সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমার লাজুক স্বভাব কাটিয়ে উঠতে আমি সাহায্য পেয়েছি

আমার লাজুক স্বভাব কাটিয়ে উঠতে আমি সাহায্য পেয়েছি

জীবন কাহিনী

আমার লাজুক স্বভাব কাটিয়ে উঠতে আমি সাহায্য পেয়েছি

রূত এল. উল্‌রিক দ্বারা কথিত

সেদিন প্রচারে এক পাদ্রি যখন ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট চার্লস টেজ রাসেলের নামে একেবারে মিথ্যা কথাগুলো বলছিলেন, আমি নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। তার দরজায় দাঁড়িয়েই আমি কেঁদে দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনারা কি জানতে চান যে কী করে সেদিন আমি, একটা ছোট্ট মেয়ে একজন পাদ্রির কাছে প্রচার করেছিলাম? আসুন আমি আপনাদের শুরু থেকেই বলি।

 আমেরিকার নেব্রাসকারের এক খামারে ১৯১০ সালে আমার জন্ম হয়। আমি এক ধর্মপ্রাণ পরিবারে বড় হয়েছি। আমরা পরিবারের সবাই মিলে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় খাবারের পর বাইবেল পড়তাম। বাবা ছিলেন উইনসাইড নামের এক ছোট্ট শহরের মেথোডিস্ট গির্জার সানডে স্কুলের পরিচালক। আমাদের খামার থেকে সানডে স্কুল প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে ছিল। আমাদের একটা ঘোড়ার গাড়ি ছিল আর এর জানালায় পর্দা লাগানো ছিল, তাই কাঠফাটা রোদ হোক কিংবা মুষলধারে বৃষ্টিই হোক, প্রতি রোববার সকালে আমরা গির্জায় যেতাম।

আমার বয়স যখন আট, আমার ছোট ভাইয়ের পোলিও হয়। মা তাকে কাছেই লোয়া শহরের হাসপাতালে নিয়ে যায়। মা ভাইয়ের যত্নের কোন ত্রুটি করেনি কিন্তু সে লোয়ার হাসপাতালেই মারা যায়। লোয়াতে মার সঙ্গে একজন বাইবেল ছাত্রের দেখা হয়। যিহোবার সাক্ষিদের তখন বাইবেল ছাত্র বলা হতো। ওই বাইবেল ছাত্রের সঙ্গে মা অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলে আর তার সঙ্গে তাদের কয়েকটা মিটিংয়েও যায়।

মা তাদের কাছ থেকে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির ছাপানো শাস্ত্র অধ্যয়ন (ইংরেজি) বইগুলো নিয়ে বাড়িতে আসে। বইগুলো পড়েই মা বুঝতে পারে যে বাইবেল ছাত্রদের শিক্ষাই সত্য এবং আত্মার অমরত্ব, দুষ্ট লোকেরা চিরকাল নরকে যন্ত্রণা ভোগ করে এই শিক্ষাগুলো আসলে ভুল।—আদিপুস্তক ২:৭; উপদেশক ৯:৫, ১০; যিহিষ্কেল ১৮:৪.

মার এই আগ্রহ দেখে বাবা খুবই রেগে যায় আর মাকে মিটিংয়ে যেতে বাধা দেয়। বাবা আমাকে ও আমার বড়দা ক্ল্যারেন্সকে সঙ্গে করে গির্জায় নিয়ে যেত। কিন্তু বাবা যখন বাড়িতে থাকত না, মা আমাদের সঙ্গে বাইবেল স্টাডি করত। আর তাই, এত ছোট বয়সেই আমরা বাইবেল ছাত্রদের শিক্ষা ও গির্জার শিক্ষাকে যাচাই করে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম।

