যিহোবা আমার আশ্রয় ও বল
জীবন কাহিনী
যিহোবা আমার আশ্রয় ও বল
মার্সেল ফিলটো দ্বারা কথিত
“ওই লোককে বিয়ে করলে তোমাকে জেলে যেতে হবে।” আমি যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম তাকে লোকেরা এই কথা বলেছিল। আসুন আমি আপনাদের পুরো ঘটনাটা বলি যে কেন লোকেরা এমন কথা বলেছিল।
উনিশশো সাতাশ সালে যখন আমার জন্ম হয় তখন কানাডার কুইবেক ছিল গোঁড়া ক্যাথলিক এলাকা। প্রায় চার বছর পর, সিসিলি ডুফৌর নামে একজন যিহোবার সাক্ষি যিনি পূর্ণ সময়ের প্রচারিকা ছিলেন মনট্রিলে আমাদের বাড়িতে আসা শুরু করেছিলেন। এইজন্য আমাদের প্রতিবেশীরা তাকে অহরহ কথা শোনাত ও ভয় দেখাত। বাইবেলের কথা প্রচার করার কারণে তাকে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ও তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে আমরা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নিয়েছিলাম যীশুর এই কথাগুলো কত সত্যি: “আমার নাম প্রযুক্ত সমুদয় জাতি তোমাদিগকে দ্বেষ করিবে।”—মথি ২৪:৯.
সেই সময়ে অনেকে ভাবতেই পারত না যে একটা ফ্রেঞ্চ-কানাডীয় পরিবার তাদের ক্যাথলিক ধর্ম ছেড়ে দেবে। আমার বাবামা যদিও কখনও বাপ্তিস্ম নেননি, তবুও তারা অন্তত এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন যে ক্যাথলিক গির্জায় যা যা শেখানো হতো তা বাইবেলের শিক্ষা ছিল না। তাই তারা তাদের আট ছেলেমেয়েকে সবসময় সাক্ষিদের বইপত্র পড়ার জন্য বলতেন আর আমরা ভাইবোনদের মধ্যে যারাই বাইবেলের সত্যের পক্ষে কোন পদক্ষেপ নিয়েছি, বাবামা সবসময় আমাদের সাহায্য করেছেন।
কঠিন সময়েও বিশ্বাসে অটল থাকা
১৯৪২ সালে, তখনও আমি স্কুলে পড়ি আর সেই সময় থেকেই বাইবেলের প্রতি আমি সত্যি সত্যি আগ্রহী হয়ে উঠি। তখন কানাডায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজ নিষিদ্ধ ছিল কারণ তারা প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের মতো চলতেন ও যুদ্ধে অংশ নিতেন না। (যিশাইয় ২:৪; মথি ২৬:৫২) আমার বড়দা রোল্যান্ডকে শ্রমিকদের শিবিরে পাঠানো হয়েছিল কারণ সে বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধে যেতে চায়নি।
* এইসব পড়ে আমার সাহস বেড়ে গিয়েছিল আর আমিও তাদের একজন হতে চেয়েছিলাম, যারা বিশ্বস্ততা ও সাহস দেখানোর ব্যাপারে উদাহরণ ছিলেন। তাই আমি যিহোবার সাক্ষিদের সভায় যেতে শুরু করি, যা সেইসময় গোপনে কারও কারও বাড়িতে হতো। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাকে প্রচার করার জন্য ডাকা হয়। আমি ভাল করেই জানতাম যে এর জন্য আমাকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে আর এমনকি আমার জেলও হতে পারে, তবুও জেনেশুনেই আমি এই ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম।
প্রায় সেই সময়েই বাবা আমাকে ফ্রেঞ্চ ভাষায় একটা বই দিয়েছিলেন, যেখানে আ্যডল্ফ্ হিটলারের সামরিক অভিযানে যোগ দিতে অস্বীকার করায় জার্মান সাক্ষিদের ওপর যে নির্মম তাড়না করা হয়েছিল, সেই বিষয়ে লেখা ছিল।প্রচারে গিয়ে যিহোবার কাছে শক্তি চেয়ে প্রার্থনা করে আমি প্রথম ঘরে কড়া নাড়ি। একজন হাসিখুশি মহিলা দরজা খুলেছিলেন আর আমি তাকে নিজের পরিচয় দিই। তারপর আমি তাকে ২ তীমথিয় ৩:১৬ পদটা পড়ে শোনাই যেখানে লেখা আছে “ঈশ্বর-নিশ্বসিত প্রত্যেক শাস্ত্রলিপি . . . উপকারী।”
তারপর আমি জিজ্ঞেস করি, “আপনি কি বাইবেলের বিষয়ে আরও বেশি কিছু জানতে চান?”
