিছু দিক দিয়ে, পৃথিবী নামক গ্রহের বেলায়ও একই বিষয় বলা যেতে পারে।

বেশ কিছু সংখ্যক বিজ্ঞানীর মতানুসারে, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং সমুদ্রে মানবঘটিত পরিবর্তনগুলোর কারণে বার বার ও অধিকতর চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঘটায়, আমাদের গ্রহ এক বিপদজনক স্থান হয়ে উঠেছে। আর এর ফলে ভবিষ্যৎকে অনিশ্চিত বলে মনে হয়। সায়েন্স পত্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর আলোচনায় এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ বলেছিল, “আমরা একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহে অনিয়ন্ত্রিত এক বিরাট পরীক্ষানিরীক্ষার মাঝামাঝিতে রয়েছি।”

প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা এবং চরম অবস্থার ওপর মানুষের কার্যকলাপ কীভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, সেই বিষয়ে আরও ভালভাবে বোঝার জন্য আমাদের মৌলিক প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো সম্বন্ধে আরেকটু বুঝতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, চরম ঝড়গুলো কী কারণে ঘূর্ণিঝড়ের মতো রূপ ধারণ করে থাকে?

গ্রহ সংক্রান্ত তাপ পরিবর্তনকারী

পৃথিবীর জলবায়ু ব্যবস্থাকে একটা যন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যেটা সৌরশক্তিকে রূপান্তরিত ও বন্টন করে থাকে। গ্রীষ্মমণ্ডল যেহেতু সূর্যের অধিকাংশ তাপ লাভ করে থাকে, তাই এর ফলে ঘটিত তাপমাত্রার ভারসাম্যহীনতা বায়ুমণ্ডলকে গতিশীল করে। * পৃথিবীর দৈনিক আবর্তনের কারণে এই বিরাট স্থানান্তর ঘটে, আর্দ্র বায়ু ঘূর্ণিবায়ুর রূপ নেয় আর সেগুলোর মধ্যে কিছু নিম্নচাপে পরিণত হয়। এক সময় নিম্নচাপ ঝড়ে পরিণত হতে পারে।

আপনি যদি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়গুলোর সাধারণ গতিপথ পর্যবেক্ষণ করে থাকেন, তা হলে আপনি দেখতে পাবেন যে, সেগুলো বিষুবরেখা থেকে—হয় উত্তরে বা দক্ষিণে—অধিকতর শীতল অঞ্চলগুলোতে সরে যেতে চায়। এর ফলে, ঝড়গুলো এক প্রকাণ্ড তাপ পরিবর্তনকারী হিসেবে কাজ করে এবং জলবায়ুর তীব্রতাকে হ্রাস করতে সাহায্য করে। কিন্তু যখন সাগরের উপরিভাগের—জলবায়ু যন্ত্রের “বয়লার রুমের”—তাপমাত্রা প্রায় ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তখন গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড়গুলো ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হওয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তি লাভ করে, যেগুলোর নাম অঞ্চলভেদে সাইক্লোন, হারিকেন বা টাইফুন হয়ে থাকে।

মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনা করলে, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ১৯০০ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর ঘূর্ণিঝড়ের কারণে টেক্সাসের গালভেস্টন দ্বীপের ওপর সবচেয়ে প্রলংয়করী প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। ঝোড়ো ঢেউগুলো সেই শহরের ৬,০০০ থেকে ৮,০০০ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছে ও সেইসঙ্গে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোর প্রায় ৪,০০০ জনের মৃত্যু ঘটিয়েছে আর ৩,৬০০টা ঘরবাড়িকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। বস্তুতপক্ষে, গালভেস্টনে মনুষ্যনির্মিত কোনো কাঠামোই অক্ষত ছিল না।

আগের অধ্যায়ে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কিছু সংখ্যক শক্তিশালী ঝড় হয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখছে যে, এর সঙ্গে পৃথিবীর উষ্ণতার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, যা হয়তো ঝড়ের ব্যবস্থায় অধিক শক্তি সরবরাহ করে যাচ্ছে। কিন্তু, আবহাওয়ার নানা পরিবর্তন হয়তো পৃথিবীর উষ্ণতার কেবলমাত্র একটা লক্ষণ হতে পারে। আরেকটা সম্ভাব্য ক্ষতিকর পরিণতি হয়তো ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও বনভূমি নিধন

