প্রার্থনার শক্তি
প্রার্থনার শক্তি
মধ্য প্রাচ্যের নাহোর শহরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। এমন সময় ইলীয়েষর নামে সিরিয়ার একজন লোক, উটে টানা গাড়িতে করে শহরের বাইরে একটা কুয়োর কাছে আসেন, যে গাড়িটা দশটা উট টেনে নিয়ে এসেছে। কোন সন্দেহ নেই যে ইলীয়েষর খুবই ক্লান্ত এবং তৃষ্ণার্ত কিন্তু তারপরও তিনি নিজের চেয়ে বরং অন্যদের জন্য আরও বেশি চিন্তিত ছিলেন। তিনি অন্য দেশ থেকে তার প্রভুর ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজতে এসেছেন। আর তাকে তার প্রভুর আত্মীয়দের মধ্যে থেকেই মেয়ে খুঁজতে হবে। এই কঠিন কাজটা তিনি কীভাবে করবেন?
ইলীয়েষর বিশ্বাস করেন যে প্রার্থনার অনেক শক্তি আছে। একজন ছোট বাচ্চা যেমন তার বাবামাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করে, ঠিক সেইরকম বিশ্বাস দেখিয়ে তিনি নম্রভাবে প্রার্থনা করেছিলেন: “হে সদাপ্রভো, আমার কর্ত্তা অব্রাহামের ঈশ্বর, বিনয় করি, অদ্য আমার সম্মুখে শুভফল উপস্থিত কর, আমার প্রভু অব্রাহামের প্রতি দয়া কর। দেখ, আমি এই সজল কূপের নিকটে দাঁড়াইয়া আছি, এবং এই নগরবাসীদের কন্যাগণ জল তুলিতে বাহিরে আসিতেছে; অতএব যে কন্যাকে আমি বলিব, আপনার কলশ নামাইয়া আমাকে জল পান করাউন, সে যদি বলে, পান কর, তোমার উষ্ট্রদিগকেও পান করাইব, তবে তোমার দাস ইস্হাকের জন্য তোমার নিরূপিত কন্যা সেই হউক; ইহাতে আমি জানিব যে, তুমি আমার প্রভুর প্রতি দয়া করিলে।”—আদিপুস্তক ২৪:১২-১৪.
প্রার্থনার শক্তির ওপর ইলীয়েষরের পুরোপুরি বিশ্বাস ছিল আর তিনি তার প্রার্থনার উত্তরও পেয়েছিল। কারণ কুয়োর কাছে প্রথমে যে মেয়ে আসেন তিনি হলেন অব্রাহামের ভাইয়ের নাতনী! তার নাম রিবিকা আর তিনি অবিবাহিতা, পবিত্রা আর সেইসঙ্গে দেখতে খুবই সুন্দরী ছিলেন। আর আশ্চর্যের বিষয় হল যে তিনি শুধু ইলীয়েষরকেই জল দেননি কিন্তু খুশি মনে তার উটদেরও জল খাইয়ে তৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন। পরে, পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করার পর রিবিকা, অব্রাহামের ছেলে ইস্হাকের স্ত্রী হওয়ার জন্য ইলীয়েষরের সঙ্গে দূর দেশে যেতে রাজি হয়েছিলেন। এর থেকে খুব ভাল করে বোঝা যায় যে ইলীয়েষর তার প্রার্থনার উত্তর পেয়েছিলেন আর এটা এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন ঈশ্বর লোকেদের জন্য খুব কমই অলৌকিক কাজ করতেন!
