চেরনোবিলে এক দিনের ভ্রমণ
চেরনোবিলে এক দিনের ভ্রমণ
ইউক্রেনের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক
২০ বছর আগে চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের বিস্ফোরণ এক নজিরবিহীন ঘটনা ছিল। ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল সেই ঘটনাস্থলে বিদ্যমান চারটে চুল্লির একটা ধ্বংসাত্মকভাবে বিগলিত হয়। অধিকাংশ দুর্যোগের পর—তা মনুষ্যনির্মিত বা প্রাকৃতিক যা-ই হোক না কেন—পরিষ্কার এবং পুননির্মাণ করা তখনও সম্ভব থাকে। কিন্তু, এই বিস্ফোরণের ফলে ঘটিত দূষণ দীর্ঘসময়ের জন্য এক ক্ষতিকর প্রভাব রেখে গিয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, প্রতি বছর ৯ই মে সেই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বসবাসকারী প্রাক্তন অধিবাসীরা—মাঝে মাঝে তাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের নিয়ে—পরিত্যক্ত বাড়িঘর পরিদর্শন করার জন্য সেখানে গিয়েছে, যেগুলো একসময় তাদের নিজেদের বাড়ি ছিল। অন্যান্য সময়ে তারা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য সেখানে গিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বিকিরণের প্রভাবগুলো নিয়ে গবেষণা করতে সেখানে পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি, ইউক্রেনের পর্যটন কোম্পানিগুলো এক দিনের জন্য সেই এলাকার ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছে।
২০০৫ সালের জুন মাসে দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস এর প্রথম পৃষ্ঠার খবরে, প্রিপেট শহরের সংক্ষিপ্ত “শ্যাপেরোন্ড্ টুর” (একজন গাইডকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ) সম্বন্ধে বলা হয়েছিল যে-ভ্রমণে “কোনো স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি নেই।” * প্রিপেট শহরটা—চুল্লিগুলো থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত প্রায় ৪৫,০০০ জন অধিবাসী নিয়ে গঠিত—১৯৭০ এর দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু, পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর আরও অন্যান্য শহরের মতো এটাকে পরিত্যক্ত করা হয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার কারণে এই জায়গাগুলো নিষিদ্ধ এলাকার আওতাভুক্ত হয়েছিল। বিস্ফোরণের দ্বারা বিগলিত হয়ে যাওয়ার সময়, আ্যনা ও ভিক্টর রুডনিক প্রায় এক বছর ধরে প্রিপেটে বাস করছিল। *
বেশ ছোট শহর চেরনোবিল (পারমাণবিক কেন্দ্রেরও নাম), চুল্লিগুলো থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কয়েক বছর ধরে, শহরের প্রাক্তন অধিবাসীদের প্রতি বছর এটাকে একবার পরিদর্শন করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়েছে। যেহেতু চেরনোবিল আসলে রুডনিকের নিজের শহর, তাই তারা এই সময়ে চেরনোবিল পরিদর্শন করেছে। কয়েক বছর আগে আমার স্ত্রী ও আমি তাদের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলাম। আসুন, আপনাদের কাছে সেটাই বর্ণনা করি।
