সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

এক ঘুমন্ত দৈত্যের ছায়ায় বসবাস করা

এক ঘুমন্ত দৈত্যের ছায়ায় বসবাস করা

এক ঘুমন্ত দৈত্যের ছায়ায় বসবাস করা

আগ্নেয়গিরিগুলো সবসময়ই রহস্যময়। এগুলো শত শত বছর ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকতে পারে, আবার এমনভাবে জেগেও উঠতে পারে, যা একইসঙ্গে আকর্ষণীয় ও মারাত্মক। কোনো আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটা পল্লিঅঞ্চলকে বিধ্বস্ত করতে এবং জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে।

আগ্নেয়গিরিগুলো যে বিপদজনক, এই বিষয়ে কারোরই কোনো সন্দেহ নেই। কেবলমাত্র বিগত তিনশো বছরেই এগুলো লক্ষ লক্ষ ব্যক্তির জীবন কেড়ে নিয়েছে। অবশ্য, আমাদের মধ্যে অধিকাংশই এই ঘুমন্ত দৈত্যগুলোর থেকে নিরাপদ দূরত্বে বসবাস করছি কিন্তু পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ অধিবাসী বিভিন্ন জীবন্ত আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করে। উদাহরণস্বরূপ, ইকুয়েডরের রাজধানী কিটো, সেই শহরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পিচিন্‌চা আগ্নেয়গিরি থেকে অল্প দূরত্বে অবস্থিত। মাউন্ট পোপোক্যাটেপেটল্‌, আ্যজটেক ভাষায় যে-নামের অর্থ “ধূমায়িত পর্বত,” সেটা মেক্সিকো শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড ও ইতালির নেপলসের মতো বড় বড় শহর বিভিন্ন আগ্নেয়গিরির পাদদেশে অবস্থিত। সব মিলিয়ে, লক্ষ লক্ষ লোক এই সম্ভাবনা নিয়ে বসবাস করছে যে, ভূগর্ভস্থ শক্তিগুলো প্রবলভাবে গর্জে উঠতে পারে আর এর ফলে ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যকে জীবন্ত করে তুলতে পারে।

এক বিপদজনক দৈত্য

নেপলসের অধিবাসীরা প্রায় ৩,০০০ বছর ধরে ভিসুভিয়াস পর্বতের কাছাকাছি বাস করছে। এই পর্বত নেপলস থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আসলে এটা প্রাচীন মন্টি সমা-র প্রান্তে একটা শঙ্কু (আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মোচাকার অংশ)। ভিসুভিয়াস হল পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে একটা। যেহেতু এর ভিত্তি সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে অবস্থিত, তাই এই পর্বত আসলে দেখতে যতটা বড় দেখা যায়, তার চেয়েও আরও অনেক বড়।

ভিসুভিয়াস পর্বতের অগ্নুৎপাতের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। সা.কা. ৭৯ সালের সুপরিচিত এক অগ্নুৎপাত, যে-অগ্নুৎপাতে পম্পেই ও হারকুলেনিয়াম শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল সেটার পর, এতে ৫০ বারেরও বেশি অগ্নুৎপাত হয়েছে। ১৬৩১ সালে এক মারাত্মক অগ্নুৎপাতে প্রায় ৪,০০০ লোক মারা গিয়েছিল। সেই সময় থেকেই “লাভা” শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। ল্যাটিন শব্দ লাবি থেকে উদ্ভূত এই শব্দের অর্থ “গড়িয়ে পড়া” আর এটি যথার্থভাবেই লাভার নির্গমনকে বর্ণনা করে, যা ভিসুভিয়াসের খাড়া ঢালগুলোর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।

শত শত বছর ধরে ভিসুভিয়াসে ক্রমাগত অগ্নুৎপাত হয়েছে। ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এখান থেকে অগ্নুৎপাত হয়েছিল, যা মিত্রবাহিনীর (সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র) সৈন্যদের ওপর ছাইভস্মের বৃষ্টি বর্ষণ করে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। এর ফলে কাছাকাছি শহর মাসা ও সান সেবাস্তিয়ানো আর একইসঙ্গে ইতালির জনপ্রিয় “ফিউনিকুলি, ফিউনিকুলা” লোকগীতিতে বর্ণিত পর্বতের উতরাইয়ের বিখ্যাত ফিউনিকুলার (তার ও স্থির ইঞ্জিনের সাহায্যে ঢালু পথে চালিত) রেলগাড়িও ছাইভস্মে ঢেকে গিয়েছিল।