ইলীয়েষরের প্রার্থনা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। এর থেকে তার দৃঢ় বিশ্বাস, নম্রতা এবং অন্যদের জন্য যে তিনি নিঃস্বার্থভাবে চিন্তা করতেন তা দেখা যায়। এছাড়া ইলীয়েষরের প্রার্থনা থেকে এটাও দেখা যায় যে যিহোবা মানুষের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করেন, তা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। এতে কোন সন্দেহ নেই যে তিনি খুব ভাল করে জানতেন, ঈশ্বর অব্রাহামকে কত ভালবাসতেন আর তিনি এও জানতেন যে ঈশ্বর অব্রাহামের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সমস্ত মানবজাতিকে আশীর্বাদ করার প্রতিজ্ঞা করেছেন। (আদিপুস্তক ১২:৩) তাই, ইলীয়েষর এই কথাগুলো দিয়ে তার প্রার্থনা শুরু করেছিলেন: “হে সদাপ্রভো, আমার কর্ত্তা অব্রাহামের ঈশ্বর।”
যীশু খ্রীষ্ট ছিলেন অব্রাহামের সেই বংশধর, যিনি সমস্ত বাধ্য মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ নিয়ে আসবেন। (আদিপুস্তক ২২:১৮) আজকে, আমরাও যদি আমাদের প্রার্থনার উত্তর পেতে চাই, তাহলে আমাদেরকে ঈশ্বর তাঁর পুত্রের মাধ্যমে মানবজাতির সঙ্গে যেভাবে যোগাযোগ রাখেন তা নম্রভাবে মেনে নিতে হবে। যীশু খ্রীষ্ট বলেছিলেন: “তোমরা যদি আমাতে থাক, এবং আমার বাক্য যদি তোমাদিগেতে থাকে, তবে তোমাদের যাহা ইচ্ছা হয়, যাচ্ঞা করিও, তোমাদের জন্য তাহা করা যাইবে।”—যোহন ১৫:৭.
যীশুর একজন শিষ্য, প্রেরিত পৌল এই কথাগুলো সত্যি হতে দেখেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রার্থনার অনেক শক্তি আছে আর তার বিশ্বাস মিথ্যে হয়নি। এইজন্য তিনি সমস্ত খ্রীষ্টান ভাইবোনদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন তারা যেন তাদের সমস্ত চিন্তার ভার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে তাঁর ওপর ছেড়ে দেন এবং পরীক্ষা করে দেখেন: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।” (ফিলিপীয় ৪:৬, ৭, ১৩) তাহলে এর মানে কি এই যে ঈশ্বর পৌলের সব প্রার্থনাই শুনেছিলেন আর তার উত্তর দিয়েছিলেন? আসুন তা দেখা যাক।
সব প্রার্থনাই শোনা হয় না
মনপ্রাণ দিয়ে প্রচার করার সময় পৌলকে একটা অসুবিধা সহ্য করতে হয়েছিল, যেটাকে তিনি তার “মাংসে একটা কন্টক” বলেছিলেন। (২ করিন্থীয় ১২:৭) হতে পারে তার বিরোধী এবং “ভাক্ত ভ্রাতাদের” কাছ থেকে পাওয়া মানসিক এবং আবেগগত কষ্টের কারণে তাকে অসুবিধা সহ্য করতে হয়েছিল। (২ করিন্থীয় ১১:২৬; গালাতীয় ২:৪) অথবা তিনি হয়তো অনেক দিন ধরে চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন। (গালাতীয় ৪:১৫) কারণ যাই হোক না কেন, ‘মাংসের একটা কন্টক’ পৌলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। তিনি লিখেছিলেন “এই বিষয় লইয়া আমি প্রভুর কাছে তিন বার নিবেদন করিয়াছিলাম, যেন উহা আমাকে ছাড়িয়া যায়।” কিন্তু যিহোবা তাকে এই বলে বুঝিয়েছিলেন যে ইতিমধ্যেই তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে পরীক্ষা সহ্য করার মতো যে আধ্যাত্মিক দান পেয়েছেন তাই-ই তার জন্য যথেষ্ট ছিল। এছাড়াও ঈশ্বর বলেছিলেন: “আমার শক্তি দুর্ব্বলতায় সিদ্ধি পায়।”—২ করিন্থীয় ১২:৮, ৯.
