আমি অত্যন্ত নিরাশার সময় আশা খুঁজে পেয়েছিলাম
হঠাৎ আমি বুঝতে পারি যে, আমি জলের মধ্যে উবুড় হয়ে পড়ে আছি। আমি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য মাথা ওঠানোর চেষ্টা করি কিন্তু আমার ঘাড়ের পেশিগুলো যেন কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমি ভয় পেয়ে পাশ ফেরার চেষ্টা করি কিন্তু আমার হাত-পা যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল। আমার ফুসফুসে জল ঢুকতে শুরু করে। ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মকালের সেই দিনে আমার জীবন পুরোপুরিভাবে পালটে গিয়েছিল।
আমি হাঙ্গারির উত্তর-পূর্বে অবস্থিত সেরেঞ্চ শহরে জন্মগ্রহণ করি এবং টিসালাডানি নামে এক গ্রামে বড়ো হয়ে উঠি। ১৯৯১ সালের জুন মাসে, আমি ও আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব মিলে টিসা নদীর ধারে এক অপরিচিত জায়গায় ঘুরতে যাই। নদীটা যথেষ্ট গভীর ভেবে আমি সাঁতার কাটার জন্য এতে ঝাঁপ দিই। সেটা ছিল এক বিরাট ভুল! আমার ঘাড়ের তিনটে হাড় ভেঙ্গে যায় এবং আমার মেরুদণ্ড প্রচণ্ড আঘাত পায়। আমার এক বন্ধু বুঝতে পারে যে, আমি নড়াচড়া করতে পারছি না আর তাই আমি ডুবে যাওয়ার আগেই সে আমাকে যত্ন সহকারে জল থেকে তুলে আনে।
আমার তখনও জ্ঞান ছিল আর আমি বুঝতে পেরেছিলাম, বড়োসড়ো কিছু একটা ঘটেছে। কেউ একজন আপৎকালীন পরিষেবায় ফোন করে এবং একটা হেলিকপ্টার এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে ডাক্তাররা আমার মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার করেন, যাতে সেটার অবনতি না হয়। পরে, আমাকে চিকিৎসার জন্য রাজধানী বুডাপেস্টে পাঠানো হয়, যাতে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারি। এরপর, আমি তিন মাস শয্যাশায়ী হয়ে থাকি। যদিও আমি মাথা নাড়াতে পারতাম কিন্তু আমার কাঁধের নীচ থেকে কোনো পেশি কাজ করত না। মাত্র ২০ বছর বয়সে আমি অন্যদের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। সেই সময়, আমি এতটাই হতাশ হয়ে পড়ি যে, আমি মরে যেতে চাইতাম।
অবশেষে, আমি যখন বাড়ি ফিরে যাই, তখন আমার বাবা-মা বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন, যাতে তারা আমার যত্ন নিতে পারেন। কিন্তু, আমার যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব তাদেরকে শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয় আর প্রায় এক বছরের মধ্যে আমি আবার হতাশায় ডুবে যাই। সেই সময়, আমি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে সাহায্য লাভ করি এবং এর ফলে, অক্ষমতা সম্বন্ধে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করি।
একইসঙ্গে, আমি জীবন সম্বন্ধে গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা করতে শুরু করি। জীবনের কি কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে? কেন আমার প্রতি এমনটা ঘটেছে? উত্তর খোঁজার জন্য আমি বিভিন্ন পত্রিকা এবং বই পড়ি। এ ছাড়া, আমি বাইবেল পড়ার চেষ্টা করি কিন্তু এটি বোঝা আমার পক্ষে বেশ কঠিন ছিল। তাই, আমি বাইবেল পড়া বন্ধ করে দিই। আমি এমনকী একজন পাদরির সঙ্গেও কথা বলি কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাইনি।
তারপর, ১৯৯৪ সালের বসন্তকালে, দু-জন যিহোবার সাক্ষি আমার বাবার সঙ্গে দেখা করেন এবং বাবা তাদেরকে অনুরোধ করেন, যাতে তারা আমার সঙ্গে কথা বলেন। তারা যখন পৃথিবীকে পরমদেশে পরিণত করার এবং অসুস্থতা ও দুঃখকষ্ট দূর করার বিষয়ে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করেন, তখন আমি তা মন দিয়ে শুনি। যদিও তাদের কথা শুনতে বেশ ভালো লাগছিল, তবুও আমার মনে সন্দেহ ছিল। তা সত্ত্বেও, আমি বাইবেল অধ্যয়নের জন্য প্রস্তুতকৃত দুটো বই নিই। সেই দুটো বই পড়ার পর, সেই সাক্ষিরা আমার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন
করার প্রস্তাব দেন আর আমি তাতে রাজি হই। এ ছাড়া, তারা আমাকে প্রার্থনা করার জন্য উৎসাহিত করেন।আমি নিশ্চিত হই যে, ঈশ্বর সত্যিই আমার জন্য চিন্তা করেন
অধ্যয়নের মাধ্যমে, আমি সরাসরি বাইবেল থেকে আমার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাই। এ ছাড়া, আমি নিশ্চিত হই যে, ঈশ্বর সত্যিই আমার জন্য চিন্তা করেন। অবশেষে, দু-বছর ধরে বাইবেল অধ্যয়ন করার পর, ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখে, আমাকে নিজের বাড়িতেই একটা বাথটাবে বাপ্তিস্ম দেওয়া হয়। সেই দিনটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিনগুলোর মধ্যে একটা।
২০০৭ সালে, আমি প্রতিবন্ধীদের জন্য একটা সংস্থায় স্থায়ীভাবে থাকার জন্য চলে যাই। এর ফলে, আমি যে-অপূর্ব বিষয়গুলো শিখেছি, সেই সম্বন্ধে অন্যদেরকে জানানোর অনেক সুযোগ পাই। যখন আবহাওয়া ভালো থাকে, তখন আমি এক বিশেষ ধরনের মোটরচালিত হুইলচেয়ারের সাহায্যে বাইরে গিয়ে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। আমি সেই হুইলচেয়ারটাকে আমার থুতনি দিয়ে চালাই।
আমার মণ্ডলীর একটা পরিবার আমাকে আর্থিকভাবে অনেক সাহায্য করেছে এবং এর ফলে, আমি একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার কিনতে পেরেছি, যেটা আমার মাথার নড়াচড়া শনাক্ত করার মাধ্যমে কাজ করে। এই ল্যাপটপ আমাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টেলিফোন করতে এবং সেই গৃহকর্তাদের জন্য চিঠি লিখতে সাহায্য করে, যাদেরকে প্রচার করার সময় বাড়িতে পাওয়া যায়নি। অন্যদেরকে এইভাবে সাহায্য করার মাধ্যমে, আমার কথা বলার দক্ষতা বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটা আমাকে নিজের পরিস্থিতি সম্বন্ধে অতিরিক্ত চিন্তা করা থেকে বিরত রেখেছে।
আমি এমনকী খ্রিস্টীয় সভাতেও যোগদান করতে পারি। আমি যখন কিংডম হলে আসি, তখন আমার আধ্যাত্মিক ভাইয়েরা হুইলচেয়ার-সহ আমাকে এক তলা উঠিয়ে নিয়ে যায়। সভা চলাকালীন, যখন শ্রোতাদের উত্তর দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন আমার পাশে বসে থাকা ভাই আমার হয়ে হাত তোলেন। এরপর, আমি যখন উত্তর দিই, তখন তিনি আমার বাইবেল কিংবা অধ্যয়নের প্রকাশনাটা ধরে থাকেন।
আমি সবসময় যন্ত্রণা ভোগ করি এবং প্রায় সমস্তকিছুর জন্য অন্যদের ওপর নির্ভর করি। তাই, এখনও আমি আবেগগতভাবে কষ্ট পাই। কিন্তু, যিহোবা ঈশ্বরের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কারণে আমি সান্ত্বনা পাই কারণ আমি জানি যে, আমি যখন হৃদয় উজাড় করে আমার উদ্বেগগুলো তাঁকে জানাই, তখন তিনি তা শোনেন। আমি প্রতিদিন বাইবেল পড়া থেকে এবং আমার আধ্যাত্মিক ভাই-বোনদের কাছ থেকে শক্তি লাভ করি। তাদের বন্ধুত্ব, আবেগগত সাহায্য এবং আমার জন্য করা প্রার্থনার সাহায্যে আমি নিজের মানসিক এবং আবেগগত ভারসাম্য বজায় রাখতে পেরেছি।
যিহোবা আমাকে ঠিক সেই সময় সান্ত্বনা দিয়েছিলেন, যখন আমি অত্যন্ত নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম। এ ছাড়া, তিনি আমাকে নতুন জগতে নিখুঁত স্বাস্থ্য লাভ করার আশা প্রদান করেছেন। তাই, আমি সেই সময়ের জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করে রয়েছি, যখন আমি তাঁর অসাধারণ প্রেম এবং দয়ার জন্য ‘বেড়াইতে, লম্ফ দিতে, এবং ঈশ্বরের প্রশংসা করিতে’ পারব।—প্রেরিত ৩:৬-৯. ▪ (g১৪-E ১১)