সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

‘মারা যাওয়ার আগে আমি ঈশ্বরকে সেবা করতে চাই’

‘মারা যাওয়ার আগে আমি ঈশ্বরকে সেবা করতে চাই’

‘মারা যাওয়ার আগে আমি ঈশ্বরকে সেবা করতে চাই’

মেমি ফ্রির কাহিনী

উনিশশো নব্বই সালে লাইবেরিয়ায় হঠাৎ করে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধ তীব্রতর হলে, ক্রান উপজাতির মেমি নামের ১২ বছর বয়সি একটা মেয়ে ও তার পরিবার, রাজধানী শহর মনরোভিয়ায় তাদের বাড়িতে আটকা পড়ে। “আমরা পাশের বাড়ি থেকে বিস্ফোরণের এক বিকট শব্দ শুনতে পাই,” মেমি বলেন। “আমাদের প্রতিবেশীর বাড়িতে একটা ক্ষেপণাস্ত্র খুব জোরে আঘাত করে ও সেই বাড়িতে আগুন লেগে যায়। আগুনের শিখা আমাদের বাড়িতেও ছড়িয়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়।” প্রচণ্ড লড়াইয়ের মাঝখানে মেমি, তার মা এবং তার মামা পালিয়ে যায়।

“হঠাৎ, কিছু একটা আমাকে আঘাত করে,” মেমি মনে করে বলেন।

“এরপর আমার মা জিজ্ঞেস করেন, ‘কী হল?’”

“আমাকে কিছু একটা আঘাত করেছে! মনে হয় আমার গুলি লেগেছে,” আমি উত্তর দিই।

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করে মেমি মাটিতে পড়ে যান এবং প্রার্থনা করেন: “ঈশ্বর, দয়া করে আমার কথা শোনো। আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি কিন্তু মারা যাওয়ার আগে আমি তোমাকে সেবা করতে চাই।” এরপর তিনি জ্ঞান হারান।

মেমি মারা গিয়েছে মনে করে প্রতিবেশীরা তাকে কাছেই একটা সমুদ্রসৈকতে কবর দিতে চায়। কিন্তু, তার মা বার বার বলতে থাকেন যে তাকে যেন স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দুঃখের বিষয় যে, হাসপাতাল তখন দলে দলে আসা আহত নারী-পুরুষ ও শিশুর আর্তনাদকে সামলে উঠতে পারছিল না। মেমির আহত মামা সেই রাতে মারা যান কিন্তু মেমি বেঁচে যান, তবে তার শরীর কোমরের নিচ থেকে অবশ হয়ে যায়।

তার শরীরের ভিতরে রক্তক্ষরণ হতে থাকে ও তিনি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। চার মাস পর, শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা গুলিটা তার শরীরে কোথায় রয়েছে, তা জানার জন্য এক্স-রে করে। তার হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের মাঝখানে গুলিটা আটকে ছিল। অপারেশন করা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে, তাই মেমির মা তাকে একজন সাধারণ ভেষজ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। “তিনি একটা খুর দিয়ে আমার শরীরটা কাটেন,” মেমি স্মরণ করে বলেন, “ও এরপর তার মুখ আমার ক্ষতস্থানে রেখে গুলিটা চুষে বের করার চেষ্টা করেন। তার মুখ থেকে একটা গুলি বের করে তিনি বলেন, ‘এই তো এটাই।’ আমরা তাকে পয়সা দিই ও চলে আসি।”

কিন্তু সেই ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলেছিলেন। আরেকবার এক্স-রে করায় ধরা পড়ে যে, গুলিটা তখনও সেখানেই রয়েছে। তাই মেমি ও তার মা সেই ভেষজ চিকিৎসকের কাছে ফিরে যায়, যিনি তাদেরকে নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে, গুলিটা যে বের হয়েছে সেটা এক্স-রেতে ধরা পড়তে আরও নয় মাস সময় লাগবে। তারা বাড়িতে ফিরে আসে ও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। এর মধ্যে মেমি তার ব্যথা লাঘব করতে বিভিন্ন ওষুধ খান। নয় মাস পর আবার এক্স-রে করা হয়। দেখা যায় যে, গুলিটা তখনও সেখানেই রয়েছে। শেষে সেই চিকিৎসক পালিয়ে যান।