ইলীয়েষর এবং পৌলের উদাহরণ থেকে আমরা কী শিখি? আমরা শিখি যে যিহোবা ঈশ্বর সত্যিই তাদের প্রার্থনা শোনেন, যারা নম্রভাবে তাঁর সেবা করতে চান। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তিনি সবসময় তাদের প্রার্থনা শোনেন কারণ প্রত্যেকটা বিষয়ে ঈশ্বরের দূরদৃষ্টি রয়েছে। আমাদের জন্য কোন্টা সবচেয়ে ভাল তা তিনি আমাদের থেকে ভাল জানেন। আর সবচেয়ে জরুরি বিষয় হল যে তিনি তাঁর উদ্দেশ্যের সঙ্গে মিল রেখে কাজ করেন, যা তিনি বাইবেলে লিখে রেখেছেন।
আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ হওয়ার সময়
ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করেছেন যে পৃথিবীতে তাঁর পুত্রের হাজার বছর রাজত্বের সময় তিনি মানুষের সমস্ত শারীরিক, মানসিক এবং আবেগগত দুঃখকষ্ট দূর করে দেবেন। (প্রকাশিত বাক্য ২০:১-৩; ২১:৩-৫) আন্তরিক খ্রীষ্টানেরা ভবিষ্যতে এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ হওয়ার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন আর তারা পুরোপুরি বিশ্বাস করেন যে তা করার ক্ষমতা ঈশ্বরের আছে। আর তারা আশা করেন না যে ঈশ্বর এখনই তাদের অলৌকিকভাবে সুস্থ করে দেবেন বরং তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন যেন পরীক্ষার সময় তিনি তাদের সান্ত্বনা এবং শক্তি দেন। (গীতসংহিতা ৫৫:২২) এছাড়া তারা যখন অসুস্থ হন তখন তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভাল চিকিৎসা করানোর জন্যও তারা ঈশ্বরের নির্দেশনা চেয়ে প্রার্থনা করেন।
যীশু এবং তাঁর প্রেরিতেরা অলৌকিকভাবে সুস্থ করেছিলেন আর এই বিষয়টা বলে কোন কোন ধর্মগুরুরা অসুস্থ লোকেদের এখনই সুস্থ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতে উৎসাহ দেন। কিন্তু সেইসময় এক বিশেষ উদ্দেশ্যে এইরকম অলৌকিক কাজ করা হয়েছিল। এই অলৌকিক কাজগুলো প্রমাণ করেছিল যে যীশু খ্রীষ্ট ছিলেন প্রকৃত মশীহ এবং দেখিয়েছিল যে ঈশ্বরের অনুগ্রহ এখন যিহুদি জাতির কাছ থেকে নতুন গড়ে ওঠা খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর ওপর এসেছে। এছাড়াও সদ্য গড়ে ওঠা খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর বিশ্বাসকে শক্তিশালী করার জন্য অলৌকিক বরের দরকার ছিল। কিন্তু যখন এই নতুন মণ্ডলীর ভিত্তি দৃঢ় হয় এবং তারা পরিপক্ব হয়ে ওঠে তখন অলৌকিক বর ‘লোপ হয়ে’ যায়।—১ করিন্থীয় ১৩:৮, ১১.
আজকে এই কঠিন সময়ে যিহোবা ঈশ্বর তাঁর উপাসকদের আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ করার কাজে পথ দেখাচ্ছেন আর এই কাজটা খুবই জরুরি। আর যেহেতু লোকেদের হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে, তাই দেরি না করে তাদের এখনই এই ডাকে সাড়া দেওয়া খুবই জরুরি: “সদাপ্রভুর অন্বেষণ কর, যাবৎ তাঁহাকে পাওয়া যায়, তাঁহাকে ডাক, যাবৎ তিনি নিকটে থাকেন; দুষ্ট আপন পথ, অধার্মিক আপন সঙ্কল্প ত্যাগ করুক; এবং সে সদাপ্রভুর প্রতি ফিরিয়া আইসুক, তাহাতে তিনি তাহার প্রতি করুণা করিবেন; আমাদের ঈশ্বরের প্রতি ফিরিয়া আইসুক, কেননা তিনি প্রচুররূপে ক্ষমা করিবেন।”—যিশাইয় ৫৫:৬, ৭.
ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচার করে অনুতপ্ত পাপীদের আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ করা হচ্ছে। (মথি ২৪:১৪) যিহোবা ঈশ্বর তাঁর দাসদের এই জীবন রক্ষাকারী কাজ করতে শক্তি দিয়ে, সমস্ত জাতির লাখ লাখ লোকেদের পাপের জন্য অনুতাপ করতে এবং এই দুষ্ট বিধিব্যবস্থার শেষ আসার আগে তাঁর সঙ্গে এক কাছের সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন। আর যারা আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ হওয়া এবং আধ্যাত্মিকভাবে সুস্থ করার জন্য সাহায্য চেয়ে প্রার্থনা করেন তারা সত্যিই তাদের প্রার্থনার উত্তর পাচ্ছেন।
[৩ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]
ইলীয়েষর ও রিবিকা/The Doré Bible Illustrations/Dover Publications