সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সমাধিগুলো—প্রাচীন বিশ্বাস সম্বন্ধে জানার এক মাধ্যম

সমাধিগুলো—প্রাচীন বিশ্বাস সম্বন্ধে জানার এক মাধ্যম

সমাধিগুলো—প্রাচীন বিশ্বাস সম্বন্ধে জানার এক মাধ্যম

কল্পনা করুন যে, আপনি কয়েক হাজার বছর আগে বেঁচে আছেন। আপনি বাবিলের সুমারের এক সমৃদ্ধশালী রাজকীয় শহর ঊরে রয়েছেন। সুমেরীয়দের এক বিরাট দল শোভাযাত্রা সহকারে শহর পরিত্যাগ করে কবরস্থানে প্রবেশ করেছে আর এখন ঢালু পথ ধরে সম্প্রতি প্রয়াত একজন শাসকের সমাধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাধির দেওয়াল এবং মেঝে মাদুর দিয়ে আবৃত আর ভিতরের কক্ষ চমৎকার সুমেরীয় শিল্পকর্ম দ্বারা সজ্জিত। সৈনিক, দাস এবং স্ত্রীলোকদের শোভাযাত্রায় গায়কদলও সমাধির অভিমুখে যাত্রা করছে। সকলের সাজসজ্জাই ঝলমলে। কর্মকর্তারা গর্বের সঙ্গে তাদের পদমর্যাদার চিহ্ন ধারণ করেছে। রঙিন সজ্জায় সজ্জিত লোকেদের এই ভিড়ের মধ্যে রয়েছে ষাঁড় বা গাধায় টানা রথ ও সেইসঙ্গে পশুদের সঙ্গে সঙ্গে হেঁটে চলা অশ্বপালকরা। সকলেই নিজ নিজ স্থান গ্রহণ করে আর যন্ত্রসংগীত সহকারে এক ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান শেষ হলে প্রত্যেক ব্যক্তি—সুরকার থেকে শুরু করে দাস—এই উপলক্ষের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে আসা কাদামাটি, পাথর অথবা ধাতু দিয়ে তৈরি ছোট একটা পেয়ালা নেয় ও তারপর সেটাকে একটা তামার পাত্রের মধ্যে ডুবিয়ে দেয় এবং বিশেষভাবে প্রস্তুত করা পানীয়ে চুমুক দেয়। এরপর সকলেই সারি সারি করে শুয়ে পড়ে, চুপচাপ শুয়ে থাকে, ঘুমিয়ে পড়ে ও মারা যায়। কোনো একজন দেরি না করে পশুগুলোকে হত্যা করে। কর্মীরা সমাধি পর্যন্ত যাওয়া সুরঙ্গপথকে ভরাট করে সেটাকে সীল করে বন্ধ করে দেয়। সুমেরীয়রা বিশ্বাস করে যে, তাদের দেবরাজ এখন গৌরবের সঙ্গে তার সমাহিত রথে চড়ে, ঝলমলে সজ্জায় সজ্জিত তার অনুগত দাস ও রক্ষীদের সঙ্গে পরজগতে যাত্রা করেছে।

দক্ষিণ ইরাকে কাজ করার সময় প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলি, প্রাচীন ঊরের কবরস্থানে, ঠিক যেমনটা বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেইরকম ১৬টা রাজকীয় সমাধি আবিষ্কার করেন। সেগুলো ভয়ংকর ছিল বটে কিন্তু সেইসঙ্গে উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারও ছিল। “মেসোপটেমিয়ার প্রত্নতত্ত্বে অতুলনীয় হয়ে থাকা এই সমস্ত সমাধির ধনসম্পদের অন্তর্ভুক্ত হল, সুমেরীয় শিল্পকর্মের সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু বস্তু, যেগুলো এখন ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ইউনিভারসিটি অভ্‌ পেনসিলভানিয়া মিউজিয়াম-এ সাজানো রয়েছে,” পল্‌ বান তার লেখা সমাধি, কবর ও মমিগুলো (ইংরেজি) নামক বইয়ে বলেন।

