সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

বিজ্ঞান কি সমস্ত অসুস্থতাকে দূর করতে পারবে?

বিজ্ঞান কি সমস্ত অসুস্থতাকে দূর করতে পারবে?

বিজ্ঞান কি সমস্ত অসুস্থতাকে দূর করতে পারবে?

আধুনিক বিজ্ঞান কি সমস্ত অসুস্থতাকে দূর করতে পারবে? বাইবেলের যিশাইয় ও প্রকাশিত বাক্য বইয়ের ভবিষ্যদ্বাণীগুলো কি এমন এক সময়ের বিষয়ে উল্লেখ করে, যখন স্বয়ং মানুষই অসুস্থতাবিহীন এক বিশ্ব নিয়ে আসবে? স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অর্জিত অনেক সাফল্যের পরিপ্রেক্ষিতে কারো কারো কাছে এটা অসম্ভব কিছু নয়।

রোগব্যাধির বিরুদ্ধে এক নজিরবিহীন অভিযানে রাষ্ট্রসংঘের সঙ্গে এখন সরকার এবং বেসরকারি জনহিতৈষী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো একত্রে কাজ করছে। এক সম্মিলিত প্রচেষ্টা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের প্রতিষেধক দেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। রাষ্ট্রসংঘের শিশু তহবিল অনুসারে, এই দেশগুলো যদি তাদের লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে, তা হলে “২০১৫ সালের মধ্যে, বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে বাস করে এমন ৭ কোটিরও বেশি শিশু প্রতি বছর এই রোগগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক লাভ করবে, যথা: যক্ষ্মা, ডিপথিরিয়া, টিটেনাস, হুপিংকাশি, হাম, রুবেলা (জার্মান হাম), ইয়েলো ফিভার (পীতজ্বর), হেমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি, হেপাটাইটিস বি, পোলিও, রোটাভাইরাস, নিউমোককাস, মেনিংগোককাস এবং জাপানি এনসেফ্যালাইটিস।” পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ জল সরবরাহ, অধিক পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্বন্ধীয় শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়গুলো সরবরাহ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু, বিজ্ঞানীরা স্বাস্থ্যসেবার শুধুমাত্র মৌলিক বিষয়গুলো সরবরাহ করার চেয়েও আরও বেশি কিছু করতে চায়। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা চিকিৎসাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। এইরকম বলা হয় যে, প্রায় প্রতি আট বছরে বিজ্ঞানীদের চিকিৎসা বিষয়ক জ্ঞান দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। রোগব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাগত অর্জন ও লক্ষ্যের কয়েকটা নমুনা নীচে দেওয়া হল।

এক্স-রে চিত্র ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ডাক্তার ও হাসপাতালগুলো সিটি স্ক্যান নামে পরিচিত এক পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। আদ্যক্ষর সিটি (CT) দিয়ে বোঝায় কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি। সিটি স্ক্যানারগুলো আমাদের দেহের ভিতরকার ত্রিমাত্রিক এক্স-রে চিত্র তুলে ধরে। রোগনির্ণয় এবং দেহের আভ্যন্তরীণ অস্বাভাবিকতা পরীক্ষানিরীক্ষা করতে এই চিত্রগুলো খুবই সাহায্যকারী।

রঞ্জনরশ্মির সংস্পর্শে আসার বিপদগুলো নিয়ে যদিও কিছু বিতর্ক বিদ্যমান কিন্তু চিকিৎসা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা এই প্রগতিশীল প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উপকারগুলোর বিষয়ে আশাবাদী। ইউনিভারসিটি অভ্‌ শিকাগো হসপিটাল এর রেডিওলজি (রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে রোগনির্ণয় বিজ্ঞান) বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল ভেনার বলেন: “কেবলমাত্র বিগত কয়েক বছরের মধ্যেই মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয়েছে।”

