সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ক্যালিপসো ত্রিনিদাদের অদ্বিতীয় লোকসংগীত

ক্যালিপসো ত্রিনিদাদের অদ্বিতীয় লোকসংগীত

ক্যালিপসো ত্রিনিদাদের অদ্বিতীয় লোকসংগীত

ত্রিনিদাদের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক

জমজ দ্বীপ ত্রিনিদাদ ও টোবাগো প্রজাতন্ত্রের নাম শুনলে আপনার মনে কোন বিষয়টা ভেসে ওঠে? অনেকে সঙ্গে সঙ্গে স্টিল ড্রাম ব্যবহৃত অর্কেস্ট্রার কথা চিন্তা করে আর অনেকে ক্যালিপসো সংগীতের প্রাণবন্ত সুরের কথা ভেবে থাকে। বস্তুতপক্ষে, ক্যালিপসোর আকর্ষণীয় তাল এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্টাইল এই সংগীতের উৎপত্তিস্থল দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান সাগর ছাড়িয়ে আরও অনেক জায়গায় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। *

ক্যালিপসো কালেলু বই অনুসারে, ক্যালিপসো নামটা ‘প্রায় ১৮৯৮ সালের পর ত্রিনিদাদে কার্নিভালের সময়ে গাওয়া যেকোনো গানকে’ বোঝাতে পারে, ‘যা রাস্তায় রাস্তায় ফুর্তিবাজদের করা গান হোক অথবা অপেশাদার ও পেশাদার গায়ক-গায়িকাদের দ্বারা মঞ্চে পরিবেশিত গান হোক।’ ক্যালিপসো সংগীত সম্ভবত আফ্রিকার লোককাহিনীর ঐতিহাসিক পরম্পরা থেকে উদ্ভূত হয়েছে, যা আফ্রিকার ক্রীতদাসরা ত্রিনিদাদে নিয়ে এসেছিল। এর পরবর্তী সময়ে, আফ্রিকার গান, নাচ এবং ড্রাম বাজানো আনন্দদায়ক উপাদান ছিল আর সেগুলোসহ ফরাসি, হিস্প্যানিক, ইংরেজি এবং অন্যান্য উপজাতিগত প্রভাব এক ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে ক্যালিপসো সংগীত উদ্ভূত হয়েছে।

ক্যালিপসো নামের উৎপত্তি কোথা থেকে তা নিশ্চিত নয়। কেউ কেউ মনে করে যে, এটা পশ্চিম আফ্রিকার শব্দ কাইসো থেকে এসেছে, যেটা ভাল কিছু উপস্থাপন করা হলে প্রশংসা করার জন্য ব্যবহৃত হতো। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে ১৮৩০ এর দশকে ক্রীতদাস প্রথা সমাপ্ত হওয়ারও আগে, বার্ষিক কার্নিভাল উদ্‌যাপনের সময় বিরাট জনতা চ্যান্টওয়েলস্‌ (গায়কদের) গান শুনতে মিলিত হতো, যারা তাদের গানে নিজ নিজ গুণের প্রশংসা করত আর অন্যদেরকে উপহাস করত। অন্যদের থেকে নিজেদের পার্থক্য করার জন্য প্রত্যেক ক্যালিপসোনিয়ান, যে-নামে ক্যালিপসো গায়করা পরিচিত, নিজস্ব এক ডাকনাম এবং পরিচিতির জন্য এক নির্দিষ্ট স্টাইল ধারণ করত।

এটার স্টাইল ও প্রভাব

ক্যালিপসো গায়করা সবসময়ই তাদের চতুর রসিকতার কারণে সমাদৃত হতো। এ ছাড়া, অনেক ক্যালিপসো গায়ক কোনো প্রস্তুতি না নিয়েই বেশ কয়েকটা পঙ্‌ক্তির নির্ভুল কবিতা রচনা করার লক্ষণীয় ক্ষমতা গড়ে তুলেছিল আর প্রায়ই সেগুলোর সঙ্গে প্রাণবন্ত দৃষ্টান্ত দিত, যা গানের বিষয়বস্তুর সঙ্গে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যেত। শুরুর সময়গুলোতে ক্যালিপসো গায়করা মূলত আফ্রিকার বংশোদ্ভূত ত্রিনিদাদের ও সমাজের নিম্নশ্রেণীর অধিবাসী ছিল কিন্তু আজকে এমনকি প্রতিটা বংশ, বর্ণ ও শ্রেণীতে তাদের পাওয়া যায়।

ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রাক্তন সাংস্কৃতিক পরিচালক ড. হালিস লিভারপুল হলেন একজন ইতিহাসবেত্তা এবং ক্যালিপসো গায়কও। শুরুর সময়ের ক্যালিপসো গায়কদের সম্বন্ধে তিনি সচেতন থাক!-কে বলেছিলেন: “তাদের বিশেষত্ব ছিল যে, তারা খুব রসিক ছিল, কারণ লোকেরা [ক্যালিপসো গায়কদের] তাঁবুতে আসত, মূলত আনন্দ পাওয়ার জন্য, গুজব শোনার জন্য, তারা যে-ঘটনাগুলো সম্বন্ধে শুনেছে সেগুলোর বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। বিশেষ করে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা নিম্নশ্রেণীর লোকেরা যা করছে তা শুনতে আসত, এমনকি রাজ্যপাল ও তার সফরসঙ্গীরা দেখতে আসত যে, তাদের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা বেশি নাকি কম।”

প্রায়ই ক্যালিপসো গায়করা আমলাবর্গ ও সমাজের উচ্চশ্রেণীর লোকেদের তাদের উপহাসের পাত্র করত। ফলে, ক্যালিপসো গায়কদেরকে সাধারণ লোকেদের নায়ক ও বীর হিসেবে শ্রদ্ধা করা হতো কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ঝামেলাসৃষ্টিকারী হিসেবে বিবেচনা করত। ক্যালিপসো গায়করা মাঝে মাঝে এমন রূঢ় সমালোচনামূলক গান রচনা করত যে, শেষ পর্যন্ত ঔপনিবেশিক সরকার তাদেরকে দমন করার উপযোগী আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ গায়করা তাদের গানের কথাগুলোতে বক্রোক্তি বা দ্বৈত অর্থ ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং এতে পটু হয়ে উঠেছিল। বর্তমান দিনের ক্যালিপসো গানের কথাগুলোতেও বক্রোক্তি বা দ্বৈত অর্থ এক প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে অব্যাহত রয়েছে।

ক্যালিপসো গায়করা শুধুমাত্র ভাষা ব্যবহারই করত না কিন্তু উদ্ভাবনও করত। বস্তুতপক্ষে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথ্য ভাষার শব্দভাণ্ডারে তাদের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, অনেকে এমনকি কিছু রাজনীতিবিদও প্রায়ই কোনো একটা বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ার জন্য ক্যালিপসো গায়কদের বিষয় উদ্ধৃতি করে থাকে।

আধুনিক ক্যালিপসো সংগীত

সম্প্রতি ক্যালিপসো সংগীতের বহু স্টাইল ও বিভিন্ন স্টাইলযুক্ত সংমিশ্রণ উদ্ভাবিত হয়েছে, যেগুলো বিভিন্ন ধরনের সংগীতপ্রেমীদের আকৃষ্ট করে। অন্যান্য ধরনের সংগীতের বেলায় যেমনটা দেখা যায়, কিছু কিছু ক্যালিপসো গানের কথাগুলোতে নৈতিক মূল্যের কোনো প্রতিফলন নেই বললেই চলে। তাই, আমরা কী ধরনের কথা বলব বা শুনব, সেই ক্ষেত্রে বাছাই করা বিজ্ঞতার কাজ হবে। (ইফিষীয় ৫:৩, ৪) আমরা হয়তো নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারি, ‘আমি কি আমার বাচ্চাকে বা ক্যালিপসো সংগীতের সঙ্গে পরিচিত নন এমন কাউকে একটা নির্দিষ্ট শব্দের বক্রোক্তি বা দ্বৈত অর্থ ব্যাখ্যা করতে সংকোচ বোধ করব?’

আপনি যদি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে আসেন, তা হলে নিঃসন্দেহে আপনি অপূর্ব সমুদ্রসৈকত ও প্রবাল-প্রাচীর দেখে মুগ্ধ হয়ে যাবেন এবং দ্বীপের বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মিলনমেলার প্রতি আকৃষ্ট হবেন। সেইসঙ্গে আপনি হয়তো স্টিল ড্রাম ব্যবহৃত অর্কেস্ট্রা ও ক্যালিপসো সংগীতও উপভোগ করবেন—সেই প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় সুর, যা সারা পৃথিবীর ছোট বড় সকলকে মুগ্ধ করেছে। (g ১২/০৬)

[পাদটীকা]

^ বাদ্যযন্ত্র হিসেবে স্টিল ড্রাম বাজানো দলগুলো প্রায়ই ক্যালিপসো সংগীতগুলো বাজায় কিন্তু ক্যালিপসো গায়ক সাধারণত গিটার, তুরী, সেক্সোফোন এবং ড্রামগুলোর সাহায্যে গান গেয়ে থাকে।

[২৮, ২৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

স্টিল ড্রামগুলো