‘প্রজ্ঞা নম্রদিগের সহচরী’
‘প্রজ্ঞা নম্রদিগের সহচরী’
“নম্রভাবে তোমার ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন, ইহা ব্যতিরেকে সদাপ্রভু তোমার কাছে আর কিসের অনুসন্ধান করেন?”—মীখা ৬:৮.
১, ২. নম্রতা কী এবং কোন্ দিক দিয়ে এটা অহংকারের চেয়ে আলাদা?
একজন বিখ্যাত প্রেরিত নিজেকে বড় মনে করেননি। ইস্রায়েলের একজন সাহসী বিচারক নিজেকে সবচেয়ে ছোট বলেছিলেন। আর এই পৃথিবীর সর্বমহান পুরুষ স্বীকার করেন যে তাঁর হাতে পুরো ক্ষমতা নেই। এরা সবাই নম্রতা দেখান।
২ নম্রতা হল অহংকারের বিপরীত। একজন নম্র ব্যক্তি তার সামর্থ্য ও যোগ্যতা কতটুকু তা জানেন এবং অযথা গর্ব করেন না। তিনি তার সীমা জানেন এবং নিজেকে কখনোই বড় মনে করেন না বা তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আর তাই তিনি অন্যদের আবেগ-অনুভূতিকে সম্মান করেন এবং তাদের কথাকে গুরুত্ব দেন।
৩. প্রজ্ঞা কীভাবে “নম্রদিগের সহচরী”?
৩ তাই, বাইবেল ঠিক কথাই বলে: “প্রজ্ঞাই নম্রদিগের সহচরী।” (হিতোপদেশ ১১:২) একজন নম্র ব্যক্তির বুদ্ধি আছে কারণ তিনি ঈশ্বরের পথে চলেন এবং অহংকার করেন না, যার পরিণতি হল অপমান। (হিতোপদেশ ৮:১৩; ১ পিতর ৫:৫) নম্র ব্যক্তিদের যে প্রজ্ঞা আছে, তা ঈশ্বরের অনেক দাসেরাই প্রমাণ করেছেন। আসুন আমরা প্রথম অনুচ্ছেদে বলা ঈশ্বরের তিনজন দাসের উদাহরণ দেখি।
পৌল—একজন “সেবক” ও “অধ্যক্ষ”
৪. পৌল কোন্ বিশেষ সুযোগগুলো পেয়েছিলেন?
৪ প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের মধ্যে পৌল যে বিখ্যাত ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ প্রচার করার জন্য তিনি সমুদ্রপথে ও স্থলপথে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিলেন এবং অনেক অনেক মণ্ডলী শুরু করেছিলেন। এছাড়াও যিহোবা পৌলকে অনেক আশীর্বাদ করেছিলেন আর তাই তিনি অনেক দর্শন পেয়েছিলেন এবং অনেক ভাষায় কথা বলতে পারতেন। (১ করিন্থীয় ১৪:১৮; ২ করিন্থীয় ১২:১-৫) শুধু তাই নয়, ঈশ্বরের পবিত্র আত্মার শক্তিতে পৌল ১৪টা চিঠি লিখেছিলেন, যেগুলো এখন বাইবেলের অংশ। তাই বলা যায় যে অন্য সব প্রেরিতদের চেয়ে পৌল বেশি কাজ করেছিলেন।—১ করিন্থীয় ১৫:১০.
৫. পৌল কী করে দেখিয়েছিলেন যে তিনি নিজেকে কখনোই বড় মনে করেননি?
৫ পৌল যেহেতু বেশি কাজ করেছিলেন, তাই কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে তিনি হয়তো নিজেকে বড় মনে করতেন, লোকেদের কাছে তার ক্ষমতা জাহির করে বেড়াতেন। কিন্তু পৌল তা করেননি কারণ তিনি নম্র ছিলেন। তিনি নিজেকে ‘প্রেরিতগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র’ বলেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে “আমি . . . প্রেরিত নামে আখ্যাত হইবার অযোগ্য, কারণ আমি ঈশ্বরের মণ্ডলীর তাড়না করিতাম।” (১ করিন্থীয় ১৫:৯) পৌল আগে খ্রীষ্টানদের তাড়না করতেন আর তাই তিনি কখনোই ভুলে যাননি যে ঈশ্বরের অপার দয়ার কারণেই তিনি ঈশ্বরের কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন এবং তাঁকে সেবা করার বিশেষ সুযোগগুলো পেয়েছিলেন। (যোহন ৬:৪৪; ইফিষীয় ২:৮) তাই, পৌল যদিও প্রচার কাজে অনেক কিছু করেছিলেন, তবুও তিনি নিজেকে কখনোই অন্যদের চেয়ে বড় মনে করেননি।—১ করিন্থীয় ৯:১৬.
