সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অনেক দেশে জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়া

অনেক দেশে জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়া

জীবন কাহিনী

অনেক দেশে জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়া

জর্জ ইয়ংয়ের কাহিনী রূত ইয়ং নিকলসন যেমন বলেন

“তাহলে আমাদের গির্জা কেন একেবারে চুপ? . . . সত্য জেনেও যে চুপ করে থাকে তাকে আমরা কেমন লোক বলব? আমি জেনে গেছি যে সত্য কী আর আমার কাছে তার প্রমাণও আছে। তাহলে বলতে লজ্জা কোথায়? সত্য তো সবসময়ই লোকেদের কাছে খোলাখুলি বলার মতো বিষয়।”

 এই কথাগুলো বাবা তার ৩৩ পৃষ্ঠা লম্বা চিঠিতে লিখেছিল। গির্জা থেকে নাম কাটানোর জন্য বাবা ১৯১৩ সালে এই চিঠি লিখেছিল। এর পর থেকে বাবার জীবন যেন এক নতুন উৎসাহ আর আনন্দে ভরে উঠেছিল। দেশে বিদেশে বাবা যেন জগতের জ্যোতি হয়ে আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল। (ফিলিপীয় ২:১৫) বাবার সব গল্প আমি ছোটবেলা থেকেই জোগাড় করতে শুরু করে দিই। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে আমি বাবার কথা জিজ্ঞেস করতাম। খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকা থেকেও আমি তার বিষয়ে জানবার চেষ্টা করেছি। বাবার কথা যখন আমি ভাবি আমার প্রেরিত পৌলের কথা মনে পড়ে। বাবার জীবন প্রেরিতের জীবনের সঙ্গে যেন একেবারে মিলে যায়। পৌল যেমন “পরজাতীয়দের জন্য প্রেরিত” ছিলেন তেমনই বাবাও বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপে গিয়ে যিহোবার সেবা করেছিলেন। (রোমীয় ১১:১৩; গীতসংহিতা ১০৭:১-৩) আপনারা কি আমার বাবা জর্জ ইয়ংয়ের জীবন কাহিনী শুনতে চান? আসুন আমি আপনাদের বলি।

বাবার ছোটবেলা

আমার দাদুদিদিমা জন ও মার্গারেট ইয়ং স্কটল্যান্ডের এডনবার্গ শহরে থাকতেন আর স্কটিশ প্রেসবিটেরিয়ান গির্জায় যেতেন। স্কটল্যান্ডে তাদের তিন ছেলে আলেকজান্ডার, জন আর ম্যালকম জন্মায়। এরপর তারা ব্রিটিশ কলম্বিয়ার সানীচে চলে যান যেটা পশ্চিম কানাডার একটা শহর। সেখানে ১৮৮৬ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর বাড়ির ছোট ছেলে আমার বাবার জন্ম হয় আর তার দুবছর পর ম্যারিয়ন জন্মায়। ম্যারিয়ন ঘরের সবচেয়ে ছোট আর সবার আদুরে একমাত্র বোন হওয়ায় সবাই তাকে আদর করে নেলী বলে ডাকত।

বাবাদের সব ভাইবোনেদের ছোটবেলা সানীচ শহরের ফার্মে হাসি খেলায় কেটেছিল। বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করতেও শিখেছিল। এইজন্য যখন দাদুদিদিমা কাজের জন্য কাছেই ভিক্টোরিয়া শহরে যেতেন, ফিরে এসে দেখতেন যে ঘরদোরের সব কাজ, ঝাড়ামোছা সারা। ঘরদোর একেবারে ঝকঝক করছে।

বড় হয়ে বাবা ও অন্য ভাইরা খনিতে কাজ করতে শুরু করে আর তার সঙ্গে কাঠের ব্যাবসাও শুরু করে। তাদের ব্যাবসা খুবই ভাল চলত। তাই তাদের বেশ নামডাকও হয়েছিল। ব্যাবসায় টাকাপয়সার ব্যাপারটা বাবা দেখাশোনা করত।

