সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

নাৎসি নির্যাতনের মুখে বিশ্বস্ত ও সাহসী

নাৎসি নির্যাতনের মুখে বিশ্বস্ত ও সাহসী

নাৎসি নির্যাতনের মুখে বিশ্বস্ত ও সাহসী

১৯৪৬ সালের ১৭ই জুন, নিদারল্যান্ডের রানি উইলহেলমিনা আমস্টারডামের এক যিহোবার সাক্ষি পরিবারকে সমবেদনা জানিয়ে একটা চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠিতে তিনি তাদের ছেলে জেকোব ভেন বেনিকমের প্রতি তার শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন, যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিরা হত্যা করেছিল। কয়েক বছর আগে নিদারল্যান্ডের পূর্বাঞ্চলে ডুটিকেম শহরের নগর পরিষদ ওই শহরের একটা রাস্তার নাম বারনার্ড পোলম্যান রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। বারনার্ড পোলম্যানও একজন যিহোবার সাক্ষি ছিলেন, যাকে যুদ্ধের সময় হত্যা করা হয়েছিল।

 কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কেন নাৎসিরা জেকোব, বারনার্ড ও অন্য যিহোবার সাক্ষিদের ওপর নির্যাতন করেছিল? আর কী এই সাক্ষিদেরকে নিষ্ঠুর নির্যাতনের মুখে বিশ্বস্ত থাকতে সাহায্য করেছিল, যার জন্য তারা তাদের দেশের লোকেদের ও রানির কাছ থেকে সম্মান ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য আসুন আমরা কিছু ঘটনা দেখি যে কেন যিহোবার সাক্ষিদের ছোট দল নাৎসি সরকারের বিশাল সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয়েছিল, ঠিক যেমন দায়ূদ দৈত্যাকার গলিয়াতের মুখোমুখি হয়েছিলেন।

নিষেধাজ্ঞা ছিল কিন্তু তবুও আরও বেশি কাজ করা হয়েছিল

১৯৪০ সালের ১০ই মে, নাৎসি সেনাবাহিনী হঠাৎ করেই নিদারল্যান্ডকে আক্রমণ করে। যিহোবার সাক্ষিরা যে বইপত্রিকা লোকেদের দিতেন সেগুলো নাৎসিদের খারাপ কাজ সকলের সামনে ফাঁস করে দিত ও ঈশ্বরের রাজ্যের পক্ষে কথা বলত, তাই নাৎসিরা এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে সাক্ষিদের কাজ বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। নিদারল্যান্ড দখল করে নেওয়ার তিন সপ্তারও কম সময়ের মধ্যে নাৎসিরা যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে এক গুপ্ত আদেশ জারি করেছিল। ১৯৪১ সালের ১০ই মার্চ একটা খবরের কাগজে বলা হয়েছিল যে যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ওই খবরের কাগজে সাক্ষিদের নামে দোষ দেওয়া হয়েছিল যে তারা “সরকার এবং সমস্ত গির্জার বিরুদ্ধে” কাজ করছে। আর এর ফলে সাক্ষিদেরকে গ্রেপ্তার করার হিড়িক পড়ে যায়।

কিন্তু আগ্রহের বিষয় হল যে কুখ্যাত গেসটাপো বা গোয়েন্দা পুলিশেরা যদিও সমস্ত গির্জার ওপর নজর রেখেছিল কিন্তু তারা শুধু একটা খ্রীষ্টান সংগঠনের লোকদের ওপর প্রচণ্ড নির্যাতন করেছিল। ওলন্দাজ ইতিহাসবেত্তা ড. লুই ডি ইয়ং বলেন: “শুধু একটা ধর্মের লোকেদেরকেই মারা না যাওয়া পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছিল আর তারা ছিলেন যিহোবার সাক্ষি।”—হেট কোনিংক্রিক ডার নিদারল্যান্ডেন ইন ডি টোয়াডি ভারেল্ডোর্‌লক (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নিদারল্যান্ড রাজ্য)।

ওলন্দাজ পুলিশেরা সাক্ষিদেরকে খুঁজে বের করতে ও গ্রেপ্তার করতে গেসটাপোদের সাহায্য করেছিল। শুধু তাই নয়, যিহোবার সাক্ষিদের একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষও নাৎসিদের ভয়ে ধর্মভ্রষ্ট হয়েছিল এবং সাক্ষি ভাইবোনেরা কে কোথায় আছেন তা তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিল। ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে ১১৩ জন সাক্ষি তাদের হাতে ধরা পড়েছিলেন। এই আক্রমণ কি তাদের প্রচার কাজকে থামিয়ে দিতে পেরেছিল?