৬. পৌল করিন্থীয়দের সঙ্গে যেরকম ব্যবহার করেছিলেন তাতে কীভাবে দেখা গিয়েছিল যে তিনি নম্র ছিলেন?
৬ পৌল যে নম্র ছিলেন, তা করিন্থীয়দের সঙ্গে তিনি যেরকম ব্যবহার করেছিলেন তাতে দেখা যায়। করিন্থের কিছু খ্রীষ্টানরা আপল্লো, কৈফা ও পৌলকে অন্য সবার চেয়ে একটু আলাদা চোখে দেখতেন এবং তাদেরকে বেশি পছন্দ করতেন। (১ করিন্থীয় ১:১১-১৫) কিন্তু, পৌল করিন্থীয়দের কাছ থেকে প্রশংসা চাননি বা তাদের এইরকম মনোভাবকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাননি। তিনি যখন তাদের মণ্ডলীতে গিয়েছিলেন তখন “বাক্যের কি জ্ঞানের উৎকৃষ্টতা” দেখাননি। বরং তিনি নিজের এবং তার সাথিদের বিষয়ে বলেছিলেন: “লোকে আমাদিগকে এরূপ মনে করুক যে, আমরা খ্রীষ্টের সেবক ও ঈশ্বরের নিগূঢ়তত্ত্বরূপ ধনের অধ্যক্ষ।” *—১ করিন্থীয় ২:১-৫; ৪:১.
৭. পরামর্শ দেওয়ার সময়ও পৌল কী করে নম্রতা দেখিয়েছিলেন?
৭ পৌল তার খ্রীষ্টান ভাইবোনদেরকে পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার সময়ও নম্র ছিলেন। তিনি প্রেরিত ছিলেন বলে যে খুব কড়াভাবে তাদেরকে পরামর্শ দিতেন তা নয়, বরং তিনি ‘ঈশ্বরের করুণা’ ও “প্রেম” দেখিয়ে তাদেরকে অনুরোধ করে বলতেন। (রোমীয় ১২:১, ২; ফিলীমন ৮, ৯) কেন? কারণ তিনি নিজেকে তার ভাইদের “সহকারী” মনে করতেন, তিনি কখনোই তাদের “বিশ্বাসের উপরে প্রভুত্ব” করতেন না। (২ করিন্থীয় ১:২৪) তিনি নম্র ছিলেন বলেই প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানরা তাকে এত ভালবাসতেন।—প্রেরিত ২০:৩৬-৩৮.
বিশেষ সুযোগগুলোকে নম্রভাবে দেখা
৮, ৯. (ক) কেন আমাদের নিজেদেরকে বড় মনে করা উচিত নয়? (খ) যারা ঈশ্বরকে সেবা করার বিশেষ সুযোগগুলো পেয়েছেন তারা কী করে নম্র হতে পারেন?
৮ পৌল আজকের খ্রীষ্টানদের জন্য এক সুন্দর উদাহরণ রেখে গেছেন। ঈশ্বরকে সেবা করার যে সুযোগই আমরা পাই না কেন, আমাদের কখনোই অন্যদের চেয়ে নিজেদেরকে বড় মনে করা উচিত নয়। এই বিষয়ে পৌল লিখেছিলেন: “যদি কেহ মনে করে আমি কিছু, কিন্তু বাস্তবিক সে কিছুই নয়, তবে সে আপনি আপনাকে ভুলায়।” (গালাতীয় ৬:৩) কেন? কারণ “সকলেই পাপ করিয়াছে এবং ঈশ্বরের গৌরব-বিহীন হইয়াছে।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (রোমীয় ৩:২৩; ৫:১২) আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে আমরা সবাই-ই আদমের কাছ থেকে পাপ ও মৃত্যু পেয়েছি। তাই, ঈশ্বরকে সেবা করার বিশেষ সুযোগ পাওয়া আমাদেরকে পাপ থেকে শুচি করে না বা বড় কিছু করে তোলে না। (উপদেশক ৯:২) পৌলের মতো আমরাও শুধু যিহোবার অপার দয়ার কারণেই তাঁর কাছাকাছি আসতে পারি ও তাঁকে সেবা করার বিশেষ সুযোগ পাই।—রোমীয় ৩:১২, ২৪.