“নিশ্চয়ই,” সেই মহিলা উত্তর দিয়েছিলেন।
তাই আমি তাকে বলেছিলাম যে আমার চেয়েও ভাল বাইবেল জানেন এমন কাউকে আমি তার কাছে নিয়ে আসব আর পরের সপ্তাতেই আমি তার কাছে ফিরে গিয়েছিলাম। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতার পর আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গিয়েছিল আর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমরা আমাদের নিজেদের শক্তিতে প্রচার কাজ করি না। প্রেরিত পৌল যেমন বলেছিলেন, আমরা সত্যিই যিহোবার সাহায্যে প্রচার কাজ করি। আর আমরা বুঝি যে “পরাক্রমের উৎকর্ষ ঈশ্বরের হয়, আমাদের হইতে নয়।”—২ করিন্থীয় ৪:৭.
এরপর থেকে আমি রোজ প্রচারে যেতাম ফলে প্রচার করার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া ও জেলে যাওয়াও আমার নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে আমার ভাবী স্ত্রীকে বলা হয়েছিল, “ওই লোককে বিয়ে করলে তোমাকে জেলে যেতে হবে”! কিন্তু তবুও সেই সময়গুলো আসলে ততটা কঠিন ছিল না। কারণ একরাত জেলে কাটানোর পর কোন না কোন সাক্ষি ভাই আমাদের জামিনে ছাড়িয়ে আনতেন।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত
১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে আমি নিজেকে যিহোবার কাছে উৎসর্গ করি ও তা দেখানোর জন্য জলে বাপ্তিস্ম নিই। এরপর, ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে আমি প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের বাফেলোতে বড় সম্মেলনে যোগ দিই, যা ঠিক কানাডার সীমান্তের কাছেই ছিল। সেখানে প্রায় ২৫,০০০ জন এসেছিলেন আর সেই সম্মেলনের বক্তৃতা শুনে আমার মনে অগ্রগামী হওয়ার ইচ্ছা জাগে, যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণ-সময়ের পরিচারকদের অগ্রগামী বলা হয়। ১৯৪৫ সালের মে মাসে কানাডায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় আর আমি এর পরের মাস থেকে অগ্রগামীর কাজ শুরু করি।
কিন্তু, আমি যত বেশি করে প্রচার করতে শুরু করি তত বেশি আমাকে জেলে যেতে হয়েছিল। একবার আমাকে জেলে গালাতীয় ৫:১৫.
ভাই মিক মিলারের সঙ্গে একই ঘরে রাখা হয়েছিল, যিনি অনেক বছর ধরে যিহোবার সেবা করছিলেন। আমরা পাকা মেঝেতে বসে কথাবার্তা বলতাম। আমাদের বিশ্বাস বাড়ানোর মতো কথাবার্তা থেকে আমি অনেক সাহস ও শক্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু, এরপর আমার মনে একটা প্রশ্ন আসে, ‘আমাদের মধ্যে যদি আগে কোন ভুলবোঝাবুঝি হতো আর আমরা যদি কথা বলা বন্ধ করে দিতাম, তাহলে এখন কী হতো?’ এই ভাইয়ের সঙ্গে জেলে থেকে আমি খুব বড় একটা বিষয় শিখেছিলাম যে আমাদের ভাইবোনদের আমাদের দরকার আছে আর তাই একজন আরেকজনের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করা ও একজন অন্যজনকে ক্ষমা করে দেওয়া দরকার। তা না হলে, ফল এইরকম হবে যেমন প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “তোমরা যদি পরস্পর দংশাদংশি ও গেলাগেলি কর, তবে দেখিও, যেন পরস্পরের দ্বারা কবলিত না হও।”