সায়েন্স পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ অনুসারে, “সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বিগত শতাব্দীতে ১০ থেকে ২০ সেন্টিমিটার [চার থেকে আট ইঞ্চি] বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।” পৃথিবীর উষ্ণতার সঙ্গে এটা কীভাবে সম্পর্কযুক্ত? গবেষকরা দুটো সম্ভাব্য প্রক্রিয়ার বিষয় উল্লেখ করে। একটা সম্ভাবনা হচ্ছে, মেরুদেশীয় স্থলভাগের বরফ ও হিমবাহ গলে যাওয়া, যা সমুদ্রের জলের আয়তন বৃদ্ধি করে। আরেকটা হচ্ছে, তাপীয় প্রসারণ—সমুদ্রের জল উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের আয়তনও বৃদ্ধি পায়।

প্রশান্ত মহাসাগরের অতি ক্ষুদ্র দ্বীপ টুভালু হয়তো ইতিমধ্যেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির প্রভাবগুলো দেখতে পেয়েছে। স্মিথসোনিয়ান পত্রিকা অনুসারে, ফুনাফুটির আ্যটল প্রবালবলয় থেকে সংগৃহীত উপাত্ত দেখায় যে, সেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা “বিগত দশকে গড়ে বার্ষিক ৫.৬ মিলিমিটার করে” বৃদ্ধি পেয়েছে।

পৃথিবীর অনেক জায়গায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি মানে আরও বেশি শহুরে অঞ্চল, আরও বেশি বস্তি অঞ্চল এবং আরও বেশি করে পরিবেশ সংক্রান্ত অবক্ষয়। এই বিষয়গুলো হয়তো প্রাকৃতিক দুর্যোগের চরম অবস্থাকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। কয়েকটা উদাহরণ বিবেচনা করুন।

হাইতি হচ্ছে জনবহুল এক দ্বীপের দেশ, যেখানে বনভূমি নিধনের ইতিহাস রয়েছে। সম্প্রতি এক সংবাদ বিবরণী বলেছিল যে, হাইতির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো যত গুরুতরই হোক না কেন, বনভূমি নিধনের চেয়ে আর কোনোকিছুই সেই দেশের অস্তিত্বের জন্য এতটা হুমকিস্বরূপ নয়। দুঃখের বিষয় যে, এই হুমকি ২০০৪ সালে আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে কাদাধস হওয়ায় হাজার হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে।

টাইম এশিয়া উল্লেখ করে যে, “পৃথিবীর উষ্ণতা, বাঁধ, বনভূমি নিধন এবং কর্তন-দহন চাষপদ্ধতি (শস্য উৎপাদনের জন্য গাছপালা কাটা ও পুড়িয়ে ফেলা)” হল সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর বৃদ্ধির কারণ, যেগুলো দক্ষিণ এশিয়ায় আঘাত হেনেছে। আরেকটা চরম বিষয় হচ্ছে, বনভূমি নিধন মাটিকে এত দ্রুত শুষ্ক করে ফেলে যে এর ফলে মারাত্মক খরা হতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলে অনাবৃষ্টির কারণে সেই বনগুলোতে রেকর্ড ভঙ্গকারী দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো সাধারণত এতটাই আর্দ্র ছিল যে, সেখানে আগুন ধরার কথা নয়। কিন্তু, চরম আবহাওয়াই প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একমাত্র কারণ নয়। অনেক দেশে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো ঘটে থাকে, যেগুলো ভূঅভ্যন্তরে সংঘটিত হয়।

যখন ভূমি প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়

ভূত্বক বিভিন্ন আকারের কঠিন পাত নিয়ে গঠিত, যেগুলো একটা অন্যটার তুলনায় আন্দোলিত হয়ে থাকে। বস্তুতপক্ষে, ভূত্বকে এত আলোড়ন ঘটে থাকে যে, প্রতি বছর হয়তো কয়েক লক্ষ ভূমিকম্প হতে পারে। অবশ্য, এগুলোর মধ্যে অনেক ভূমিকম্প অজ্ঞাতই থেকে যায়।

কথিত রয়েছে যে, সমস্ত ভূমিকম্পের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশই কঠিন পাতের পরিসীমায় চ্যুতিসহ ঘটে থাকে। কিন্তু, কখনো কখনো কঠিন পাতের মধ্যে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প হয়ে থাকে, তবে তা খুবই বিরল। অনুমান অনুসারে, লিপিবদ্ধ ইতিহাসে ১৫৫৬ সালে চিনের তিনটে প্রদেশে সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্প ৮,৩০,০০০ জনের জীবন কেড়ে নিয়েছিল!