এর উত্তর আমরা একটা গুপ্ত দলিল থেকে পাই, যার নাম মেলডানগেন অউস ডেন নিদারল্যান্ডেন (নিদারল্যান্ড থেকে রিপোর্ট)। এটা জার্মান সিখরহাইটস্‌পোলীৎসসাই (নিরাপত্তা পুলিশ বাহিনী) ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে লিখেছিল। এতে যিহোবার সাক্ষিদের সম্বন্ধে এই কথা বলা আছে: “এই বেআইনি সম্প্রদায় গোটা দেশে উদ্যমের সঙ্গে কাজ করে চলেছে, তারা অবৈধভাবে সভা করছে এবং ‘ঈশ্বরের সাক্ষিদের নির্যাতন করা একটা অপরাধ’ ও ‘যিহোবা নির্যাতনকারীদের অনন্তকালের জন্য ধ্বংস করে দিয়ে শাস্তি দেবেন,’ এইরকম শ্লোগান লেখা পোস্টার লাগাচ্ছে।” দুই সপ্তা পর ওই একই নিরাপত্তা পুলিশ রিপোর্ট দেয় যে “নিরাপত্তা পুলিশ বাইবেল ছাত্রদের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সবরকম চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও তাদের কাজ দিন দিন বেড়েই চলেছে।” হ্যাঁ, গ্রেপ্তার হওয়ার ভয় থাকা সত্ত্বেও সাক্ষিরা তাদের কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন এবং শুধু ১৯৪১ সালেই ৩,৫০,০০০ এরও বেশি বইপত্রিকা লোকেদের দিয়েছিলেন!

সেই সময়ে সাক্ষিদের সংখ্যা খুবই অল্প ছিল তবে তারা দিন দিন বেড়ে চলেছিলেন। কিন্তু, কোথা থেকে এই ছোট দল তাদের ভয়ংকর শত্রুদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছিল? প্রাচীনকালের বিশ্বস্ত ভাববাদী যিশাইয়ের মতো, সাক্ষিরা মানুষকে নয় কিন্তু ঈশ্বরকে ভয় করেছিলেন। কেন? কারণ যিশাইয়কে আশ্বাস দিয়ে যিহোবা যে কথাগুলো বলেছিলেন তার ওপর তারা পুরো আস্থা রেখেছিলেন: “আমি, আমিই তোমাদের সান্ত্বনাকর্ত্তা। তুমি কে যে, মর্ত্ত্যকে ভয় করিতেছ।”—যিশাইয় ৫১:১২.

সাহসের জন্য সম্মান পান

১৯৪১ সালের শেষ নাগাদ ২৪১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে তাদের মধ্যে কিছু জন নাৎসিদের ভয়ে সত্যের পথ ছেড়ে দিয়েছিল। একজন কুখ্যাত জার্মান গোয়েন্দা পুলিশ উইলি লেগস্‌ বলেছিলেন: “৯০ শতাংশ যিহোবার সাক্ষিই মুখ খোলেনি কিন্তু অন্য ধর্মের খুব কম লোকই তাদের মুখ বন্ধ রেখেছিল।” ওলন্দাজ পাদ্রি জোহানেস জে. বাসকেস, যাকে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বন্দি করা হয়েছিল তিনি যা বলেছিলেন সে কথা থেকে জানা যায় যে লেগস্‌ সত্যি কথাই বলেছিলেন। ১৯৫১ সালে বাসকেস লিখেছিলেন:

“সেই সময় ঈশ্বরের ওপর তাদের ভরসা এবং তাদের বিশ্বাসের শক্তি দেখে তাদের জন্য আমার সম্মান অনেক বেড়ে গিয়েছিল। আমি সেই যুবকের কথা জীবনেও ভুলব না যার বয়স তখন বোধহয় ১৯ বছরও হয়নি। সে কিছু পুস্তিকা লোকেদের দিয়েছিল যাতে হিটলার এবং নাৎসি সরকারের পতন সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা ছিল। . . . সে চাইলেই ছয় মাসের মধ্যে ছাড়া পেয়ে যেতে পারত যদি কি না সে আর এই কাজ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করত। কিন্তু, সে আপোশ করেনি আর তাই শাস্তি হিসেবে তাকে জার্মানির শ্রম শিবিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমরা সবাই ভাল করেই জানতাম যে শ্রম শিবিরে নিয়ে যাওয়ার মানে কী। পরের দিন সকালে তাকে নিয়ে যাওয়ার সময় যখন আমরা সবাই তাকে বিদায় জানাতে এসেছিলাম, তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে তার কথা আমরা সবাই মনে রাখব ও তার জন্য প্রার্থনা করব। সে শুধু এটুকুই বলেছিল: ‘আমার জন্য ভাববেন না। ঈশ্বরের রাজ্য অবশ্যই আসবে।’ এইরকম কথা আপনি কখনোই ভুলতে পারবেন না, এমনকি যিহোবার সাক্ষিদের শিক্ষাকে যদি আপনি বিশ্বাস নাও করেন।”

