সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সম্মান করা—এক খ্রীষ্টীয় দায়িত্ব

সম্মান করা—এক খ্রীষ্টীয় দায়িত্ব

সম্মান করা—এক খ্রীষ্টীয় দায়িত্ব

 কাউকে সম্মান করার মানে হল সেই ব্যক্তিকে মনে বিশেষ জায়গা দেওয়া, তার যোগ্যতা, গুণ, সাফল্য, কাজ ও পদকে শ্রদ্ধা করা। মূল যে ভাষাগুলোয় বাইবেল লেখা হয়েছিল সেই ভাষাগুলোতেও সম্মান শব্দের মানে এইরকমই ছিল যেমন কাউকে সমীহ করা বা তাকে অখুশি করতে ভয় পাওয়া। বাইবেলে খ্রীষ্টানদের খুব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে তারা যেন অন্যদেরকে সম্মান করেন। কিন্তু কাকে তাদের সম্মান করতে হবে?

যিহোবাকে সম্মান করা

যিহোবা ঈশ্বর সারা পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা আর তাই তিনিই সবচেয়ে বেশি সম্মান পাওয়ার যোগ্য। সমস্ত মানুষের তাঁকে হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা করা উচিত। (প্রকাশিত বাক্য ৪:১১) যিহোবাকে সম্মান করার জন্য তাঁর বাধ্য হওয়া দরকার। আর এই বাধ্যতা তাঁর প্রতি ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতার কারণে আসা দরকার কারণ তিনি আমাদের জন্য অনেক ভাল কাজ করেছেন। (১ যোহন ৫:৩) “আমি যদি পিতা হই, তবে আমার সমাদর কোথায়? আর আমি যদি প্রভু হই, তবে আমার প্রতি ভয় কোথায়?” যিহোবা ইস্রায়েল জাতিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। এটা দেখায় যে যিহোবাকে সম্মান করার মানে হল তাঁকে অখুশি করার ভয় রাখা।—মালাখি ১:৬.

মহাযাজক এলির দুই ছেলে হফ্‌নি ও পীনহসের মধ্যে ঈশ্বরকে অখুশি করার ভয় ছিল না। তাদের মহান প্রভু যিহোবার অবাধ্য হয়ে তারা তাঁর উপাসনার তাঁবু থেকে তাঁর প্রতি করা সমস্ত উৎসর্গের সবচেয়ে ভাল অংশটা নিয়ে নিত। আর এটা করে তারা যিহোবাকে অসম্মান করেছিল কারণ যে বস্তুতে শুধু যিহোবার অধিকার, অন্যেরা তাকে নিজের বলে মনে করলে তা পবিত্র বস্তুকে অসম্মান করা বোঝায়। আর এলি তার ছেলেদেরকে শুধরানোর জন্য কোন পদক্ষেপ না নিয়ে যিহোবাকে অসম্মান করেছিলেন কারণ তিনি যিহোবার চেয়ে তার ছেলেদের বেশি সম্মান দিয়েছিলেন। যিহোবাকে সম্মান দেখাতে না পারায় এলির পরিবারকে চরম দুঃখ ভোগ করতে হয়েছিল।—১ শমূয়েল ২:১২-১৭, ২৭-২৯; ৪:১১, ১৮-২১.

যিহোবার বাধ্য হয়ে আর তাকে অখুশি করতে ভয় পেয়ে আমরা তাঁকে সম্মান করি। কিন্তু যিহোবাকে সম্মান করার আরেকটা উপায়ও আছে আর তা হল আমাদের নিজেদের সম্পদ দিয়ে তাঁর সম্মান করা। হিতোপদেশ ৩:৯ পদে আমরা পড়ি: “তুমি সদাপ্রভুর সম্মান কর আপনার ধনে।” একজন ব্যক্তি তার সময়, শক্তি এবং সম্পদ দিয়ে যিহোবার উপাসনা করতে পারেন।

প্রাচীনকালের এবং আজকের ঈশ্বরের ব্যবহৃত লোকেদের সম্মান করা

প্রাচীনকালে যিহোবার ভাববাদীরা যিহোবার হয়ে কথা বলতেন আর তাই তারা সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিলেন। কিন্তু ইস্রায়েলীয়রা, ভাববাদীদের সম্মান করার বদলে প্রায়ই তাদের গালিগালাজ করেছিল, মারধোর করেছিল এমনকি তাদের কিছুজনকে মেরেও ফেলেছিল। শেষে তারা ঈশ্বরের পুত্রকে পর্যন্ত হত্যা করেছিল। যীশু বলেছিলেন: “পুত্ত্রকে যে সমাদর করে না, সে পিতাকে সমাদের করে না, যিনি তাঁহাকে পাঠাইয়াছেন।” (যোহন ৫:২৩) আর এইভাবে চরম অসম্মান করায় এই অবিশ্বস্ত লোকেদের ওপর যিহোবা এতই ক্রোধী হয়েছিলেন যে তিনি সা.কা. ৭০ সালে যিরূশালেমকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।—মার্ক ১২:১-৯.