নিরানন্দে ছুটি কাটানো
আমরা ইউক্রেনের রাজধানী কিভ শহর ত্যাগ করে দুই লেনবিশিষ্ট রাস্তা ধরে উত্তরদিকে এগোই। আমরা ছোট ছোট শহরের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাই, যেখানে রাস্তার ধারে বাড়িঘর পর পর দেখা যায়, যেগুলোর উঠান টিউলিপ ফুলে ভরা এবং লোকেরা সবজি বাগান করেছে। এক শহর থেকে অন্য শহরের মধ্যবর্তী জায়গাগুলোতে দিগ্দিগন্ত জুড়ে ভুট্টা, গম এবং সূর্যমুখীর খেত দেখা যায়।
কিন্তু, একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে মনে হয় যেন আমরা একটা সীমানা পেরিয়ে এসেছি, যেটা অদৃশ্য। সীমানা যে পেরোলাম সেটার কোনো চিহ্ন রাস্তায় দেখিনি কিন্তু পরিবর্তনটা আমরা অনুভব করি। সেই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় শহরগুলোতে বিদ্যমান গা ছমছম-করা নিস্তব্ধতা অনুভব করি। পোড়ো বাড়িগুলোতে জানালাগুলো ভেঙে গিয়েছিল এবং দরজাগুলোতে তালা লাগানো ছিল। সামনের উঠোন আগাছায় ভরা ছিল এবং বাগানগুলো ঝোপজঙ্গল হয়ে গিয়েছিল।
আমরা নিষিদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করেছিলাম, যা চুল্লিগুলো থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। “এই অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত শহরগুলোতে উচ্চ মাত্রার বিকিরণ বিদ্যমান,” আ্যনা আমাদের জানিয়েছিলেন। “এখানকার অনেক শহর ও গ্রামের ১,৫০,০০০ জনের চেয়েও বেশি লোক প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের নানা জায়গায় তাদের নতুন বাড়িগুলোতে চলে গিয়েছিল।”
ভ্রমণ করতে করতে আমরা শীঘ্রই আরেকটা অঞ্চলে এসে উপস্থিত হই, যেটা অত্যন্ত উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল যার ফলে অঞ্চলটা বিশ্বের থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিল। কাছেই, কাঠের কেবিনে থাকা রক্ষীরা—কাস্টমস্ চেকিং পয়েন্টের মতো দেখতে—সমস্ত যানবাহনের আসা-যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। একজন রক্ষী আমাদের পাসপোর্ট চেক করে রেজিস্টারে আমাদের গাড়ির নম্বর লিখে নেন ও এরপর গেট খুলে দেন।
আমরা এখন নিষিদ্ধ অঞ্চলের ভিতরে ছিলাম। নতুন কচি পাতায় ভরা গাছগুলো রাস্তার ওপর এক সবুজ ছাউনির মতো হয়ে ঢেকে রেখেছিল। জঙ্গল ঘন ঝোপঝাড়ে ভরা ছিল—নিশ্চিতভাবেই পুড়ে যাওয়া গাছপালা ও বিবর্ণ হয়ে পড়া ঝোপঝাড়ের চিত্র নয়, যেমনটা আমি কল্পনা করেছিলাম। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পাওয়া যায় যে, এক সাদা ইটের ওপর নীল অক্ষরে চেরনোবিল শহরের নাম লেখা রয়েছে।