বাবা খুব ধর্মমনাও ছিল আর তাই বাবা প্রেসবিটেরিয়ান গির্জার পাদ্রি হয়েছিল। সেই সময়েই ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রথম সভাপতি চার্লস টি. রাসেলের বক্তৃতা খবরের কাগজে ছাপানো হতো। ঐ বক্তৃতা বাবার জীবনকে যেন একেবারে বদলে দিয়েছিল। বাবা গির্জা থেকে নাম কাটিয়ে নিতে চেয়েছিল। আর তারজন্য যে চিঠিটা বাবা লিখেছিল তার কিছুটা আপনারা শুরুতেই পড়েছেন।

চিঠিতে বাবা খুব ভাল করে কিন্তু খুবই স্পষ্ট ভাষায় বলেছিল যে গির্জার সমস্ত শিক্ষা একেবারে ভুল। বাইবেলের পদ থেকে বুঝিয়ে বাবা বলেছিল যে অমর আত্মার শিক্ষা একেবারে মিথ্যে আর শাস্তি দেওয়ার জন্য ঈশ্বর লোকেদের নরকে যন্ত্রণা দেন না। বাবা লিখেছিল, ত্রিত্বের শিক্ষা অন্য ধর্ম থেকে এসেছে কারণ বাইবেলের কোথাও এই কথা পাওয়া যায় না। গির্জা ছেড়ে দেওয়ার পর থেকে বাবা যীশু খ্রীষ্টের পদচিহ্নে চলে খুব উৎসাহ নিয়ে ঈশ্বরের সেবা করতে থাকে। বাবা তার সমস্ত শক্তি আর বুদ্ধি ঈশ্বরের মহিমার জন্য কাজে লাগিয়েছিল।

১৯১৭ সালে সোসাইটি বাবাকে পিলগ্রিম বা ভ্রমণ অধ্যক্ষ করে। বাবা কানাডার শহর আর গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে অনেক বক্তৃতা দিত। বাবা সেখানে “ফটো ড্রামা অফ ক্রিয়েশন” আর অনেক ছবিও দেখায়। বাবা যেখানেই যেত হলগুলো সবসময়ই লোকে লোকে একেবারে ভরে যেত। বাবা কবে কোন শহরে যাবে তার একটা তালিকা ১৯২১ সাল পর্যন্ত প্রহরীদুর্গ পত্রিকায় ছাপানো হতো।

একবার উইনিপেগ কাগজে ছাপা হয়েছিল যে প্রচারক ইয়ংয়ের বক্তৃতায় ২৫০০ জন লোক এসেছিলেন। আরও অনেক লোকেরাই তার বক্তৃতা শোনার জন্য সেখানে ভীড় করেছিলেন কিন্তু হলে পা ফেলার পর্যন্ত জায়গা ছিল না। তাই অনেক লোক ভিতরে আসতে পারেননি। ওটায়াতে বাবা একটা অদ্ভুত বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিল: “নরক থেকে ফেরা।” একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বলেছিলেন: “বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর জর্জ ইয়ং একদল পাদ্রির সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য তাদের স্টেজে ডেকেছিলেন। কিন্তু তাদের একজনও একথা মেনে নেয়নি। আমি কিন্তু সেইসময়েই বুঝে ফেলেছিলাম যে আমি সত্য খুঁজে পেয়েছি।”

বাবা ভ্রমণের কাজে যেখানেই যেত সেখানেই চলে আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত লোকেদের আধ্যাত্মিক খাবার দেওয়ার চেষ্টায় থাকত। আর তারপর তাড়াহুড়ো করে আবার পরের মণ্ডলীতে যাওয়ার জন্য ট্রেন ধরত। গাড়িতে করে যাওয়ার সময় বাবা জলখাবার খাওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়ত। বাবা যে শুধু উৎসাহ নিয়ে প্রচার করত তাই-ই নয় অন্যদের জন্য ভাল কাজ করার ব্যাপারেও বাবার কোন জুড়ি ছিল না। লোকেরা বলত যে তিনি লোকেদের খুব ভালবাসেন আর তার মতো লোক হয় না।

১৯১৮ সালে এলবার্টার এডমন্টন শহরে যে সম্মেলন হয়েছিল তার কথা বাবা কখনও ভুলতে পারত না। এই সম্মেলনে নেলী বাপ্তিস্ম নিয়েছিল আর পরিবারের সবাই সেখানে হাজির ছিল। আর এই সময়েই শেষবারের মতো তারা সব ভাইবোনেরা এক জায়গায় হয়েছিল। কারণ দুবছর পর ম্যালকম নিউমোনিয়ায় মারা গিয়েছিল। দাদু আর তার চারজন ছেলের স্বর্গে যাওয়ার আসা ছিল। তারা সবাই তাদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে যিহোবা ঈশ্বরের সেবা করেছিলেন।—ফিলিপীয় ৩:১৪.