বড়দা ও আমি নিয়মিত সানডে স্কুলে যেতাম আর দাদা টিচারকে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত কিন্তু তিনি উত্তর দিতে পারতেন না। বাড়ি ফিরে আমরা মাকে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম আর এই বিষয়গুলো নিয়ে মা আলোচনা করত। শেষ পর্যন্ত আমি গির্জায় যাওয়া ছেড়ে দিই ও মার সঙ্গে বাইবেল ছাত্রদের মিটিংয়ে যেতে শুরু করি। অল্প কয়েকদিন পর ক্ল্যারেন্সও তাই করে।

লাজুক স্বভাব কাটিয়ে ওঠা

মা ও আমি ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাইবেল ছাত্রদের ওহাইওর সিডার পয়েন্টের সম্মেলনে যাই। আমার এখনও মনে আছে যে ভাই যোসেফ এফ. রাদারফোর্ড, যিনি তখন ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি সেখানে আসা ১৮,০০০ লোকের সামনে একটা বড় ব্যানার তুলে ধরেছিলেন যেখানে লেখা ছিল: “রাজা ও রাজ্যের বিষয় ঘোষণা কর।” ওই লেখাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিল আর আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয় প্রচার করা এখন খুবই জরুরি।—মথি ৬:৯, ১০; ২৪:১৪.

১৯২২ সাল থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে বেশ কয়েকটা সম্মেলন হয়েছিল আর ওই সম্মেলনগুলোতে বেশ কয়েকটা সংকল্প নেওয়া হয়েছিল। রাজ্যের খবর ট্র্যাক্টের মধ্যে ছাপানো হয়েছিল আর বাইবেল ছাত্ররা সারা পৃথিবীতে কোটি কোটি কপি বিতরণ করেছিলেন। আমি খুব রোগাপাতলা ছিলাম বলে তারা আমাকে তালপাতার সেপাই বলে ডাকতেন। তবে রোগা হওয়ায় আমি খুব তাড়াতাড়ি ট্র্যাক্টগুলো লোকেদের কাছে পৌঁছে দিতে পারতাম। ট্র্যাক্ট বিতরণ করতে আমার খুব ভাল লাগত। কিন্তু ঘরে ঘরে গিয়ে লোকেদের কাছে প্রচার করার কথা আমি ভাবতেই পারতাম না।

কারণ আমি খুবই লাজুক ছিলাম। মা প্রতি বছর আমাদের বাড়িতে যখন আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করত তখনও আমি লজ্জায় তাদের সামনে আসতাম না। তারা যতক্ষণ থাকত আমি আমার ঘরেই থাকতাম। একদিন মা পরিবারের সবার একটা ছবি তুলতে চেয়েছিল, তাই আমারও ডাক পড়ে। এত লোকেদের সামনে আমি যেতে চাইনি কিন্তু মা একরকম টেনে হিঁচড়ে ওই ঘর থেকে আমাকে বের করে নিয়ে গিয়েছিল।

একদিন আমি ঠিক করি যে আজকে আমি প্রচারে যাবই যাব। তাই আমার প্রচারের ব্যাগে আমি কিছু বইপত্র ঢুকাই। আমার এক মন বার বার বলে, “আমাকে দিয়ে এই কাজ হবে না” কিন্তু পরক্ষণেই অন্য মন বলে, “আমাকে পারতেই হবে।” যাব কী যাব না এই টানাপোড়েনের পর শেষ পর্যন্ত আমি প্রচারে যাই। প্রচারে যাওয়ার জন্য এই সাহস পেয়ে আমি খুবই খুশি হয়েছিলাম। যদিও প্রথম দিন প্রচারে গিয়ে আমি কিছুই বলতে পারিনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রচারে বের হতে পেরেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম। প্রথমেই আমি ওই পাদ্রির বাড়িতে গিয়েছিলাম যার কথা আগে বলেছি আর সেখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যিহোবার সাহায্যে আমি আমার লাজুক স্বভাব কাটিয়ে উঠি ও ঘরে-ঘরে গিয়ে লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। আর তা করতে পেরে আমার আনন্দও দিন দিন বেড়ে চলে। তারপর, ১৯২৫ সালে আমি জলে বাপ্তিস্ম নিয়ে যিহোবার কাছে আমার উৎসর্গীকরণকে দেখিয়েছিলাম।

