নম্রতা কি এক দুর্বলতা, নাকি দৃঢ়তা?
বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
নম্রতা কি এক দুর্বলতা, নাকি দৃঢ়তা?
এই জগতের লোকেরা, গর্বিত এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ব্যক্তিদেরকে প্রায়ই অনুকরণের যোগ্য বলে তুলে ধরে। আর নম্র ও বিনয়ী ব্যক্তিদের সাধারণত দুর্বল, ভীরু অথবা তোষামোদকারী বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু, অকৃত্রিম নম্রতা কি সত্যিই এক দুর্বলতা? আর গর্ব কি আসলেই এক দৃঢ়তা? বাইবেল কী বলে?
প্রথমেই এটা বলে নেওয়া আবশ্যক যে, বাইবেল নির্দিষ্ট ধরনের গর্বকে সমর্থন করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, খ্রিস্টানদের এই বিষয়ের জন্য শ্লাঘা বা গর্ব করা উচিত যে, যিহোবা হলেন তাদের ঈশ্বর এবং তিনি তাদের জানেন। (গীতসংহিতা ৪৭:৪; যিরমিয় ৯:২৪; ২ থিষলনীকীয় ১:৩, ৪) বাবামারা তাদের সেই সন্তানদের জন্য গর্ববোধ করতে পারে, যারা খ্রিস্টীয় আচরণের ক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ স্থাপন করে এবং সাহসের সঙ্গে সত্য উপাসনার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়। (হিতোপদেশ ২৭:১১) কিন্তু, গর্বের এক ক্ষতিকর দিকও রয়েছে।
গর্ব ও নম্রতা সম্বন্ধে আরও ভালভাবে জানা
গর্বের একটা সংজ্ঞা হল অতিরিক্ত আত্মসম্মানবোধ। এই ধরনের গর্ব একজনকে সম্ভবত তার সৌন্দর্য, জাতি, পদমর্যাদা, মেধা অথবা ধনসম্পদের কারণে আত্মগৌরব ও শ্রেষ্ঠতার অনুপযুক্ত অনুভূতি এনে দেয়। (যাকোব ৪:১৩-১৬) বাইবেল এমন ব্যক্তিদের সম্বন্ধে বলে, যারা “গর্ব্বান্ধ।” (২ তীমথিয় ৩:৪) অন্য কথায়, নিজেদের সম্বন্ধে তাদের দাম্ভিকতাপূর্ণ ধারণা রয়েছে, যেটা একেবারেই অযৌক্তিক।
অন্যদিকে নম্র ব্যক্তিরা নিজেদেরকে সৎ ও নিরপেক্ষভাবে দেখার চেষ্টা করে, ঈশ্বরের সামনে তাদের অসিদ্ধতা ও নিচু অবস্থান সম্বন্ধে স্বীকার করে। (১ পিতর ৫:৬) অধিকন্তু, তারা অন্যদের মধ্যে যে-উৎকৃষ্ট গুণাবলি দেখে, সেগুলোকে স্বীকার করে আর এমনকি এতে আনন্দিতও হয়। (ফিলিপীয় ২:৩) তাই, তারা তিক্ত ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে না অথবা প্রতিহিংসার দ্বারা পরাভূত হয় না। (গালাতীয় ৫:২৬) অতএব এটা যুক্তিসংগত যে, অকৃত্রিম নম্রতা অন্যদের সঙ্গে উত্তম সম্পর্ক স্থাপনে সহায়তা করে এবং আবেগগত দিক দিয়ে নিরাপত্তা ও স্থিরতা এনে দেয়।
যিশুর উদাহরণ বিবেচনা করুন। পৃথিবীতে আসার আগে তিনি স্বর্গে এক শক্তিশালী আত্মিক প্রাণী হিসেবে ছিলেন। আর পৃথিবীতে থাকাকালীন তিনি একজন সিদ্ধ, নিষ্পাপ ব্যক্তি ছিলেন। (যোহন ১৭:৫; ১ পিতর ২:২১, ২২) তাঁর অতুলনীয় ক্ষমতা, বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞান ছিল। তারপরও তিনি নিজেকে জাহির করেননি, বরং সবসময় নম্রতা দেখিয়েছিলেন। (ফিলিপীয় ২:৬) একবার একটা ঘটনায় তিনি এমনকি তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন; আর ছোট শিশুদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আগ্রহ ছিল। (লূক ১৮:১৫, ১৬; যোহন ১৩:৪, ৫) বস্তুতপক্ষে, একটা শিশুকে তাঁর পাশে নিয়ে যিশু বলেছিলেন: “যে কেহ আপনাকে এই শিশুর মত নত করে, সেই স্বর্গ-রাজ্যে শ্রেষ্ঠ।” (মথি ১৮:২-৪) হ্যাঁ, যিশুর দৃষ্টিতে—এবং তাঁর পিতার দৃষ্টিতে—প্রকৃত মহত্ত্ব গর্ব থেকে নয়, বরং নত হওয়া বা নম্রতা থেকেই উদ্ভূত হয়।—যাকোব ৪:১০.