এ ছাড়া, ভূমিকম্পগুলোর কারণে আরও মারাত্মক পরিণতি ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ১৭৫৫ সালের ১লা নভেম্বরে সংঘটিত একটা ভূমিকম্প পোর্তুগালের লিসবন শহরকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল, যেখানকার জনসংখ্যা ছিল ২,৭৫,০০০ জন। কিন্তু আতঙ্ক সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। সেই ভূমিকম্পের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল এবং সেইসঙ্গে আনুমানিক ১৫ মিটার উঁচু সুনামি বয়ে গিয়েছিল, যা কাছের আটলান্টিক মহাসাগর থেকে সর্বোচ্চ গতিতে এগিয়ে এসেছিল। সব মিলিয়ে সেই শহরে মৃতের সংখ্যা ৬০,০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু, আবারও বলতে হয় যে এই ধরনের দুর্যোগের তীব্রতা কিছুটা হলেও মানবঘটিত কারণের জন্য হয়ে থাকে। একটা কারণ হচ্ছে, অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে জনসংখ্যার ঘনত্ব। গ্রন্থকার এন্ড্রু রবিনসন বলেন, “বিশ্বের বৃহত্তম শহরগুলোর প্রায় অর্ধেকই এখন ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে গড়ে উঠেছে।” আরেকটা কারণ হচ্ছে বিল্ডিংগুলো—ব্যবহৃত বস্তুসামগ্রী ও এর কাঠামোগত মান। “ভূমিকম্প মানুষকে হত্যা করে না; হত্যা করে বিল্ডিংগুলো,” এই প্রবাদ বাক্যটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য হয়। কিন্তু, লোকেরা যখন এতটাই দরিদ্র হয় যে ভূমিকম্প প্রতিরোধী বাড়িঘর বানাতে পারে না, তখন তাদের আর কীই বা করার আছে?

আগ্নেয়গিরি—গাঁথক ও বিনাশক

“আপনি এই কথাগুলো পড়ার সময় কমপক্ষে ২০টা আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্নুৎপাত হচ্ছে,” যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট এর দ্বারা প্রণীত একটা রিপোর্ট বলে। সাধারণ অর্থে বলতে গেলে, পাত সংস্থান (প্লেট টেকটোনিকস) তত্ত্ব বলে যে, ভূমিকম্প ও অগ্নুৎপাত একই অঞ্চলে ঘটবে—সেই ফাটলগুলোতে, বিশেষ করে সমুদ্রতলের ফাটলগুলোতে; ভূত্বকে, যেখানে গুরুমণ্ডল থেকে ফাটলের মধ্যে দিয়ে ম্যাগমা বের হয়ে আসে; এবং অধোগামী অঞ্চলগুলোতে, যেখানে একটা পাত অন্যটার নীচে নিমগ্ন থাকে।

অগ্নুৎপাতের সংখ্যার জন্য এবং জনবহুল এলাকার কাছেই ঘটার কারণে অধোগামী অগ্নুৎপাত লোকেদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে থাকে। প্রশান্ত মহাসাগীয় অঞ্চলের দেশগুলো, যেগুলোকে আগ্নেয়বেষ্টনী বলা হয়, সেগুলোতে এইরকম শত শত অধোগামী আগ্নেয়গিরি রয়েছে। এ ছাড়া, কঠিন পাতের সীমানা থেকে দূরে তপ্ত অঞ্চলেও এইরকম কয়েকটা আগ্নেয়গিরি দেখা যায়। হাওয়াই দ্বীপ, এজর্স, গালাপেগাস দ্বীপ এবং সোসাইটি দ্বীপ, সবই তপ্ত অঞ্চলের আগ্নেয়গিরির কারণে উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে হয়।

বস্তুতপক্ষে, আগ্নেয়গিরি পৃথিবীর ইতিহাসে এক দীর্ঘ ও গঠনমূলক ভূমিকা রেখেছে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ওয়েব সাইট অনুসারে, “সমস্ত মহাদেশ ও সমুদ্রের অববাহিকার প্রায় ৯০ শতাংশই অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট হয়েছে।” কিন্তু, কোন কারণে কিছু কিছু অগ্নুৎপাত চরম ধ্বংসাত্মক হয়ে থাকে?