এই সময় অবধি, মেমির শরীরে গুলিটা ১৮ মাস ধরে রয়েছে। একজন আত্মীয় তাকে একজন মহিলা ওঝার কাছে নিয়ে যান। তাকে সাহায্য করার বদলে তিনি বলেন যে, হয় মেমি নতুবা তার মা এক নির্দিষ্ট দিনে মারা যাবেন। মেমির বয়স তখন ১৩ বছর। “আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি,” মেমি বলেন। “কিন্তু, সেই নির্ধারিত দিনটা যখন আসে তখন আমরা কেউই মারা যাইনি।”

এরপর মেমির এক কাকা তাকে গির্জার একজন পাদরির কাছে নিয়ে যান, যিনি একটা দর্শন পেয়েছেন বলে দাবি করেন, যেটাতে জানানো হয়েছে যে, মেমির শরীর অবশ হওয়ার কারণ কোনো গুলি নয় বরং তাকে জাদু করা হয়েছে। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন যে, মেমি যদি তার পরামর্শকৃত রীতিনীতিগুলো মেনে চলেন, তা হলে তিনি এক সপ্তাহের মধ্যেই আবার হাঁটতে পারবেন। মেমি বলেন: “আমি সাগরের জলে বহুবার পবিত্র স্নান করেছি, উপোস থেকেছি ও প্রত্যেক দিন মধ্যরাতে ঘন্টার পর ঘন্টা মাটিতে গড়াগড়ি খেয়েছি। কিন্তু এই সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়েছিল এবং আমার অবস্থা আগে যেমন, তেমনই ছিল।”

তবে, শেষ পর্যন্ত আরও উন্নত চিকিৎসা আসে এবং দীর্ঘসময় পর মেমির শরীর থেকে গুলিটা বের করা সম্ভব হয়। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় কষ্ট পেয়েছেন। “অপারেশনের পর,” তিনি বলেন, “যন্ত্রণা বলতে গেলে একদমই ছিল না এবং আমি সহজেই শ্বাস নিতে পারছিলাম। যদিও আমার শরীর আংশিকভাবে অবশ থেকে যায়, তারপরেও আমি একটা ওয়াকারের সাহায্যে দাঁড়াতে পারছিলাম।”

যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে মেমির দেখা হয়

অপারেশনের কয়েক সপ্তাহ পর, মেমির মার সঙ্গে দুজন যিহোবার সাক্ষির দেখা হয়। তার মেয়ে বাইবেল পড়তে ভালবাসে জেনে তিনি সাক্ষিদের তার ঘরে আসার আমন্ত্রণ জানান। মেমি সঙ্গে সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হন। কিন্তু, কয়েক মাস পর তাকে আবার হাসপাতালে যেতে হয় আর এর ফলে সাক্ষিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।

তা সত্ত্বেও, বাইবেলের জ্ঞান নেওয়ার প্রতি মেমির তৃষ্ণা থেকেই যায়। তাই, একটা গির্জার একজন পাদরি যখন তাকে সাহায্য করতে চান, তখন তিনি তাতে রাজি হন। সানডে স্কুলের একটা ক্লাস চলাকালীন একজন ছাত্র, শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেন, “যিশু কি ঈশ্বরের সমান?”

“হ্যাঁ,” সেই শিক্ষক বলেন। “তারা সমান। কিন্তু, যিশু ঈশ্বরের সমভাবে সমান নন।”

‘সমভাবে সমান নন?’ মেমি চিন্তা করেন। ‘এই কথার কোনো মানেই নেই। নিশ্চয়ই, কিছু ভুল আছে।’ তিনি যে বাইবেলের সত্য শিখছেন এই ব্যাপারে সন্তুষ্ট না হয়ে, মেমি শেষ পর্যন্ত সেই গির্জায় যাওয়া বন্ধ করে দেন।

