সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

কাপড়ে রঞ্জনকার্য প্রাচীন ও আধুনিক পদ্ধতি

কাপড়ে রঞ্জনকার্য প্রাচীন ও আধুনিক পদ্ধতি

কাপড়ে রঞ্জনকার্য প্রাচীন ও আধুনিক পদ্ধতি

ব্রিটেনের সচেতন থাক! লেখক কর্তৃক

আমাদের আবেগের ওপর রং যে-প্রভাব ফেলে থাকে, তা কি আপনি কখনো লক্ষ করেছেন? এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই যে, ইতিহাস জুড়ে মানুষ সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করে কাপড়কে রঙিন করা বেছে নিয়েছে, যে-পদ্ধতিকে বলা হয় ডাইয়িং অর্থাৎ রঞ্জনকার্য।

আমরা যখন জামাকাপড় এবং জানালা-দরজার পর্দা, আসবাবপত্রের ঢাকনা কিনি অথবা সেগুলো তৈরি করার জন্য কাপড় কিনি, তখন আমরা চাই না যে, সেগুলোর রং উঠে যাক কিংবা ফ্যাকাশে হয়ে যাক। কাপড়ের রং পাকা করার পদ্ধতিগুলো কী এবং রং করার চিরাচরিত কলাকৌশলগুলো কীভাবে উদ্ভাবিত হয়েছিল, তা জানার জন্য আমরা ইংল্যান্ডের উত্তরাংশে ব্রেডফোর্ডে এসডিসি কালার মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছিলাম। * সেখানে আমরা অদ্ভুত কিছু পদার্থ দেখেছিলাম, যেগুলো শত শত বছর ধরে রং হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।

প্রাচীনকালে যে-রঞ্জক পদার্থগুলো ব্যবহৃত হতো

উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝির আগে পর্যন্ত কাপড়ে রং করার জন্য যে-পদার্থগুলো ব্যবহৃত হতো, সেগুলো পুরোপুরিভাবে গাছপালা, কীটপতঙ্গ এবং ঝিনুকের মতো প্রাকৃতিক উৎসগুলো থেকে সংগ্রহ করা হতো। উদাহরণস্বরূপ, ওয়ড উদ্ভিদ (এক ধরনের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ) থেকে নীল রঞ্জক পদার্থ (১), ওয়েল্ড উদ্ভিদ থেকে হলুদ রঞ্জক পদার্থ (২) এবং মঞ্জিষ্ঠা গাছ থেকে লাল রঞ্জক পদার্থ আহরণ করা হতো। লগউড উদ্ভিদ থেকে কালো রঞ্জক পদার্থ এবং আর্কিল নামে শৈবালের ন্যায় এক প্রকার ছত্রাক থেকে বেগুনি রঞ্জক পদার্থ সংগ্রহ করা হতো। মুরেক্স ঝিনুক অত্যন্ত মূল্যবান বেগুনি রঞ্জক পদার্থ উৎপন্ন করত, যে-রঞ্জক পদার্থকে কেউ কেউ টিরিয়ান অথবা ইমপিরিয়াল পারপেল বলে থাকে (৩). এই রঞ্জক পদার্থ রোমীয় সম্রাটদের বস্ত্রকে রঞ্জিত করত।

রোমীয় সম্রাটদের বহু বছর আগে, বিশিষ্ট ও ধনবান ব্যক্তিরা প্রাকৃতিক পদার্থে রঞ্জিত কাপড়চোপড় পরত। (ইষ্টের ৮:১৫) উদাহরণস্বরূপ, স্ত্রী কারমিজ পতঙ্গ থেকে লাল রঞ্জক পদার্থ উৎপন্ন করা হতো (৪). স্পষ্টত, এটাই ছিল টকটকে লাল রঙের উৎস, যা প্রাচীন ইস্রায়েলের আবাস তৈরির কাপড়ে ও সেইসঙ্গে ইস্রায়েলের মহাযাজকের বস্ত্রে ব্যবহার করা হতো।—যাত্রাপুস্তক ২৮:৫; ৩৬:৮.

রঞ্জনকার্যের পদ্ধতি

কালার মিউজিয়াম এর প্রদর্শিত বস্তু দেখায় যে, রঞ্জনকার্যের অধিকাংশ পদ্ধতিই রঞ্জক দ্রবণে সুতো বা কাপড় ডুবানোর থেকে অনেক বেশি জটিল। অনেক ক্ষেত্রে, রঞ্জনকার্যের পদ্ধতির একটা ধাপে রংস্থাপক (মরড্যান্ট) ব্যবহার করা হয়, যেটা হচ্ছে এমন এক পদার্থ, যা তন্তু ও রঞ্জক পদার্থ দুটোকেই ধরে রাখে। এই রংস্থাপক ব্যবহার করার ফলে, রঞ্জক পদার্থ তন্তুর মধ্যে আটকে থাকে আর তা ধুলেও উঠে যায় না। অনেক রাসায়নিক দ্রব্য রংস্থাপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেগুলোর মধ্যে কয়েকটা ব্যবহার করা বিপদজনক।

রঞ্জনকার্যের কয়েকটা পদ্ধতি উটকো গন্ধ সৃষ্টি করে। এই পদ্ধতিগুলোর একটা হল দীর্ঘ ও জটিল, যেটা উজ্জ্বল লাল রং (টার্কি রেড) উৎপন্ন করতে ব্যবহৃত হতো। এই পদ্ধতিকে সুতি কাপড়ে ব্যবহার করা হতো এবং এর ফলে এক উজ্জ্বল লাল রং তৈরি হতো, যা রোদে, কাচাধোয়ায় অথবা ব্লিচিং করলেও ফ্যাকাশে হতো না। এক সময়, এই পদ্ধতিতে ৩৮টা বিভিন্ন ধাপ জড়িত ছিল এবং সেগুলো শেষ করতে চার মাস সময় লাগত! কালার মিউজিয়াম-এ প্রদর্শিত সবচেয়ে সুন্দর কাপড়গুলোর মধ্যে কয়েকটা হল সেই কাপড় যেগুলো উজ্জ্বল লাল রং দিয়ে রঞ্জিত করা হয়েছিল। (৫).