সিটি স্ক্যানারগুলো এখন অধিকতর দ্রুত ও সঠিকভাবে কাজ করে এবং এতে খরচও কম হয়। সবচেয়ে নতুন স্ক্যানিং পদ্ধতিগুলোর গতি হচ্ছে একটা বড় সুবিধা। বিশেষ করে হার্টের স্ক্যান করার ক্ষেত্রে তা দেখা যায়। ক্রমাগত হৃৎস্পন্দন হচ্ছে বলে হার্টের অনেক এক্স-রে চিত্র অস্পষ্ট এসেছিল আর এর ফলে সঠিকভাবে পরীক্ষা করা কঠিন হয়ে উঠেছিল। নিউ সায়েনটিস্ট পত্রিকা যেমন ব্যাখ্যা করে, নতুন স্ক্যানারগুলো “সারা শরীরে আবর্তিত হতে কেবলমাত্র এক সেকেন্ডের এক তৃতীয়াংশ সময় নেয়, যা একবার হৃৎস্পন্দনের চেয়েও অধিক দ্রুত” আর এর ফলে তা আরও স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।

সর্বাধুনিক স্ক্যানারগুলোর সাহায্যে ডাক্তাররা শুধু দেহের আভ্যন্তরীণ গঠন সম্বন্ধে বিস্তারিত চিত্রই দেখতে পারে না কিন্তু সেইসঙ্গে নির্দিষ্ট অংশগুলোর জৈবরাসায়নিক কাজ সম্বন্ধেও পরীক্ষা করতে পারে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে হয়তো প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সারের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব।

রোবটের সাহায্যে অপারেশন আধুনিক রোবটগুলো এখন আর শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির রাজ্যে সীমাবদ্ধ নয়—অন্ততপক্ষে চিকিৎসাক্ষেত্রে নয়। ইতিমধ্যেই, রোবটের সাহায্যে হাজার হাজার অপারেশন করা হচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সার্জনরা রিমোট কন্ট্রোল চালিত এক যন্ত্রের সাহায্যে অপারেশন করে থাকে, যা তাদেরকে বেশ কয়েকটা রোবটের হাতকে নিপুণভাবে কাজে লাগাতে সমর্থ করে। এই হাতগুলোতে ছোট ছুরি, কাঁচি, ক্যামেরা, কটারি (যে-যন্ত্রের সাহায্যে কোষ পুড়িয়ে দেওয়া হয়) এবং অপারেশন করার অন্যান্য সরঞ্জাম থাকে। এই প্রযুক্তি সার্জনদের অতি জটিল অপারেশনগুলোও অবিশ্বাস্য রকমের নির্ভুলভাবে করতে সাহায্য করে। “যে-সার্জনরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা দেখেছে যে, অপারেশনের সময়ে যাদের শরীরের অনেকটা জায়গা কাটা হয়, তাদের চেয়ে এভাবে অপারেশনকৃত রোগীদের কম রক্তক্ষরণ হয় ও কম ব্যথা হয়, জটিলতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি কম থাকে, হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে কম সময় থাকতে হয় এবং দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে,” নিউজউইক পত্রিকা রিপোর্ট করে।

ন্যানোচিকিৎসা ন্যানোচিকিৎসা হচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগ। আর ন্যানোপ্রযুক্তি হচ্ছে আণুবীক্ষণিক বস্তুগুলো কাজে লাগানোর ও উদ্ভাবন করার বিজ্ঞান। এই প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত পরিমাপের একককে বলা হয় ন্যানোমিটার, যা হচ্ছে এক মিটারের একশো কোটি ভাগের এক ভাগ। *

এই পরিমাপটা যে কত ছোট, তা বোঝার জন্য এই বিষয়টা একটু কল্পনা করুন। আপনি এখন যে-পৃষ্ঠাটা পড়ছেন, সেটা ১,০০,০০০ ন্যানোমিটার পুরু আর মানুষের একটা চুল হচ্ছে প্রায় ৮০,০০০ ন্যানোমিটার পুরু। একটা লোহিত রক্তকণিকার ব্যাস হচ্ছে প্রায় ২,৫০০ ন্যানোমিটার। একটা ব্যাকটিরিয়া জীবাণু প্রায় ১,০০০ ন্যানোমিটার লম্বা ও একটা ভাইরাস জীবাণু প্রায় ১০০ ন্যানোমিটার লম্বা। আপনার ডিএনএ-র ব্যাস হচ্ছে প্রায় ২.৫ ন্যানোমিটার।