নৃশংসভাবে নির্যাতন করা হলেও সাক্ষিদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে, সাক্ষিদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০০ জন আর ১৯৪৩ সালে তাদের সংখ্যা বেড়ে ১,৩৭৯ জনে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, যে ৩৫০ জনেরও বেশি সাক্ষিকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে ৫৪ জন মারা গিয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালেও নিদারল্যান্ডের ১৪১ জন যিহোবার সাক্ষি বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক ছিলেন।

নাৎসি নির্যাতনের শেষ বছর

১৯৪৪ সালের ৬ই জুন আমেরিকা ও ব্রিটিশ সেনা ফ্রান্স আক্রমণ করে আর এটাই ছিল সাক্ষিদের ওপর নির্যাতন করার শেষ বছর। সেই সময় নাৎসি সেনা এবং তাদের পক্ষে যারা ছিল তাদের পিঠ দেয়ালে গিয়ে ঠেকে। নাৎসিদের এই অবস্থা দেখে কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে এবারে তারা নিরীহ খ্রীষ্টানদের পিছনে লাগা বন্ধ করবে। কিন্তু, ওই বছর আরও ৪৮ জন সাক্ষিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং বন্দি ৬৮ জন সাক্ষি প্রাণ হারান। তাদের মধ্যে একজন ছিল জেকোব ভেন বেনিকম যার কথা আগে বলা হয়েছে।

১৯৪১ সালে ৫৮০ জন লোক বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার সাক্ষি হয়েছিলেন আর ১৮ বছরের জেকোবও তাদের সঙ্গে বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। এর কয়েকদিন পরই সে তার ভাল মাইনের চাকরি ছেড়ে দেয় কারণ ওই চাকরি করলে সে খ্রীষ্টান হিসেবে নিরপেক্ষ থাকতে পারত না। তাই সে ছোটখাটো একটা চাকরি নেয় আর পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ শুরু করে। একবার বাইবেলের বইপত্রিকা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার সময় সে ধরা পড়ে আর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসে ২১ বছরের জেকোব রটেরডামের এক জেল থেকে তার পরিবারকে চিঠি লেখে:

“আমি খুব ভাল আছি এবং আনন্দে আছি। . . . এরই মধ্যে আমাকে চারবার জেরা করা হয়েছে। প্রথম দুবার আমার খুব কষ্ট হয়েছিল কারণ ওরা আমাকে খুব মেরেছিল কিন্তু প্রভু আমাকে দয়া করেছেন ও শক্তি জুগিয়েছেন যার জন্য এখনও পর্যন্ত আমি মুখ বন্ধ করে রাখতে পেরেছি। . . . আমি এই পর্যন্ত মোট ছটা বক্তৃতা দিয়েছি আর ১০২ জন লোক আমার বক্তৃতা শুনেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন বেশ আগ্রহ দেখিয়েছেন এবং কথা দিয়েছেন যে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করবেন।”

১৯৪৪ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর জেকোবকে আ্যমার্সফোর্ট শহরের এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও সে প্রচার করেছিল। কীভাবে? তার সঙ্গের একজন বন্দি, স্মৃতির পাতা ঘেঁটে বলেছিলেন: “পাহারাদারদের ফেলে দেওয়া সিগারেটের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে বন্দিরা সেগুলোতে বাইবেলের পাতা জড়িয়ে সিগারেট বানিয়ে খেত। বাইবেলের যে পাতা দিয়ে সিগারেট বানানো হতো জেকোব মাঝে মাঝে তা কুড়িয়ে পেয়ে পড়ত আর দেরি না করে বাইবেলের ওই কথাগুলো থেকেই আমাদের কাছে প্রচার করত। তাই আমরা তার নাম রেখেছিলাম ‘বাইবেলওয়ালা।’”