বিদেশে যাওয়ার জন্য রওনা

১৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাবা যখন কানাডায় তার ভ্রমণের কাজ শেষ করে তখন সোসাইটির সভাপতি ভাই যোষেফ এফ. রাদারফোর্ড বাবাকে ক্যারিবিয়ান দ্বীপগুলোতে যাওয়ার জন্য বলেন। এই দ্বীপে বাবা অনেক জায়গাতে “ফটো ড্রামা অফ ক্রিয়েশন” দেখিয়েছিল। লোকেদের এটা দেখতে খুবই ভাল লেগেছিল। ত্রিনিদাদ থেকে বাবা লিখেছিল: “হল একেবারে ভরে গিয়েছিল, ফলে অনেক লোকেদের ফিরে যেতে হয়েছিল। আর দ্বিতীয় দিনে হল একেবারে উপচে পড়েছিল।”

পরে ১৯২৩ সালে বাবাকে ব্রাজিলে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে বাবা অনেক অনেক লোকেদের সামনে বক্তৃতা দিয়েছিল। অনুবাদ করার জন্য বাবা অনেক সময় বাইরের অনুবাদকদের ডাকত। ১৯২৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বরের প্রহরীদুর্গ-এ লেখা হয়েছিল: “১লা জুন থেকে ৩০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভাই ইয়ং ২১ জায়গায় বক্তৃতা দেন যেখানে মোট ৩,৬০০ লোক এসেছিলেন। মণ্ডলীতে ৪৮ বার মিটিং করা হয়েছিল আর সেখানে ১,১০০ জন এসেছিল। পর্তুগীজ ভাষায় প্রায় ৫০০০ বইপত্র বিনা পয়সায় লোকেদের দেওয়া হয়েছিল।” বাবা যখন “লক্ষ লক্ষ লোক যারা বেঁচে আছেন কখনও মারা যাবেন না” এই বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছিল তখন অনেক লোকেরা সত্য শিখতে চেয়েছিল।

১৯৯৭ সালের ৮ই মার্চ যখন ব্রাজিল শাখায় নতুন বিল্ডিং উৎসর্গ করা হয়েছিল তখন একটা উৎসর্গ ব্রোশার ছাপানো হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল: “১৯২৩: জর্জ ইয়ং ব্রাজিলে এসেছিলেন। রিও ডি জেনিরোর শাখা অফিস তার কথামতোই বানানো হয়েছিল।” সেই সময়ে ব্রাজিলে যদিও স্প্যানিশ ভাষায় বইপত্র পাওয়া যেত কিন্তু পর্তুগীজ ভাষার বইপত্র খুবই দরকারী ছিল। কারণ সেখানকার বেশিরভাগ লোকেরা পর্তুগীজ ভাষা বলত। এইজন্য ১৯২৩ সালের ১লা অক্টোবর থেকে পর্তুগীজ ভাষায় প্রহরীদুর্গ ছাপানো শুরু হয়।

ব্রাজিলে এমন অনেক লোকেদের সঙ্গে বাবার বন্ধুত্ব হয় যাদের ভোলা যায় না। তাদের একজন ছিলেন এক গণ্যমান্য পর্তুগীজ ভদ্রলোক জাসীন্টু পীমেন্টেল কেব্রেল। এই ভদ্রলোক প্রথমে তার ঘরে মিটিং করতে দিয়েছিলেন আর খুব তাড়াতাড়িই নিজে সত্য শিখেছিলেন। পরে তিনি ব্রাজিল বেথেলে কাজ করার জন্য এসেছিলেন। আরেকজন ছিলেন এক অল্প বয়সী পর্তুগীজ মালী যার নাম ছিল ম্যানুয়েল ড্যা সিলভা জোর্ড্যাও। বাবার একটা বক্তৃতা তার এত ভাল লেগেছিল যে সে তার নিজের দেশ পর্তুগালে ফিরে যায় আর সেখানে গিয়ে কল্পটর অর্থাৎ পূর্ণ-সময়ের প্রচার শুরু করে দেয়।