পূর্ণ-সময় প্রচার কাজ শুরু

আমার বয়স যখন ১৮ বছর তখন আমি আমার মাসির কাছ থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে একটা গাড়ি কিনি ও অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করি। যারা পূর্ণ-সময় প্রচার করে তাদেরকে অগ্রগামী বলা হয়। দুবছর পর ১৯৩০ সালে আরেকজন বোন ও আমাকে একটা এলাকায় প্রচার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর মধ্যে ক্ল্যারেন্সও অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করেছিল। এর কয়েকদিন পরই সে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করার ডাক পায় ও সেখানে চলে যায়।

সেই সময় আমাদের বাবামা আলাদা হয়ে যায় আর আমি ও মা মিলে একটা ট্রেইলার বানাই এবং দুজনে মিলে অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। তখন আমেরিকায় চরম অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। তাই, অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন ছিল কিন্তু তবুও আমরা ঠিক করেছিলাম যে যা কিছুই আসুক না কেন, অগ্রগামীর কাজ ছাড়ব না। আমরা মুরগি, ডিম, শাকসবজি, পুরনো ব্যাটারি এবং আ্যলুমিনিয়ামের হাড়িবাসনের বদলে বাইবেলের বইপত্র দিতাম। পুরনো ব্যাটারি ও আ্যলুমিনিয়ামের জিনিস বিক্রি করে আমরা গাড়ির তেল ও অন্যান্য জিনিস কিনতাম। এছাড়া গাড়িতে কী করে তেল ভরতে হয় তা আমি নিজেই শিখে নিয়েছিলাম, ফলে ওই টাকাটা বেঁচে যেত। আমরা দেখেছিলাম যে যিহোবার প্রতিজ্ঞা সত্যি কারণ তিনি আমাদের সামনে থেকে সব বাধা দূর করে দিয়েছিলেন।—মথি ৬:৩৩.

মিশনারি কাজ শুরু

১৯৪৬ সালে আমাকে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের সপ্তম ক্লাসে ডাকা হয়। নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যান্সিংয়ের কাছে গিলিয়েড স্কুল ছিল। গিলিয়েডে যাওয়ার আগে মা ও আমি একসঙ্গে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম কিন্তু মা আমাকে মিশনারি কাজের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে বাধা দেয়নি। সে আমাকে বলেছিল যে গিলিয়েডে যাওয়ার এই সুযোগ আমি যেন হাতছাড়া না করি। গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে পিয়োরিয়া ইল্লিনোয়িস অঞ্চলের মার্থা হেস্‌ ও আমি একসঙ্গে কাজ করি। আমাদের দুজনকে এবং আরও দুজন অগ্রগামী বোনকে ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে এক বছরের জন্য প্রচার করতে বলা হয় আর সেই সময় আমরা বিদেশে গিয়ে প্রচার করার অপেক্ষায় ছিলাম।

১৯৪৭ সালে আমাদের বিদেশে প্রচার করার সুযোগ আসে। মার্থা ও আমাকে হাওয়াই দ্বীপে পাঠানো হয়। এই দ্বীপে স্থায়ীভাবে থাকা সহজ ছিল বলে মা-ও ওখানে চলে এসেছিল আর আমাদের কাছাকাছি হনোলুলু শহরে ছিল। তার শরীর দিন দিন খারাপ হতে থাকে আর তাই মিশনারি কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি মার দেখাশোনাও করতাম। ১৯৫৬ সালে ৭৭ বছর বয়সে মা হাওয়াই দ্বীপে মারা যায়। আমরা যখন হাওয়াই দ্বীপে এসেছিলাম তখন সেখানে মাত্র ১৩০ জন সাক্ষি ছিলেন কিন্তু মা যখন মারা গিয়েছে সেই সময়ে সেখানে সাক্ষিদের সংখ্যা এক হাজারকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

তারপর মার্থা ও আমি ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির কাছ থেকে একটা চিঠি পাই, যেখানে আমাদের দুজনকে প্রচার করার জন্য জাপানে যেতে বলা হয়। কিন্তু আমরা ভাবছিলাম যে এই বয়সে আমরা কতদূর জাপানি ভাষা শিখতে পারব। তখন আমার বয়স ছিল ৪৮ আর মার্থা আমার চেয়ে চার বছরের ছোট ছিল। কিন্তু আমরা এই বিষয়টা যিহোবার হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম ও জাপান যাব বলে ঠিক করেছিলাম।

১৯৫৮ সালে, নিউ ইয়র্কের ইয়াংকি স্টেডিয়াম ও পোলো গ্রাউন্ডে আন্তর্জাতিক সম্মেলন শেষ হওয়ার পর পরই আমরা জাহাজে চড়ে টোকিওর পথে যাত্রা করেছিলাম। ইয়োকোহামা বন্দরের কাছে এসে আমরা এক ঝড়ের কবলে পড়েছিলাম, বন্দরে পৌঁছে দেখেছিলাম যে সেখানে ডন ও ম্যাবেল হেসলেট্‌, লয়েড ও মেলবা ব্যারি এবং অন্যান্য মিশনারিরা এসেছেন। ওই সময় জাপানে মাত্র ১,১২৪ জন সাক্ষি ছিল।

জাপানে গিয়েই আমরা জাপানি ভাষা শিখতে শুরু করি এবং ঘরে-ঘরে প্রচারে যাই। ইংরেজি অক্ষর দিয়ে আমরা জাপানি কথা লিখে নিতাম ও প্রচারে গিয়ে ওই লেখাগুলো পড়তাম। উত্তরে গৃহকর্তারা বলতেন, “ইয়োরশি দেস্‌” অথবা “কেক্কো দেস্‌” যার মানে ছিল “খুব সুন্দর খবর” অথবা “বেশ ভাল কথা।” কিন্তু আমরা কখনও কখনও বুঝতে পারতাম না যে গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর আসলে আগ্রহ আছে কি না কারণ কেউ না শুনতে চাইলেও এই কথাই বলত। ব্যক্তির গলার স্বর অথবা মুখের ভাবভঙ্গি দেখেই আমাদেরকে এর মানে বুঝতে হতো। এই কথাগুলোর সত্যিকার মানে বুঝতে আমাদের আরও অনেক সময় লেগেছিল।

যে অভিজ্ঞতাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিল

ভাষা খুব বেশি না জানলেও একদিন আমি মিতসুবিসি কোম্পানির বাসভবনগুলোতে প্রচার করতে যাই ও সেখানে ২০ বছরের একজন মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়। সে বাইবেল স্টাডি করে সত্যে উন্নতি করে এবং ১৯৬৬ সালে বাপ্তিস্ম নেয়। এক বছর পর সে অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করে এবং কিছুদিন পরই তাকে বিশেষ অগ্রগামী করা হয়। তখন থেকে আজ পর্যন্ত সে অগ্রগামীর কাজ করে যাচ্ছে। যুবতী বয়স থেকেই সে তার পুরো সময় ও শক্তি দিয়ে পূর্ণ-সময় প্রচার করে চলেছে দেখে আমি অনেক উৎসাহ পাই।

বাইবেলের সত্যকে মেনে নেওয়া খুবই কঠিন কাজ আর তার ওপর যদি তারা খ্রীষ্টান না হয়, তাহলে তো আরও বেশি কঠিন। কিন্তু অনেকেই এই কঠিন অবস্থাকে মোকাবিলা করেছে আর এমন কয়েকজনের সঙ্গে আমি বাইবেল স্টাডি করেছিলাম। তারা দামি দামি বৌদ্ধ বেদী এবং শিনটো বেদী ভেঙে ফেলেছে, যা সাধারণত প্রত্যেক জাপানি ঘরেই থাকে। আত্মীয়রা যেহেতু প্রায়ই বলত যে বেদী ভেঙে ফেললে মৃত পূর্বপুরুষদের প্রতি অসম্মান দেখানো হয়, তাই নতুন ব্যক্তিদের তা করার জন্য অনেক সাহসের দরকার ছিল। প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানেরা যেমন মিথ্যা উপাসনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত কিছু নষ্ট করে ফেলেছিলেন, তেমনই তারাও মিথ্যা উপাসনার সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলোকে নষ্ট করে ফেলেছিল।—প্রেরিত ১৯:১৮-২০.

আমার মনে আছে আমার একজন বাইবেল স্টাডি টোকিও ছেড়ে অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি তার নতুন বাড়িতে মিথ্যা উপাসনার সঙ্গে জড়িত কোন জিনিস রাখতে চাননি। তার স্বামীকে তিনি তার ইচ্ছার কথা জানালে তিনিও এতে সায় দেন। ওই স্ত্রী আমাকে খুশি মনে এই কথা জানিয়েছিলেন আর তার পরই পরই তার মনে পড়ে যে তার কাছে মার্বেল পাথরের একটা বড় ও দামি ফুলদানি আছে, যেটা ঘরে সুখ-শান্তি বাড়ায় বলে মনে করা হয়। মিথ্যা ধর্মের সঙ্গে এর কোন সংযোগ আছে মনে করে সে ওই ফুলদানিটা ভেঙে ফেলে।

এই মহিলা ও আরও অনেকে যিহোবাকে সেবা করার জন্য মিথ্যা ধর্মের সমস্ত কিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে দেখে আমার খুবই ভাল লাগে আর আমি অনেক শান্তি ও পরিতৃপ্তি পাই। আমি রোজ যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই যে ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি জাপানে মিশনারি কাজ করতে পেরেছি।

আজকের দিনের “অলৌকিক কাজ”

আমি আমার ৭০ বছরেরও বেশি পূর্ণ-সময় পরিচর্যার কথা চিন্তা করে অবাক হয়ে ভাবি যে আজকের দিনে নিশ্চয়ই কোন অলৌকিক কাজ হয়েছে। ছোটবেলায় লাজুক ছিলাম বলে আমি কখনও ভাবিনি যে আমি আমার সারাটা জীবন লোকেদের কাছে ঈশ্বরের রাজ্যের কথা বলেই কাটিয়ে দিতে পারব, যে কথাটা বেশির ভাগ লোকেরাই হয়তো শুনতে চাইবে না। কিন্তু হাজার হাজার ব্যক্তিকে আমি দেখেছি যে তারা সত্য শুনেছে। আর তারা খুবই উদ্যোগের সঙ্গে সত্যকে নিজের করে নিয়েছে কারণ জাপানে ১৯৫৮ সালে মাত্র কয়েক হাজার সাক্ষি ছিল, কিন্তু আজকে সেখানে প্রায় ২,২২,০০০ জন সাক্ষি আছে। সত্যিই যে ছোট সে সহস্র হয়ে উঠেছে!

আমি ও মার্থা যখন প্রথমে জাপানে আসি, আমাদেরকে টোকিওর শাখা অফিসে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৩ সালে ওই জায়গায় একটা নতুন ছয় তলা বিল্ডিং বানানো হয়েছিল আর তখন থেকে আমরা এই বিল্ডিংয়েই থাকতাম। ১৯৬৩ সালের নভেম্বর মাসে শাখা অধ্যক্ষ ভাই লয়েড ব্যারি ওই বিল্ডিং উৎসর্গীকরণ বক্তৃতা দিয়েছিলেন ও সেখানে আসা ১৬৩ জনের মধ্যে আমি এবং মার্থাও ছিলাম। ওই সময়ে জাপানে প্রায় ৩,০০০ জন সাক্ষি ছিলেন।