—১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে কানাডার টরেন্টোতে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির শাখা অফিসে কাজ করার জন্য ডাকা হয় যাকে আমরা বেথেল বলি। সেখানকার আধ্যাত্মিক কার্যক্রম থেকে সত্যিই আমাদের সাহস বাড়ে ও বিশ্বাস শক্তিশালী হয়। পরের বছর আমাকে বেথেলের খামারে কাজ করতে বলা হয়, যা শাখা অফিস থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে ছিল। সেই সময়ে আমি আ্যন ওল্নেকের সঙ্গে স্ট্রবেরি বাছাই করার কাজ করতাম। আর আ্যনকে আমার ভাল লাগে কিন্তু আমি কেবল আ্যনের বাইরের সৌন্দর্যই দেখিনি, যিহোবার জন্য তার ভালবাসা এবং উদ্যোগ আমি দেখেছিলাম। আমাদের দুজনের মধ্যে ভালবাসা গড়ে ওঠে আর ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা বিয়ে করি।
পরের আড়াই বছর আমরা লন্ডনের ওন্টারিও এবং এরপর কেপ ব্রিটন আইল্যান্ডে অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম এবং কেপ ব্রিটনে আমরা একটা মণ্ডলী গড়ে তুলতেও সাহায্য করেছিলাম। এরপর, ১৯৪৯ সালে আমাদেরকে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ১৪তম ক্লাসের জন্য ডাকা হয়েছিল আর সেখানে আমাদেরকে মিশনারি হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
কুইবেকে মিশনারি কাজ
আগের গিলিয়েড ক্লাসে কানাডার যে ভাইবোনেরা গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন তাদেরকে কুইবেকে প্রচার করার জন্য পাঠানো হয়েছিল। ১৯৫০ সালে ১৪তম ক্লাসের আমরা দুজন ও আরও ২৫ জন ওখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। মিশনারিদের কাজ বেড়ে যাওয়ায় রোমান ক্যাথলিক গির্জার পাদ্রিরা লোকেদের উস্কে দিয়েছিল আর আমাদের ওপর তাড়না ও লোকেদের খারাপ ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে গিয়েছিল।
আমাদের প্রথম মিশনারি কাজ ছিল রুন শহরে আর সেখানে আসার দুদিন পরই আ্যনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হয়েছিল। আ্যনের জন্য এটা ছিল একেবারে নতুন ঘটনা, কারণ সে কানাডার মানিটোবা প্রদেশের একটা ছোট্ট গ্রামে থাকত, যেখানে পুলিশ বলতে গেলে দেখাই যেত না। স্বাভাবিকভাবেই সে খুব ভয় পেয়ে যায় আর তার ওই কথাগুলো মনে পড়ে যায়, “ওই লোককে বিয়ে করলে তোমাকে জেলে যেতে হবে।” কিন্তু, গাড়ি ছাড়ার আগে পুলিশ আমাকে দেখে ফেলে এবং আমাকেও গাড়িতে উঠিয়ে আ্যনের পাশে বসায়। “তোমাকে দেখে আমার ভীষণ ভাল লাগছে!” সে জোরে বলে ওঠে। কিন্তু তবুও সে খুবই শান্তভাবে বসেছিল আর বলেছিল, “যীশুর বিষয়ে প্রচার করতে গিয়ে প্রেরিতদেরও তো এমনই হয়েছিল।” (প্রেরিত ৪:১-৩; ৫:১৭, ১৮) সেই দিনই কিছু সময় পরে আমরা জামিনে ছাড়া পেয়েছিলাম।
ওই ঘটনার প্রায় এক বছর পর, আমাদের নতুন কাজের জায়গা মনট্রিলে একদিন ঘরে ঘরে প্রচার করছিলাম আর তখন আমি রাস্তার অন্য দিক থেকে প্রচণ্ড হইচই শুনতে পাই ও দেখি যে হিংস্র জনতা পাথর ছুঁড়ছে। আমি যখন আ্যন ও তার সঙ্গীকে বাঁচানোর জন্য ছুটে যাই তখন সেখানে পুলিশ এসে পড়ে। সেই উদ্ধত জনতাকে গ্রেপ্তার করার বদলে পুলিশ আ্যন ও তার সঙ্গীকে গ্রেপ্তার করে! জেলে বসে আ্যন ওই নতুন সাক্ষিকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে তারা যীশুর এই কথাগুলোকে সত্যি হতে দেখছেন: “আমার নাম প্রযুক্ত তোমরা সকলের ঘৃণিত হইবে।”—মথি ১০:২২.