কিন্তু, প্রাচীন ঊরের সমাধিগুলো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, এমনকি মানুষ ও পশুবলির ভয়ংকর দিকগুলোর ক্ষেত্রেও নয়। অনেক প্রাচীন সভ্যতায়, সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর এবং রাজবংশীয় ব্যক্তিরা তাদের মৃত্যু ও মৃত্যুর পরে জীবনের জন্য প্রচুর পরিমাণে—এবং কখনো কখনো নিষ্ঠুর উপায়ে—বিনিয়োগ করেছিল। শৈল্পিক চমৎকারিত্বে পূর্ণ এবং সম্পদে বোঝাই তাদের এই সমাধিগুলো প্রায়ই জীবিত ব্যক্তিদের প্রাসাদগুলোর সমান ছিল কিংবা সেগুলোর চেয়েও বড় ছিল। কিন্তু, বর্তমানে সেই সমাধিগুলো ও সেইসঙ্গে অন্যান্য আরও সাধারণ কবর যেগুলো অতীত সম্বন্ধে জানার এক মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, সেগুলো আমাদেরকে প্রাচীন লোকেদের ও বিলুপ্ত সভ্যতাগুলোর বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং শৈল্পিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতাগুলো পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ করে দেয়।

সঙ্গীদের সঙ্গে রাজকীয়ভাবে ক্ষয় পাওয়া

১৯৭৪ সালে, চিনের শিয়ান শহরের কাছে কৃষকরা একটা কুয়ো খুঁড়ছিল। কিন্তু, জল পাওয়ার পরিবর্তে তারা মাটি দিয়ে তৈরি মানুষের অবয়বের অংশ, ব্রোঞ্জের আড়ধনুক এবং তিরের ফলা খুঁজে পায়। অজান্তেই, হঠাৎ করে তারা ২,১০০ বছরের পুরনো চিন্‌ পোড়ামাটির তৈরি সৈন্যবাহিনীটা আবিষ্কার করে, যে-সৈন্যবাহিনীতে স্বাভাবিক আকৃতির চেয়ে বড় আকৃতির ৭,০০০রেরও বেশি মাটির তৈরি সৈন্য ও ঘোড়া ছিল—সকলেই সৈন্যবাহিনীতে তাদের অবস্থান অনুযায়ী সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চিনের সম্রাটদের সবচেয়ে বড় সমাধির একটা অংশ হল, চিন্‌ পোড়ামাটির সৈনবাহিনী যেটা সম্রাট চিন্‌ শিঃ হুয়াং তির নামানুসারে নামকরণ করা হয়, যে-সম্রাট সা.কা.পূ. ২২১ সালে চিনের সংগ্রামরত রাজ্যগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।

চিন্‌ এর জাঁকালো সমাধিকে এক ভূগর্ভস্থ প্রাসাদ বলে বর্ণনা করা যেতে পারে। কিন্তু কেন তাকে পোড়ামাটির এক সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সমাধিস্থ করা হয়েছিল? জাং ওয়েনলি তার কিন টেরাকোটা আর্মি নামক বইয়ে ব্যাখ্যা করেন যে, চিন্‌ এর “জাঁকালো সমাধিটা হল কিন সাম্রাজ্যের এক প্রতীক [এবং] এটা স্থাপন করার উদ্দেশ্য ছিল, কিন শিঃ হুয়াংদি [চিন্‌ শিঃ হুয়াং তি] জীবিত থাকতে তার যে-মহিমা ও ক্ষমতা ছিল, মৃত্যুর পরও তাকে সেগুলো জোগানো।” সেই সমাধিটা এখন একটা বিরাট জাদুঘরের অংশ, যেটার কাছেই ৪০০টা সমাধি ও গহ্বর রয়েছে।