তপ্ত ভূগর্ভ থেকে ম্যাগমা নির্গত হওয়ার মাধ্যমে অগ্নুৎপাতের সূত্রপাত হয়। কিছু আগ্নেয়গিরি সাধারণত ধীরে ধীরে লাভা নির্গত করে, যা আকস্মিকভাবে লোকেদের গ্রাস করার জন্য কদাচিৎ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়। কিন্তু, অন্যগুলো একটা পারমাণবিক বোমার চেয়েও প্রবল শক্তি সহকারে বিস্ফোরিত হয়! মূল কারণগুলোর অন্তর্ভুক্ত গলিত পদার্থের মিশ্রণ ও সান্দ্রতা (পদার্থের আঠালো, চটচটে ভাব) এবং সেইসঙ্গে গ্যাসের পরিমাণ ও সেই পদার্থে দ্রবীভূত উত্তপ্ত জল, যা অগ্নুৎপাত ঘটিয়ে থাকে। ম্যাগমা ভূতলের কাছাকাছি গেলে শুঁষে নেওয়া জল ও গ্যাস দ্রুতগতিতে প্রসারিত হয়। নির্দিষ্ট পরিমাণ ম্যাগামা মিশ্রণের ফলে এর প্রভাব অনেকটা সোডার মতো হয়ে থাকে, যা একটা ক্যান খুললে বুদ বুদ করে বের হয়ে আসে।

আনন্দের বিষয় যে, আগ্নেয়গিরিগুলো প্রায়ই অগ্নুৎপাতের আগাম সতর্কবাণী দিয়ে থাকে। ১৯০২ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের মার্টিনিক দ্বীপের পিলে পর্বতের ক্ষেত্রে ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তবে, স্যাঁ পিয়ারের নিকটবর্তী একটা এলাকায় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল আর রাজনীতিবিদরা লোকেদের সেখানে থাকতে উৎসাহিত করেছিল, যদিও সেই শহরে ইতিমধ্যেই ভস্ম নির্গত হচ্ছিল এবং অসুস্থতা ও ভয় ছড়িয়ে পড়েছিল। বস্তুতপক্ষে, অধিকাংশ দোকানই দিনের পর দিন বন্ধ ছিল!

মে মাসের ৮ তারিখ ছিল যিশুর স্বর্গারোহণের দিন উপলক্ষে আয়োজিত ছুটির দিন আর অনেক লোক আগ্নেয়গিরির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে ক্যাথলিক গির্জায় গিয়েছিল। সেদিন সকালে ৮টা বাজার অল্প কিছুসময় আগেই, পিলে পর্বতে অগ্নুৎপাত ঘটে, প্রচুর পরিমাণে আগ্নেয়শিলা—ভস্ম, কয়লা, আগ্নেয় কাচ, ঝামাপাথর এবং উত্তপ্ত গ্যাস—নির্গত হতে থাকে, যেগুলোর তাপমাত্রা ছিল ২০০ থেকে ৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভূমি ঘেঁষে উদ্ভূত মারাত্মক কালো মেঘ আকস্মিক পর্বত থেকে তীব্র বেগে নেমে আসে, শহরকে পুরোপুরি ছেয়ে ফেলে, প্রায় ৩০,০০০ লোকের মৃত্যু ঘটায়, গির্জার ঘন্টা গলে যায় এবং পোতাশ্রয়ের জাহাজগুলোকে জ্বালিয়ে দেয়। এটা ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক অগ্নুৎপাত। কিন্তু, লোকেরা যদি সতর্কতামূলক চিহ্নগুলোতে মনোযোগ দিত, তা হলে এটা এতটা মারাত্মক হতো না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো কি আরও বৃদ্ধি পাবে?

ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অভ্‌ রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস তাদের ২০০৪ সালের বিশ্ব দুর্যোগের রিপোর্ট (ইংরেজি) বলে যে, বিগত দশকে ভূপদার্থবিদ্যা এবং আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগগুলো ৬০ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই রিপোর্ট বলে যে, “এগুলো দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশের ইঙ্গিত বহন করে,” যা সেই বছর ২৬শে ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরে সর্বনাশা সুনামি ঘটার আগে প্রকাশিত হয়েছিল। নিঃসন্দেহে, অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে জনসংখ্যা যদি ক্রমাগত বাড়তেই থাকে আর বনভূমি যদি হ্রাস পেতেই থাকে, তা হলে কোনো আশা নেই বললেই চলে।

অধিকন্তু, অনেক শিল্পোন্নত দেশ বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত আগের চেয়ে আরও বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত করে চলেছে। সায়েন্স পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধ অনুসারে, গ্যাস নির্গতকরণ হ্রাস নিয়ে গড়িমসি করা “কোনো সংক্রামক রোগের জন্য ওষুধ গ্রহণ করতে না চাওয়ার মতোই: পরবর্তী সময়ে যে-চরম মূল্য দিতে হবে, এটা তা নিশ্চিত করছে।” সেই মূল্যগুলোর বিষয়ে উল্লেখ করে দুর্যোগ হ্রাস করার ওপর কানাডার একটা রিপোর্ট বলেছিল: “জলবায়ুর পরিবর্তনকে এ যাবৎ আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠীর দ্বারা আলোচিত সবচেয়ে পরিব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী পরিবেশগত সমস্যা বলা যেতে পারে।”