এই প্রযুক্তিবিদ্যার সমর্থকরা মনে করে যে, অদূর ভবিষ্যতে বিজ্ঞানীরা মানবদেহের ভিতরে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগের জন্য অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যন্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হবে। প্রায়ই ন্যানোযন্ত্র হিসেবে উল্লেখিত এই ছোট ছোট রোবটগুলো অতি ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক কম্পিউটার বহন করবে, যেখানে সুনির্দিষ্ট নির্দেশাবলি প্রোগ্রাম করা থাকবে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, অতি জটিল এই যন্ত্রগুলো এমন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হবে, যেগুলো ১০০ ন্যানোমিটারের চেয়ে বড় নয়। অর্থাৎ একটা লোহিত রক্তকণিকার ব্যাসের চেয়ে ২৫ গুণ ছোট!

যেহেতু এগুলো খুবই ছোট, তাই আশা করা হয় যে, ন্যানোযন্ত্রগুলো কোনো একদিন দেহের ক্ষুদ্র কৈশিক নালীর মধ্যে দিয়ে গমন করতে পারবে এবং রক্তবাহী ধমনীর মধ্যে থেকে প্রতিবন্ধকগুলো ও মস্তিষ্কের কোষ থেকে প্ল্যাককে দূর করতে রক্তাল্পতাগ্রস্ত কলাগুলোর মধ্যে অক্সিজেন প্রদান করতে পারবে আর এমনকি ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া ও অন্যান্য সংক্রামক উপাদানগুলোকে খুঁজে বের করে সেগুলোকে ধ্বংস করতে পারবে। এ ছাড়া, ন্যানোযন্ত্রগুলো হয়তো ঠিক যেখানে দরকার, সরাসরি সেই নির্দিষ্ট কোষগুলোতে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে।

বিজ্ঞানীরা অনুমান করে যে, ন্যানোচিকিৎসার সাহায্যে ক্যান্সার শনাক্ত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হবে। চিকিৎসাবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক ড. স্যামুয়েল উইকলাইন বলেছিলেন: “আগের চেয়ে এখন আরও দ্রুত ছোট আকারের ক্যান্সার খুঁজে বের করার এবং শুধুমাত্র যে-জায়গাটাতে টিউমার রয়েছে, সেখানে শক্তিশালী ওষুধের দ্বারা চিকিৎসা করার ও একইসময়ে যেকোনো ধরনের ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হ্রাস করানোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।”

যদিও এই কথাগুলোকে ভবিষ্যৎ অলীক কল্পনার মতো শোনায় কিন্তু ন্যানোচিকিৎসা কিছু বিজ্ঞানীর কাছে খুবই বাস্তব এক বিষয়। এই ক্ষেত্রে বিখ্যাত গবেষকরা আশা করে যে, পরবর্তী দশকের মধ্যেই সজীব কোষগুলোর আণবিক গঠনকে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করতে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। একজন সমর্থক দাবি করেন: “ন্যানোচিকিৎসা বিংশ শতাব্দীর প্রায় সব সাধারণ রোগব্যাধিকে, মূলত সব ধরনের চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যথা ও কষ্টকে নির্মূল করবে এবং মানব ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটাবে।” এমনকি এখনই বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে পশুদের ওপর ন্যানোচিকিৎসা প্রয়োগ করার ব্যাপারে বেশ সাফল্য লাভ করেছে বলে রিপোর্ট করছে।