প্রথম শতাব্দীর মণ্ডলীতে কিছু লোকেদের শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। মণ্ডলীর সমস্ত লোকেদেরকে এই দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইদের সমর্থন এবং সম্মান করতে হতো। (ইব্রীয় ১৩:৭, ১৭) প্রেরিত পৌল তীমথিয়কে লিখেছিলেন যে এই অধ্যক্ষরা “দ্বিগুণ সমাদরের যোগ্য।” তাদের দ্বিগুণ সমাদর করার মানে এটাও বোঝাত যে সম্পদ দিয়ে তাদের সম্মান করা কারণ তারা মণ্ডলীর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতেন। (১ তীমথিয় ৫:১৭, ১৮) খ্রীষ্টানদের একে অন্যকেও সম্মান করা উচিত। পৌল পরামর্শ দিয়েছিলেন: “সমাদরে এক জন অন্যকে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান কর।” (রোমীয় ১২:১০) প্রত্যেক খ্রীষ্টান নিজে সবচেয়ে বেশি করে জানেন যে তার মধ্যে কোন দুর্বলতাগুলো আছে যা মণ্ডলীর অন্য ভাইবোনেরা হয়তো তত ভাল করে জানেন না। তাই তাদের সবসময়ই অন্যদেরকে নিজেদের আগে রাখা, তাদেরকে শ্রদ্ধা করা ও সম্মান করা দরকার।—ফিলিপীয় ২:১-৪.

পরিবারের সদস্যদের একে অন্যকে সম্মান করা

স্বামীকে গভীর সম্মান করা একজন স্ত্রীর দায়িত্ব কারণ স্বামী পরিবারের মস্তক। (ইফিষীয় ৫:৩৩) আর পুরুষকে এই অধিকার যিহোবা দিয়েছেন। প্রথমে নারীকে নয় কিন্তু পুরুষকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং তিনি হলেন “ঈশ্বরের প্রতিমূর্ত্তি ও গৌরব।” (১ করিন্থীয় ১১:৭-৯; ১ তীমথিয় ২:১১-১৩) স্বামীকে গভীর সম্মান করার ব্যাপারে সারা হলেন এক ভাল উদাহরণ। তিনি তার স্বামীকে হৃদয় থেকে গভীর সম্মান করতেন কারণ তিনি তার স্বামীকে “নাথ” বলে ডাকতেন আর তা তিনি শুধু অন্যদের দেখিয়েই যে করতেন তা নয় কিন্তু ‘মনে মনেও’ তিনি তাকে সেভাবেই দেখতেন।—১ পিতর ৩:১, ২, ৫, ৬; আদিপুস্তক ১৮:১২.

অন্যদিকে স্বামীদেরকেও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে: “অপেক্ষাকৃত দুর্ব্বল পাত্র বলিয়া [তোমাদের স্ত্রীদের] সহিত জ্ঞানপূর্ব্বক বাস কর, তাহাদিগকে আপনাদের সহিত জীবনের অনুগ্রহের সহাধিকারিণী জানিয়া সমাদর কর।” (১ পিতর ৩:৭) পিতর এই কথাগুলো অভিষিক্ত পুরুষদের বলেছিলেন। তাদের এই কথাগুলো মনে রাখতে হতো যে তাদের মতো তাদের স্ত্রীরাও যীশুর সঙ্গে রাজত্ব করবেন। আর সেইসঙ্গে তাদের এটাও ভোলা উচিত ছিল না যে স্ত্রীরা পুরুষদের চেয়ে দুর্বল আর তাই স্ত্রীদের সঙ্গে তাদের ভাল ও সম্মানের সঙ্গে ব্যবহার করা উচিত।—গালাতীয় ৩:২৮.

ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দেওয়া, শাসন করা এবং ঠিক রাস্তায় চালানোর দায়িত্ব যিহোবা বাবামায়েদের দিয়েছিলেন। তাই বাবামায়েরা তাদের ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে সম্মান পাওয়ার যোগ্য। (ইফিষীয় ৬:১-৩) এর মানে এই নয় যে ছেলেমেয়েরা শুধু ছোটবেলাতেই তাদের বাবামায়ের বাধ্য থাকবে এবং সম্মান করবে। কিন্তু বড় হয়েও তারা তাদের বুড়ো বাবামায়ের দেখাশোনা করে তাদের সম্মান করবে। প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীতে কেউ যদি তাদের বয়স্ক ও অভাবী বাবামার দেখাশোনা না করত, তাহলে তাদেরকে অবিশ্বাসীদের চেয়েও অধম বলে মনে করা হতো। (১ তীমথিয় ৫:৮) প্রেরিত পৌল তীমথিয়কে লিখেছিলেন যে, যদি কোন বিধবার ছেলেমেয়ে অথবা নাতি-নাতনি থাকে আর তাদের যদি বস্তুগত সাহায্য দিয়ে দেখাশোনা করার ক্ষমতা থাকে, তাহলে তারা তাদের দেখাশোনা করবে। মণ্ডলীর তাদের দেখাশোনার ভার নেওয়ার দরকার নেই।—১ তীমথিয় ৫:৪.

