সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

সিরিল লুকারিস—যিনি বাইবেলকে শ্রদ্ধা করতেন

সিরিল লুকারিস—যিনি বাইবেলকে শ্রদ্ধা করতেন

সিরিল লুকারিসযিনি বাইবেলকে শ্রদ্ধা করতেন

সময়টা ছিল ১৬৩৮ সাল। গরমের এক দিন। অটোম্যান সাম্রাজ্যের রাজধানী, কনস্টানটিনপোলের (আজকে ইস্তানবুল) কাছে মার্মারা সাগরে জেলেরা হঠাৎ করে একটা মৃতদেহ ভেসে উঠতে দেখে। মৃতদেহকে কাছ থেকে দেখে তারা চমকে ওঠে, ভয়ে শিউরে ওঠে। এ যে কনস্টানটিনপোলের অর্থোডক্স গির্জার, প্রধান বিশপের মৃতদেহ। সপ্তদশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত ধর্মীয় নেতা সিরিল লুকারিসের জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গিয়েছিল।

 লুকারিসের স্বপ্ন ছিল যে তিনি চলিত গ্রিক ভাষায় খ্রীষ্টান গ্রিক শাস্ত্রের অনুবাদ প্রকাশ করবেন। কিন্তু তার এই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই তাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়। লুকারিসের আরেকটা স্বপ্নও ছিল যা আজও সত্যি হয়নি আর তা হল অর্থোডক্স গির্জায় “বাইবেলের সত্য” শেখানো। লুকারিস আসলে কে ছিলেন? তার স্বপ্নকে সত্যি করতে গিয়ে তাকে কোন্‌ বাধাগুলোর মুখোমুখি হতে হয়েছিল?

অশিক্ষার কারণে শঙ্কা

সিরিল লুকারিস ১৫৭২ সালে ক্রিটের ক্যানডিয়ায় (এখন ইরাক্লিয়ন) জন্মগ্রহণ করেছিলেন যা সেই সময় ইতালির ভেনিসের অধিকারে ছিল। মেধাবী হওয়ায় তিনি ইতালির ভেনিস ও পাদুয়া শহরে লেখাপড়া করেছিলেন এবং পরে ইতালি ও আরও অন্যান্য জায়গায় গিয়েছিলেন। গির্জার লোকেদের মধ্যে গণ্ডগোল দেখে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন আর ইউরোপে যে ধর্মসংস্কার চলছিল তা তাকে টেনেছিল বলে তিনি জেনেভাতে চলে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে জেনেভাতে ক্যালভিনের মতবাদ বেশ ভালরকম ছড়িয়ে পড়েছিল।

পোল্যান্ডে গিয়ে লুকারিস দেখেছিলেন যে সেখানকার অর্থোডক্স গির্জার পাদ্রি ও সেইসঙ্গে সাধারণ লোকেদের আধ্যাত্মিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল, কারণ তারা একেবারেই বাইবেল জানত না। আলেকজান্দ্রিয়া এবং কনস্টানটিনপোলে ফিরে গিয়ে তিনি খুবই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে কিছু কিছু গির্জা থেকে মঞ্চ পর্যন্ত সরিয়ে ফেলা হয়েছে, যেখান থেকে কিনা বাইবেল পড়া হতো!

১৬০২ সালে লুকারিস আলেকজান্দ্রিয়ায় যান আর প্যাট্রিয়ার্ক মেলেটিওস নামে তারই এক আত্মীয়ের পরে তিনি সেখানকার বিশপ হন। এরপর তিনি ইউরোপের সেই সমস্ত পাদ্রিদের সঙ্গে চিঠি লিখে যোগাযোগ করতে শুরু করেন যারা তার মতোই গির্জায় সংস্কার-সাধন করতে চাইতেন। তার একটা চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে অর্থোডক্স গির্জার শিক্ষায় অনেক ভুল রয়েছে। তার অন্য কিছু চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে গির্জায় কুসংস্কারের বদলে “বাইবেলের সত্য” শেখানো দরকার আর গির্জায় যা কিছু শেখানো হবে তার একমাত্র ভিত্তি হওয়া উচিত বাইবেল।