জিনোমিক্‌স্‌ জিনের গঠন কাঠামো অধ্যয়ন জিনোমিক্‌স্‌ নামে পরিচিত। মানবদেহের প্রতিটা কোষ, বেঁচে থাকার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ অনেক উপাদানে পরিপূর্ণ। এই উপাদানগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে জিন। আমাদের প্রত্যেকের প্রায় ৩৫,০০০ জিন রয়েছে, যা চুলের রং ও বিন্যাস, ত্বক ও চোখের রং, উচ্চতা এবং আমাদের একেক জনের দৈহিক গড়নের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যকে নির্ধারণ করে। এ ছাড়া, আমাদের জিনগুলো আমাদের আভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর গুণগত মান নির্ণয়েও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জিনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। বস্তুতপক্ষে, কিছু গবেষক মনে করে যে, জিনের অস্বাভাবিকতাই হচ্ছে সব ধরনের রোগের কারণ। কিছু ত্রুটিপূর্ণ জিন আমরা আমাদের বাবামার কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। অন্যগুলো আমাদের পরিবেশে কিছু ক্ষতিকর উপাদানের সংস্পর্শে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বিজ্ঞানীরা আশা করে যে, তারা শীঘ্রই সেই নির্দিষ্ট জিনগুলোকে শনাক্ত করতে সক্ষম হবে, যেগুলো আমাদের রোগপ্রবণ করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, এটা ডাক্তারদের বুঝতে সাহায্য করতে পারে যে, কেন কিছু ব্যক্তির অন্যদের চেয়ে অধিক ক্যান্সার হয় অথবা কেন কোনো ধরনের ক্যান্সার অন্যদের চেয়ে কিছু লোকের ওপর বেশি আক্রমণ করে। এ ছাড়া, জিনোমিক্‌স্‌ হয়তো এও প্রকাশ করতে পারে যে, কেন কোনো একটা ওষুধ কিছু রোগীর বেলায় কার্যকর প্রমাণিত হয় কিন্তু অন্যদের বেলায় হয় না।

জিন সংক্রান্ত এই ধরনের নির্দিষ্ট তথ্য হয়তো এমন ধরনের চিকিৎসার উদ্ভাবন করতে পারে, যেটাকে প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপযোগী চিকিৎসা বলা যায়। এই প্রযুক্তিবিদ্যা থেকে আপনি কীভাবে উপকার লাভ করতে পারেন? প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপযোগী চিকিৎসার এই ধারণা ইঙ্গিত করে যে, আপনাকে আপনার অদ্বিতীয় জিন সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্যগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চিকিৎসা প্রদান করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আপনার জিনগুলো নিয়ে গবেষণা যদি প্রকাশ করে যে, আপনার কোনো একটা রোগ হওয়ার প্রবণতা রয়েছে, তা হলে ডাক্তাররা যেকোনো ধরনের উপসর্গ দেখা দেওয়ার বহু আগেই তা নির্ণয় করতে পারবে। সমর্থকরা দাবি করে যে, এমন ক্ষেত্রগুলো যেখানে এখনও পর্যন্ত রোগ দেখা দেয়নি, সেখানে সঠিক চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস এবং অভ্যাসের পরিবর্তন হয়তো সেই রোগকে পুরোপুরিভাবে নির্মূল করে দিতে পারে।

আপনার জিন হয়তো ডাক্তারদের কোনো একটা ওষুধের প্রতি আপনার প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনার বিষয়েও তাদের সতর্ক করে দিতে পারে। এই তথ্য ডাক্তারদেরকে আপনার নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ধরনের ওষুধ ও এর মাত্রা স্থির করার ক্ষমতা প্রদান করতে পারে। দ্যা বোস্টন গ্লোব খবরের কাগজ রিপোর্ট করে: “২০২০ সালের মধ্যে [প্রত্যেক ব্যক্তির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের উপযোগী চিকিৎসার] প্রভাব, বর্তমানে আমরা যতখানি কল্পনা করতে পারি, তার চেয়েও আরও বহু গুণ বেশি কার্যকারী হবে। ডায়াবিটিস, হার্টের রোগ, আ্যলজিমার্স রোগ, স্কিটজোফ্রেনিয়া এবং অন্যান্য অনেক অবস্থার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তির জিনের ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করা হবে, যে-রোগগুলো আমাদের সমাজে প্রচুর ঝুঁকির কারণ হয়।”

বিজ্ঞান ভবিষ্যতের জন্য যে-বিষয়গুলোর প্রতিজ্ঞা করতে পারে, উপরোক্ত প্রযুক্তিগুলো তার একটা নমুনা মাত্র। চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান নজিরবিহীন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা এইরকমটা আশা করে না যে, শীঘ্রই তারা অসুস্থতাকে নির্মূল করে দিতে পারবে। এমন অনেক প্রতিবন্ধক রয়েছে, যেগুলোকে এখনও অজেয় বলে মনে হয়।

