সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

মদের দাস আর নয়

মদের দাস আর নয়

মদের দাস আর নয়

পরিমিত মাত্রায় মদের ব্যবহার কোনো ভোজে পূর্ণতা এনে দিতে পারে অথবা কোনো অনুষ্ঠানের আনন্দকে বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু, কিছু লোকের জন্য মদের ব্যবহার গুরুতর সমস্যার দিকে চালিত করে। একজন ব্যক্তি সম্বন্ধে নীচের কাহিনিটা বিবেচনা করুন, যিনি মদের অপব্যবহারের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

আমাদের ঘরে যে-উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করত, তা বর্ণনা করা আমার জন্য এমনকি এখনও খুবই কষ্টদায়ক। বাবামা মদ খেতে শুরু করত। তারপর বাবা, মাকে মারধর করতেন। প্রায়ই আমি তার মারধরের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতাম। তারা যখন পৃথক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তখন আমার বয়স মাত্র চার বছর। আমার মনে আছে যে, আমাকে দিদিমার বাড়িতে থাকার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

নিজেকে আমার অনেক অবাঞ্ছিত বলে মনে হতো। আমার বয়স যখন সাত বছর, তখন আমি ঘরে তৈরি ওয়াইন খাওয়ার জন্য চুপি চুপি ভূগর্ভস্থ যে-ঘরে মদ রাখা হতো সেখানে চলে যেতাম, যা আমাকে আমার দুঃখ থেকে স্বস্তি দিত বলে মনে হতো। ১২ বছর বয়সে, আমাকে নিয়ে আমার মা ও দিদিমার মধ্যে প্রচণ্ড তর্কবিতর্ক হয়েছিল। মা এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, তিনি আমার দিকে একটা লম্বা হাতলসহ কাঁটা লাগানো দণ্ড ছুঁড়ে মেরেছিলেন। আমি কোনোরকমে লাফ দিয়ে ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলাম! কেবলমাত্র এই একবারই আমার জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়েনি। কিন্তু, আমার শরীরের ক্ষত আমার মনের ভিতরে থাকা আবেগগত ক্ষতের মতো এতটা গভীর ছিল না।

১৪ বছর বয়সে আমি মদের নেশায় জড়িয়ে পড়েছিলাম। অবশেষে, ১৭ বছর বয়সে আমি ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। মদ খাওয়া আমাকে স্বাধীনতার অনুভূতি এনে দিয়েছিল আর আমি খুবই আক্রমণাত্মক হয়ে পড়েছিলাম, স্থানীয় ক্যাফেগুলোতে ঝামেলা করতাম। মদ খাওয়াই আমার জীবনের একমাত্র আনন্দ ছিল। মাত্র এক দিনে আমি ৫ লিটার ওয়াইন, কয়েক বোতল বিয়ার ও সেইসঙ্গে কড়া মদ খেতে পারতাম।

আমি যখন বিয়ে করেছিলাম, তখন মদ খাওয়া আমার স্ত্রীর জন্যও বড় বড় সমস্যা নিয়ে এসেছিল। বিরক্তি ও তিক্ততা গড়ে উঠেছিল আর আমি তাকে ও সন্তানদের মারধর করতাম, সেই একই ধ্বংসাত্মক পরিবেশ সৃষ্টি করতাম, যেখানে আমি বড় হয়েছিলাম। আমি যে-টাকাপয়সা আয় করতাম, তার প্রায় পুরোটাই মদের পিছনে ব্যয় হতো। আমাদের ঘরে কোনো আসবাবপত্র ছিল না, তাই আমি ও আমার স্ত্রী মেঝেতে ঘুমাতাম। আমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থই ছিল না আর আমি আমাদের পরিস্থিতিকে উন্নত করার জন্য কোনো প্রচেষ্টাই করতাম না।

একদিন আমি একজন যিহোবার সাক্ষির সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, কেন এত দুঃখকষ্ট এবং সেই সাক্ষি আমাকে বাইবেল থেকে সমস্যামুক্ত এক জগতের বিষয়ে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে দেখিয়েছিলেন। সেটা আমাকে সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল। আমি যখন বাইবেলের শিক্ষাগুলো কাজে লাগিয়েছিলাম এবং মদ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলাম, তখন আমাদের পারিবারিক জীবন অনেক উন্নত হয়েছিল। তা সত্ত্বেও, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি যদি যিহোবা ঈশ্বরকে গ্রহণযোগ্য উপায়ে সেবা করতে চাই, তা হলে আমাকে মদ খাওয়ার সমস্যা কাটিয়ে উঠতে হবে। তিন মাস সংগ্রাম করার পর আমি মদ থেকে মুক্ত হয়েছিলাম। ছয় মাস পর, আমি ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম এবং এর প্রতীক হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

মদের দাসত্ব শেষ করার পর আমি আমার আর্থিক ঋণগুলো পরিশোধ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। শেষপর্যন্ত আমি একটা বাড়ি ও সেইসঙ্গে একটা গাড়ি কিনেছিলাম, যেটাকে আমরা সভাগুলোতে যোগ দেওয়ার ও ঘরে ঘরে প্রচারে অংশ নেওয়ার জন্য ব্যবহার করি। অবশেষে, আমি আত্মসম্মান অর্জন করেছিলাম।