লুকারিস এটা দেখেও খুব শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন যে গির্জার পাদ্রিরা তাদের ইচ্ছামতো যা কিছুই শেখান সেটাকে ততখানিই গুরুত্ব দেওয়া হয় যতখানি যীশু ও তাঁর প্রেরিতদের শিক্ষাকে দেওয়া উচিত। তিনি লিখেছিলেন, “মানুষের পরম্পরাগত রীতিকে বাইবেলে লেখা কথার মতো গুরুত্ব দেওয়ার ব্যাপারকে আমি আর বেশি দিন সহ্য করব না।” (মথি ১৫:৬) এছাড়াও তিনি বলছিলেন যে খ্রীষ্টানেরা যদি প্রতিমাপূজা করে তাহলে তার জন্য তাদের খুবই খারাপ ফল ভোগ করতে হবে। তিনি বলেছিলেন যে “সাধুদের” কাছে প্রার্থনা করার মানে হল আমাদের একমাত্র মধ্যস্থ যীশুকে অপমান করা।—১ তীমথিয় ২:৫.

প্রধান বিশপের পদ নিলাম হয়

লুকারিসের এই সমস্ত বিশ্বাস ও সেইসঙ্গে রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রতি তার বিরক্তির কারণে কিছু জেসুইট ও অর্থোডক্স গির্জার সেই লোকেরা তার শত্রু হয়ে দাঁড়ায় ও তার ওপর তাড়না শুরু করে দেয়, যারা ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে যোগ দিতে চাইতেন। কিন্তু এত বিরোধিতার মধ্যেও, ১৬২০ সালে লুকারিসকে কনস্টানটিনপোলের বিশপ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। সেই সময়ে অর্থোডক্স গির্জার বিশপকে বহাল করা ও তাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অটোম্যান সাম্রাজ্যের হাতে ছিল। অটোম্যান সরকার পয়সা নিয়ে যে কোন বিশপকে সরিয়ে দিয়ে যে কোন নতুন বিশপকে নিয়োগ করতে পারত।

মূলত জেসুইটরা ও সর্বক্ষমতাময়, ভয়ংকর পোপদের সমিতি কংগ্রিগেশিও ডি প্রোপাগান্ডা ফিডে (বিশ্বাস প্রচারের সমিতি) ছিল লুকারিসের প্রধান শত্রু। এরা লুকারিসের ওপর একের পর এক দোষ চাপাতে থাকে ও ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিরিলস্‌ লোকারিস নামের বই বলে “এটা করার জন্য জেসুইটরা সমস্ত দিক দিয়ে সবরকমের চেষ্টা চালিয়েছিল—তারা ছলনা করেছিল, প্রতারণা করেছিল, অপবাদ দিয়েছিল, ঠকিয়েছিল ও সবচেয়ে বড় বিষয় হল যে তারা তার নামে ঘুষ নেওয়ার দোষ চাপিয়েছিল যা [অটোম্যান] সাম্রাজ্যের সমর্থন পাওয়ার সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল।” ফলে ১৬২২ সালে লুকারিসকে রোহ্‌ডস্‌ দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল আর আ্যমাসিয়ার গ্রেগরি, ২০,০০০ রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে ওই পদ কিনে নিতে চান। কিন্তু গ্রেগরি তার চুক্তি মতো টাকা শোধ করতে না পারায় আদ্রিয়ানপোলের আ্যনথিমাস ওই পদ কিনে নেন ও পরে পদত্যাগ করেন। আর অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার হল যে লুকারিসই পরে আবার বিশপের পদ ফিরে পান।