আপাতদৃষ্টিতে অজেয় প্রতিবন্ধকগুলো

মানব অভ্যাস হয়তো রোগব্যাধি নির্মূল করার অগ্রগতিকে ধীরগতি করে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা মনে করে যে মানুষ নির্দিষ্ট কিছু বাস্তুসংস্থানকে নষ্ট করে দেওয়ার ফলে নতুন নতুন, মারাত্মক রোগব্যাধির সৃষ্টি হয়েছে। নিউজউইক পত্রিকার একটা সাক্ষাৎকারে, ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট এর প্রেসিডেন্ট মেরি পার্ল ব্যাখ্যা করেছিলেন: “১৯৭০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে, এইডস, আ্যবোলা, লাইম ডিজিস এবং সার্স রোগসহ ৩০টারও বেশি নতুন রোগের আবির্ভাব হয়েছে। এই রোগগুলোর অধিকাংশই বন্যপ্রাণীদের কাছ থেকে উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে করা হয়।”

অধিকন্তু, লোকেরা টাটকা ফল ও শাকসবজি কম খায় এবং চিনি, লবণ, স্যাচুরেটেড (সম্পৃক্ত) চর্বি অধিক পরিমাণে খেয়ে থাকে। এই বিষয়টা ও সেইসঙ্গে কায়িক পরিশ্রম হ্রাস পাওয়া এবং অন্যান্য অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস অধিক কার্ডিভাসকুলার (হার্ট ও রক্তবাহী শিরার) রোগের সৃষ্টি করেছে। ধূমপানের অভ্যাস বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে আর তা গুরুতর স্বাস্থ্যসমস্যার কারণ হচ্ছে ও পৃথিবীব্যাপী লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটাচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় ২ কোটি লোক গাড়ি দুর্ঘটনার কারণে গুরুতর আহত হয় বা মারা যায়। যুদ্ধ এবং অন্যান্য ধরনের দৌরাত্ম্যের কারণে অগণিত লোক নিহত বা বিকলাঙ্গ হয়। লক্ষ লক্ষ লোক মদ বা নেশাকর ওষুধের অপব্যবহারের কারণে খারাপ স্বাস্থ্য ভোগ করে।

অসুস্থতার কারণ যা-ই হোক না কেন ও চিকিৎসাপ্রযুক্তিতে সব ধরনের উন্নতি সত্ত্বেও, কিছু কিছু রোগের কারণে এখনও মানুষকে অনেক মাশুল দিতে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, ‘১৫ কোটিরও বেশি লোক জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হতাশায় ভোগে, প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ লোক স্কিটজোফ্রেনিয়ায় এবং ৩ কোটি ৮০ লক্ষ লোক মৃগীরোগে ভুগে থাকে।’ এইচআইভি/এইডস, ডায়ারিয়া সংক্রান্ত রোগ, ম্যালেরিয়া, হাম, নিউমোনিয়া এবং যক্ষ্মা লক্ষ লক্ষ লোককে সংক্রামিত করে, অগণিত ছোট বড় সকলের মৃত্যুর কারণ হয়।

রোগব্যাধিকে নির্মূল করার পথে আপাতদৃষ্টিতে আরও অনেক অজেয় প্রতিবন্ধক রয়েছে। দরিদ্রতা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার হচ্ছে দুটো বড় বাধা। সম্প্রতি একটা রিপোর্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল যে, যদি সরকারের ব্যর্থতা ও অর্থ-তহবিলের অভাব না থাকত, তা হলে যে-লক্ষ লক্ষ লোক সংক্রামক রোগব্যাধিতে ভুগে মারা যায়, তাদেরকে বাঁচানো যেত।

বিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞান এবং চিকিৎসাপ্রযুক্তিতে নাটকীয় উন্নতিগুলো কি এই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে? আমরা কি শীঘ্রই অসুস্থতাবিহীন এক জগৎ দেখতে পাব? এটা ঠিক যে, ওপরে বর্ণিত বিষয়গুলো এই প্রশ্নের কোনো স্পষ্ট উত্তর দেয় না। কিন্তু, বাইবেল এই প্রশ্নটির ওপর আলোকপাত করে। পরের প্রবন্ধটি আলোচনা করবে যে, ভবিষ্যতের এমন এক সময়ের প্রত্যাশার বিষয়ে বাইবেল কী জানায়, যখন অসুস্থতা আর থাকবে না। (g ১/০৭)

[পাদটীকা]