জাং বলেন যে, সমাধিটা নির্মাণ করার জন্য “সাম্রাজ্যের সমস্ত জায়গা থেকে ৭,০০,০০০রও বেশি পুরুষকে নিযুক্ত করা হয়েছিল।” সা.কা.পূ. ২১০ সালে চিন্‌ এর মৃত্যুর পর কাজ চলতে থাকে এবং শেষ করতে মোট ৩৮ বছর লাগে। কিন্তু, চিন্‌ এর সঙ্গে সমাহিত সমস্ত সঙ্গী পোড়ামাটির তৈরি ছিল না। তার উত্তরাধিকারী আদেশ জারি করেছিল যে, চিন্‌ এর নিঃসন্তান উপপত্নীদের যেন তার সঙ্গে কবর দেওয়া হয়, এর ফলে ইতিহাসবেত্তারা বলেন, “বহু সংখ্যক” লোকের মৃত্যু হয়েছিল। এই ধরনের অভ্যাসগুলো অন্যান্য দেশেও বিদ্যমান ছিল।

মেক্সিকো শহরের উত্তরপূর্ব দিকে প্রাচীন তেওতিওয়াকান শহরের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এই শহরে একটা রাস্তা রয়েছে, যেটাকে বলা হয় স্ট্রিট অভ্‌ দ্যা ডেড বা মৃত লোকেদের রাস্তা। “এই রাস্তার পাশ দিয়ে,” বান লেখেন, “পৃথিবীর কিছু সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যশিল্প রয়েছে।” এগুলোর মধ্যে রয়েছে সা.কা. প্রথম শতাব্দীতে নির্মিত পিরামিড অভ্‌ দ্যা সান ও পিরামিড অভ্‌ দ্যা মুন এবং কেটসালকোয়াটল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।

পিরামিড অভ্‌ দ্যা সান এর অভ্যন্তরে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের কবর দেওয়ার একটা কক্ষ রয়েছে বলে মনে করা হয়, যার মধ্যে উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবিশেষদের, সম্ভবত যাজকদের সমাধি রয়েছে। কাছেই গণকবরগুলোতে পাওয়া মানবদেহের ধ্বংসাবেশষগুলো ইঙ্গিত করে যে, পিরামিডের অভ্যন্তরে সমাহিত ব্যক্তিদের রক্ষা করার জন্য যোদ্ধারা হয়তো নিজেদের জীবন বলি দিয়েছে। কবরগুলোর স্বতন্ত্র গঠনের কারণে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এইরকম মনে করতে পরিচালিত হয়েছে যে, অভ্যন্তরে শিশুসহ প্রায় ২০০ জন লোকের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে, যাদেরকে হয়তো স্মৃতিসৌধগুলো উৎসর্গীকরণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বলি দেওয়া হয়েছে।

নৌকায় অথবা ঘোড়ায় চড়ে পরজীবনে যাত্রা করা

স্ক্যানডিনেভিয়ার জলদস্যু অর্থাৎ সমুদ্রে ভ্রমণরত যেসব যোদ্ধা প্রায় ১,০০০ বছর আগে ইউরোপে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল, তারাও মৃত্যুর পরে এক পার্থিব আরামআয়েশপূর্ণ জীবন উপভোগ করার আশা করেছিল। তারা বিশ্বাস করত যে, তাদের মৃত ব্যক্তিরা নিজ নিজ ঘোড়ায় অথবা বিশাল নৌকায় চড়ে পরজগতে যাত্রা করেছে। তাই, জলদস্যুদের কবরস্থানগুলোতে হয়তো বধ করা ঘোড়ার কঙ্কাল থেকে শুরু করে নৌকার পচে যাওয়া কাঠ, এমন যে যেকোনোকিছু থাকতে পারে। তাই, গুয়িন জোন্স জলদস্যুদের এক ইতিহাস (ইংরেজি) নামক বইয়ে লেখেন: “মৃত নারী-পুরুষদের মৃত্যুর পরের জীবন যাতে পৃথিবীতে থাকাকালীন জীবনের মতো আরামদায়ক ও সম্মানজনক হয়, সেইজন্য তাদের জানা সমস্তকিছুই দেওয়া হয়েছিল . . . ডেনমার্কের ল্যাদবুয়েতে [সমাধিস্থ] জাহাজটিতে . . . নোঙ্গর রাখা ছিল, যেটা এর প্রভুর সমুদ্রযাত্রার শেষে ফেলার জন্য তৈরি করা ছিল।”