৯ এ কথা মনে রেখে একজন নম্র ব্যক্তি, তার পাওয়া সুযোগগুলোর জন্য অহংকার করেন না বা তার কাজের জন্য গর্ব করেন না। (১ করিন্থীয় ৪:৭) পরামর্শ বা নির্দেশনা দেওয়ার সময় তিনি তার ভাইবোনদের ওপর প্রভুত্ব করেন না বরং তিনি নিজেকে তাদের সহকারী বলে মনে করেন। তাই, কেউ যদি বিশেষ কিছু কাজে দক্ষ থাকেন আর এইজন্য তার খ্রীষ্টান ভাইবোনেরা তার প্রশংসা করুক বলে চান বা ভাইবোনেরা তার কাজ দেখে মুগ্ধ হলে তিনি যদি সেটাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগান, তাহলে তা অন্যায়। (হিতোপদেশ ২৫:২৭; মথি ৬:২-৪) অন্যের কাছ থেকে জোর করে প্রশংসা আদায় করলে সেই প্রশংসার কোন দাম থাকে না। কিন্তু, ভাইবোনেরা যখন নিজে থেকে প্রশংসা করেন তখনও আমাদের নিজেদেরকে বড় মনে করা উচিত নয়।—হিতোপদেশ ২৭:২; রোমীয় ১২:৩.
১০. অনেক ভাইবোনেরা যারা অন্যদের নজরে পড়েন না তারা কীভাবে “বিশ্বাসে ধনবান্” বুঝিয়ে বলুন।
১০ মণ্ডলীতে আমরা যখন সেবা করার বিশেষ কোন সুযোগ পাই তখন আমরা যদি নম্র হই, তাহলে নিজেদেরকে বড় মনে করব না এবং এমন ভাব দেখাব না যে আমাদের চেষ্টা এবং দক্ষতার জন্যই মণ্ডলী ঠিক মতো চলছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমরা হয়তো ভাল শিক্ষক হতে পারি। (ইফিষীয় ৪:১১, ১২) কিন্তু আমরা যদি নম্র হই, তাহলে আমরা অবশ্যই মনে রাখব যে মণ্ডলীর সভাগুলোতে আমরা যা কিছু ভাল ভাল বিষয় শিখি তার সবই যে ভাইদের বক্তৃতাগুলো থেকে শিখি, তা নয়। মণ্ডলীর অন্যান্য ভাইবোনদের কাছ থেকেও আমরা শিখি। যেমন আপনি যখন একজন একক বাবা কিংবা মাকে তার বাচ্চাদের নিয়ে প্রত্যেকটা সভায় আসতে দেখেন, তখন কি উৎসাহ পান না? বা একজন ভাই বা বোন যিনি সবসময় ভাবেন যে তাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তিনি যখন বিশ্বস্তভাবে প্রত্যেকটা সভায় আসেন তখন তাকে দেখে কি আপনি কিছু শেখেন না? আর অল্পবয়স্করা যারা স্কুলের বা অন্য চাপের মধ্যেও সত্যে উন্নতি করে চলছে তাদের বিষয়েই বা কী বলা যায়? (গীতসংহিতা ৮৪:১০) এরা হয়তো সবসময় সবার নজরে পড়েন না। বিশ্বস্ততার যে পরীক্ষার মুখোমুখি তারা হন, তা বেশির ভাগ ভাইবোনদেরই নজর এড়িয়ে যায়। কিন্তু, তারা হয়তো মণ্ডলীতে যাদের বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে তাদের মতোই “বিশ্বাসে ধনবান্।” (যাকোব ২:৫) আর সবচেয়ে বড় কথা হল যে যারা শেষ পর্যন্ত বিশ্বস্ত থাকবেন তারাই যিহোবার আশীর্বাদ পাবেন।—মথি ১০:২২; ১ করিন্থীয় ৪:২.
গিদিয়ন তার বাবার পরিবারে “কনিষ্ঠ” ছিলেন
১১. ঈশ্বরের দূতের সঙ্গে কথা বলার সময় গিদিয়ন কী করে নম্রতা দেখিয়েছিলেন?