লুকারিস এবার মনে মনে স্থির করেছিলেন যে নতুন সুযোগকে তিনি পুরোপুরি কাজে লাগাবেন ও বাইবেলের এক নতুন অনুবাদ ও তার ওপর ভিত্তি করে কিছু পুস্তিকা ছাপাবেন। তিনি ভেবেছিলেন যে এভাবে তিনি অর্থোডক্স গির্জার পাদ্রি ও সাধারণ লোকেদের বাইবেল শেখাবেন। এটা করার জন্য তিনি ইংরেজ রাষ্ট্রদূতের সাহায্য নিয়ে একটা মুদ্রণযন্ত্র কনস্টানটিনপোলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ১৬২৭ সালের জুন মাসে যখন এই মুদ্রণযন্ত্র আসে, তখন লুকারিসের শত্রুরা বলে যে তিনি রাজনৈতিক কাজ করার জন্য এটাকে ব্যবহার করবেন আর তাই শেষ পর্যন্ত তারা এটাকে নষ্ট করে দেয়। এরপর লুকারিসকে জেনেভার মুদ্রণযন্ত্রগুলো ব্যবহার করতে হয়েছিল।

খ্রীষ্টান গ্রিক শাস্ত্রের অনুবাদ

বাইবেল ও এর ক্ষমতার বিষয়ে লুকারিসের মনে এতখানিই গভীর শ্রদ্ধা ছিল যে তিনি বাইবেলের প্রত্যেকটা শব্দ যেন সাধারণ লোকেরা খুব সহজে বুঝতে পারে তার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে পুরনো গ্রিক পাণ্ডুলিপিতে যে ভাষা রয়েছে তা বেশির ভাগ লোকেরা বুঝতে পারছে না। তাই সবচেয়ে প্রথমে লুকারিস খ্রীষ্টান গ্রিক শাস্ত্রকে তার দিনের চলিত গ্রিক ভাষায় অনুবাদ করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ম্যাক্সিমাস ক্যাল্লিপোলাইটস্‌ নামে একজন শিক্ষিত পাদ্রি ১৬২৯ সালের মার্চ মাসে অনুবাদ করতে শুরু করেন। কিন্তু অর্থোডক্স গির্জার অনেকে এই কাজকে অপমানজনক বলে মনে করেছিলেন, তা সে পুরনো বাইবেল বোঝা লোকেদের জন্য যত কঠিনই হোক না কেন। এই লোকেদের শান্ত করার জন্য লুকারিস পুরনো বাইবেলের পদগুলোর পাশে পাশে নতুন অনুবাদ লিখিয়েছিলেন আর এর পাশে কিছু কিছু টীকাও লিখিয়েছিলেন। অনুবাদের কাজ শেষ হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই ক্যাল্লিপোলাইটস্‌ মারা গিয়েছিলেন তাই ছাপানোর আগে লুকারিস নিজেই এই পাণ্ডুলিপি পড়েছিলেন। ১৬৩৮ সালে লুকারিসের মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পর এই অনুবাদ ছাপা হয়েছিল।

লুকারিস এত সাবধানে কাজ করলেও, অনেক বিশপই এই অনুবাদকে বাতিল করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি লুকারিসের ভালবাসা যে কত গভীর ছিল তা ওই অনুবাদের ভূমিকার কথাগুলো থেকেই বোঝা যায়। এতে তিনি লিখেছিলেন যে শাস্ত্রকে যখন সাধারণ লোকেদের ভাষায় ছাপানো হয় তখন তা “আমাদের জন্য স্বর্গ থেকে আসা মধুর বাক্য।” তিনি লোকেদের “[বাইবেলের] সমস্ত বিষয়বস্তু খুব ভালভাবে জানার জন্য” পরামর্শ দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, “বিশ্বাস সম্বন্ধে ঠিক করে জানার অন্য আর কোন উপায় নেই . . . ঈশ্বরের কাছ থেকে আসা পবিত্র সুসমাচার থেকেই পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।”—ফিলিপীয় ১:৯, ১০.

যারা বাইবেল পড়তে ও বাইবেল অনুবাদ করতে নিষেধ করত লুকারিস তাদের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “যদি আমরা এমন কিছু বলি যা কেউ বুঝতেই পারে না, তাহলে তা হাওয়ার সঙ্গে কথা বলার মতো হবে।” (১ করিন্থীয় ১৪:৭-৯ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) ভূমিকার শেষে তিনি লিখেছিলেন: “আপনারা যখন ঈশ্বরের বাক্য, তাঁর কাছ থেকে আসা এই পবিত্র সুসমাচার আপনাদের নিজেদের ভাষায় পড়েন, তখন এর থেকে পুরোপুরি উপকার পাওয়ার চেষ্টা করুন . . . আর ঈশ্বর যেন আপনাদের পথকে আলোকিত করেন ও আপনাদের মঙ্গল করেন।”—হিতোপদেশ ৪:১৮.