১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে জেকোব ও আরও অনেক বন্দিকে যুদ্ধের ট্যাংকগুলোর গতিরোধ করার জন্য গর্ত খুঁড়তে বলা হয়। কিন্তু জেকোব এই কাজ করেনি কারণ তার বিবেক যুদ্ধকে সমর্থন করে এমন কোন কাজ করতে সায় দেয়নি। এইজন্য পাহারাদাররা তাকে বার বার ভয় দেখিয়েছিল কিন্তু তবুও সে তা করেনি। ফলে তাকে এমন একটা জেলে পাঠানো হয়েছিল যেখানে সে একা ছিল। ১৩ই অক্টোবর একজন কর্মকর্তা তাকে জেল থেকে সেই গর্ত খোঁড়ার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। এবারও জেকোব তার সিদ্ধান্তে অটল ছিল। শেষে জেকোবকে নিজের কবর খুঁড়তে বলা হয় এবং তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সাক্ষিদের ওপর নির্যাতন চলতেই থাকে

জেকোব ও অন্য সাক্ষিদের অটল সাহস দেখে নাৎসিরা প্রচণ্ড রেগে যায় আর সাক্ষিদের ওপর আরও বেশি করে নির্যাতন শুরু করে দেয়। এবারে তারা ১৮ বছরের ইভার্ট কেটেলারিকে ধরে। প্রথম দিকে ইভার্ট তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেছিল কিন্তু পরে সে ধরা পড়ে এবং তাকে ভীষণ মারধর করা হয়, যাতে সে অন্য সাক্ষিরা কোথায় আছে তা বলে দেয়। কিন্তু সে একটা কথাও বলেনি আর তাই তাকে জার্মানির শ্রম শিবিরে পাঠানো হয়।

১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসেই পুলিশ ইভার্টের দাদাবাবু বারনার্ড লুইমেসের পিছনে লাগে। আর তাকে গ্রেপ্তার করার সময় তার সঙ্গে আ্যনটনি রেমেয়ার এবং আ্যলবারটাস বস নামে অন্য আরও দুজন সাক্ষি ছিলেন। আ্যলবারটাস এরই মধ্যে ১৪ মাস কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটক ছিলেন। কিন্তু ছাড়া পেয়ে তিনি আবারও উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথমে নাৎসি পুলিশেরা ওই তিনজনকে নির্দয়ভাবে মারে এবং পরে তাদের গুলি করে হত্যা করে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে তাদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় এবং কবর দেওয়া হয়। যুদ্ধ থামার পর ওই এলাকার কিছু খবরের কাগজে এই হত্যার খবর বের হয়। একটা খবরের কাগজ লিখেছিল যে তিনজন সাক্ষি নাৎসিদের জন্য এমন কোন কাজই করতে রাজি হয়নি, যা ঈশ্বরের আইনের বিরুদ্ধে ছিল আর “এইজন্যই তাদেরকে তাদের জীবন দিতে হয়েছিল।”

এরই মধ্যে ১৯৪৪ সালের ১০ই নভেম্বর বারনার্ড পোলম্যান, যার কথা আগে বলা হয়েছে তাকে গ্রেপ্তার করে যুদ্ধের জন্য কাজ করতে পাঠানো হয়। ওই শ্রম শিবিরে তিনি একাই সাক্ষি ছিলেন এবং এই কাজ করতে তিনি রাজি হননি। তার মন পালটানোর জন্য পাহারাদাররা নানাভাবে চেষ্টা করে দেখেছিল। তাকে না খেতে দিয়ে রাখা হয়। তারা তাকে লাঠি, কোদাল এবং রাইফেলের বাট দিয়ে নির্মমভাবে মারে। শুধু তাই নয়, তারা তাকে জোর করে ঠাণ্ডা জলে নামিয়ে দেয় আর তাকে ওই হাঁটুজলে হাঁটতে বলা হয়, এরপর তাকে মাটির নিচের একটা স্যাঁতসেঁতে ঘরে আটকে রাখা হয়। ওই ঘরে তিনি ভেজা কাপড়েই রাত কাটান। কিন্তু তারপরও তিনি নতি স্বীকার করেননি।