১১ গিদিয়ন মনঃশি বংশের একজন সাহসী যুবক ছিলেন। তার সময়ে ইস্রায়েল জাতি খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে ছিল। সাত বছর ধরে তারা মিদিয়নীয়দের অত্যাচার সহ্য করে আসছিল। কিন্তু, গিদিয়নের সময়ে যিহোবা তাঁর লোকেদের অত্যাচারীদের হাত থেকে রেহাই দেবেন বলে ঠিক করেন। তাই, ঈশ্বরের এক দূত এসে গিদিয়নকে বলেন: “হে বলবান বীর সদাপ্রভু তোমার সহবর্ত্তী।” গিদিয়ন নম্র ছিলেন আর তাই দূতের কথা শুনে গর্বে তার বুক ফুলে ওঠেনি। বরং তিনি সম্মানের সঙ্গে দূতকে বলেছিলেন: “নিবেদন করি, হে আমার প্রভু যদি সদাপ্রভু আমাদের সহবর্ত্তী হন, তবে আমাদের প্রতি এ সমস্ত কেন ঘটিল?” তখন দূত গিদিয়নকে পরিষ্কার করে বলেছিলেন যে “তুমি . . . মিদিয়নের হস্ত হইতে ইস্রায়েলকে নিস্তার কর।” এটা শুনে গিদিয়ন কী করেছিলেন? নিজেকে সবার সামনে বীর প্রমাণ করার জন্য গিদিয়ন সঙ্গে সঙ্গেই সেই সুযোগকে লুফে নেননি। তিনি বলেছিলেন: “বিনয় করি, হে প্রভু, ইস্রায়েলকে কিরূপে নিস্তার করিব? দেখুন, মনঃশির মধ্যে আমার গোষ্ঠী সর্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র, এবং আমার পিতৃকুলে আমি কনিষ্ঠ।” তার এ কথা থেকে বোঝা যায় যে তিনি কত নম্র ছিলেন!—বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ৬:১১-১৫.
১২. গিদিয়নকে ঈশ্বর যে কাজ দিয়েছিলেন তা কী করে তিনি বুদ্ধি খাটিয়ে করেছিলেন?
১২ গিদিয়নকে যুদ্ধে পাঠানোর আগে যিহোবা তাকে পরীক্ষা করেছিলেন। কীভাবে? যিহোবা গিদিয়নকে তার বাবার বাল দেবের যজ্ঞবেদি ভেঙে ফেলতে ও আশেরা মূর্তি টুকরো টুকরো করতে বলেছিলেন। এই কাজ করার জন্য অনেক সাহসের দরকার ছিল কিন্তু গিদিয়ন নম্র হয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে এই কাজটা করেছিলেন। দিনের বেলায় না করে রাতের অন্ধকারে তিনি কাজটা করেছিলেন, যাতে অযথা সমস্যায় পড়তে না হয়। শুধু তাই নয়, গিদিয়ন অনেক সাবধান হয়ে এই কাজটা করেছিলেন। তিনি তার সঙ্গে দশজন দাসকে নিয়েছিলেন। সম্ভবত কয়েকজনকে তিনি পাহারা দেওয়ার জন্য রেখেছিলেন এবং কয়েকজন তাকে যজ্ঞবেদি ও আশেরা মূর্তি ভেঙে ফেলতে সাহায্য করেছিল। * যাই হোক না কেন, যিহোবার আশীর্বাদে গিদিয়ন তার কাজ ঠিক মতো করেছিলেন এবং যিহোবা তাকে দিয়ে মিদিয়নীয়দের হাত থেকে ইস্রায়েলীয়দের উদ্ধার করেছিলেন।—বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ৬:২৫-২৭.
নম্র হোন ও বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করুন
১৩, ১৪. (ক) যখন আমাদের কোন বিশেষ কাজ দেওয়া হয় তখন আমরা কী করে নম্রতা দেখাতে পারি? (খ) ভাই এ. এইচ ম্যাকমিলান কী করে নম্রতা দেখানোর বিষয়ে উদাহরণ রেখেছিলেন?