বাবা রেলরোড দিয়ে সারা ব্রাজিলে ঘুরে বেড়াত আর আগ্রহী লোকেদের খুঁজে বের করত। এইরকমই একবার বাবা বনী আর ক্যাটারিনা গ্রেনের কাছে যায়, তাদের সঙ্গে দুসপ্তা থাকে আর তাদের বাইবেল থেকে সত্য জানায়। তাদের পরিবারের সাতজন যিহোবার কাছে নিজেদের সমর্পণ করে বাপ্তিস্ম নেয়।

বাবার আরেকটা ভাল অভিজ্ঞতা ছিল ১৯২৩ সালে সেরা বেলোনা ফারগেসানের সঙ্গে দেখা হওয়া। সেরা ১৮৬৭ সালে তার বড়ভাই ইরাসমস ফলটন স্মিথ ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে আমেরিকা থেকে ব্রাজিলে এসে থাকতে শুরু করেছিলেন। আর ১৮৯৯ সাল থেকে তিনি নিয়মিত প্রহরীদুর্গ পত্রিকা পড়তেন। ১৯২৩ সালে যখন বাবা সেরার দেখা পান তখন সেরা তার চার ছেলেমেয়ে ও আরেকজন ভদ্রমহিলা যাকে বাবা স্যালি মাসি বলে ডাকত তারা বাপ্তিস্ম নেওয়ার জন্য একেবারে তৈরি ছিল। সেরা যেন অপেক্ষাই করছিলেন যে কবে কোন একজন সাক্ষি তার কাছে আসবেন। বাবাকে দেখে তারা খুব খুশি হয়েছিলেন আর ১৯২৪ সালের ১১ই মার্চ সবাই বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।

এরপর বাবা দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোতে প্রচার করার জন্য চলে যায়। ১৯২৪ সালের ৮ই নভেম্বর বাবা পেরু থেকে এই চিঠিটা লিখেছিল: “আমি এরমধ্যেই লাইমা আর ক্যালাও শহরে ১৭,০০০ ট্র্যাক্ট লোকেদের দিয়ে ফেলেছি।” এরপর বাবা ট্র্যাক্ট দিতে বলিভিয়া যাওয়ার জন্য রওনা দেয়। বাবা লিখেছিল: “ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমার খাটাখাটনি কাজে আসছে। দক্ষিণ আমেরিকার একজন ভদ্রলোক আমাকে ট্র্যাক্টগুলোকে লোকেদের দিতে সাহায্য করেছেন। তার ঘর আমাজন নদীর ধারে। ফেরার সময় তিনি ১০০০ ট্র্যাক্ট আর কিছু বইপত্র সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন।”

বাবার জন্য মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশে বাইবেল সত্যের বীজ বোনা গিয়েছিল। ১৯২৪ সালের ১লা ডিসেম্বরের প্রহরীদুর্গ লিখেছিল: “জর্জ ইয়ং দুবছরেরও বেশি সময় ধরে দক্ষিণ আমেরিকায় আছেন . . . আর স্ট্রেইট অফ ম্যাগলনের পুন্টা এরেনাতে প্রচার করার সুযোগ এই প্রিয় ভাই পেয়েছিলেন।” এছাড়া কোষ্টা রিকা, পানামা ও ভেনিজুয়েলাতে গিয়েও বাবা লোকেদের সত্য শুনিয়েছিল। সেইসময়ে ম্যালেরিয়া হওয়ায় বাবার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু তবুও বাবা প্রচার করা ছেড়ে দেয়নি।

ইউরোপে প্রচার

১৯২৫ সালের মার্চ মাসে বাবা জাহাজে করে ইউরোপে যায়। বাবা এখানে অনেককিছু করবে বলে ভেবেছিল। এখানে বাবা স্প্যানিশ আর পর্তুগীজ ভাষায় ৩,০০,০০০ ট্র্যাক্ট লোকেদের দিতে চেয়েছিল আর ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতার ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্পেনে এসে বাবা জানতে পারে যে এখানকার লোকেরা অন্যের ধর্মের কথা একেবারেই শুনতে চায় না। সেইজন্য বাবা ভাই রাদারফোর্ডকে বক্তৃতা দিতে আসতে মানা করে।