জলদস্যুরা যোদ্ধা জাতি ছিল এবং তারা বিশ্বাস করত যে, যদি তারা যুদ্ধ করতে করতে মারা যায়, তা হলে তারা দেবতাদের আবাসে যাবে—যে-আবাসকে আ্যসগার্ড বলা হয়। “সেখানে তারা সারাটা দিন লড়াই করতে ও রাতভর ভোজনপান করতে পারবে,” ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোডিয়া বলে। এ ছাড়া, জলদস্যুদের সমাহিত করার সঙ্গেও মানুষ বলি দেওয়া জড়িত ছিল। “যখন কোনো দলপতি মারা যেত, তখন ক্রীতদাস ও পরিচারকদের জিজ্ঞেস করা হতো যে, কে তার সঙ্গে মরতে ইচ্ছুক,” জলদস্যুরা (ইংরেজি) বইটি বলে।

উত্তর ইউরোপের কেল্‌ট জাতির লোকেরা বিশ্বাস করত যে, এমনকি পরজগতে গিয়েও ঋণ পরিশোধ করা যেতে পারে—সম্ভবত দেনা পরিশোধে বিলম্ব করার এক ধূর্ত অজুহাত! মেসোপটেমিয়ার ছেলেমেয়েদেরকে তাদের খেলনাসহ কবর দেওয়া হতো। প্রাচীন ব্রিটেনের কিছু এলাকায়, সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খাবারদাবার যেমন, ভেড়ার পা কবর দেওয়া হতো, যাতে পরজীবনে তাদের খিদে ভোগ করতে না হয়। মধ্য আমেরিকাতে, মায়া রাজবংশীয় লোকেদের পান্নার তৈরি জিনিসপত্র দিয়ে সমাহিত করা হতো আর এই পান্না হল এক সবুজবর্ণের রত্ন, যা তরল ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘনীভূত রূপকে চিত্রিত করে। মৃত্যুর পরে যে জীবন রয়েছে, সেই ধারণাকে নিশ্চিত করাই হয়তো এর উদ্দেশ্য ছিল।

সা.কা.পূ. ১,০০০ সালের কিছু সময় পর, থ্রাসিয়ানরা—এক ভীতু জাতি কিন্তু সেইসঙ্গে দক্ষ স্বর্ণকার হিসেবেও পরিচিত ছিল—সেই অঞ্চলে বাস করত, যেটা আজকে বুলগেরিয়া, উত্তর গ্রিস ও তুর্কিতে রয়েছে। থ্রাসিয়ান সমাধিগুলো প্রকাশ করে যে, তাদের নেতাদেরকে রথ, অশ্ব, তীক্ষ্ণ অস্ত্রশস্ত্র আর অবশ্যই তাদের স্ত্রীসহ জাঁকজমকভাবে কবর দেওয়া হয়েছিল। বস্তুতপক্ষে, একজন থ্রাসিয়ান স্ত্রী বলিকৃত হওয়া ও তার স্বামীর পাশে কবরস্থ হওয়াকে এক সম্মানজনক বিষয় হিসেবে দেখতেন!