বিশ্বাসের স্বীকার

বাইবেল অনুবাদের কাজ শুরু করার পর লুকারিস আরেকটা সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৬২৯ সালে তিনি জেনেভাতে বিশ্বাসের স্বীকার (ইংরেজি) নামে একটা বই ছাপিয়েছিলেন। এই বইয়ে তিনি তার নিজের কিছু বিশ্বাস ও ধারণা সম্বন্ধে লিখেছিলেন আর আশা করেছিলেন যে অর্থোডক্স গির্জা তা মেনে নেবে। দি অর্থোডক্স চার্চ নামের বই বলে, স্বীকার বইটা “সেই সমস্ত শিক্ষার বিরোধিতা করে যেগুলো অর্থোডক্স গির্জার পাদ্রি ও পবিত্র লোকেরা প্রতিষ্ঠা করেছিল আর এটা এও বলে যে প্রতিমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো ও সাধুদের কাছে প্রার্থনা করা মূর্তিপূজার সমান।”

স্বীকার বইয়ে ১৮টা প্রবন্ধ ছিল। এর দ্বিতীয় প্রবন্ধে বলা হয়েছিল যে বাইবেল ঈশ্বর নিজে লিখিয়েছিলেন আর গির্জার শিক্ষার চেয়ে এর শিক্ষা অনেক গুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটা বলে: “আমরা বিশ্বাস করি যে পবিত্র শাস্ত্র ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন। . . . আমরা মানি যে পবিত্র শাস্ত্রের গির্জার চেয়েও বেশি ক্ষমতা রয়েছে। পবিত্র আত্মা যা শেখায় তা আর মানুষের শিক্ষার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে।”—২ তীমথিয় ৩:১৬.

অষ্টম ও দশম প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে যীশু খ্রীষ্ট হলেন আমাদের একমাত্র মধ্যস্থ, মহাযাজক এবং মণ্ডলীর মস্তক। লুকারিস লিখেছিলেন: “আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের প্রভু যীশু খ্রীষ্ট তাঁর পিতার দক্ষিণ দিকে বসে আছেন এবং তিনি আমাদের হয়ে পিতার কাছে অনুরোধ করেন কারণ একমাত্র তিনিই আমাদের প্রকৃত ও বৈধ মহাযাজক এবং মধ্যস্থ।”—মথি ২৩:১০.

দ্বাদশ প্রবন্ধ বলে যে গির্জা বিপথে যেতে পারে, মিথ্যা শিক্ষা দিতে পারে কিন্তু যদি বিশ্বস্ত সেবকেরা পবিত্র আত্মার সাহায্যে ও পরিশ্রমের সঙ্গে বাইবেলের সত্য বলেন তাহলে গির্জার বিপথে যাওয়াকে রোখা যেতে পারে। ১৮ অধ্যায়ে লুকারিস বলেন যে পুরগাতরি বলে সত্যিকারের কোন জায়গা নেই, এটা শুধু মানুষের এক কল্পনা। তিনি বলেন: “পুরগাতরির মিথ্যা শিক্ষাকে সত্যি বলে মেনে নেওয়া ঠিক নয়।”

স্বীকার বইয়ের পরিশিষ্টে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর দেওয়া ছিল। এখানে লুকারিস প্রথমে জোর দেন যে প্রত্যেক ব্যক্তির শাস্ত্র পড়া উচিত আর ঈশ্বরের বাক্য না পড়া তাদের জন্য বিপদ নিয়ে আসতে পারে। এরপর তিনি বলেন যে মিথ্যা বইগুলো থেকে একেবারেই দূরে থাকা উচিত।—প্রকাশিত বাক্য ২২:১৮, ১৯.