কর্তৃপক্ষ এবং মণ্ডলীর বাইরের লোকেদের সম্মান করা

উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্তৃপক্ষরা শ্রদ্ধা অথবা সম্মান পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু একজন খ্রীষ্টান কোন কিছু পাওয়ার জন্য এই সম্মান দেখান না বরং এটা ঈশ্বরের আজ্ঞা বলে দেখান। এই লোকেরা হয়তো সৎ নাও হতে পারেন। (প্রেরিত ২৪:২৪-২৭ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) কিন্তু তবুও খ্রীষ্টানেরা তাদেরকে তাদের দায়িত্বপূর্ণ পদের জন্য সম্মান করেন। (রোমীয় ১৩:১, ২, ৭; ১ পিতর ২:১৩, ১৪) একইভাবে দাসেদেরও আজ্ঞা দেওয়া হয়েছে যে তারা যেন তাদের মনিবদের গভীর সম্মান করে। দাসেদের তাদের নিজেদের কাজ দায়িত্বের সঙ্গে করা দরকার যাতে ঈশ্বরের নামের নিন্দা না হয়।—১ তীমথিয় ৬:১.

যখন কোন ব্যক্তি খ্রীষ্টানদেরকে তাদের আশার কারণ জিজ্ঞাসা করেন তখন তারা “মৃদুতা ও ভয় সহকারে” উত্তর দেন। হতে পারে যে লোকেরা হয়তো অপমানকর প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন কিন্তু তবুও খ্রীষ্টানেরা রেগে গিয়ে বা বিরক্ত হয়ে উত্তর না দিয়ে শান্তভাবে তাদেরকে যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেন। এর মানে এই নয় যে তারা লোকেদের ভয় করেন বরং তারা লোকেদের সম্মান করেন আর তারা মনে রাখেন যে তারা যেন যিহোবা এবং প্রভু যীশু খ্রীষ্টের সামনে রয়েছেন।—১ পিতর ৩:১৪, ১৫.

সম্মান করার পুরস্কার

যারা ঈশ্বরকে সম্মান করেন তিনিও তাদেরকে সম্মান করেন। আর তিনি তাদের আশীর্বাদ ও পুরস্কার দেন। তিনি বলেন: “যাহারা আমাকে গৌরবান্বিত করে, তাহাদিগকে আমি গৌরবান্বিত করিব।” (১ শমূয়েল ২:৩০) উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাজা দায়ূদ বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করেছিলেন এবং শুধু তার মূল্যবান বস্তুই নয় কিন্তু তার সমস্ত জীবন ও শক্তি দিয়ে তিনি সত্য উপাসনা করেছিলেন, যিহোবার গৌরব করেছিলেন। যিহোবাও দায়ূদের বিশ্বস্ত কাজকে সম্মান করেছিলেন। তিনি দায়ূদের সঙ্গে রাজ্যের চুক্তি করে তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন।—২ শমূয়েল ৭:১-১৬.

আজকে খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীকে দেখাশোনা করার জন্য যিহোবা কিছু লোকেদের দায়িত্ব দিয়েছেন আর তারা প্রেমের সঙ্গে এই কাজ করেন। যারা এই অধ্যক্ষদের সম্মান করেন তারা অনেক আশীর্বাদ পান। তারা এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে এই অধ্যক্ষরা তাদের জন্য ‘আনন্দপূর্ব্বক নিকাশ দেবেন।’ (ইব্রীয় ১৩:১৭) যে সব বিধবারা বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করেন তাদের মণ্ডলীর ভাইবোনেরা সম্মান করেন আর দরকার পড়লে তারা তাদেরকে সাহায্য করেন ও তাদের দেখাশোনা করেন। (১ তীমথিয় ৫:৩, ৯, ১০) যে স্বামী স্ত্রীরা একে অন্যকে সম্মান করেন তারা বিবাহিত জীবনে সুখী হন এবং যে ছেলেমেয়েরা বাবামাকে সম্মান করে তারা ঈশ্বর এবং মানুষের কাছ থেকে সুনাম পায়। (লূক ২:৫১, ৫২) যখন খ্রীষ্টানেরা সরকারি কর্ত্তৃপক্ষ এমনকি বিরোধিদেরও সম্মান করেন, তখন তাদের বিবেক পরিষ্কার থাকে আর তা যিহোবার নামের জন্য সম্মান নিয়ে আসে। সব চেয়ে বড় কথা হল যে যারা তাদের মহান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা এবং উদ্দেশ্যর প্রতি গভীর সম্মান দেখান তারা এক সুন্দর পৃথিবীতে চিরকাল যিহোবার সেবা করে চলতে পারবেন।