নম্রতা এক দৃঢ়তা
যদিও তিনি নম্রতা দেখানোর ক্ষেত্রে এক আদর্শ ছিলেন কিন্তু যিশু কোনোভাবেই একজন তোষামোদকারী অথবা ভীরু, দুর্বল ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি সাহসের সঙ্গে সত্য সম্বন্ধে বলেছিলেন এবং নিঃসন্দেহে তাঁর কোনো লোকভয় ছিল না। (মথি ২৩:১-৩৩; যোহন ৮:১৩, ৪৪-৪৭; ১৯:১০, ১১) সেই কারণে তিনি এমনকি তাঁর বিরোধীদের মধ্যেও কারো কারো সম্মান অর্জন করেছিলেন। (মার্ক ১২:১৩, ১৭; ১৫:৫) কিন্তু, যিশু কখনোই উদ্ধত ছিলেন না। এর পরিবর্তে নম্রতা, দয়া ও প্রেমের সঙ্গে তিনি লোকেদের উষ্ণ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আর এভাবে এমন এক উপায়ে তাদের হৃদয় জয় করেছিলেন, যা গর্বিতরা কখনোই করতে পারে না। (মথি ১১:২৮-৩০; যোহন ১৩:১; ২ করিন্থীয় ৫:১৪, ১৫) এমনকি আজকেও, লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর প্রতি অকৃত্রিম প্রেম ও গভীর সম্মানের কারণে অনুগতভাবে খ্রিস্টের বশীভূত হয়।—প্রকাশিত বাক্য ৭:৯, ১০.
ঈশ্বরের বাক্য নম্রতাকে উৎসাহিত করে কারণ নম্রচিত্ত লোকেরা সানন্দে পরামর্শ গ্রহণ করে আর তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া অনেক আনন্দদায়ক। (লূক ১০:২১; কলসীয় ৩:১০, ১২) যখন সঠিক নতুন তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তখন একজন বাক্পটু, প্রাথমিক খ্রিস্টান শিক্ষক আপল্লোর মতো তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে রদবদল করতে ইচ্ছুক থাকে। (প্রেরিত ১৮:২৪-২৬) আর তারা প্রশ্ন করতে ভয় পায় না কিন্তু অন্যদিকে গর্বিতরা প্রায়ই তা করা এড়িয়ে চলে এই ভয়ে যে, তাদের অজ্ঞানতা প্রকাশ হয়ে পড়বে।
প্রথম শতাব্দীর একজন ইথিওপীয় নপুংসকের কথা বিবেচনা করুন, যিনি শাস্ত্রের একটি নির্দিষ্ট বাক্যাংশ পড়ে বুঝতে পারেননি। “আপনি যাহা পাঠ করিতেছেন, তাহা কি বুঝিতে পারিতেছেন?” খ্রিস্টান শিষ্য ফিলিপ তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। সেই ইথিওপীয় উত্তর দিয়েছিলেন: “কেহ আমাকে বুঝাইয়া না দিলে কেমন করিয়া বুঝিতে পারিব?” নম্রতার কী এক উদাহরণ—বিশেষ করে এই বিষয়টা বিবেচনা করলে যে, তার দেশে সেই নপুংসক সম্ভবত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন! তার নম্রতার কারণে তিনি শাস্ত্র সম্বন্ধে গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছিলেন।—প্রেরিত ৮:২৬-৩৮.