এর অল্প কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আর সামান্য দূরে—কৃষ্ণ সাগরের ঠিক উত্তরে—স্কুথীয়রা বাস করত। এই যুদ্ধবাজ ব্যক্তিরা যে-লোকেদের হত্যা করেছিল, তাদের মাথার খুলি দিয়ে তৈরি পেয়ালায় পান করত এবং মাথার চামড়া দিয়ে তৈরি আলখাল্লা পরত। একজন স্কুথীয়ের সমাধিতে একটা স্ত্রীলোকের কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল আর তার পাশে গাঁজা লুকিয়ে রাখা ছিল। তার মাথার খুলিতে তিনটে ছোট ফুটো ছিল, সম্ভবত ফুলে ওঠা ও এর ফলে যন্ত্রণা থেকে স্বস্তি লাভ করার জন্য। সম্ভবত এই কারণে তার পাশে গাঁজা রাখা হয়েছিল, যাতে পরজগতে মাথাব্যথা হলে তা কমানোর জন্য তার কাছে কিছু থাকে।

মিশরীয়দের মৃত্যুর পরের জীবন

কায়রোর কাছে মিশরের পিরামিডগুলো এবং লাক্সোর কাছে ভ্যালি অভ্‌ দ্যা কিংস্‌ এর সমাধিকক্ষগুলো হল, সমস্ত প্রাচীন সমাধির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। প্রাথমিক মিশরীয়দের কাছে “সমাধি” শব্দটি “বাড়ি”—পার—কথাটার সমরূপ শব্দ ছিল। “তাই, জীবিত থাকাকালীন একটা বাড়ি ছিল ও মৃত্যুর পর একটা বাড়ি ছিল,” প্রাচীন মিশরের মমিগুলো, পৌরাণিক কাহিনী এবং জাদু (ইংরেজি) নামক তার বইয়ে ক্রিস্টিন এল মেহ্‌দি বলেন। এ ছাড়া, তিনি এও বলেন যে, “[মিশরীয়দের] বিশ্বাস অনুসারে, তাদের সত্তার অন্যান্য অংশ যেমন, কা, বা এবং আখ্‌ এর বেঁচে থাকার জন্য মৃত্যুর পরে দেহের বেঁচে থাকা অত্যাবশ্যক ছিল।”

কা ছিল মাংসিক দেহের এক আত্মিক প্রতিরূপ এবং এর মধ্যে দেহের প্রত্যাশা, আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজনগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৃত্যুর পরে, কা দেহ ছেড়ে চলে যায় ও সমাধিতে বসবাস করতে থাকে। কারণ জীবিত থাকতে সেই ব্যক্তির যা যা প্রয়োজন ছিল, কা-রও ঠিক সেগুলোই লাগত, তাই “সমাধিতে রাখা জিনিসগুলো প্রধানত এর প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য ছিল,” এল মেহ্‌দি লেখেন। বা-কে একজন ব্যক্তির চরিত্র অথবা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এবং তা মানুষের মাথাবিশিষ্ট একটা পাখির দ্বারা চিত্রিত করা হতো। জন্মের সময় এই বা দেহে প্রবেশ করত এবং মৃত্যুতে দেহ ছেড়ে যেত। তৃতীয় সত্তা, আখ্‌ মন্ত্রের গুণে মমি থেকে “বেরিয়ে আসত।” * আখ্‌ দেবতাদের জগতে বসবাস করত।

একজন ব্যক্তিকে তিনটে সত্তায় ভাগ করে, মিশরীয়রা প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চেয়ে আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে, যারা মানুষকে দুটো সত্তায় ভাগ করেছিল—এক মরণশীল অংশ ও এক (অদৃশ্য) অমর অংশ। যদিও এটা এখনও এক জনপ্রিয় শিক্ষা কিন্তু এই ধারণাকে বাইবেল সমর্থন করে না, যেটি বলে: “জীবিত লোকেরা জানে যে, তাহারা মরিবে; কিন্তু মৃতেরা কিছুই জানে না।”—উপদেশক ৯:৫.

কেন মৃত্যুর দ্বারা আচ্ছন্ন?