১৩ গিদিয়নের নম্রতা থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। যেমন, আমাদের যখন বিশেষ কোন কাজ করতে বলা হয় তখন আমরা কী করি? প্রথমেই কি আমরা এই কাজ করার ফলে আমাদের কতটুকু নাম হবে বা কতটা সম্মান আমরা পাব তা নিয়ে মাথা ঘামাই? নাকি আমরা নম্র হয়ে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করে চিন্তা করি যে এই কাজটা আমরা ঠিক মতো করতে পারব কি না? ভাই এ. এইচ ম্যাকমিলান এই ব্যাপারে সুন্দর উদাহরণ রেখেছেন, যিনি ১৯৬৬ সালে মারা গেছেন। একবার ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রথম প্রেসিডেন্ট সি. টি. রাসেল, ভাই ম্যাকমিলানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তিনি যখন বাইরে থাকেন তখন তার কাজ করার জন্য কাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় ভাই ম্যাকমিলান একবারও নিজের কথা বলেননি, যদিও সেই কাজ করার জন্য তিনি সবদিক থেকে যোগ্য ছিলেন। আলোচনার শেষে ভাই রাসেল তাকে সেই দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করতে বলেছিলেন। তখন তার অনুভূতি কেমন হয়েছিল সেই সম্বন্ধে কয়েক বছর পর ভাই ম্যাকমিলান লিখেছিলেন: ‘আমি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গেই আমি হ্যাঁ, না কিছুই বলিনি। আমি বেশ কিছু দিন ধরে এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম ও প্রার্থনা করেছিলাম। আর তারপরই আমি তাকে এই কাজটা করব বলে জানিয়েছিলাম।’
১৪ এর কিছুদিন পরই ভাই রাসেল মারা যান আর এর ফলে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্টের পদ খালি হয়ে যায়। যেহেতু প্রচারের জন্য ভাই রাসেলের শেষ যাত্রার সময় ভাই ম্যাকমিলান সোসাইটির দায়িত্বে ছিলেন, তাই একজন ভাই তাকে বলেছিলেন: “ম্যাক, এবার তুমিই প্রেসিডেন্ট হবে। কারণ ভাই রাসেল যাওয়ার আগে তোমাকেই দায়িত্ব দিয়ে গেছেন আর আমাদের সবাইকে বলেছেন যেন আমরা তোমার কথা মেনে চলি। তিনি চিরকালের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আর তাই তোমাকেই তার দায়িত্ব নিতে হবে।” ভাই ম্যাকমিলান বলেছিলেন: “ভাই, এই ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা ঠিক না। কারণ এটা প্রভুর কাজ আর তাই প্রভু যাকে যোগ্য মনে করবেন শুধু তাকেই তিনি তাঁর সংগঠনে সেই দায়িত্ব দেবেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে আমি সেই ব্যক্তি নই।” পরে ভাই ম্যাকমিলান অন্য আরেকজন ভাইকে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য বলেছিলেন। গিদিয়নের মতো তিনিও নম্র ছিলেন আর আমাদের সবার এরকম হওয়া দরকার।
১৫. লোকেদের কাছে প্রচার করার সময় কী করে আমরা বুদ্ধি খাটিয়ে কথা বলতে পারি?
১৫ আমাদেরকে যে কাজ দেওয়া হয় তা আমাদেরও সবার নম্রভাবে করা উচিত। গিদিয়ন বুদ্ধিমান ছিলেন আর তাই তিনি বিরোধিদের অযথাই রাগাতে চাননি। তেমনই প্রচার করার সময় আমাদের নম্র হয়ে এবং বুদ্ধি খাটিয়ে লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। এটা ঠিক যে আমরা “দুর্গসমূহ [দৃঢ়ভাবে স্থাপিত বিষয়গুলো]” ও “বিতর্ক সকল” দূর করার জন্য এক আত্মিক যুদ্ধ করছি। (২ করিন্থীয় ১০:৪, ৫) কিন্তু, আমরা অন্যদের ছোট করব না বা এমনভাবে কথা বলব না যাতে তারা আমাদের কথা শুনে বিরক্ত হন। বরং তাদের কথা আমাদের মন দিয়ে শোনা উচিত এবং এমন কিছু বিষয় বলা উচিত যে বিষয়ে তারা আমাদের সঙ্গে একমত আর তারপরই আমরা তাদেরকে সুসমাচার জানাতে পারি।—প্রেরিত ২২:১-৩; ১ করিন্থীয় ৯:২২; প্রকাশিত বাক্য ২১:৪.
নম্রতা দেখানোর ব্যাপারে যীশু ছিলেন সবচেয়ে বড় উদাহরণ
১৬. কীভাবে যীশু দেখিয়েছিলেন যে তিনি নম্র ছিলেন?