এক সময় কুইবেকে যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৭০০ মামলা অমীমাংসিত অবস্থায় ছিল। সাধারণত আমাদেরকে দেশদ্রোহী বইপত্র বা লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে বইপত্র বিতরণের দোষে দোষী করা হতো। ফলে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির আইন বিভাগ কুইবেক সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে। অনেক বছর ধরে মামলা চলার পর যিহোবা আমাদেরকে কানাডার সুপ্রিম কোর্টে দুটো বড় বড় জয় এনে দেন। ১৯৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের ওপর থেকে দেশদ্রোহী বইপত্র বিতরণের দোষ তুলে নেওয়া হয়েছিল আর ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে লাইসেন্স ছাড়াই বাইবেল ভিত্তিক বইপত্র বিতরণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এভাবে আমরা সবসময় দেখেছিলাম যে যিহোবা সত্যিই আমাদের পক্ষে “আশ্রয় ও বল। তিনি সঙ্কটকালে অতি সুপ্রাপ্য সহায়।”—গীতসংহিতা ৪৬:১.
যিশাইয় ৫৪:১৭.
কুইবেকে ১৯৪৫ সালে যখন আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করি তখন সেখানে মাত্র ৩৫৬ জন সাক্ষি ছিলেন আর আজ সেই সংখ্যা বেড়ে ২৪,০০০ জনকেও ছাড়িয়ে গেছে! ঠিক সেইরকমই হয়েছে যেমন বাইবেলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল: “যে কোন অস্ত্র তোমার বিপরীতে গঠিত হয়, তাহা সার্থক হইবে না; যে কোন জিহ্বা বিচারে তোমার প্রতিবাদিনী হয়, তাহাকে তুমি দোষী করিবে।”—ফ্রান্সে আমাদের কাজ
১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আ্যন ও আমাকে ফ্রান্সের প্যারিসে বেথেলে কাজ করার জন্য ডাকা হয় আর আমাকে সেখানে ছাপাখানার কাজ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬০ সালের জানুয়ারি মাসে আমরা সেখানে যাই। তার আগে পর্যন্ত বাণিজ্যিক ছাপাখানায় বই-পত্রিকা ছাপানো হতো। যেহেতু ফ্রান্সে প্রহরীদুর্গ ছাপানো নিষেধ ছিল তাই আমরা এই পত্রিকাকে ৬৪ পৃষ্ঠার একটা পুস্তিকার আকারে প্রত্যেক মাসে ছাপাতাম। ওই পুস্তিকার নাম ছিল যিহোবার সাক্ষিদের ভিতরের খবর আর এতে পুরো মাসের জন্য মণ্ডলীতে অধ্যয়ন করার প্রবন্ধগুলো ছাপানো হতো। ১৯৬০ সালে ফ্রান্সে যেখানে প্রচারকদের সংখ্যা ছিল ১৫,৪৩৯ জন, ১৯৬৭ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে ২৬,২৫০ জন হয়।
পরে, বেশির ভাগ মিশনারিদের আলাদা আলাদা জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কাউকে কাউকে আফ্রিকার ফ্রেঞ্চ-ভাষী দেশগুলোতে ও অন্যান্যদের আবারও কুইবেকে পাঠানো হয়। আ্যনের শরীর তখন খুব একটা ভাল যাচ্ছিল না আর তার অপারেশন করার দরকার ছিল, তাই আমরা কুইবেকে ফিরে গিয়েছিলাম। তিন বছর চিকিৎসার পর, আ্যন সুস্থ হয়ে ওঠে। এরপর আমাকে সীমার কাজ দেওয়া হয়, প্রত্যেক সপ্তাহে বিভিন্ন মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করে সেগুলোকে আধ্যাত্মিকভাবে সাহায্য করা ছিল আমার কাজ।
আফ্রিকায় মিশনারি কাজ
কয়েক বছর পর, ১৯৮১ সালে আমাদের মিশনারি করে জাইরে পাঠানো হয়েছিল যেটা এখন কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র আর এতে আমরা খুব খুশি হয়েছিলাম। এখানকার লোকেরা ছিল খুবই গরিব আর তারা অনেক কষ্ট সহ্য করত। আমরা যখন সেখানে গিয়েছিলাম তখন সেখানে ২৫,৭৫৩ জন সাক্ষি ছিলেন কিন্তু আজকে সেই সংখ্যা বেড়ে ১,১৩,০০০ জন হয়েছে আর ১৯৯৯ সালে খ্রীষ্টের মৃত্যুর স্মরণার্থক সভায় ৪,৪৬,৩৬২ জন এসেছিলেন!