১৯৯৬ সালে মনরোভিয়াতে আবারও দৌরাত্ম্য শুরু হয়। মেমি তার পরিবারের আরও দুজনকে হারায় এবং দ্বিতীয় বার তার বাড়িতে আগুন লাগে। কয়েক মাস পর, দুজন সাক্ষি ঘরে ঘরে পরিচর্যার সময় মেমির সঙ্গে তাদের দেখা হয়। মেমি আবার বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। প্রথম বার সভাতে যাওয়ার পর তিনি এটা দেখে খুব অবাক হয়ে যান যে, প্রত্যেকে—যাদের মধ্যে মণ্ডলীর প্রাচীনরাও রয়েছে—কিংডম হল পরিষ্কার করতে সাহায্য করছে। সেই বছরের শেষের দিকে “ঈশ্বরীয় শান্তির বার্তাবাহকগণ” জেলা সম্মেলনগুলোর একটাতে যোগ দিয়ে তিনি অভিভূত হয়ে যান। এটাই ছিল তার তখন পর্যন্ত যোগ দেওয়া যিহোবার সাক্ষিদের বড় সমাবেশগুলোর মধ্যে প্রথম।

“আমি সেখানে গিয়ে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলাম,” মেমি বলেন। “সাক্ষিরা বিভিন্ন জাতি থেকে আসা সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা রয়েছে। আর সবকিছুই খুব সুসংগঠিত ছিল।”

ঈশ্বরকে সেবা করার বিষয়ে তার ইচ্ছা পূর্ণ হয়

১৯৯৮ সালে যুদ্ধ নতুন করে শুরু হওয়ায় মেমি ও তার মা প্রতিবেশী দেশ কোট ডিভোরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, যেখানে তারা লাইবেরিয়ার প্রায় ৬,০০০ অধিবাসীর সঙ্গে পিস টাউন শরণার্থী শিবিরে থাকতে শুরু করে। সেখানে মেমি সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন চালিয়ে যান ও দ্রুত উন্নতি করেন। শীঘ্রই তিনি অন্যদেরকে তার বিশ্বাস সম্বন্ধে জানাতে চান। তিনি যাতে জনসাধারণ্যে পরিচর্যায় অংশ নিতে পারেন, সেইজন্য তার আত্মিক ভাইবোনেরা তাকে হুইলচেয়ারে করে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। এভাবে মেমি অন্য শরণার্থীদের কাছে উত্তমভাবে সাক্ষ্য দিতে সক্ষম হন।

যদিও তার শারীরিক সীমাবদ্ধতার কারণে, বাড়ি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কিংডম হলে যাওয়া তার পক্ষে কষ্টকর ছিল কিন্তু তবুও মেমি সমস্ত সভাতে যোগ দিতেন। ২০০০ সালের ১৪ই মে, সে একটা বিশেষ সম্মেলনে যোগ দিতে ও তার উৎসর্গীকরণের প্রতীক হিসেবে জলে বাপ্তিস্ম নিতে ১৯০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ পাড়ি দেন। (মথি ২৮:১৯, ২০) মেমিকে যখন একটা ছোট নদীতে কোলে তুলে নিয়ে গিয়ে জলে নিমজ্জিত করা হয়, তখন অনেকে অশ্রুভরা চোখে তা দেখে। জল থেকে উঠে আসার সময় তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

এখন ঘানার এক শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত মেমির লক্ষ্য হচ্ছে একজন নিয়মিত অগ্রগামী বা পূর্ণসময়ের সুসমাচার প্রচারক হওয়া। তার মা-ও যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করেছেন এবং যা শিখেছেন, তা এখন অন্যদের জানাচ্ছেন। দুজনেই ঈশ্বরের বাক্যে প্রতিজ্ঞাত সেই সময়ের জন্য উৎসুকভাবে সানন্দে অপেক্ষা করে আছে, যখন “খঞ্জ হরিণের ন্যায় লম্ফ দিবে, ও গোঙ্গাদের জিহ্বা আনন্দগান করিবে।”—যিশাইয় ৩৫:৫-৭. (g ৩/০৬)

[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]

মেমির শরীর থেকে যে-গুলিটা বের করা হয়েছিল

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাপ্তিস্মের জন্য মেমিকে একটা ছোট নদীতে কোলে তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

তার মা ইমার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করছেন