চতুর্থ যে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা হয়েছে তা হল: “প্রতিমাকে আমাদের কীভাবে দেখা উচিত?” উত্তরে লুকারিস বলেন: “পবিত্র শাস্ত্র আমাদের তা জানায়। পবিত্র শাস্ত্র খুব পরিষ্কার করে বলে, ‘তুমি নিজের জন্য কোন প্রতিমা নির্মাণ করো না; স্বর্গ বা পৃথিবীর কোন কিছুর মূর্তি নির্মাণ করো না; তুমি সেগুলোর কাছে প্রণিপাত করো না বা সেগুলোর উপাসনা করো না; [যাত্রাপুস্তক ২০:৪, ৫]’ কারণ আমাদের একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, স্বর্গ ও পৃথিবীর নির্মাতা ঈশ্বরের উপাসনা করা উচিত ও একমাত্র তাঁকেই শ্রদ্ধা করা উচিত, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট কোন বস্তুকে নয়। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে পবিত্র শাস্ত্রে . . . [প্রতিমার] উপাসনা করাকে একেবারে নিষেধ করা হয়েছে . . . তাই আমাদের কোন ছবি, মূর্তি বা প্রাণীর নয় কিন্তু শুধু সৃষ্টিকর্তা ও নির্মাতার উপাসনা করা উচিত।”—প্রেরিত ১৭:২৯.

লুকারিস যে সময়ে বাস করতেন তা যদিও আধ্যাত্মিক অন্ধকারের যুগ ছিল আর তিনি সমস্ত কিছু ঠিক করে বুঝতেও পারেননি, * তবুও গির্জায় যাতে বাইবেল থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় ও সাধারণ লোকেদের মধ্যে যাতে বাইবেলের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার জন্য তিনি যা করেছিলেন তার কোন তুলনা হয় না।

স্বীকার বইটা প্রকাশের পরপরই লুকারিসের ওপর নতুন করে বিরোধিতার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। ১৬৩৩ সালে, লুকারিসের সবচেয়ে বড় শত্রু, বিরয়ার (এখন এলেপ্পো) বিশপ সিরিল কনটারি লুকারিসের জায়গায় প্রধান বিশপ হতে চান। আর এই পদ পাওয়ার জন্য তিনি অটোম্যানদের সঙ্গে দর কষাকষি শুরু করেন আর জেসুইটরা তার এই কাজে সমর্থন করে। কিন্তু কনটারি টাকা শোধ করতে না পারায় তাদের সমস্ত ফন্দি ভেস্তে যায়। লুকারিস তার পদে বহাল থাকেন। পরের বছর থেসলনিকীর আথানাসিয়াস ওই পদের জন্য প্রায় ৬০,০০০ রৌপ্য মুদ্রা দেন। লুকারিসকে আবারও তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একমাসের মধ্যে তাকে আবার ডেকে পাঠানো হয় এবং বিশপের পদ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সিরিল কনটারি ৫০,০০০ রৌপ্য মুদ্রা জমিয়ে ফেলেছিলেন। এবারে লুকারিসকে বন্দি করে রোহ্‌ডস্‌ দ্বীপে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ছয় মাস পরে তার বন্ধুরা আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।

কিন্তু, ১৬৩৮ সালে জেসুইটরা ও তাদের অর্থোডক্স সাথিরা লুকারিসের বিরুদ্ধে এই বলে রাজদ্রোহীর দোষ চাপায় যে তিনি অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন। এইবার অটোম্যান সাম্রাজ্যের সুলতান তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। লুকারিসকে বন্দি করা হয় আর ১৬৩৮ সালের ২৭শে জুলাই একটা ছোট্ট নৌকায় করে তাকে এমনভাবে নিয়ে যাওয়া হয় যে যেন তাকে নির্বাসনে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু নৌকা সমুদ্রের মাঝে পৌঁছালে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। তাকে তীরের কাছে নিয়ে এসে কবর দেওয়া হয় কিন্তু পরে সেখান থেকে বের করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হয়। জেলেরা তার মৃতদেহ পায় আর তার বন্ধুরা তাকে আবার কবর দেন।