১৯৮৪ সালে আমরা সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৫০০ একর জমি পেয়েছিলাম যেখানে আমরা নতুন শাখা অফিস বানাতে চেয়েছিলাম। তারপর, ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজধানী শহর কিনশাসায় একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়েছিল আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩২,০০০ জন প্রতিনিধি এখানে এসেছিলেন। এরপরে পাদ্রিদের উস্কানিতে ও বিরোধিতায় জাইরে আমাদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৬ সালের ১২ই মার্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের কাছে একটা চিঠি আসে যেখানে এই কথা বলা হয়েছিল যে জাইরে যিহোবার সাক্ষিদের সংগঠন বেআইনী। আমাদের কাজের ওপর এই নিষেধাজ্ঞায় তখনকার প্রেসিডেন্ট প্রয়াত মোবুটু সেসে সিকো স্বাক্ষর করেছিলেন।
এই সমস্তকিছু হঠাৎ করে হয়েছিল আর তাই আমাদেরকে বাইবেলের এই উপদেশ কাজে লাগাতে হয়েছিল: “সতর্ক লোক বিপদ দেখিয়া আপনাকে লুকায়।” (হিতোপদেশ ২২:৩) কিনশাসায় আমাদের প্রকাশনাগুলো ছাপানোর জন্য আমরা বিদেশ থেকে কাগজ, কালি, ফিল্ম, ছাপার চাকতি এবং রাসায়নিক দ্রব্য আনার পথ খুঁজে বের করেছিলাম। এছাড়া সেগুলো বিতরণ করার রাস্তাও আমরা বের করে নিয়েছিলাম। সংগঠিত হয়ে যাওয়ার পর, আমাদের এই ব্যবস্থা সরকারি ডাক ব্যবস্থার চেয়ে ভালভাবে কাজ করছিল!
হাজার হাজার সাক্ষিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আর অনেকের ওপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছিল। কিন্তু, মাত্র অল্প কয়েকজন ছাড়া বেশির ভাগ সাক্ষিই তাদের বিশ্বস্ততা বজায় রেখেছিলেন আর এই তাড়না সহ্য করেছিলেন। আমাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং জেলে ভাইয়েরা কেমন ভয়ানক অবস্থার মধ্যে ছিলেন তা আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম। অনেক বার গুপ্ত পুলিশ ও কর্তৃপক্ষেরা আমাদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেছিল কিন্তু যিহোবা সবসময়ই আমাদের জন্য কোন না কোন পথ করে দিয়েছিলেন।—২ করিন্থীয় ৪:৮.
আমরা একজন ব্যবসায়ীর গুদামে প্রায় ৩,০০০ বাক্স বইপত্র লুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তারই একজন কর্মী গুপ্ত পুলিশকে খবর দিয়ে দিয়েছিল আর পুলিশ ওই ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছিল। তাকে জেলে নিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই তারা রাস্তায় আমাকে দেখতে পায় কারণ আমি আমার গাড়ি করে ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিলাম। ব্যবসায়ী তাদেরকে বলে দিয়েছিলেন যে আমিই তার কাছে বইপত্র লুকিয়ে রাখার সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলাম। পুলিশ গাড়ি থামায় আর এই ব্যাপারে আমাকে জেরা করতে শুরু করে, তারা আমার ওপর এই ব্যক্তির গুদামে অবৈধ বইপত্র রাখার দোষ দেয়।
আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, “আপনাদের কাছে কি সেগুলোর মধ্যে থেকে কোন বই আছে?”
তারা উত্তর দেয়, “আছে।”
আমি বলি “আমি কি সেটা একবার দেখতে পারি?”
