অস্ত্র বানানো ছেড়ে দিয়ে আমি মানুষের জীবন বাঁচাতে শুরু করেছি
জীবন কাহিনী
অস্ত্র বানানো ছেড়ে দিয়ে আমি মানুষের জীবন বাঁচাতে শুরু করেছি
ইসিডরোস ইসমাইলিডিস দ্বারা কথিত
একদিন রাতে আমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছিলাম আর সেই সময় আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। আমি ঈশ্বরকে বলছিলাম: “হে ঈশ্বর আমি এখন কী করব? আমার বিবেক আমাকে বলছে যে আমার অস্ত্র বানানোর কাজ করা উচিত না। কিন্তু অনেক খুঁজেও আমি এখন পর্যন্ত আরেকটা চাকরি পাইনি। কাল আমি চাকরি ছেড়ে দেব। যিহোবা, আমাদেরকে একটু দয়া কর যাতে আমাদের চার বাচ্চা খিদেয় কষ্ট না পায়।” কিন্তু, কেন আমি এভাবে প্রার্থনা করেছিলাম? সেই কথাই আমি আপনাদের বলছি।
উনিশশ বত্রিশ সালে উত্তর গ্রিসের ড্রামায় আমার জন্ম। এখানকার জীবন খুব সাদাসিধে ও শান্তিপূর্ণ ছিল। আমার বাবা আমাকে প্রায়ই তার ইচ্ছের কথা বলত। সে চেয়েছিল আমি আমেরিকা গিয়ে পড়ালেখা করে অনেক বড় হই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রিসের ধনসম্পত্তি লুট করা হয়েছিল। আর এরপর গ্রিকদের মুখে মুখে এই কথাটা শোনা যেত: “তোমরা আমাদের ধনসম্পদ কেড়ে নিতে পার কিন্তু আমাদের বিদ্যাবুদ্ধিকে কখনোই কেড়ে নিতে পারবে না।” আর তাই আমি ঠিক করেছিলাম যে আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় হব এবং সেই বিদ্যাবুদ্ধি লাভ করব, যা কেউ কখনও কেড়ে নিতে পারবে না।
ছেলেবেলা থেকেই আমি গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার বিভিন্ন যুব সংঘের সাথে জড়িত ছিলাম। গির্জা আমাদেরকে বলে দিয়েছিল যে আমরা যেন বিপদজনক সম্প্রদায়গুলো থেকে দূরে থাকি। আমার স্পষ্ট মনে আছে তারা যিহোবার সাক্ষিদের নাম ধরে বলেছিল যে তারা যীশু খ্রীষ্টকে মানে না আর তাই আমরা যেন তাদের থেকে দশ হাত দূরে থাকি।
১৯৫৩ সালে এথেন্সের একটা টেকনিক্যাল স্কুল থেকে পাশ করে আমি চাকরির খোঁজে জার্মানি গিয়েছিলাম, যাতে আমি আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারি। কিন্তু জার্মানি গিয়ে আমি কোন চাকরি পাইনি, তাই সেখান থেকে অন্য দেশে চলে যাই। কয়েক সপ্তা পর আমি বেলজিয়ামের একটা বন্দরে এসে পৌঁছি আর আমার হাতে তখন একটা পয়সাও ছিল না। আমার এখনও মনে আছে যে আমি একটা গির্জায় গিয়ে
অনেক কেঁদেছিলাম। আমি ঈশ্বরকে বলেছিলাম যে আমি যদি কোনরকমে আমেরিকা যেতে পারি, তাহলে আমি টাকাপয়সার পিছনে না ছুটে পড়ালেখা করব এবং একজন সৎ খ্রীষ্টান ও ভাল নাগরিক হতে চেষ্টা করব। শেষে ১৯৫৭ সালে আমি আমেরিকা যাই।আমেরিকায় নতুন জীবন
আমি ওই দেশে নতুন এসেছিলাম, ওই দেশের ভাষা ভাল করে জানতাম না আর তার ওপর আমার হাতে কোন টাকাপয়সা ছিল না। তাই আমেরিকাতে ওই দিনগুলো আমার খুব কষ্টে কেটেছিল। আমি রাতে দুটো চাকরি করতাম ও দিনে স্কুলে যেতাম। আমি বেশ কয়েকটা কলেজ থেকে ডিগ্রি নিই। তারপর আমি লস আ্যঞ্জেলস্ এর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাই এবং সেখান থেকে ফলিত পদার্থবিদ্যার ওপর ব্যাচেলর অফ সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করি। বাবার ইচ্ছের কথা আমার মাথায় ছিল বলেই আমি এত কষ্টের মধ্যেও আমার পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।
এই সময় ইকাটেরিনি নামে এক সুন্দরী গ্রিক মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আর ১৯৬৪ সালে আমরা বিয়ে করি। বিয়ের তিন বছরের মাথায় আমাদের প্রথম ছেলের জন্ম হয় আর এর পরের চার বছরেরও কম সময়ে আমাদের আরও দুই ছেলে ও এক মেয়ে হয়। পরিবারের ভরণপোষণ করা ও সেইসঙ্গে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন ছিল।
আমি ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেলে আমেরিকার বিমানবাহিনীর হয়ে একটা মিশাইল ও স্পেইস কোম্পানিতে কাজ করতাম। আমি বিভিন্ন এয়ার আ্যন্ড স্পেইস প্রকল্পে কাজ করতাম, এর মধ্যে এজেনা আ্যন্ড আ্যপোলো প্রোগ্রামও ছিল। এমনকি আ্যপোলো ৮ এবং আ্যপোলো ১১ মিশনে কাজ করার জন্য আমি পদকও পেয়েছিলাম। এরপর আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাই এবং সামরিক কাজে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ি। তখন আমার মনে হতো যে আমি পুরোপুরি সুখী কারণ আমার ঘরে সুন্দরি স্ত্রী ও চারটে ফুটফুটে ছেলেমেয়ে আছে, আমি ভাল চাকরি করি এবং সুন্দর বাড়িতে থাকি। বেঁচে থাকার জন্য এর চেয়ে বেশি আর কী চাওয়ার আছে!
এক নাছোড়বান্দা লোক
১৯৬৭ সালের প্রথম দিকে জিমের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জিম খুব নম্র ও ভাল লোক ছিল। আমরা দুজনে একসঙ্গেই কাজ করতাম। জিমের মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত আর আমি যখনই তাকে একসঙ্গে কফি খাওয়ার জন্য ডাকতাম, সে না করত না। কফি খেতে খেতে সে আমার সঙ্গে বাইবেল থেকে বিভিন্ন কথা বলত। জিম আমাকে জানিয়েছিল যে সে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে বাইবেল স্টাডি করছে।
জিম যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে মেলামেশা করছে শুনে আমার খুব খারাপ লেগেছিল। এত ভাল একজন মানুষ কী করে এই লোকেদের পাল্লায় পড়ল, যারা কিনা যীশু খ্রীষ্টকেই মানে না? কিন্তু এর জন্য আমি জিমের সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করিনি কারণ সে আমাকে অনেক ভালবাসত। বলতে গেলে রোজই সে আমাকে কোন না কোন বই দিত। যেমন, একদিন সে আমার অফিসে এসে আমাকে বলে: “ইসিডরোস, প্রহরীদুর্গ এর এই প্রবন্ধে পারিবারিক বন্ধনকে কী করে আরও অটুট করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করেছে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তুমি ও তোমার স্ত্রী একসঙ্গে পড়ে দেখ।” আমি পড়ব বললেও কিছুক্ষণ পরই টয়লেটে গিয়ে পত্রিকাটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিই।
তিন বছর ধরে জিম আমাকে যে বইপত্রিকা দিত সেগুলো আমি এভাবেই ফেলে দিতাম। যিহোবার সাক্ষিদের সম্বন্ধে তখনও পর্যন্ত আমার ভুল ধারণা ছিল। কিন্তু তাই বলে আমি জিমের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বকে নষ্ট করতে চাইনি। সেইজন্য
আমি ঠিক করেছিলাম যে জিম যা বলে, তা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেব।তবে জিমের কথা থেকে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি যা বিশ্বাস করতাম ও মানতাম সেগুলো আসলে বাইবেলের শিক্ষা ছিল না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে ত্রিত্ব, নরক ও আত্মার অমরত্বের শিক্ষা বাইবেলে নেই। (উপদেশক ৯:১০; যিহিষ্কেল ১৮:৪; যোহন ২০:১৭) যেহেতু আমি একজন গ্রিক অর্থোডক্স ছিলাম তাই আমার মধ্যে কিছুটা অহংকার ছিল। সেইজন্য জিমের কথাগুলো যে ঠিক ছিল তা আমি খোলাখুলিভাবে কখনোই স্বীকার করিনি। কিন্তু সে সবসময় বাইবেল থেকেই কথা বলত এবং কখনও তার নিজের মতামত অন্যের ওপর চাপিয়ে দিত না। আর তাই শেষ পর্যন্ত আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে জিম আসলে আমাকে বাইবেল থেকে খুব মূল্যবান বিষয় জানিয়েছিল।
আমাকে দেখে আমার স্ত্রী বুঝতে পেরেছিল যে কিছু একটা হয়েছে, তাই সে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি জিমের সঙ্গে কথা বলেছি কিনা, যে সাক্ষিদের সঙ্গে স্টাডি করত। তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে বলার পর আমার স্ত্রী বলেছিল: “যিহোবার সাক্ষিদের ছাড়া অন্য যে কোন গির্জায় যেতে আমি রাজি আছি।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা দুজনে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে যিহোবার সাক্ষিদের মিটিংগুলোতেই যেতে শুরু করি।
এক কঠিন সিদ্ধান্ত
বাইবেল পড়তে পড়তে একদিন আমি ভাববাদী যিশাইয়ের এই কথাগুলো পড়ি: “তাহারা আপন আপন খড়্গ ভাঙ্গিয়া লাঙ্গলের ফাল গড়িবে, ও আপন আপন বড়শা ভাঙ্গিয়া কাস্তা গড়িবে; এক জাতি অন্য জাতির বিপরীতে আর খড়্গ তুলিবে না, তাহারা আর যুদ্ধ শিখিবে না।” (যিশাইয় ২:৪) এই পদ পড়ে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, ‘শান্তিপ্রিয় ঈশ্বরের একজন দাস কী করে অস্ত্র বানাতে পারে?’ (গীতসংহিতা ৪৬:৯) আমি সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করি যে এই চাকরিটা আমি ছেড়ে দেব।
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা ছিল এক কঠিন সিদ্ধান্ত। কারণ এই চাকরিতে অনেক সম্মান ছিল। এই চাকরি পাওয়ার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, পড়ালেখা করতে হয়েছে ও অনেক ত্যাগস্বীকার করতে হয়েছে। ওপরে ওঠার এই সিঁড়িতে পা দেওয়ার জন্য আমাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আর এখন এই চাকরিটাই আমাকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু, আমি যিহোবাকে ভালবাসি ও তাঁর ইচ্ছা পালন করতে চাই।—মথি ৭:২১.
আমি ঠিক করেছিলাম যে ওয়াশিংটনের সিয়াটলে একটা কোম্পানিতে কাজ করব কিন্তু সেখানে গিয়ে আমি দেখি যে এখানে কাজ করলেও আমি যিশাইয় ২:৪ পদের কথা মেনে চলতে পারব না। আমি এই অফিসেরই অন্যান্য প্রজেক্টে কাজ করি কিন্তু বিবেকের দংশনে সেই কাজগুলোও করতে পারি না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই চাকরি করলে আমি ঈশ্বরের সামনে আমার বিবককে শুদ্ধ রাখতে পারব না।—১ পিতর ৩:২১.
আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদেরকে আরও অনেক বড় বড় পরিবর্তন করতে হবে। ছয় মাসেরও কম সময়ে আমরা পরিবারের খরচ প্রায় অর্ধেক কমিয়ে এনেছিলাম। এরপর আমরা আমাদের সুন্দর বড় বাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে কলোরাডোর ডেনভারে একটা ছোট্ট বাড়ি কিনেছিলাম। এবারে আমি চাকরিটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য একেবারে তৈরি। আমার নিরপেক্ষতার কথা জানিয়ে আমি পদত্যাগপত্র লিখি। ওইদিন রাতেই ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমি ও আমার স্ত্রী হাঁটু গেড়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি, যা শুরুতে বলেছি।
কয়েকদিন পরই আমরা ডেনভারে চলে যাই এবং দুসপ্তা পর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আমি ও আমার স্ত্রী একসঙ্গে বাপ্তিস্ম নিই। ছয় মাস আমার কোন চাকরি ছিল না তাই বাধ্য হয়েই আমাদেরকে জমানো টাকায় হাত দিতে হয়। আমাদের জমানো টাকা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল আর সাত মাসের মাথায় ব্যাংকে, আমাদের বাড়ির জন্য মাসে মাসে যে টাকা দিতে হতো তার চেয়েও কম টাকা ছিল। তাই আমি ছোটখাটো যে কোন একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকি। আর কয়েকদিন পরই আমি ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পাই। এই চাকরিতে আমার বেতন আগের বেতনের অর্ধেক ছিল কিন্তু আমি যিহোবার কাছে যা চেয়েছিলাম তার চেয়েও আরও অনেক বেশি পেয়েছিলাম। ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়গুলোকে জীবনে প্রথমে রাখতে পেরে আমি কত খুশি হয়েছিলাম!—আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের যিহোবাকে ভালবাসতে শিখিয়েছি
আমি ও ইকাটেরিনি আমাদের চার ছেলেমেয়েকে ঈশ্বরের নীতিগুলো শেখাতে থাকি, যা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু আনন্দের বিষয় হল, তারা চারজনই ভাল খ্রীষ্টান হয়েছে। তারা চারজনই তাদের জীবনকে সবচেয়ে জরুরি কাজ অর্থাৎ রাজ্যের প্রচার কাজের জন্য উজাড় করে দিয়েছে। আমাদের তিন ছেলে ক্রিসটোস, লেকস্ এবং গ্রেগরি মিনিস্টেরিয়াল ট্রেইনিং স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েছে এবং এখন বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করছে, বিভিন্ন মণ্ডলী পরিদর্শন করে সেগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে। আমাদের মেয়ে টুলা এখন নিউ ইয়র্কে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয়ে কাজ করে। আমরা যখন দেখি যে তারা সবাই-ই যিহোবাকে সেবা করার জন্য ভাল ভাল ক্যারিয়ার ও ভাল মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়েছে তখন গর্বে আমাদের বুক ফুলে ওঠে।
অনেকে আমাদের জিজ্ঞেস করেছে যে কীভাবে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছি। ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন নিয়ম নেই কিন্তু আমরা হাল ছেড়ে না দিয়ে তাদের হৃদয়ে যিহোবা ও প্রতিবেশীর জন্য ভালবাসা গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬, ৭; মথি ২২:৩৭-৩৯) বাচ্চারা বুঝতে পেরেছিল যে আমরা যিহোবাকে ভালবাসি, এই কথা শুধু মুখে বললেই হবে না কিন্তু আমাদের কাজের মধ্যে দিয়েও তা দেখাতে হবে।
সাধারণত প্রতি শনিবারে আমরা পরিবারের সবাই মিলে প্রচারে যেতাম। প্রতি সোমবার রাতের খাবারের পর আমরা পরিবারের সবাই মিলে বাইবেল স্টাডি করতাম। শুধু তাই নয়, আমরা প্রত্যেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে আলাদা আলাদা স্টাডি করতাম। বাচ্চারা যখন ছোট ছিল তখন আমরা প্রত্যেকটা বাচ্চার সঙ্গে অল্প সময় নিয়ে সপ্তায় বেশ কয়েকবার স্টাডি করতাম। কিন্তু, তারা যখন বড় হতে থাকে আমরা সপ্তায় একদিন একটু বেশি সময় নিয়ে স্টাডি করাতাম। স্টাডি করানোর সময় বাচ্চারা মন খুলে তাদের সমস্যার কথা আমাদের জানাত।
মাঝে মাঝে আমরা পরিবারের সবাই মিলে মজা করতাম। আমরা একসঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজাতাম এবং প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ে তাদের প্রিয় গানগুলো বাজাতে ভালবাসত। মাঝে মাঝে শনি-রবিবারগুলোতে আমরা অন্যদেরকে আমাদের বাড়িতে
নিমন্ত্রণ দিতাম। এছাড়া আমরা ছুটি কাটানোর জন্য বাইরেও বেড়াতে যেতাম। একবার আমরা দুসপ্তার ছুটি কাটাতে কলোরাডোর পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম ও সেখানকার মণ্ডলীর সঙ্গে প্রচার করেছিলাম। ছেলেমেয়েরা জেলা সম্মেলনের বিভিন্ন বিভাগে এবং বিভিন্ন জায়গায় কিংডম হল বানানোর কাজে সাহায্য করে খুবই খুশি হয়েছিল। আমাদের ছেলেমেয়েরা আজও সেই কথা মনে করে আনন্দ পায়। আমরা যখন ছেলেমেয়েদেরকে গ্রিসে আত্মীয়স্বজনদের দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম তখন তারা অনেক বিশ্বস্ত সাক্ষি ভাইবোনদেরও দেখেছিল, যারা তাদের বিশ্বাসের জন্য জেল খেটেছিলেন। এই ভাইবোনদের অটল বিশ্বাস তাদের ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল আর তারা সত্যে অটল থাকার জন্য আরও সাহসী হওয়ার শক্তি পেয়েছিল।অবশ্য, মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ অবাধ্য হয়েছিল এবং খারাপ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করেছিল। আবার মাঝে মাঝে আমরাও খুব বেশি কড়া হয়ে তাদের জন্য সমস্যা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু, বাইবেলে ‘যিহোবার চেতনা’ সম্বন্ধে যা কিছু বলা আছে তা কাজে লাগিয়ে আমরা সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম।—ইফিষীয় ৬:৪; ২ তীমথিয় ৩:১৬, ১৭.
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়
আমাদের চার ছেলেমেয়েই পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করার পর, আমি ও ইকাটেরিনি আমাদের প্রচার কাজকে আরও কীভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করি কারণ এই কাজ মানুষের জীবন বাঁচায়। তাই, ১৯৯৪ সালের প্রথম দিকে আমি ইচ্ছা করেই কিছুটা আগে চাকরি থেকে অবসর নিই এবং আমরা দুজনেই অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করি। আমরা এখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচার করি ও কিছু ছাত্রদের সঙ্গে বাইবেল স্টাডিও করি। খুব বেশি আগে নয়, আমিও তাদের মতোই ছিলাম তাই আমি তাদের অসুবিধাগুলো বুঝতে পারি ও যিহোবার সম্বন্ধে জানাতে তাদেরকে সাহায্য করতে পারি। ইথিয়পিয়া, চিলি, চিন, তুরস্ক, থাইল্যান্ড, বলিভিয়া, ব্রাজিল, মিশর এবং মেক্সিকো থেকে আসা ছাত্রদের সঙ্গে বাইবেল স্টাডি করা এক দারুণ অভিজ্ঞতা! এছাড়াও আমি টেলিফোনে প্রচার করি, বিশেষ করে তাদের কাছে যারা আমার ভাষা জানেন।
আমার কথার মধ্যে গ্রিক ভাষার টান থাকায় ও বয়স হয়ে যাওয়ায় আমার কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু আমি সবসময় চেষ্টা করেছি যিশাইয়ের মতো মনোভাব রাখতে, যিনি বলেছিলেন: “এই আমি, আমাকে পাঠাও।” (যিশাইয় ৬:৮) আমরা অনেক খুশি যে আমরা বেশ কয়েকজনকে সত্য জানতে সাহায্য করেছি ও তারা যিহোবার কাছে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে। তাই, এটাই হল আমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।
একসময় আমি মানুষদের মেরে ফেলার অস্ত্র বানানোর কাজ করতাম। কিন্তু, যিহোবা আমাদেরকে তাঁর অপার দয়া দেখিয়েছেন। আর এইজন্য আমি ও আমার পরিবারের সবাই তাঁর উৎসর্গীকৃত দাস হতে পেরেছি এবং পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্ত জীবনের সুসমাচার প্রচার করার সুযোগ পেয়েছি। আমাকে যে কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিতে হয়েছিল সেগুলো নিয়ে আমি যখন চিন্তা করি তখন মালাখি ৩:১০ পদের কথা আমার মাথায় আসে: “তোমরা ইহাতে আমার পরীক্ষা কর, ইহা বাহিনীগণের সদাপ্রভু কহেন, আমি আকাশের দ্বার সকল মুক্ত করিয়া তোমাদের প্রতি অপরিমেয় আশীর্ব্বাদ বর্ষণ করি কি না।” সত্যিই তিনি আমাদেরকে অপরিমেয় আশীর্বাদ করেছেন!
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
লেকস্: আমার বাবা ভণ্ডামি ঘৃণা করত। সে কখনোই ভণ্ডামি করেনি আর এই ব্যাপারে সে সবসময়ই আমাদের জন্য ভাল উদাহরণ রেখেছে। সে প্রায়ই আমাদের বলত: “যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করা অনেক বড় দায়িত্ব। এর জন্য তোমাদেরকে ত্যাগস্বীকার করতে হবে। আর একজন খ্রীষ্টানের জীবন মানেই ত্যাগস্বীকারের জীবন।” এই কথাগুলো আমার মনে একেবারে গেঁথে গেছে আর আমি আমার বাবাকে দেখেই যিহোবার জন্য ত্যাগস্বীকার করতে পেরেছি।
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
ক্রিস্টোস: আমার বাবামা যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে এবং আমাদের প্রতি তাদের দায়িত্বগুলো ঠিক ঠিকভাবে পালন করেছে বলে আমি তাদের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। আমরা পরিবারের সবাই মিলে, প্রচার কাজ থেকে শুরু করে ছুটি কাটানো সবকিছুই একসঙ্গে করতাম। তারা আরও অনেক কিছুই করতে পারত কিন্তু তা না করে তারা তাদের জীবনকে সাদাসিধে রেখেছে ও শুধু প্রচারের ওপরই তাদের চোখকে স্থির রেখেছে। আজকে আমিও পুরোপুরিভাবে যিহোবার কাজ করতে পারছি বলে অনেক খুশি।
[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
গ্রেগরি: শুধু আমার বাবামার উৎসাহই নয় বরং তাদের উদাহরণ ও যিহোবার সেবায় তাদের আনন্দপূর্ণ মনোভাবই আমাকে আমার পরিস্থিতি আবারও যাচাই করে দেখতে ও মন থেকে সমস্ত দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে যিহোবার কাজ করতে সাহায্য করেছে। যিহোবার কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে আমাকে আনন্দ খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য আমি আমার বাবামাকে ধন্যবাদ জানাই।
[২৮ পৃষ্ঠার বাক্স/চিত্র]
টুলা: আমার বাবামা সবসময় আমাদেরকে বলত যে যিহোবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হল সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আর একমাত্র যিহোবার জন্য কাজ করেই আমরা সত্যিকারের সুখী হতে পারি। তারা আমাদের সামনে যিহোবাকে বাস্তব ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেছে। আমার বাবা প্রায়ই বলত যে রোজ রাতে তুমি যখন শুদ্ধ বিবেক নিয়ে বিছানায় যাও ও বুঝতে পার যে যিহোবাকে খুশি করার জন্য তুমি তোমার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছ, তার চেয়ে বড় শান্তি আর কিছু হতে পারে না।
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৫১ সালে গ্রিসে, আমি একজন সৈনিক ছিলাম
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৬৬ সালে ইকাটেরিনির সঙ্গে
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৯৬ সালে আমার পরিবার: (বাঁ দিক থেকে ডানে, পেছনে) গ্রেগরি, ক্রিসটোস, টুলা; (সামনে) লেকস্, ইকাটেরিনি ও আমি