ইথিওপীয় ব্যক্তি সেইসমস্ত যিহুদি অধ্যাপক ও ফরীশী থেকে একেবারেই আলাদা ছিলেন, যারা তাদের সময়ে নিজেদের ধর্মীয় নেতা বলে গণ্য করত। (মথি ২৩:৫-৭) নম্রভাবে যিশু ও তাঁর অনুসারীদের কথা শোনার পরিবর্তে এই নেতারা তাদেরকে বিদ্রূপ করত ও তাদের দোষ খুঁজে বেড়াত। এভাবে তাদের গর্ব তাদেরকে আধ্যাত্মিক অন্ধকারে রেখেছিল।—যোহন ৭:৩২, ৪৭-৪৯; প্রেরিত ৫:২৯-৩৩.
আপনি কি নরম, নাকি শক্ত কাদামাটির মতো?
বাইবেল যিহোবাকে একজন কুম্ভকারের সঙ্গে এবং মানুষকে মৃত্তিকা বা কাদামাটির সঙ্গে তুলনা করে। (যিশাইয় ৬৪:৮) নম্রতা একজন ব্যক্তিকে ঈশ্বরের হাতে নরম কাদামাটির মতো হতে সাহায্য করে, যাকে তিনি এক আকাঙ্ক্ষিত পাত্রের আকার দিতে পারেন; অন্যদিকে অহংকারীরা শুকনো, শক্ত কাদামাটির মতো, যা কেবল চূর্ণ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিষয়টার এক কুখ্যাত উদাহরণ হলেন প্রাচীন মিসরের অহংকারী রাজা ফরৌণ, যিনি যিহোবার বিরোধিতা করেছিলেন আর এর ফলস্বরূপ তার জীবন হারিয়েছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৫:২; ৯:১৭; গীতসংহিতা ১৩৬:১৫) ফরৌণের মৃত্যু এই প্রবাদকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরে: “বিনাশের পূর্ব্বে অহঙ্কার, পতনের পূর্ব্বে মনের গর্ব্ব।”—হিতোপদেশ ১৬:১৮.
ওপরে উল্লেখিত বিষয় এটা ইঙ্গিত করে না যে, ঈশ্বরের লোকেদের কখনোই গর্বের সঙ্গে লড়াই করতে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, যিশুর প্রেরিতরা প্রায়ই এই বিষয়টা নিয়ে তর্ক করত যে, তাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ। (লূক ২২:২৪-২৭) তা সত্ত্বেও, তারা গর্বের দ্বারা পরাভূত হয়নি বরং যিশুর কথা শুনেছিল আর শেষ পর্যন্ত তাদের মনোভাব পরিবর্তন করেছিল।
“নম্রতার ও সদাপ্রভুর ভয়ের পুরস্কার, ধন, সম্মান ও জীবন,” শলোমন লিখেছিলেন। (হিতোপদেশ ২২:৪) নম্রতা গড়ে তোলার কত যুক্তিসংগত কারণই না আমাদের রয়েছে! এটা কেবলমাত্র এক দৃঢ় ও প্রীতিকর গুণই নয় বরং সেইসঙ্গে এটা আমাদের ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং অনন্তজীবনের পুরস্কার অর্জন করতে সাহায্য করে।—২ শমূয়েল ২২:২৮; যাকোব ৪:১০. (g ৩/০৭)
আপনি কি ভেবে দেখেছেন?
◼ সকল ধরনের গর্ব বা শ্লাঘাই কি খারাপ?—২ থিষলনীকীয় ১:৩, ৪.
◼ শিক্ষা লাভ করার ক্ষেত্রে নম্রতা কীভাবে সাহায্য করে?—প্রেরিত ৮:২৬-৩৮.
◼ ঈশ্বরের দাসদের কি নম্রতা গড়ে তুলতে হবে?—লূক ২২:২৪-২৭.
◼ নম্র ব্যক্তিদের জন্য কোন ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে?—হিতোপদেশ ২২:৪.
[২০, ২১ পৃষ্ঠার চিত্র]
শিশুরা যিশুর কাছে আসত কারণ তিনি একজন নম্র ব্যক্তি ছিলেন