^ পূর্বপদ “ন্যানো” এসেছে ক্ষুদ্রাকৃতির জন্য ব্যবহৃত গ্রিক শব্দ থেকে, যেটির অর্থ হচ্ছে “একশো কোটি ভাগের এক ভাগ।”

[৭ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

এক্স-রে চিত্র

মানবদেহের অধিকতর স্পষ্ট, সঠিক চিত্র হয়তো প্রাথমিক পর্যায়েই রোগনির্ণয় করতে সাহায্য করতে পারে

[সৌজন্যে]

© Philips

Siemens AG

রোবটের সাহায্যে অপারেশন

অপারেশনের সরঞ্জামের দ্বারা সজ্জিত রোবটগুলো ডাক্তারদের অত্যন্ত জটিল অপারেশনগুলো অবিশ্বাস্য রকমের নির্ভুলভাবে করতে সাহায্য করে

[সৌজন্যে]

© ২০০৬ Intuitive Surgical, Inc.

ন্যানোচিকিৎসা

মনুষ্যনির্মিত আণুবীক্ষণিক যন্ত্রগুলো হয়তো ডাক্তারদের কোষীয় পর্যায়েই রোগব্যাধির চিকিৎসা করার জন্য সক্ষম করতে পারে। এই ফটো ন্যানোযন্ত্র সম্বন্ধে একজন শিল্পীর ধারণাকে প্রকাশ করে, যে-যন্ত্রটা একটা রক্তকণিকার কাজ অনুকরণ করবে

[সৌজন্যে]

শিল্পী: Vik Olliver (vik@diamondage.co.nz)/ নকশাকারী: Robert Freitas

জিনোমিক্‌স্‌

একজন ব্যক্তির জিনগত গঠন সম্বন্ধে অধ্যয়ন করে এমনকি রোগীর কোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই বিজ্ঞানীরা রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা করার আশা রাখে

[সৌজন্যে]

ক্রোমোজম: © Phanie/ Photo Researchers, Inc.

[৮, ৯ পৃষ্ঠার বাক্স]

ছয়টা অজেয় শত্রু

চিকিৎসা সংক্রান্ত জ্ঞান এবং সম্পর্কযুক্ত প্রযুক্তিবিদ্যা নজিরবিহীন মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও, সংক্রামক রোগব্যাধির আক্রমণ এখনও বিশ্বকে জর্জরিত করে চলেছে। নীচে তালিকাবদ্ধ ঘাতক রোগগুলো এখনও অজেয় রয়ে গিয়েছে।

এইচআইভি/এইডস

প্রায় ৬ কোটি লোক এইচআইভি-র দ্বারা সংক্রামিত হয়েছে আর প্রায় ২ কোটি লোক এইডস এর কারণে ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছে। ২০০৫ সালে পঞ্চাশ লক্ষ নতুন ব্যক্তি সংক্রামিত হয়েছে এবং ত্রিশ লক্ষেরও বেশি লোক এইডস সংক্রান্ত কারণে মারা গিয়েছে। এই রোগের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে ৫,০০,০০০রেও বেশি শিশু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এইচআইভি-র শিকার অধিকাংশ ব্যক্তির পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই।

ডায়ারিয়া

প্রতি বছর প্রায় চারশো কোটি লোক আক্রান্ত হওয়ায়, ডায়ারিয়াকে দরিদ্র লোকেদের মধ্যে এক প্রধান ঘাতক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এটা বিভিন্ন সংক্রামক রোগের দ্বারা হয়ে থাকে, যা দূষিত জল বা খাদ্য অথবা যথাযথ ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবে ছড়াতে পারে। এই সংক্রামক রোগের কারণে প্রতি বছর কুড়ি লক্ষেরও বেশি লোক মারা যায়।

ম্যালেরিয়া

বছরে প্রায় ৩০ কোটি লোক ম্যালেরিয়ার কারণে অসুস্থ হয়। এই রোগের শিকার হয়ে প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা যায়, যাদের মধ্যে অনেকেই শিশু। আফ্রিকায় প্রতি ৩০ সেকেন্ডে একজন শিশু ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুসারে, “ম্যালেরিয়া রোগকে নির্মূল করার জন্য বিজ্ঞানের কাছে এখনও কোনো ম্যাজিক বুলেট নেই আর অনেকে সন্দেহ করে যে, এই ধরনের একটা সমাধান আদৌ অস্তিত্ব লাভ করবে কি না।”