আজকে, নেপলসের অধিবাসীরা অতি আসন্ন সেই ঝুঁকি সম্বন্ধে ভুলে গিয়ে বসবাস করছে বলে মনে হয়। পর্যটকরা ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন দেখে বিস্মিত হয়। দোকানপাট ও ক্যাফেগুলো কর্মব্যস্ত থাকে আর নেপলস উপসাগরের জলে অনেক জাহাজ ছড়িয়েছিটিয়ে থাকে। ভিসুভিয়াস এখনও এক জনপ্রিয় আকর্ষণ হিসেবে অব্যাহত রয়েছে আর এটাকে এক বিপদজনক ঘুমন্ত দৈত্যের পরিবর্তে, প্রাকৃতিক পরিবেশের এক অক্ষতিকর অংশ হিসেবেই দেখা হয়।

অকল্যান্ড—আগ্নেয়গিরির শহর

নিউজিল্যান্ডের বন্দরনগরী অকল্যান্ডে অনেক আগ্নেয় শঙ্কু ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে। বস্তুতপক্ষে, এর দশ লক্ষেরও বেশি অধিবাসী ৪৮টা ছোট ছোট আগ্নেয়গিরির মাঝে বাস করে। প্রাচীন আগ্নেয় উপত্যকাগুলো দুটো বন্দর গঠন করেছে, দ্বীপগুলো অগ্নুৎপাতের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান দ্বীপ রাঙ্গিটোটো ৬০০ বছরের পুরোনো, যেটা ভিসুভিয়াসের মতো একই প্রতিসম রেখা থেকে জলের ওপরে উত্থিত হয়েছে। এই দ্বীপের উত্থানের সময় কাছেই অবস্থিত মাওরি গ্রাম ছাইভস্মের নীচে চাপা পড়েছিল।

অকল্যান্ডের অধিবাসীরা তাদের এখানে আগ্নেয়গিরিগুলোর সঙ্গে বসবাস করতে শিখেছে। একসময়ে মঙ্গেকিকি নামে পরিচিত একটা আগ্নেয় শঙ্কু আজকে অকল্যান্ড শহরের কেন্দ্রে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত একটা পার্ক হিসেবে অবস্থিত আর সেখানে একটা মেষের খামার রয়েছে। কিছু কিছু আগ্নেয়গিরি এখন হ্রদ, পার্ক অথবা খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। একটা কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক অধিবাসী প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য আগ্নেয়গিরির ঢালু এলাকাতে বাস করা বেছে নেয়।

প্রথমে মাওরিরা আর তারপর ১৮০ বছর আগে ইউরোপীয়রা যখন অকল্যান্ডে বাস করতে শুরু করেছিল, তখন সম্ভবত এর অতীত অগ্নুৎপাতের বিষয়ে খুব একটা চিন্তা করা হয়নি। এর পরিবর্তে লোকেরা দেখেছিল যে, এই জমি সহজেই প্রাপ্তিসাধ্য ও সমুদ্রের কাছাকাছি—আর এর মাটি উর্বর। শেষের বৈশিষ্ট্যটা বিশ্বের অন্যান্য জায়গার আগ্নেয় মৃত্তিকার বেলায়ও সত্য। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ায় সবচেয়ে বেশি ধান উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলোর মধ্যে কয়েকটা জীবন্ত আগ্নেয়গিরির আশেপাশের এলাকায় অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান কৃষি এলাকার অধিকাংশ মৃত্তিকা অগ্নুৎপাতের ফলে সৃষ্ট। উপযুক্ত পরিবেশে, লাভায় আচ্ছাদিত জমিতে অগ্নুৎপাতের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যেই উদ্ভিদ জন্মাতে পারে।

পূর্বসতর্কীকরণ ব্যবস্থা

অনেকে ভাবতে পারে, ‘আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি এলাকায় বাস করা কি ঝুঁকিপূর্ণ নয়?’ অবশ্যই উত্তরটা হল, হ্যাঁ। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্প ও অগ্নুৎপাতের বিষয়ে বেশ ভালভাবেই সতর্ক করে দিতে সমর্থ। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ভূবিদ্যা সমীক্ষা সারা বিশ্বের—নেপলস ও অকল্যান্ডসহ যেখানে অগ্নুৎপাতের ব্যাপারে জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয় এমন সমস্ত জায়গার—জীবন্ত আগ্নেয়গিরির ওপর নজর রাখে। ২৪ ঘন্টা কৃত্রিম উপগ্রহ গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেমস্‌ এবং সিসমোমিটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ম্যাগমা ও ভূঅভ্যন্তরের আলোড়ন শনাক্ত করতে পারে।