প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম (ইংরেজি) নামক তার বইয়ে ই. ও. জেমস্‌ লেখেন: “মানুষ যে-সমস্ত . . . পরিস্থিতিগুলোর মুখোমুখি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে মৃত্যু হচ্ছে সবচেয়ে বিরক্তিজনক এবং ধ্বংসাত্মক . . . তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মৃতদের প্রতি গভীর ভক্তি দেখানো এতটাই বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে আর মানবসমাজের একেবারে শুরু থেকেই এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেছে।”

অকৃত্রিম প্রজ্ঞার সবচেয়ে প্রাচীন বই বাইবেল, মৃত্যুকে মানুষের এক শত্রু বলে অভিহিত করে। (১ করিন্থীয় ১৫:২৬) এটা কতই না উপযুক্ত! প্রত্যেক জাতি ও সভ্যতা অত্যন্ত জোরালোভাবে এই ধারণার বিরোধিতা করেছে যে, মৃত্যুই হল চূড়ান্ত পরিণতি। অন্যদিকে, আদিপুস্তক ৩:১৯ পদে বাইবেল সঠিকভাবে সেইসমস্ত ব্যক্তির প্রতি প্রকৃতপক্ষে কী ঘটে তা জানায়, যারা কবরে যায়: “তুমি ধূলি, এবং ধূলিতে প্রতিগমন করিবে।” কিন্তু, বাইবেল বহু মৃত মানুষের ক্ষেত্রে “কবরস্থ [“স্মারণিক কবরে,” NW]” অভিব্যক্তিটিও ব্যবহার করে। কেন? কারণ যারা কবরে রয়েছে তাদের অনেকেই, এমনকি যাদের দেহ সম্পূর্ণরূপে পচে গিয়েছে, তারাও ঈশ্বরের স্মরণে রয়েছে এবং সেই আনন্দের সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে, যখন ঈশ্বর তাদের পুনরুত্থিত করবেন এবং এক পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তজীবন উপভোগ করার সুযোগ দেবেন।—লূক ২৩:৪৩; যোহন ৫:২৮, ২৯.

এই সময়ে মৃতেরা অচেতন অবস্থায় রয়েছে। যিশু তাদের অবস্থাকে ঘুমের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। (যোহন ১১:১১-১৪) এইরকম এক অবস্থায়, একজন ব্যক্তির কবরে জিনিসপত্রের অথবা পরিচারকদের কোনো প্রয়োজন নেই। বস্তুতপক্ষে, সমাহিত এই সম্পদগুলো থেকে বেশির ভাগ সময়ই যারা উপকৃত হয়ে থাকে, তারা মৃত ব্যক্তিরা নয় কিন্তু জীবিতরা—যারা কবর ডাকাতি করে থাকে! মৃতদের অবস্থা সম্বন্ধে বাইবেল যা শিক্ষা দেয় তার সঙ্গে মিল রেখে বাইবেল বলে: “আমরা জগতে কিছুই সঙ্গে আনি নাই, কিছুই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেও পারি না।” (১ তীমথিয় ৬:৭) খ্রিস্টানরা এই সত্যের জন্য কতই না কৃতজ্ঞ, যা প্রাচীনকালের—এবং কখনো কখনো এমনকি আধুনিক সময়ের—মৃতদের প্রতি গভীর ভক্তি দেখানোর নির্মম ও নৃশংস অভ্যাসগুলো থেকে ‘তাহাদিগকে স্বাধীন করে।’—যোহন ৮:৩২.

যদিও মৃতদের প্রতি গভীর ভক্তি দেখানোর এই অভ্যাসগুলো অর্থহীন কিন্তু প্রাচীনকালের জাঁকালো সমাধিগুলো পুরোপুরিভাবে কেবল অপচয়ই নয়। অনেক শিল্পকর্ম এবং এমনকি কবরগুলোর মধ্যে মৃতদের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া, সুদূর অতীত এবং এর কিছু লুপ্ত হয়ে যাওয়া সভ্যতা সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান বস্তুতপক্ষে অস্পষ্টই থাকত। (g০৫ ১২/৮)

[পাদটীকা]

^ “মমি” শব্দটি আরবি শব্দ মুমিয়া থেকে এসেছে, যেটির অর্থ “বিটুমিন” অথবা “পিচ।” এগুলো দেখতে কালো হওয়ায় এই শব্দটিকে মূলত রজনে-সিক্ত শবগুলোর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়েছিল। এখন এটাকে যেকোনো সংরক্ষিত দেহের—মানুষ অথবা জীবজন্তুর—ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, তা সেই সংরক্ষণ দুর্ঘটনাক্রমে হোক কিংবা ইচ্ছা করেই হোক।

[২৪ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

প্রাচীনকালের লোকেরা কতটা স্বাস্থ্যবান ছিল?