হাম

২০০৩ সালে, হামের কারণে ৫,০০,০০০রও বেশি লোক মারা গিয়েছে। শিশুমৃত্যুর প্রধান কারণের মধ্যে হাম হচ্ছে অত্যন্ত সংক্রামক এক রোগ। প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি লোকের হাম হয়। অথচ বিগত ৪০ বছর ধরেই হামের বিরুদ্ধে এক কার্যকর ও সস্তা প্রতিষেধক রয়েছে।

নিউমোনিয়া

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দাবি করে যে, অন্য যেকোনো সংক্রামক রোগের চেয়ে নিউমোনিয়ায় ভুগে সবচেয়ে বেশি শিশু মারা যায়। প্রতি বছর পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় কুড়ি লক্ষ শিশু নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা যায়। এই মৃত্যুগুলোর অধিকাংশই আফ্রিকা ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ঘটে থাকে। বিশ্বের অনেক দেশে, স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুযোগ থাকায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা লাভ করার ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

যক্ষ্মা

২০০৩ সালে, যক্ষ্মার (টিবি) কারণে ১৭,০০,০০০রও বেশি লোক মারা গিয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়টা হচ্ছে যক্ষ্মা রোগের এমন জীবাণুর উত্থান, যা ওষুধ দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না। কিছু প্রজাতিকে যক্ষ্মা রোগের জন্য ব্যবহৃত সব ধরনের বড় বড় ওষুধ দিয়েও প্রতিরোধ করা যায় না। ওষুধ দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না এমন কিছু যক্ষ্মার জীবাণু সেই রোগীদের মধ্যে বৃদ্ধি পায়, যাদের তেমন তত্ত্বাবধান করা হয় না বা অসম্পূর্ণ চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

[৯ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো বৃদ্ধি পাচ্ছে

আরোগ্য লাভ করার বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলো প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতির চিকিৎসকদের কাছে তেমন একটা গ্রহণযোগ্য নয়। সাধারণত এগুলো ঐতিহ্যগত চিকিৎসাপদ্ধতি ও বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অধিকাংশ জনসংখ্যা তাদের স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনে ঐতিহ্যগত ওষুধের ওপর নির্ভর করে থাকে। দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে অনেকে প্রচলিত চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারে না আবার অন্য লোকেরা সাধারণত ঐতিহ্যগত পদ্ধতিগুলো পছন্দ করে থাকে।

ধনী দেশগুলোতে বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো সমৃদ্ধি লাভ করছে। বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা হচ্ছে আকুপাংচার, কাইরোপ্র্যাকটিক, হোমিওপ্যাথি, নেচারোপ্যাথি এবং ভেষজ ওষুধ। এই পদ্ধতিগুলোর কয়েকটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং নির্দিষ্ট কিছু অবস্থার ক্ষেত্রে উপকারজনক বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু, নির্দিষ্ট কিছু পদ্ধতির কার্যকারিতা পর্যাপ্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিকল্প ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এগুলো নিরাপদ কি না, সেই বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেক দেশে এই ধরনের আরোগ্যকর চিকিৎসাপদ্ধতিগুলোকে কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। এর ফলে এটা এমন এক ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, যেখানে ক্ষতিকর স্ব-চিকিৎসা, নকল সামগ্রী এবং হাতুড়ে চিকিৎসা প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। যদিও উদ্দেশ্য ভাল কিন্তু পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে এমন বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন প্রায়ই নিজে নিজে ডাক্তারি করতে চায়। এই সমস্তকিছু, প্রতিকূল প্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্যের অন্যান্য ঝুঁকি নিয়ে এসেছে।

বেশ কয়েকটা দেশে, যেখানে বিকল্প ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে, সেখানে প্রচলিত চিকিৎসকমহলের কাছে বিকল্প চিকিৎসাপদ্ধতিগুলো গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে আর ডাক্তাররাও তা অনুমোদন করছে। তা সত্ত্বেও, এইরকম দাবি করার কোনো উপযুক্ত কারণই নেই যে, এই পদ্ধতিগুলো কখনো অসুস্থতাবিহীন এক জগৎ নিয়ে আসতে পারবে।