কৃত্রিম রঞ্জক পদার্থের উদ্ভাবন

প্রথম যে-রঞ্জক পদার্থ প্রাকৃতিক উৎসগুলো থেকে সংগ্রহ করা হয়নি, সেটা ১৮৫৬ সালে উইলিয়াম হেনরি পারকিন উদ্ভাবন করেছেন বলে মনে করা হয়। মিউজিয়াম এর একটা প্রদর্শিত বস্তু পারকিনের মভ বা মভ্‌ইন অর্থাৎ লালচে বেগুনি রঙের আবিষ্কার সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, উজ্জ্বল রঙের অন্যান্য অনেক কৃত্রিম রঞ্জক পদার্থ উদ্ভাবিত হয়েছে। আজকে ৮০০০ এরও বেশি ধরনের কৃত্রিম রঞ্জক পদার্থ উৎপাদন করা হয়ে থাকে (৬). একমাত্র যে-প্রাকৃতিক দ্রব্যগুলো, যেগুলো এখনও নিয়মিত ব্যবহার করা হয় সেগুলো হল লগউড গাছ এবং কোচিনিল পতঙ্গ।

কালার আ্যন্ড টেক্সটাইলস্‌ গ্যালারি অভ্‌ দ্যা কালার মিউজিয়াম সেই বিশেষ পদ্ধতিগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যা করে, যেগুলো রেয়নের মতো কৃত্রিম বস্তুগুলোকে রং করার জন্য প্রয়োজন। ভিসকোস রেয়ন, বর্তমানে ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় রেয়ন, ১৯০৫ সালে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হয়েছিল। যেহেতু ভিসকোস রেয়ন রাসায়নিকভাবে তুলার মতো, তাই সেই সময়ে প্রাপ্তিসাধ্য অধিকাংশ রঞ্জক পদার্থ-ই ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত ছিল। কিন্তু, আ্যসিটেট রেয়ন, পলিয়েস্টার, নাইলন এবং আ্যকরিলিকস্‌ ফাইবারের মতো অতি আধুনিক কৃত্রিম কাপড়ের জন্য বেশ কিছু নতুন ধরনের রঞ্জক পদার্থ উদ্ভাবন করার দরকার হয়েছিল।

রং পাকা করার প্রতিদ্বন্দ্বিতা

আমরা যখন জামাকাপড় অথবা সেগুলো তৈরি করার জন্য কাপড় কিনি, তখন আমরা চাই সেগুলোর রং যেন পাকা হয়। তবুও, অনেক কাপড়ই রোদে অথবা বার বার কাচাধোয়ার দরুন, বিশেষ করে যদি ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা হয়, তা হলে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কখনো কখনো হয়তো ঘামের দরুন কাপড়চোপড়ের রং বিবর্ণ হয়ে যায় অথবা অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে যখন কাচা হয়, তখন রং পালটে যায়। কাপড় কাচার সময় রংটা যে পাকা তা রঙের অণুগুলো তন্তুর মধ্যে কতখানি শক্তভাবে লেগে রয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে। কাপড় বার বার কাচা এবং দাগ তোলার ডিটারজেন্ট ব্যবহার করার ফলে তন্তু থেকে রঞ্জক পদার্থ উঠে যায় আর এর ফলে কাপড় ফ্যাকাশে দেখায়। রঞ্জক পদার্থ প্রস্তুতকারকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো রোদের, কাচাধোয়ার, ডিটারজেন্ট ব্যবহারের এবং ঘামের দরুন টিকে থাকে কি না, তা দেখার জন্য সেগুলো পরীক্ষা করে।

আমাদের পরিদর্শন আমাদেরকে আমাদের কাপড়চোপড় কী ধরনের বস্তু থেকে তৈরি, সেই বিষয়ে আরও বেশি সচেতন হতে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু এর চেয়ে বড় কথা হল, আমরা উদ্ভাবনী দক্ষতাবিশিষ্ট সেই পদ্ধতিগুলো সম্বন্ধে জেনেছি, যেগুলো কাপড় বার বার কাচা সত্ত্বেও আমাদের কাপড়ের রংকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ব্যবহৃত হয়েছে। (g ৪/০৭)

[পাদটীকা]

^ এসডিসি—সোসাইটি অভ্‌ ডাইয়ারস্‌ আ্যন্ড কালারিস্টস্‌—রঙের ওপর গবেষণা করে।

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

১-৪ নং. ছবিগুলো: Courtesy of the Colour Museum, Bradford (www.colour-experience.org)

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

৫ নং. ছবি: Courtesy of the Colour Museum, Bradford (www.colour-experience.org); ৬ নং. ছবি: Clariant International Ltd., Switzerland