ভাই রাদারফোর্ড বাবাকে যিশাইয় ৫১:১৬ পদের কথাগুলো লিখে উত্তর দিয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল: “আমি আপন বাক্য তোমার মুখে রাখিলাম, আপন হস্তের ছায়ায় তোমাকে আচ্ছাদন করিলাম। আমার উদ্দেশ্য, আকাশমণ্ডল রোপণ করি, পৃথিবীর ভিত্তিমূল স্থাপন করি, এবং সিয়োনকে বলি, তুমি আমার প্রজা।” এই চিঠি পড়ে বাবা উত্তর দিয়েছিল: “সত্যিই প্রভু চান যে আমি সব ব্যবস্থা করি আর ফলাফল আমি চিন্তা করব না, তাঁর উপরেই সবকিছু ছেড়ে দেব।”

১৯২৫ সালের ১০ই মে ভাই রাদারফোর্ড বার্সিলোনা শহরের নোভেড্যাডেস হলে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতার অনুবাদ হয়েছিল। ২০০০রের বেশি জন সেখানে এসেছিলেন। একজন সরকারি অফিসার ও তার দেহরক্ষী মঞ্চে ছিল। মাড্রিডেও বক্তৃতা শুনতে প্রায় ১,২০০ জন লোক এসেছিলেন। বক্তৃতা শুনে অনেক লোকেরা সত্যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন ফলে স্পেনে একটা শাখা অফিস বানানো হয়েছিল। যিহোবার সাক্ষিদের ১৯৭৮ সালের বর্ষপুস্তক (ইংরেজি) বলে যে এই শাখা “জর্জ ইয়ংয়ের কথামতো বানানো হয়েছিল।”

১৯২৫ সালের ১৩ই মে ভাই রাদারফোর্ড পর্তুগালের লিসবনে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। যদিও সেখানকার পাদ্রিরা চেয়ার ভেঙে ও চিৎকার চেঁচামেচি করে বক্তৃতা পণ্ড করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু তবুও তারা সফল হয়নি। স্পেন আর পর্তুগালে ভাই রাদারফোর্ডের বক্তৃতার পর বাবা “ফটো ড্রামা” দেখানোর ব্যবস্থা করে। এই শহরে বাবা বাইবেলের বইপত্র ছাপানো ও লোকেদের হাতে তা দেওয়ারও ব্যবস্থা করে। ১৯২৭ সালে বাবা বলেছিল যে “সুসমাচার স্পেনের সমস্ত নগর ও শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

রাশিয়ায় প্রচার

মিশনারি কাজের জন্য এরপর বাবাকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। ১৯২৮ সালের ২৮শে আগস্ট বাবা রাশিয়ায় পৌঁছায়। ১৯২৮ সালের ১০ই অক্টোবর বাবা একটা চিঠি লেখে যার কিছুটা এইরকম:

“রাশিয়ায় আসার পর আমি সত্যিই অন্তর থেকে প্রার্থনা করেছিলাম যে “তোমার রাজ্য আসুক।” আমি এখানকার ভাষা শেখার জন্য খুব চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার ভাষা শেখা খুব তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে না। আমার শিক্ষক একেবারে আলাদা রকম মানুষ। তিনি একজন যিহুদি কিন্তু যীশু খ্রীষ্টের ওপর তার বিশ্বাস খুব পাকা। আর বাইবেলকেও তিনি খুব ভালবাসেন। এখানে আমার অনেক ভাল ভাল অভিজ্ঞতা হয়েছে কিন্তু জানি না যে আর কতদিন আমি এখানে থাকতে পারব। গত সপ্তাতেই আমাকে বলা হয়েছিল যে ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমি যেন এখান থেকে চলে যাই। কিন্তু এখনকার মতো কোনরকমে বোঝাপড়া হয়েছে, তাই আরও কিছুদিনের জন্য আমি এখানে থাকতে পারবো।”

খারকোভে যা এখন ইউক্রেনের একটা বড় শহর কিছু বাইবেল ছাত্র থাকতেন। তাদের সঙ্গে দেখা করা হয়েছিল। তাদের কাছে যাওয়ায় ও কথাবার্তা বলায় তারা এত খুশি হয়েছিলেন যে তাদের চোখে জল চলে এসেছিল। প্রত্যেক রাতে মাঝরাত পর্যন্ত সেখানে একটা ছোট সম্মেলন হতো। এই সভার বিষয়ে বাবা লিখেছিল: “আমাদের ভাইদের কাছে যা অল্প কয়েকটা বইপত্র ছিল তাও সরকার কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু তবুও ভাইদের মুখে কোন বিরক্তি ছিল না।”

রাশিয়ায় বাবা যে কাজ করেছিল তার কিছু কথা একটা ব্রোশারে লেখা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২১শে জুন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটা নতুন শাখা উৎসর্গ করার সময়ে ওই ব্রোশার লোকেদের দেওয়া হয়েছিল। ওই ব্রোশারে লেখা ছিল যে বাবাকে মস্কো পাঠানো হয়েছিল আর বাবা “ওখানে দুটো পুস্তিকার ১৫,০০০ কপি ছাপানো ও রাশিয়ার লোকেদের দেওয়ার অনুমতি পেয়েছিল। পুস্তিকা দুটোর নাম ছিল লোকেদের জন্য স্বাধীনতা আর মৃতেরা কোথায়?”

রাশিয়া থেকে ফিরে আসার পর বাবাকে ভ্রমণের কাজে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। দক্ষিণ ডাকোটায় বাবার সঙ্গে নেলেনা ও ভের্ডা পুল নামে দুই বোনের দেখা হয় যারা পরে পেরুতে মিশনারি হয়ে যান। বাবা যেভাবে একেবারে সময় নষ্ট না করে তার কাজ করতেন তার প্রশংসা করে তারা লিখেছিলেন: “সেই সময়ে অগ্রগামীর কাজ করার জন্য ভাইদের উৎসাহ সত্যিই দেখার মতো ছিল। তাদের কাছে সারা পৃথিবীর জিনিসপাতি তো কিছু ছিল না কিন্তু তাদের মন যিহোবার জন্য ভালবাসায় ভরে থাকত। এই ভালবাসার জন্যই তারা পৃথিবীর যে কোন জায়গায় যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি ছিলেন। আর এই ভালবাসা থাকার জন্যই তারা মিশনারি কাজে সফল হন।”

বিয়ে আর দ্বিতীয়বার যাওয়া

ক্লেরা হুবার্ট ওন্টারিও মনিটোউলিন দ্বীপে থাকতেন যার সঙ্গে বাবার বেশ কিছু সময় ধরেই যোগাযোগ ছিল আর বাবা চিঠিপত্র লিখত। ১৯৩১ সালের ২৬শে জুলাই কলম্বাস ওহিওর যে সম্মেলনে বাইবেল ছাত্ররা যিহোবার সাক্ষি নাম নিয়েছিল সেই সম্মেলনে তারা দুজনেই এসেছিল। (যিশাইয় ৪৩:১০-১২) এক সপ্তা পরে বাবা বিয়ে করে। এরপর বাবা আবার মিশনারি হয়ে দ্বিতীয় বার বেরিয়ে পড়ে আর ক্যারিবিয়ান দ্বীপে যায়। সেখানে বাবা মিটিং করতে শুরু করে ও ভাইদের প্রচার করতে শেখায়।

বাবা মাকে সুরিনাম, সেন্ট কীট আর অন্য অনেক জায়গা থেকে কার্ড ও চিঠি পাঠাত। প্রচার করার জন্য বাবা যেখানেই যেত সেখানে কী রকম উন্নতি হচ্ছে চিঠিতে তা লিখত আর কখনও কখনও সেখানকার পশুপাখি, গাছপালার কথাও লিখত। ১৯৩২ সালের জুন মাসে বাবা ক্যারিবিয়েন দ্বীপপুঞ্জে তার মিশনারি কাজ শেষ করে আর জাহাজে করে কানাডা চলে আসে। বাবা সবসময় কমদামের টিকিটই কিনত। কানাডায় ফিরে আসার পর বাবা আর মা দুজনে একসঙ্গে পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ শুরু করে। ১৯৩২/৩৩ সালের শীতকালে বাবামা অটোয়াতে পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ করছিলেন এমন ভাইবোনদের এক বড় দলের সঙ্গে প্রচার করত।

অল্প কদিনের সংসার

১৯৩৪ সালে আমার দাদা ডেভিড জন্মায়। যখন সে খুব ছোট ছিল তখন থেকেই সে মায়ের টুপি রাখার বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে “বক্তৃতা” দেওয়া অভ্যাস করত। দাদাও বাবার মতো সারা জীবন ধরে যিহোবার সেবা করেছে। বাবা যখন কানাডার ইষ্ট কোষ্ট থেকে ওয়েষ্ট কোষ্টের মণ্ডলীগুলোতে যেত তখন বেশিরভাব সময়ই মা আর দাদাকে নিয়ে বাবা গাড়িতে করে যেত। গাড়ির মাথায় লাউডস্পীকার বাঁধা থাকত। ১৯৩৮ সালে বাবা যখন ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মণ্ডলীতে মিশনারির কাজ করত সেইসময় আমার জন্ম হয়। দাদা বলে যে বাবা আমাকে বিছানায় শোয়াত আর তারপর বাবা মা আর দাদা তিনজন হাঁটু গেড়ে বসে আমার জন্য প্রার্থনা করত।

১৯৩৯ সালের শীতকালে আমরা ভেংকুভারে থাকতাম আর বাবা সেখানকার মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করতে যেত। সারা বছর ধরে বাবা যে চিঠিগুলো লিখেছিল তার মধ্যে একটা বাবা লিখেছিল ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভারনন থেকে। চিঠিটা বাবা ১৯৩৯ সালের ১৪ই জানুয়ারি মাসে লিখেছিল। এই চিঠিতে প্রথম লাইনে মা, দাদা ও আমার নাম লিখে বাবা লিখেছিল: “তোমরা সবাই আমার আন্তরিক ভালবাসা নিও।” এই চিঠিতে আমাদের সবার জন্য কিছু খবর ছিল। বাবা লিখেছিল কাটার জন্য শষ্য প্রচুর কিন্তু কাজের লোকের অভাব রয়েছে।—মথি ৯:৩৭, ৩৮.

সেখান থেকে ভেংকুবারে ফেরার পর হঠাৎই একদিন মিটিং চলাকালে বাবা পড়ে যায়। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায় যে বাবার ক্যান্সার হয়েছে। বাবার ব্রেন টিউমার হয়েছিল। ১৯৩৯ সালের ১লা মে বাবা তার পৃথিবীর জীবন শেষ করেন। আমার বয়স তখন ছিল মাত্র ৯ মাস আর দাদা পাঁচ বছরের। ১৯৬৩ সালের ১৯শে জুন আমাদের মাও আমাদের ছেড়ে চলে যায়। মায়েরও স্বর্গে যাওয়ার আশা ছিল তারা দুজনেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিল।

আলাদা আলাদা দেশে গিয়ে লোকেদেরকে সুসমাচার শোনাতে বাবার কেমন লাগত তা মাকে লেখা একটা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি। চিঠিতে বাবা লিখেছিল: “আলাদা আলাদা দেশে গিয়ে রাজ্যের বার্তার জ্যোতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যিহোবা আমাকে বেছেছিলেন। আমার প্রতি এটা তাঁর অপার দয়া। তাঁর পবিত্র নামের মহিমা হোক। দুর্বল, অযোগ্য, কমজোরি মানুষদের দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ায় যিহোবার আরও বেশি মহিমা হয়।”

আজকে জর্জ আর ক্লেরা ইয়ংয়ের ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনি ও তাদের ছেলেমেয়েরাও যিহোবার সেবা করছে। আমাকে বলা হয়েছিল যে বাবা সবসময় ইব্রীয় ৬:১০ পদের কথাগুলো বলত। যেখানে লেখা আছে: “ঈশ্বর অন্যায়কারী নহেন; তোমাদের কার্য্য, . . .তদ্দ্বারা তাঁহার নামের প্রতি প্রদর্শিত তোমাদের প্রেম, এই সকল তিনি ভুলিয়া যাইবেন না।” আমরাও আমাদের বাবার কাজ ভুলিনি।

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডানদিকে তার তিন ভাইয়ের সঙ্গে বাবা

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ভাই উডওয়ার্ত, রাদারফোর্ড ও ম্যাকমিলানের সঙ্গে বাবা (দাঁড়িয়ে)

নিচে: ভাই রাসেলের সঙ্গে দলের মধ্যে বাবা (একেবারে বাঁদিকে)

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বাবা, মা

নিচে: বাবা মায়ের বিয়ের দিন

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাবা মারা যাওয়ার কয়েক বছর পরে মা ও দাদার সঙ্গে আমি