তারা আমাকে একটা বই দেয় আর আমি তাদেরকে ভিতরের পৃষ্ঠাটা খুলে দেখাই যেখানে লেখা আছে: “ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির দ্বারা আমেরিকায় মুদ্রিত।”
আমি তাদেরকে বলেছিলাম, ‘আপনাদের হাতে যে বইগুলো আছে সেগুলো আমেরিকার সম্পত্তি, জাইরের নয়। আপনাদের সরকার জাইরে যিহোবার সাক্ষিদের বৈধ সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির ওপর নয়। তাই এই প্রকাশনাগুলোর ব্যাপারে আপনারা যা করবেন তা একটু বুঝেশুনে করবেন।’
আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল কারণ আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য আদালতের কোন আদেশ তাদের কাছে ছিল না। সেই রাতেই আমরা দুটো ট্রাক নিয়ে ওই গুদামে যাই এবং সব বইপত্র নিয়ে আসি। পরের দিন কর্তৃপক্ষ এসে সেখানে কিছুই দেখতে না পেয়ে খুবই রেগে যান। এই সময়ের মধ্যে তারা আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য আদালতের আদেশ পেয়ে যায় আর তাই তারা আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। তারা আমাকে খুঁজে পায় কিন্তু তাদের কাছে কোন গাড়ি ছিল না বলে আমি নিজেই গাড়ি চালিয়ে জেলে গিয়েছিলাম! আরেকজন সাক্ষি ভাই আমার সঙ্গে এসেছিলেন যাতে পুলিশ আমার গাড়ি বাজেয়াপ্ত করার আগেই তিনি আমার গাড়ি নিয়ে ফিরে আসতে পারেন।
আট ঘন্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা আমাকে সেই দেশ থেকে বের করে দেবে বলে ঠিক করে। কিন্তু আমি তাদেরকে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া চিঠির একটা কপি দেখাই যেখানে লেখা ছিল যে জাইরে যিহোবার সাক্ষিদের নিষিদ্ধ সংগঠনের সম্পত্তি বেচার অনুমতি সরকার আমাকে দিয়েছে। ফলে আমাকে বেথেলে কাজ করে চলার অনুমতি দেওয়া হয়।
জাইরে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে চার বছর কাজ করার পর আমার মারাত্মক আলসার হয়। আমাকে চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আর সেখানকার শাখা অফিস খুব যত্ন নিয়ে আমার দেখাশোনা করে আর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। জাইরে আমরা আট বছর কাজ করেছিলাম আর সেটা আমাদের জন্য খুবই আনন্দের সময় ছিল। ১৯৮৯ সালে আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা শাখায় চলে গিয়েছিলাম। ১৯৯৮ সালে আমরা আমাদের নিজেদের দেশে ফিরে আসি আর সেইসময় থেকেই এখনও পর্যন্ত কানাডা বেথেলে কাজ করছি।
সেবা করতে পেরে কৃতজ্ঞ
আমি ৫৪ বছর ধরে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা করেছি আর যখন আমি সেই সময়ের কথা চিন্তা করি তখন আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে যে আমি আমার যৌবনকে যিহোবার মূল্যবান পরিচর্যায় ব্যবহার করতে পেরেছি। যদিও আ্যনকে অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিন্তু তবুও সে কখনও কোন রকম অভিযোগ করেনি বরং সবসময় আমার সব কাজে পাশে পাশে থেকেছে। অনেক লোকেদের যিহোবাকে জানতে সাহায্য করার সুযোগ আমরা দুজনে পেয়েছি, এদের মধ্যে অনেকেই এখন পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ করছে। তাদের ছেলেমেয়েদের, এমনকি নাতি-নাতনিদের পর্যন্ত আমাদের মহান ঈশ্বর যিহোবাকে সেবা করতে দেখা কতই না আনন্দের বিষয়!
আমি জানি যে যিহোবা আমাদেরকে যে সুযোগ ও আশীর্বাদ দিয়েছেন তার সঙ্গে এই জগৎ আমাকে যা দিতে পারে তার কোন তুলনা হয় না। এই কথা ঠিক যে আমরা অনেক পরীক্ষা সহ্য করেছি কিন্তু সেগুলো যিহোবার ওপর আমাদের বিশ্বাস ও আস্থা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সত্যিই তিনি এক দৃঢ় দুর্গ, আশ্রয় এবং সাহায্য করার জন্য সবসময় তৈরি।
[পাদটীকাগুলো]
^ বইটা প্রথমে জার্মান ভাষায় ছাপা হয়েছিল, জার্মান ভাষায় এর নাম হল ক্রিউজাগ গেগেন ডাস্ ক্রিসটেনটাম (খ্রীষ্টতত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)। এই বইটা শুধু ফ্রেঞ্চ ও পোলিশ ভাষায় ছাপানো হয়েছিল কিন্তু ইংরেজিতে হয়নি।
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১৯৪৭ সালে একসঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করার সময়; আজকে আ্যনের সঙ্গে
[২৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
জাইরের লোকেরা বাইবেলের সত্যকে ভালবেসেছিল