মাঝে মাঝে সামাজিক মেলামেশার সময় আমাকে মদ খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি যে-কঠোর সংগ্রাম করেছি এবং কেবলমাত্র একবার মদ খাওয়াই যে আমাকে আবার আমার পুরোনো অভ্যাসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে, সেই সম্বন্ধে অনেকেই জানে না। মদের প্রতি আকাঙ্ক্ষা এখনও আমার মধ্যে বিদ্যমান। না বলার শক্তি পেতে ঐকান্তিক প্রার্থনা ও দৃঢ়সংকল্প প্রয়োজন। যখন আমি তৃষ্ণার্ত হই, তখন আমি মদ্যজাতীয় উপাদান নেই এমন যেকোনো পানীয় যতটা পারি খাই। এখন প্রায় দশ বছর হল, আমি একবারের জন্যও মদ্যজাতীয় কোনো পানীয় খাইনি।

মানুষ যা পারে না, যিহোবা তা করতে পারেন। তিনি আমাকে এমন এক স্বাধীনতা উপভোগ করতে সাহায্য করেছেন, যা কখনো সম্ভব বলে আমি মনে করিনি! ছেলেবেলার আবেগগত ক্ষত আমাকে এখনও কষ্ট দেয় আর আমাকে নেতিবাচক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, আমি ঈশ্বরের সঙ্গে এক উত্তম সম্পর্ক, প্রকৃত বন্ধুদের এক মণ্ডলী এবং আমার সঙ্গে একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী এক চমৎকার পরিবার লাভ করে আনন্দিত। মদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমার স্ত্রী ও সন্তানরা আমাকে পূর্ণহৃদয়ে সমর্থন করে থাকে। আমার স্ত্রী বলে: “আগে আমার জীবন দুঃসহ ছিল। এখন আমি আমার স্বামী ও দুই সন্তানকে নিয়ে এক সুখী পারিবারিক জীবন উপভোগ করতে পারছি বলে যিহোবার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ।”—নিবেদিত। (g ৫/০৭)

[১১ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

১৪ বছর বয়সে আমি মদের নেশায় জড়িয়ে পড়েছিলাম

[১২ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

মানুষ যা পারে না, যিহোবা তা করতে পারেন

[১২ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্রগুলো]

বাইবেল এবং মদ

◼ বাইবেল মদের ব্যবহারকে নিন্দা করে না। এটি ‘মর্ত্ত্যের চিত্তানন্দ-জনক দ্রাক্ষারসকে’ বা মদকে মানবজাতির জন্য ঈশ্বরের কাছ থেকে এক উপহার বলে বর্ণনা করে। (গীতসংহিতা ১০৪:১৪, ১৫) এ ছাড়া, বাইবেল দ্রাক্ষালতাকে সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করে। (মীখা ৪:৪) বস্তুতপক্ষে, যিশুর সাধিত প্রথম অলৌকিক কাজটা ছিল, একটা বিবাহভোজে জলকে দ্রাক্ষারসে পরিণত করা। (যোহন ২:৭-৯) আর প্রেরিত পৌল যখন শুনেছিলেন যে, তীমথিয়ের “বার বার অসুখ হয়,” তখন তিনি তাকে “কিঞ্চিৎ দ্রাক্ষারস” খেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।—১ তীমথিয় ৫:২৩.

◼ বাইবেল যেটাকে নিন্দা করে তা হল, মদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার:

“মাতাল . . . ঈশ্বরের রাজ্যে অধিকার পাইবে না।”—১ করিন্থীয় ৬:৯-১১.

“দ্রাক্ষারসে মত্ত হইও না, তাহাতে নষ্টামি আছে।”—ইফিষীয় ৫:১৮.

“কে হায় হায় বলে? কে হাহাকার করে? কে বিবাদ করে? কে বিলাপ করে? কে অকারণ আঘাত পায়? কাহার চক্ষু লাল হয়? যাহারা দ্রাক্ষারসের নিকটে বহুকাল থাকে, যাহারা সুরার সন্ধানে যায়। দ্রাক্ষারসের প্রতি দৃষ্টি করিও না, যদিও উহা রক্তবর্ণ, যদিও উহা পাত্রে চক্‌মক্‌ করে, যদিও উহা সহজে গলায় নামিয়া যায়; অবশেষে উহা সর্পের ন্যায় কামড়ায়, বিষধরের ন্যায় দংশন করে। তোমার চক্ষু পরকীয়া স্ত্রীদিগকে দেখিবে, তোমার চিত্ত কুটিল কথা কহিবে।”—হিতোপদেশ ২৩:২৯-৩৩.

এই প্রবন্ধটিতে যেমন দেখানো হয়েছে, মদ খাওয়ার সমস্যা ছিল এমন কেউ কেউ বিজ্ঞতার সঙ্গে এটা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা বেছে নিয়েছে।—মথি ৫:২৯.