আমাদের জন্য শিক্ষা

একজন পণ্ডিত বলেন, “এই বিষয়টাকে অবহেলা করা উচিত নয় যে [লুকারিসের] একটা প্রধান লক্ষ্য ছিল গির্জার পাদ্রি ও সাধারণ লোকেদের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়া কারণ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে লোকেদের বাইবেলের জ্ঞান একেবারেই ছিল না।” হাজারো বাধাবিপত্তি লুকারিসকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে বাধা দিয়েছিল। তাকে পাঁচ বার বিশপের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার মৃত্যুর চৌত্রিশ বছর পর, যিরূশালেমে এক ধর্মসভায় তার শিক্ষাকে খণ্ডন করে বলা হয়েছিল যে তিনি মিথ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। ধর্মসভায় ঘোষণা করা হয়েছিল যে বাইবেল “সকলের পড়া উচিত নয় বরং শুধু তাদেরই পড়া উচিত যারা ঠিক করে গবেষণা করার পর আত্মার গভীর বিষয়গুলো জানতে চান,” যার মানে ছিল শুধু পাদ্রিদেরই বাইবেল পড়া উচিত।

লুকারিসের প্রতি যা ঘটেছিল তা দেখায় যে কীভাবে গির্জার পাদ্রিরা একজোট হয়ে ঈশ্বরের বাক্যকে সাধারণ লোকেদের কাছে পৌঁছানোয় বাধা দিয়েছিলেন। যখনই কেউ তাদের মিথ্যা শিক্ষার দিকে আঙুল তুলেছিলেন তারা খুবই নিষ্ঠুরভাবে তাদের মুখ বন্ধ করেছিলেন। পাদ্রিরা নিজেদেরকে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সত্যের চরম শত্রু বলে প্রমাণ করেছেন। দুঃখের বিষয় হল যে পাদ্রিদের এই রূপ আজও রয়ে গেছে। এটা এই কঠিন সত্যকে মনে করিয়ে দেয় যে যখন পাদ্রিদের চিন্তা ও বলার স্বাধীনতায় বাধা দেওয়া হয় তখন তার ফল কত খারাপ হয়।

[পাদটীকাগুলো]

^ তার স্বীকার বইয়ে তিনি ত্রিত্ব, পুনর্জন্ম ও আত্মার অমরত্বের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি যদিও এগুলো বাইবেলের শিক্ষা ছিল না।

[২৯ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]

গির্জায় যাতে বাইবেল থেকে শিক্ষা দেওয়া হয় ও সাধারণ লোকেদের মধ্যে যাতে বাইবেলের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়া যায় তার জন্য লুকারিস যা করেছিলেন তার কোন তুলনা হয় না

[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]

লুকারিস এবং কোডেক্স আলেকজান্দ্রিনাস

ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে একটা অমূল্য রত্ন রয়েছে আর তা হল সা.কা. পঞ্চম শতাব্দীর বাইবেলের পাণ্ডুলিপি, কোডেক্স আলেকজান্দ্রিনাস। মনে করা হয় যে এতে মোট ৮২০টা পাতা ছিল আর তার মধ্যে ৭৭৩টা পাতা এখনও রয়েছে।

লুকারিস যখন মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ার বিশপ হয়েছিলেন তখন তিনি অনেক বই জমা করেছিলেন। যখন তিনি কনস্টানটিনপোলের প্রধান বিশপ হয়েছিলেন তখন তিনি তার সঙ্গে করে কোডেক্স আলেকজান্দ্রিনাসও নিয়ে গিয়েছিলেন। ১৬২৪ সালে তিনি এটা তুরস্কে কর্মরত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতকে দিয়েছিলেন যাতে তিনি লুকারিসের এই উপহার ব্রিটেনের রাজা জেমস ১ম-কে দেন। তিন বছর পর এটা তার পরের রাজা চার্লস ১ম-কে দেওয়া হয়েছিল।

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ রাজার রাজকীয় লাইব্রেরি ব্রিটিশ জাতিকে দান করা হয়েছিল আর এই চমৎকার কোডেক্সটাকে এখন নতুন ব্রিটিশ লাইব্রেরির জন রিটব্লাট গ্যালারিতে রাখা হয়েছে।

[সৌজন্যে]

Gewerbehalle, Vol. ১০

From The Codex Alexandrinus in Reduced Photographic Facsimile, ১৯০৯

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

Bib. Publ. Univ. de Geneve