ধ্বংসাবশেষগুলো—বিশেষত সমাধিগুলোতে প্রাপ্ত দেহগুলোর এবং স্যাঁতসেঁতে জায়গায়, মরুভূমির তপ্ত বালুকায় এবং বরফ ও তুষারে প্রাকৃতিকভাবে মমি হয়ে যাওয়া ধ্বংসাবশেষগুলো—পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা আমাদের সুদূর অতীতের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জেনেছে। বিশেষভাবে জীনতত্ত্বের ক্ষেত্রে অগ্রগতি বিজ্ঞানীদের যেকোনোকিছু—ফ্যারাও ও তাদের রানিদের পারিবারিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে ইনকা জাতির দাসীদের রক্তের গ্রুপ পর্যন্ত—নির্ধারণ করার নতুন শক্তিশালী হাতিয়ার জুগিয়েছে। এই গবেষণাগুলো প্রকাশ করেছে যে, আজকে আমরা স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যে-সমস্যাগুলো ভোগ করে থাকি, প্রাচীনকালের লোকেরাও সেগুলো ভোগ করেছে, যেমন আথ্রাইটিস ও আঁচিল।

বিশেষ করে, প্রাচীন মিশরীয়রা বেশি রোগযন্ত্রণা ভোগ করেছে বলে মনে হয় আর তা মূলত সেইসমস্ত অসংখ্য পরজীবী জীবাণুর—রক্তের মধ্যে পরজীবী কৃমি থেকে শুরু করে সূতা কৃমি ও ফিতাকৃমির—কারণে, যেগুলো নীল নদ ও খালবিল থেকে এসেছে। এটা সা.কা.পূ. ১৫১৩ সালে মিশর থেকে ইস্রায়েল জাতিকে উদ্ধার করার ঠিক পরে, তাদের উদ্দেশে বলা ঈশ্বরের এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেয়: “সদাপ্রভু . . . মিস্রীয়দের যে সকল উৎকট রোগ তুমি জ্ঞাত আছ, তাহা তোমাকে দিবেন না।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৭:১৫.

[সৌজন্যে]

© R Sheridan/ANCIENT ART & ARCHITECTURE COLLECTION LTD

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

ঊরের এক রাজবংশীয় সমাধিতে কবরপ্রাপ্ত একজন পরিচারিকার সুমেরীয় পাগড়ি এবং অলংকার

[সৌজন্যে]

© The British Museum

[২১ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

চিন্‌ পোড়ামাটির তৈরি সৈন্যবাহিনী—প্রত্যেক সৈন্যের মুখমণ্ডল আলাদা আলাদভাবে খোদাই করা হয়েছিল

[সৌজন্যে]

ইনসেট: Erich Lessing/Art Resource, NY; © Joe Carini / Index Stock Imagery

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

মেক্সিকোর তেওতিওয়াকানে পিরামিড অভ্‌ দ্যা সান এবং স্ট্রিট অভ্‌ দ্যা ডেড

[সৌজন্যে]

ওপরে: © Philip Baird www.anthroarcheart.org; চিত্রাঙ্কন: Pictorial Archive (Near Eastern History) Est.

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বামদিকে: মিশরীয় রাজা তুতাংখামেনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খাঁটি সোনার মুখোশ। নীচে: অঙ্কিত সমাধির মধ্যে বা-কে মানুষের মাথাবিশিষ্ট একটা পাখি হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে