নিখুঁত পৃথিবীতে সিদ্ধ জীবন—শুধু স্বপ্ন নয়!
নিখুঁত পৃথিবীতে সিদ্ধ জীবন—শুধু স্বপ্ন নয়!
এক নিখুঁত পৃথিবীর কথা বললে আপনার মনে কোন্ ছবি ভেসে ওঠে? এমন এক সমাজের কথা ভেবে দেখুন তো যেখানে অপরাধ নেই, ড্রাগের ব্যাবসা নেই, খাবারের অভাব নেই, গরিব লোকেরা নেই আর অন্যায় অবিচারও নেই। যেখানে সবাই খুশি, সবাই সুস্থ। কারোও কোন দুঃখ নেই কোন কষ্ট নেই কারণ কেউ আর মারা যাবে না। এইরকম এক পৃথিবীর অপেক্ষায় থাকা কি শুধুই স্বপ্ন?
বি জ্ঞান ও প্রযুক্তি যদিও অনেক এগিয়েছে, তবুও মানুষেরা যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারে না যে মানুষের বুদ্ধি আর শিক্ষা এইরকম এক নিখুঁত পৃথিবী নিয়ে আসতে পারবে যেখানে আমরা সুখে শান্তিতে বাস করব। কিন্তু তবুও মানুষ এগিয়ে চলার চেষ্টা করে ও ভুলকে শুধরে নিতে চায়। তবে শুধু আকাশ কুসুম কল্পনাই গরিব ও ঘরছাড়া লোকেদের অভাব মেটাবে না বা পঙ্গু ও অসুস্থদের সুস্থ করে দেবে না যারা মরিয়া হয়ে তাদের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে চান। মানুষ যত চেষ্টাই করুক না কেন একটা নিখুঁত পৃথিবী তারা কখনই আনতে পারবে না। কিন্তু এই সমস্ত নিরাশা, হতাশা থাকলেও আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে এক নিখুঁত পৃথিবী আমাদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে।
আপনি যখন একজন নিখুঁত বা সিদ্ধ মানুষের কথা চিন্তা করেন তখন আপনার হয়তো যীশু খ্রীষ্টের কথা মনে পড়তে পারে। কিন্তু পৃথিবীতে শুধু যীশু একাই সিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না। আমাদের প্রথম বাবামা আদম ও হবাকেও নিখুঁত করে বানানো হয়েছিল। ঈশ্বরের কিছু গুণ তাদের মধ্যে ছিল। তারা এক সুন্দর বাগান, এদোন উদ্যানে থাকত। যখন তারা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়েছিল তাদেরকে সেই সুন্দর বাগান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। (আদিপুস্তক ৩:১-৬) কিন্তু তবুও যিহোবা ঈশ্বর আমাদের মধ্যে চিরকাল বেঁচে থাকার ইচ্ছা রেখেছেন। এই বিষয়ে উপদেশক ৩:১১ পদ বলে: “[ঈশ্বর] সকলই যথাকালে মনোহর করিয়াছেন, আবার তাহাদের হৃদয়মধ্যে চিরকাল রাখিয়াছেন; তথাপি ঈশ্বর আদি অবধি শেষ পর্য্যন্ত যে সকল কার্য্য করেন, মনুষ্য তাহার তত্ত্ব বাহির করিতে পারে না।”
কিন্তু মানুষ যখন পাপ করে অসিদ্ধ হয়ে পড়েছিল ও ‘অসার’ হয়ে “ক্ষয়ের দাসত্ব” করতে শুরু করেছিল সেই অবস্থায় প্রেরিত পৌল আমাদেরকে আশার কথা শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “সৃষ্টির ঐকান্তিকী প্রতীক্ষা ঈশ্বরের রোমীয় ৮:১৯-২১) বাইবেল আমাদের খুব সোজা কথায় বলে যে ঈশ্বর আবার মানুষকে সিদ্ধ জীবন ফিরিয়ে দেবেন। আর তা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তিনি যীশু খ্রীষ্টের মাধ্যমে করেছেন।—যোহন ৩:১৬; ১৭:৩.
পুত্ত্রগণের প্রকাশপ্রাপ্তির অপেক্ষা করিতেছে। কারণ সৃষ্টি অসারতার বশীকৃত হইল, স্ব-ইচ্ছায় যে হইল, তাহা নয়, কিন্তু বশীকর্ত্তার নিমিত্ত; এই প্রত্যাশায় হইল যে, সৃষ্টি নিজেও ক্ষয়ের দাসত্ব হইতে মুক্ত হইয়া ঈশ্বরের সন্তানগণের প্রতাপের স্বাধীনতা পাইবে।” (ভবিষ্যতের এই আশা আমাদের সবার তো আছেই কিন্তু এখনই আমরা সেই জীবন পাওয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারি।
খুব বেশি দাবি করবেন না
যীশু খ্রীষ্ট সিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটাকে এতই বড় করে দেখতেন যে তিনি এক বিরাট দল যারা তাঁর কথা শুনছিল তাদেরকে বলেছিলেন: “অতএব তোমাদের স্বর্গীয় পিতা যেমন সিদ্ধ, তোমরাও তেমনি সিদ্ধ হও।” (মথি ৫:৪৮) যীশু কি আমাদের এই দুষ্ট জগতে থেকেও সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত বা সিদ্ধ হতে বলছিলেন? না। বরং তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে আমরা যেন উদার ও দয়ালু হই, অন্যদেরকে ভালবাসি। কিন্তু অনেক সময়ই ইচ্ছা থাকলেও আমরা তা করে উঠতে পারি না। যীশুর একজন শিষ্যও লিখেছিলেন: “যদি আমরা আপন আপন পাপ স্বীকার করি, তিনি বিশ্বস্ত ও ধার্ম্মিক, সুতরাং আমাদের পাপ সকল মোচন করিবেন, এবং আমাদিগকে সমস্ত অধার্ম্মিকতা হইতে শুচি করিবেন। যদি আমরা বলি যে, পাপ করি নাই, তবে তাঁহাকে মিথ্যাবাদী করি, এবং তাঁহার বাক্য আমাদের অন্তরে নাই।”—১ যোহন ১:৯, ১০.
যাই হোক না কেন, আমরা নিজেদের বিষয়ে যেমন ভাবি বা অন্যদের যে চোখে দেখি তা বদলাতে পারি। কোন ব্যাপারেই আমাদের উগ্র হওয়া উচিত নয়। ঈশ্বরের বাক্য বাইবেল আমাদের এক সুন্দর ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করে। হাসিখুশি বা ভাল স্বভাবের হলে আমরা যাদের সঙ্গে কাজ করি তাদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক রাখতে পারব, বিবাহিত জীবনে সুখী হব আর বাবামা ও ছেলেমেয়ের মধ্যেও ভালবাসার সম্পর্ক থাকবে। প্রেরিত পৌল আমাদের পরামর্শ দিয়েছিলেন: “তোমরা প্রভুতে সর্ব্বদা আনন্দ কর; পুনরায় বলিব, আনন্দ কর। তোমাদের শান্ত ভাব মনুষ্যমাত্রের বিদিত হউক।”—ফিলিপীয় ৪:৪, ৫.
খুব বেশি দাবি না করার ভাল ফল
আপনি যখন খুব বেশি দাবি করেন না আর সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হওয়ার ইচ্ছায় নিজেকে কষ্ট দেন না বা মনমরা হয়ে থাকেন না তখন তা আপনার নিজের জন্য আর অন্যদের জন্যও ভাল। আপনি কতখানি করতে পারেন তা জানার মানে হল আপনি যা করতে চান সে ব্যাপারে ঠিক করে ভাবা ও খুব বেশি দাবি না করা। আমরা পৃথিবীতে বেঁচে থাকি, কাজ করি আর সুখী হই এটাই ঈশ্বর চান।—আদিপুস্তক ২:৭-৯.
আপনার যদি সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হওয়ার স্বভাব থাকে, তাহলে তা ছাড়ার জন্য যিহোবার কাছে প্রার্থনা করুন না কেন? প্রার্থনা করে আপনি মনে অনেকখানি শান্তি পাবেন। কারণ যিহোবা আমাদের গঠন জানেন, আমরা কতটুকু করতে পারি তাও তিনি জানেন, তাই যিহোবা আমাদের কাছ থেকে খুব বেশি দাবি করেন না, অতিরিক্ত কিছু চান না। তাঁকে খুশি করাও কঠিন কিছু নয়। গীতরচক আমাদের বলেছেন: “পিতা সন্তানদের প্রতি যেমন করুণা করেন, যাহারা সদাপ্রভুকে ভয় করে, তাহাদের প্রতি তিনি তেমনি করুণা করেন। কারণ তিনিই গীতসংহিতা ১০৩:১৩, ১৪) ঈশ্বর আমাদেরকে এতখানি দয়া দেখান জেনে আমরা কতই না কৃতজ্ঞ! তিনি জানেন যে আমরা বার বার ভুল করি কিন্তু তবুও তিনি আমাদের সন্তানের মতো ভালবাসেন।
আমাদের গঠন জানেন; আমরা যে ধূলিমাত্র, ইহা তাঁহার স্মরণে আছে।” (তাই সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হতে না চেয়ে ব্যাপারগুলোকে ঠিকভাবে দেখা কতই না বুদ্ধির কাজ! আর আমাদের ভুলে যাওয়াও উচিত নয় যে যিহোবা তাঁর উদ্দেশ্য পূর্ণ করবেনই। তিনি তাঁর রাজ্যে মানুষদের সিদ্ধতায় পৌঁছে দেবেন। অর্থাৎ মানুষেরা সিদ্ধ জীবন পাবে। কিন্তু সিদ্ধ হওয়ার মানে কী?
সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হওয়ার চেয়ে সিদ্ধ জীবন ভাল
সিদ্ধ হওয়ার মানে এমন নয় যে সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হতে হবে। যারা নতুন জগতে যাবেন তারা খুব বেশি দাবি করবেন না বা নিজেদের খুব বেশি ধার্মিক মনে করবেন না। কারণ তারা বুঝবেন যে যীশুর মুক্তির মূল্যে বিশ্বাস দেখানোর জন্যই তারা মহাক্লেশ থেকে রক্ষা পেয়েছেন। (যোহন ৩:১৬) আর সেই সময় তাদের সমস্ত অসিদ্ধতা ও দোষত্রুটি চিরকালের মতো দূর হয়ে যাবে। তারা এক সিদ্ধ জীবন পাবেন। (রোমীয় ৮:২১, ২২) আর এইজন্য তারা যিহোবা ও যীশু খ্রীষ্টের প্রতি কৃতজ্ঞ হৃদয়ে বলবেন: “‘পরিত্রাণ আমাদের ঈশ্বরের, যিনি সিংহাসনে বসিয়া আছেন, এবং মেষশাবকের দান।’”—প্রকাশিত বাক্য ৭:৯, ১০, ১৪.
সিদ্ধ জীবন কেমন হবে? লোকেরা নিজেদেরকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করবে না, তাদের মধ্যে হিংসাহিংসি থাকবে না ও তারা স্বার্থপর হবে না বরং সবাই একে অন্যকে ভালবাসবে, সকলের সঙ্গে সকলে শান্তিতে থাকবে। দুশ্চিন্তা থাকবে না আর কেউ নিজেকে ছোট মনে করে কষ্ট পাবে না। আর এই জীবন একঘেয়ে হবে না। নতুন জগৎ কেমন হবে তার খুঁটিনাটি সমস্ত কিছু বাইবেল যদিও বলে না কিন্তু সেখানে জীবন কেমন হবে তার কিছুটা ছবি আমরা পাই যখন আমরা যিশাইয় ৬৫:২১-২৩ পদ পড়ি। সেখানে বলা আছে “লোকেরা গৃহ নির্ম্মাণ করিয়া তাহার মধ্যে বসতি করিবে, দ্রাক্ষাক্ষেত্র প্রস্তুত করিয়া তাহার ফল ভোগ করিবে। তাহারা গৃহ নির্ম্মাণ করিলে অন্যে বাস করিবে না, তাহারা রোপণ করিলে অন্যে ভোগ করিবে না; বস্তুতঃ আমার প্রজাদের আয়ু বৃক্ষের আয়ুর তুল্য হইবে, এবং আমার মনোনীত লোকেরা দীর্ঘকাল আপন আপন হস্তের শ্রমফল ভোগ করিবে। তাহারা বৃথা পরিশ্রম করিবে না, বিহ্বলতার নিমিত্ত সন্তানের জন্ম দিবে না।”
এছাড়াও সেখানকার পরিবেশ কেমন হবে সে বিষয়ে যিশাইয় ৬৫:২৫ পদ বলে: “কেন্দুয়াব্যাঘ্র ও মেষশাবক একত্র চরিবে, সিংহ বলদের ন্যায় বিচালি খাইবে; আর ধূলিই সর্পের খাদ্য হইবে। তাহারা আমার পবিত্র পর্ব্বতের কোন স্থানে হিংসা কিম্বা বিনাশ করিবে না, ইহা সদাপ্রভু কহেন।” আমাদের আজকের পৃথিবীর চেয়ে তা কতই না আলাদা হবে! সেইসময় আপনি যদি সেখানে থাকেন যিহোবা নিশ্চয়ই আপনার ও আপনার পরিবারের লোকেদের যত্ন নেবেন। তাই আমোদপ্রমোদ, দোকান বাজার বা যাতায়াত ব্যবস্থা কেমন হবে তা না ভেবে বরং সেই পরিবেশে নিজেকে কল্পনা করুন। সেই সময়ে সবাই ‘সদাপ্রভুতে আমোদ করিবে, তিনি সকলের মনোবাঞ্ছা সকল পূর্ণ করিবেন।’—গীতসংহিতা ৩৭:৪.
সিদ্ধ জীবন শুধুই স্বপ্ন নয়। মানুষের জন্য যিহোবার উদ্দেশ্য পূর্ণ হবেই হবে। নতুন জগতে যাদের সিদ্ধ জীবন দেওয়া হবে আপনি ও আপনার পরিবার তাদের মধ্যে থাকতে পারবেন। কারণ বাইবেল অনেক আগেই বলেছে: “ধার্ম্মিকেরা দেশের অধিকারী হইবে, তাহারা নিয়ত তথায় বাস করিবে।”—গীতসংহিতা ৩৭:২৯.
[৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমরা নিজেদের বিষয়ে যা ভাবি ও অন্যদের যে চোখে দেখি তা বদলাতে পারি আর সবকিছুতেই একেবারে নিখুঁত হওয়ার ইচ্ছাকে এড়াতে পারি
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
নতুন জগতের সুন্দর পরিবেশে নিজেকে কল্পনা করুন না কেন যেখানে আমরা সুখে শান্তিতে বাস করব?