ওই সময় বারনার্ডের দুজন বোন, যারা যিহোবার সাক্ষি ছিলেন না, তাকে দেখতে আসেন। তারা তাকে তার মন পালটানোর জন্য বার বার অনুরোধ করেন কিন্তু তারা তাকে একটুও টলাতে পারেননি। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে তারা যখন বারনার্ডকে জিজ্ঞেস করেন যে তার জন্য তারা কিছু করতে পারেন কি না, তখন তিনি তাদের বলেন যে বাড়িতে ফিরে গিয়ে তারা যেন বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। এরপর নির্যাতনকারীরা তার গর্ভবতী স্ত্রীকে তার কাছে আসতে দেয় এই আশা করে যে তিনি হয়তো তাকে টলাতে পারবেন। কিন্তু, তার স্ত্রী এসে তাকে সাহস দিয়ে কথা বলায় বারনার্ড ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার জন্য আগের চেয়ে আরও বেশি অটল হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১৭ই নভেম্বর পাঁচজন নির্যাতনকারী অন্য সমস্ত বন্দিদের সামনে বারনার্ডকে গুলি করে হত্যা করে। এমনকি বারনার্ড মারা যাওয়ার পরও তারা তার শরীরকে বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয় আর তাদের কর্মকর্তা এতটাই রেগে গিয়েছিলেন যে তিনি তার রিভলবার বের করে বারনার্ডের দুচোখে গুলি করেন।

বারনার্ডকে পাশবিকভাবে হত্যা করা হয়েছে একথা শুনে সাক্ষিরা খুবই দুঃখ পেয়েছিলেন কিন্তু তারা বিশ্বস্ত ও সাহসী ছিলেন আর তাদের খ্রীষ্টীয় কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। বারনার্ডকে যে এলাকায় হত্যা করা হয়েছিল তার কাছেরই এক এলাকায় যিহোবার সাক্ষিদের একটা ছোট্ট মণ্ডলী ছিল। আর এই মণ্ডলী এই হত্যার পর পরই বলেছিল: “শয়তান আমাদের পথে অনেক বাধা নিয়ে এসেছিল আর এই মাসে এখানকার আবহাওয়াও খুব খারাপ ছিল কিন্তু তবুও আমরা অনেক কাজ করতে পেরেছি। গত মাসে আমরা ৪২৯ ঘন্টা প্রচার করেছিলাম কিন্তু এই মাসে আমরা ৭৬৫ ঘন্টা প্রচার করেছি। . . . প্রচার করার সময় একজন ভাই এক ভদ্রলোকের দেখা পান আর তাকে খুব ভাল সাক্ষ্য দেন। ওই ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আপনিও কি সেই ব্যক্তির ধর্মেরই লোক যাকে তার বিশ্বাসের জন্য গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ভাই হ্যাঁ বলায় ওই ভদ্রলোক বলেছিলেন: ‘তার বিশ্বাসের কোন তুলনা হয় না! এইরকম লোককেই আমি বিশ্বাসের বীর বলি!’”

যিহোবা মনে রাখবেন

১৯৪৫ সালের মে মাসে নাৎসিরা পরাজিত হয় এবং তাদেরকে নিদারল্যান্ড থেকে বের করে দেওয়া হয়। যুদ্ধ চলাকালে নৃশংস নির্যাতন সত্ত্বেও, যিহোবার সাক্ষিদের সংখ্যা কয়েকশ থেকে বেড়ে ২,০০০ এর বেশি হয়েছিল। যুদ্ধের সময়ের এই সাক্ষিদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে ইতিহাসবেত্তা ড. ডি ইয়ং স্বীকার করেন: “ভয় দেখানো এবং নির্মম নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের বেশির ভাগই তাদের বিশ্বাসকে অস্বীকার করেননি।”

নাৎসি শাসনে যিহোবার সাক্ষিরা বিশ্বাসে অটল থেকে যে সাহস দেখিয়েছিলেন, তার জন্য ওই দেশের কিছু কর্তৃপক্ষ তাদের কথা স্মরণ করেন। কিন্তু আরও বড় কথা হল যে যুদ্ধ চলাকালে এই সাক্ষিরা যে অসাধারণ বিশ্বাস দেখিয়েছিলেন, তার জন্য যিহোবা ও যীশু তাদেরকে মনে রাখবেন। (ইব্রীয় ৬:১০) যীশু খ্রীষ্টের হাজার বছরের রাজত্বে এই বিশ্বস্ত ও সাহসী সাক্ষিরা, যারা ঈশ্বরের সেবার জন্য নিজেদের জীবন বলি দিয়েছিলেন, তারা পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকার আশা নিয়ে কবর থেকে বের হয়ে আসবেন।—যোহন ৫:২৮, ২৯.

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

জেকোব ভেন বেনিকম

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

খবরের কাগজের কাটা অংশ, যেটাতে যিহোবার সাক্ষিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার খবর বেরিয়েছিল

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডানে: বারনার্ড লুইমেস; নিচে: আ্যলবারটাস বস (বাঁদিকে) এবং আ্যনটনি রেমেয়ার; নিচে: হিমেস্টিডে সোসাইটির অফিস