রাজ্যের প্রচার কাজ এত তাড়াতাড়ি বেড়ে যাচ্ছে তা দেখা খুবই আনন্দের। ১৯৭২ সালে জাপানে সাক্ষিদের সংখ্যা ছিল ১৪,০০০ জন আর তখন নুমাজু শহরে আরেকটা নতুন বিল্ডিং বানানো হয়েছিল। কিন্তু ১৯৮২ সালের মধ্যে জাপানে রাজ্য ঘোষণাকারীদের সংখ্যা ৬৮,০০০ জনে দাঁড়ায় আর তখন টোকিও থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এবিনাতে আরও বড় বিল্ডিং বানানো হয়েছিল।

এর মধ্যে, টোকিওতে আগের যে শাখা অফিসটা ছিল সেটাকে মেরামত করা হয়েছিল। পরে এটাকে মিশনারি হোম করা হয়েছিল আর সেখানে ২০ জন মিশনারি থাকত। এখানে যে মিশনারিরা থাকে তারা প্রায় ৪০ বা ৫০ বছর ধরে জাপানে কাজ করছেন আর এখন আমি ও মার্থা হেস্‌ও এখানেই থাকি। একজন ডাক্তার ও তার নার্স স্ত্রী আমাদের সঙ্গে থাকে। তারা আমাদের দেখাশোনা করে, আমাদের শরীরের যত্ন নেয়। কিছুদিন আগে আরেকজন নার্স আমাদের পরিবারে যুক্ত হয়েছে আর খ্রীষ্টান বোনেরা দিনের বেলায় নার্সদের কাজে সাহায্য করার জন্য আসে। এবিনার বেথেল পরিবার থেকে রোজ পালা করে দুজন আসে, তারা আমাদের ঘর পরিষ্কার করে ও খাবার তৈরি করে দেয়। সত্যি, যিহোবা সবসময় আমাদের মঙ্গল করেছেন।—গীতসংহিতা ৩৪:৮, ১০.

আমরা যারা অনেক দিন ধরে মিশনারির কাজ করেছি আমরা যে বিল্ডিংয়ে থাকি সেটা প্রায় ৩৬ বছর আগে উৎসর্গ করা হয়েছিল। ১৯৯৯ সালের ১৩ই নভেম্বর এবিনাতে ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যন্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটির জাপান শাখার নতুন বিল্ডিংয়ের উৎসর্গীকরণ অনুষ্ঠান হয়েছে। সেখানে আমার মিশনারি জীবনের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছিল। দীর্ঘ দিন ধরে সত্যে আছেন এমন প্রায় ৪,৪৮৬ জন সাক্ষি প্রায় ৩৭টা দেশ থেকে সেখানে এসেছিলেন আর তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। এখন জাপান বেথেলে প্রায় ৬৫০ জন ভাইবোন সেবা করছে।

যখন থেকে আমি ভয়ে ভয়ে লোকেদের ঘরে-ঘরে গিয়ে বাইবেলের খবর জানিয়েছিলাম তখন থেকে অর্থাৎ প্রায় ৮০ বছর ধরে যিহোবা সবসময় আমাকে শক্তি জুগিয়ে গেছেন। যিহোবা আমাকে আমার লাজুক স্বভাব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। আমি বিশ্বাস করি যে যারা যিহোবার ওপর আস্থা রাখবে তাদের যিহোবা তাঁর কাজে ব্যবহার করবেন, এমনকি তারা যদি আমার মতো লাজুকও হয়। আমাদের ঈশ্বর যিহোবার কথা অপরিচিত লোকেদের কাছে বলে আমি কত আনন্দই না পেয়েছি!

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

মা ও ক্ল্যারেন্সের সঙ্গে, ক্ল্যারেন্স তখন বেথেল থেকে আমাদের দেখতে এসেছিল

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যান্সিং-এ গিলিয়েড স্কুলের লনে আমাদের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা অধ্যয়ন করছে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাঁ দিকে: হাওয়াই দ্বীপে আমি, মার্থা হেস্‌ ও মা

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

ওপরে: টোকিও মিশনারি হোমের ভাইবোনেরা

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

নিচে: আমার দীর্ঘদিনের সাথি মার্থা হেস্‌

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

এবিনার নতুন বড় বিল্ডিং যেটা গত নভেম্বরে উৎসর্গ করা হয়েছে