ভিসুভিয়াসের ওপর অবিরত কড়া নজর রাখা হয়। ঝুঁকি এড়িয়ে চলার জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে ইতালির কর্তৃপক্ষ জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যাতে ১৬৩১ সালে সংঘটিত তীব্র অগ্নুৎপাতের মতো অগ্নুৎপাতকে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করে যে, যারা সবচেয়ে বিপদসংকুল এলাকায় বাস করে, তাদেরকে কোনো অগ্নুৎপাত সংঘটিত হওয়ার আগেই সতর্ক করা ও সেই এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে।

অকল্যান্ড এমন জায়গায় অবস্থিত, যেটাকে বিজ্ঞানীরা মোনোজেনেটিক আগ্নেয় এলাকা বলে থাকে। এর অর্থ হল, ইতিমধ্যেই অস্তিত্বে রয়েছে এমন একটা আগ্নেয়গিরি পুনরায় জীবন্ত হয়ে ওঠার পরিবর্তে, অন্য জায়গায় একটা সম্পূর্ণ নতুন আগ্নেয়গিরি গঠিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলে যে, কয়েক দিন থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহব্যাপী ভূমিকম্প হওয়ার পরই কেবল এটা ঘটতে পারে। এই ধরনের আগাম সতর্কীকরণ লোকেদের নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় খোঁজার জন্য সময় দিয়ে থাকে।

ঝুঁকিগুলোর প্রতি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত রাখা

যদিও আগ্নেয়গিরিগুলো পর্যবেক্ষণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কিন্তু সতর্কীকরণের প্রতি মনোযোগ দেওয়া না হলে, তা অকার্যকর হয়ে পড়বে। ১৯৮৫ সালে কলম্বিয়ার আরমেরো শহরের কর্তৃপক্ষকে নেভাডো ডেল রুইজ আগ্নেয়গিরিতে যে-অগ্নুৎপাত হতে যাচ্ছে, সেই বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছিল। প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের পর্বতের গুড় গুড় শব্দ যখন এক স্পষ্ট সতর্ক সংকেত দিচ্ছিল, সেই সময়ে শহরের লোকেদের কেবলমাত্র শান্ত থাকতে বলা হয়েছিল। আগ্নেয়গিরি থেকে বের হয়ে আসা কাদামাটির প্রবাহে নিমজ্জিত হয়ে ২১,০০০রেরও বেশি লোক মারা যায়।

যদিও এই ধরনের বিপর্যয় কদাচিৎ হয়ে থাকে, তবুও দুটো অগ্নুৎপাত সংঘটিত হওয়ার মাঝে শান্ত সময়কে আরও গবেষণা ও প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। তাই, ক্রমাগত সতর্ক করে চলা, যথেষ্ট প্রস্তুতি এবং জনসাধারণকে শিক্ষা দেওয়া সেই লোকেদের ঝুঁকি হ্রাস করতে সাহায্য করতে পারে, যারা এক ঘুমন্ত দৈত্যের ছায়ায় বসবাস করছে। (g ২/০৭)

[২৪ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

প্রস্তুত থাকুন!

আপনি কি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত আছেন? আপনার এলাকার ঝুঁকিগুলো সম্বন্ধে সতর্ক থাকুন। পরিবারের সদস্যরা যদি আলাদা হয়ে পড়ে, তা হলে কোথায় মিলিত হতে হবে এবং আপনি কোথায় আছেন, তা কাকে জানাবে সেই বিষয়ে আগেই পরিকল্পনা করুন। খাবার ও জল, প্রাথমিক চিকিৎসা বাক্স, কাপড়চোপড়, রেডিও, জলনিরোধক ফ্ল্যাশলাইট এবং অতিরিক্ত ব্যাটারিসহ জরুরি জিনিসপত্র হাতের কাছেই রাখুন। সব জিনিস যথেষ্ট পরিমাণে রাখুন, যাতে আপনি কয়েক দিনের জন্য আত্মনির্ভরশীল থাকতে পারেন।

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

দর্শনার্থীরা ভিসুভিয়াসের প্রধান জ্বালামুখের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে

[সৌজন্যে]

©Danilo Donadoni/Marka/age fotostock

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

ইতালির নেপলস শহর ভিসুভিয়াস পর্বতের সামনে

[সৌজন্যে]

© Tom Pfeiffer

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

সা.কা. ৭৯ সালে যে-প্রবল অগ্নুৎপাতে পম্পেই ও হারকুলেনিয়াম শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, সেই সম্বন্ধে এক শিল্পীর চিত্রকর্ম

[সৌজন্যে]

© North Wind Picture Archives

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

রাঙ্গিটোটো, অকল্যান্ডের অনেক আগ্নেয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে একটা

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ওপরে এবং ডান দিকে: মেক্সিকোর পোপোক্যাটেপেটল্‌ পর্বত

[সৌজন্যে]

AFP/Getty Images

Jorge Silva/AFP/Getty Images

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

USGS, Cascades Volcano Observatory