চেরনোবিলের সীমান্তে একটা ওষুধের দোকান ছিল। ভিক্টরের মা একসময় সেখানে কাজ করতেন। ধুলোবালিতে ভরা, জানালায় এখনও সাইনবোর্ডটা ঝুলছে, যেটাতে দোকান খোলার ও বন্ধ করার সময়টা আবছাভাবে দেখা যায়। শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত পার্কের কাছে সাংস্কৃতিক ভবন রয়েছে। আ্যনা আগের কথা মনে করে বলেন যে, কীভাবে তিনি ও অন্যরা কাজের পর সেখানে এসে সময় কাটাতেন ও বিভিন্ন শিল্পীদের অনুষ্ঠান দেখতেন। ইউক্রেনিয়া নামে একটা সিনেমা হল কাছেই ছিল, যেখানে বাচ্চারা একসময় দুঃসহ গরম থেকে স্বস্তি পাওয়ার জন্য হলের ঠাণ্ডা পরিবেশে বসে নতুন নতুন সিনেমা দেখত। অন্ধকার মিলনায়তন থেকে হাসির শব্দ অনেক আগেই বিলীন হয়ে গিয়েছে। আ্যনা ও ভিক্টর আমাদেরকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়—যেখানে যেতে শহরের কেন্দ্র থেকে একটু হাঁটতে হয়। অযত্নে বেড়ে ওঠা গাছপালা সদর দরজাকে ঘিরে ছিল বলে আমরা বড় বড় আগাছার মধ্যে দিয়ে এক এক করে পিছনের দরজার দিকে এগিয়ে যাই—যেটা সেই সময়ের মধ্যে দেওয়ালে এক বিরাট ছিদ্রের মতো দেখাচ্ছিল।
ভিতরটা পুরোপুরিভাবে ভেঙেচুরে গিয়েছিল। মরচে-ধরা খাটের ওপর ছাতা-পড়া তোষক ঝুলে পড়েছিল। দেওয়াল থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা ওয়ালপেপারগুলো ময়লা তুষার-শলাকার মতো ঝুলছিল। আ্যনা রুমের ময়লা আবর্জনার মধ্যে থেকে একটা পুরোনো ছবি তোলার জন্য ঝোঁকেন। “আমি সবসময় চেয়েছি যেন ফিরে এসে, সবকিছু শুরুতে যেমন ছিল তেমনটাই পাই,” দুঃখের সঙ্গে তিনি বলেছিলেন। “আমাদের বাড়িটাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় দেখে; আমাদের মূল্যবান জিনিসপত্রকে বছরের পর বছর ধরে চুরি হয়ে যেতে দেখে আমার কী যে কষ্ট লাগে!”
আমরা রুডনিকদের বাড়ি ছেড়ে রাস্তার দিকে হেঁটে আসি। এক কোণে এক দল লোক প্রাণবন্ত গল্পগুজবে ব্যস্ত ছিল। আমরা আধ কিলোমিটার পথ হেঁটে একটা পার্কে গিয়ে পৌঁছাই যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়েছে আর যেখানে দাঁড়িয়ে নীচে নদীর শান্ত জল অনেক দূর
পর্যন্ত দেখা যায়। বাদামগাছের সাদা সাদা ফুল বাতাসে দুলছিল। সেই নদীতটে এঁকেবেঁকে নেমে আসা সিঁড়িগুলো ছিল, যেখানে একসময় ১৯৮৬ সালে, শত শত লোক নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে নৌকায় চড়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।গত বছর রুডনিক পরিবার প্রথমবার প্রিপেট শহরে তাদের পুরোনো বাড়ি পরিদর্শন করতে গিয়েছিল। তারা ১৯ বছর আগে পারমাণবিক বিস্ফোরণের পর সেই শহর ছেড়ে পালিয়ে এসেছিল।
গভীরভাবে চিন্তা করার এক সময়
২০০৬ সালের এপ্রিল মাস জুড়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পারমাণবিক বিস্ফোরণের ২০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করা হয়েছে। এই অনুষ্ঠানগুলো অনেক লোককে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পৃথিবীর বিষয়গুলোকে সফলভাবে ঐশিক তত্ত্বাবধান ছাড়া সামলানো তার ক্ষমতার বাইরে।—যিরমিয় ১০:২৩.