কিন্তু, বর্তমানে মানুষের কাজগুলো আদৌ পৃথিবীর উষ্ণতার ক্ষেত্রে অবদান রাখবে কি না, সেই বিষয়েই যেখানে আন্তর্জাতিক মানবগোষ্ঠী একমত হতে পারে না, সেখানে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা তো দূরের কথা। এই পরিস্থিতি বাইবেলের এই সত্যকে মনে করিয়ে দেয়: “মনুষ্য . . . আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না।” (যিরমিয় ১০:২৩) তা সত্ত্বেও, পরের প্রবন্ধে আমরা দেখব যে, পরিস্থিতি নিরাশাজনক নয়। বস্তুতপক্ষে, মানবসমাজে ঝটিকাপূর্ণ অবস্থাসহ বর্তমান সন্তাপগুলো আরও বেশি করে প্রমাণ দেয় যে, স্বস্তি কাছেই রয়েছে। (g০৫ ৭/২২)

[পাদটীকা]

^ এ ছাড়া, সৌরতাপের অসম বন্টন সাগরের স্রোত গঠন করে ও অধিকতর শীতল অঞ্চলগুলোতে শক্তি স্থানান্তরিত করে।

[৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

যখন ভুট্টা খেতে একটা আগ্নেয়গিরি বিস্তার লাভ করে

উনিশশো তেতাল্লিশ সালে, মেক্সিকোর একজন কৃষক তার ভুট্টা খেতে শুধু ভুট্টা ছাড়াও অন্য কিছুর বিস্তার লাভ করতে দেখেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন যে, ভূমিতে চিড় বা ফাটল তৈরি হচ্ছে। পরের দিন সেই ফাটলগুলো একটা ছোট্ট আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়। পরের সপ্তাহে সেই কোন্‌ ১৫০ মিটার বেড়ে যায় আর এক বছর পর তা ৩৬০ মিটার উঁচু হয়। অবশেষে, সেই কোন্‌ যা সমুদ্রতল থেকে ২,৭৭৫ মিটার উঁচু, তা শেষ পর্যন্ত ৪৩০ মিটারে গিয়ে পৌঁছায়। পারিকুটিন নামক এই আগ্নেয়গিরি ১৯৫২ সালে হঠাৎ করে অগ্নুৎপাত ঘটানো বন্ধ করে দেয় ও তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সুপ্তই রয়েছে।

[সৌজন্যে]

U. S. Geological Survey/Photo by R. E. Wilcox

[৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

যখন ঈশ্বর বিভিন্ন জাতিকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করেছিলেন

দুর্ভিক্ষ হচ্ছে এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রাচীন মিশরে, যাকোব বা ইস্রায়েলের পুত্র যোষেফের সময়ে এ যাবৎ লিপিবদ্ধ প্রথম দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষ সাত বছর স্থায়ী হয়েছিল আর তা মিশর, কনান এবং আরও অন্যান্য দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। কিন্তু, তাই বলে বহু লোক অনাহারে থাকেনি কারণ যিহোবা সাত বছর আগেই এই বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তিনি এও প্রকাশ করেছিলেন যে, সেই মধ্যবর্তী সময়ে মিশরে প্রচুর শস্য থাকবে। ঈশ্বরভয়শীল যোষেফ, যিনি ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের কারণে প্রধানমন্ত্রী ও খাদ্য প্রশাসক হয়ে উঠেছিলেন, তার তত্ত্বাবধানে মিশরীয়রা এত শস্য সঞ্চয় করে রেখেছিল যে, তারা ‘মাপিতে নিবৃত্ত হইল।’ তাই, মিশর শুধুমাত্র নিজের জন্যই নয় কিন্তু সেইসঙ্গে যোষেফের পরিবারসহ ‘সর্ব্বদেশীয় লোকের’ জন্যও খাদ্য জুগিয়েছিল।—আদিপুস্তক ৪১:৪৯, ৫৭; ৪৭:১১, ১২.

[৭ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

হাইতি ২০০৪ সাল—প্লাবিত রাস্তায় ছেলেরা পানীয় জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে বনভূমি নিধন ব্যাপক কাদাধস ঘটিয়েছে

[সৌজন্যে]

পটভূমি: Sophia Pris/EPA/Sipa Press; ইনসেট: Carl Juste/Miami Herald/Sipa Press

[৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

অনেক দেশ বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গত করে

[সৌজন্যে]

© Mark Henley/Panos Pictures