গত সেপ্টেম্বরে এক বৈজ্ঞানিক রিপোর্টের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছিল, যেটাতে সেই মর্মান্তিক ঘটনাকে পুনরায় মূল্যায়ন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘের দ্বারা নিয়োজিত রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, বিস্ফোরণের সময়ে ৫৬ জন লোক নিহত হয়েছিল এবং ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, সরাসরি তেজস্ক্রিয়তার কারণে সংঘটিত রোগে শেষ পর্যন্ত মাত্র ৪,০০০ জন মারা যাবে। প্রথমদিকের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অনুযায়ী, মৃত্যুর সংখ্যা সাধারণত ১৫,০০০ থেকে ৩০,০০০রের মধ্যে ছিল। ২০০৫ সালের ৮ই সেপ্টেম্বরের নিউ ইয়র্ক টাইমস এর এক সম্পাদকীয় প্রবন্ধ উল্লেখ করেছিল যে, রাষ্ট্রসংঘের রিপোর্টকে “কয়েকটা পরিবেশবাদী দল পারমাণবিক শক্তির সম্ভাব্য বিপদগুলো লুকানোর এক মিথ্যা প্রচেষ্টা বলে মনে করেছিল।”
ভিক্টর, যিনি এই দুর্ঘটনার পর তার সৃষ্টিকর্তা যিহোবা ঈশ্বর সম্বন্ধে শিখতে শুরু করেছিলেন, তিনি বলেন: “আমরা এখন আর বিষণ্ণ নই, কারণ আমরা জানি যে, ঈশ্বরের রাজ্য যখন আসবে, তখন এই ধরনের মারাত্মক দুর্ঘটনা আর কখনোই ঘটবে না। আমরা সেই সময়ের জন্য সানন্দে প্রতীক্ষা করে আছি, যখন চেরনোবিলের কাছে আমাদের প্রিয় বাড়ির আশেপাশের গ্রাম এর বর্তমান অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধার এবং এক চমৎকার পরমদেশের অংশ হবে।”
চেরনোবিলের বিস্ফোরণের সময় থেকে, লক্ষ লক্ষ লোকের বাইবেলের এই প্রতিজ্ঞার ওপর দৃঢ়নিশ্চয়তা গড়ে উঠেছে যে, পৃথিবীতে আদি পরমদেশ পুনর্স্থাপিত এবং পৃথিবীব্যাপী প্রসারিত হবে। (আদিপুস্তক ২:৮, ৯; প্রকাশিত বাক্য ২১:৩, ৪) শুধু ইউক্রেনেই বিগত ২০ বছরে ১,০০,০০০রও বেশি লোক সেই আশাকে গ্রহণ করে নিয়েছে! আপনিও যেন সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে বিবেচনা করতে প্রেরণা পান, যা সেই লোকেদের জন্য প্রতিজ্ঞা করা হয়েছে, যারা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যগুলো জানার চেষ্টা করে। (g ৪/০৬)
[পাদটীকাগুলো]
^ যদিও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ এই ধরনের সংক্ষিপ্ত ভ্রমণকে নিরাপদ বলে ঘোষণা করেছে কিন্তু সচেতন থাক! এই এলাকায় কোনো ব্যক্তিগত ভ্রমণের পরিকল্পনা করতে সুপারিশ বা অনুমোদন করে না।
^ ১৯৯৭ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সচেতন থাক! পত্রিকার ১৮-২১ পৃষ্ঠা দেখুন।
[১৬ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
বিকিরণ প্রতিরোধকারীদের উদ্দেশে স্মৃতিসৌধ
এই বিশাল স্মৃতিসৌধটা, চেরনোবিল দুর্ঘটনার পরিষ্কার করার কর্মী, যারা বিকিরণ প্রতিরোধকারী হিসেবে পরিচিত তাদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এই কর্মীরা আগুন নিভিয়েছিল, ধূমায়িত পারমাণিক কেন্দ্রকে সিমেন্ট দিয়ে চাপা দিয়েছিল এবং দূষণ দূর করেছিল। শেষ পর্যন্ত এই কর্মীদের সংখ্যা লাখ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল যে, সরাসরি বিস্ফোরণের কারণে প্রায় ৪,০০০ জনের মৃত্যু হবে আর অধিকাংশই এই কর্মীদের মধ্যে থেকে মৃত্যুবরণ করবে।
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
চেরনোবিল শহরের সাইনবোর্ড এবং সিনেমা হল
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
রুডনিক পরিবার ও চেরনোবিলে তাদের বাড়ি
[১৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
শক্তি কেন্দ্র যেখানে বিস্ফোরণ ঘটেছিল, যা প্রিপেটে রুডনিক পরিবারের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরত্বে ছিল (ইনসেটে)