১৬ নম্রতা দেখানোর ব্যাপারে যীশু খ্রীষ্টই ছিলেন সবচেয়ে বড় উদাহরণ। * ঈশ্বরের সঙ্গে কাছের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও, যীশু কখনোই অস্বীকার করেননি যে তাঁর হাতে পুরো ক্ষমতা নেই। (যোহন ১:১৪) উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যাকোব ও যোহনের মা যীশুকে অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি যখন রাজা হবেন তখন তার দুই ছেলে যেন তাঁর দুপাশে বসতে পারেন। কিন্তু সেই সময় যীশু বলেছিলেন: “কাহাকেও আমার দক্ষিণ পার্শ্বে ও বাম পার্শ্বে বসিতে দিতে আমার অধিকার নাই।” (মথি ২০:২০-২৩) অন্য আরেক দিন যীশু অকপটে স্বীকার করেছিলেন: “আমি আপনা হইতে কিছুই করিতে পারি না; . . . আমি আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি না, কিন্তু আমার প্রেরণকর্ত্তার ইচ্ছা পূর্ণ করিতে চেষ্টা করি।”—যোহন ৫:৩০; ১৪:২৮; ফিলিপীয় ২:৫, ৬.
১৭. যীশু কীভাবে তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করেছিলেন?
১৭ যীশু সবদিক থেকেই অসিদ্ধ মানুষদের চেয়ে অনেক ওপরে ছিলেন এবং মানুষদের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতা তাঁর পিতা, যিহোবা তাঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু তবুও যীশু তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে নম্র ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে শিষ্যদেরকে তাক লাগিয়ে দিতেন না। বরং তিনি শিষ্যদের দয়া দেখিয়েছিলেন, তাদের অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন ও তাদের শারীরিক প্রয়োজনগুলোর দিকে সবসময় খেয়াল রেখেছিলেন। (মথি ১৫:৩২; ২৬:৪০, ৪১; মার্ক ৬:৩১) যদিও যীশু নিজে সিদ্ধ ছিলেন কিন্তু তাই বলে তাঁর শিষ্যরা সবকিছু নিখুঁতভাবে করবে বলে তিনি কখনোই দাবি করেননি। তাঁর শিষ্যদের যতটুকু করার ক্ষমতা ছিল তার চেয়ে বেশি তিনি কখনোই চাননি এবং তারা যতটুকু বুঝতে পারবে তিনি ঠিক ততটুকুই তাদেরকে বলেছিলেন। (যোহন ১৬:১২) আর এই কারণেই অনেকেই তাঁর কাছে এসে সতেজ হয়েছিল!—মথি ১১:২৯.
যীশুর মতো নম্র হোন
১৮, ১৯. (ক) আমরা নিজেদেরকে যা মনে করি, ও (খ) অন্যদের সঙ্গে যেভাবে ব্যবহার করি, তাতে কী করে যীশুর মতো নম্র হতে পারি?
১৮ পৃথিবীর সর্বমহান পুরুষ যদি নম্র হতে পারেন, তাহলে আমাদের আরও কত বেশি নম্র হওয়া উচিত। অসিদ্ধ মানুষেরা স্বীকার করতে চায় না যে তাদের হাতে পুরো ক্ষমতা নেই। কিন্তু খ্রীষ্টানরা তাদের মতো নন। তারা যীশুর মতো নম্র হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। তারা যোগ্য ভাইদেরকে দায়িত্ব দিতে কুণ্ঠা বোধ করেন না বা যাদের অধিকার আছে তারা যখন তাদেরকে নির্দেশনা দেন তখন তা খুশি মনে মেনে নেন। তারা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন আর এই কারণেই মণ্ডলীর সমস্ত কাজ “উপযুক্তভাবে ও শৃঙ্খলার সংগে” হয়ে থাকে।—১ করিন্থীয় ১৪:৪০, প্রে.বা.
১৯ আমরা যদি নম্র হই, তাহলে আমরা অন্যের কাছ থেকে অনেক বেশি দাবি করব না ও তাদের প্রয়োজনগুলোর দিকে সবসময় নজর রাখব। (ফিলিপীয় ৪:৫) আমাদের হয়তো এমন কিছু কাজ করার ক্ষমতা ও শক্তি থাকতে পারে, যা অন্য ভাইবোনদের নেই। কিন্তু আমরা যদি নম্র হই, তাহলে আমরা সবসময় এমনটা চাইব না যে আমরা যেভাবে চাই তারা ঠিক সেভাবেই কাজ করবে। আমরা সবাই-ই অসিদ্ধ এ কথাটা মনে রাখলে আমরা নম্র হব ও অন্যের ভুলগুলোকে বড় করে দেখব না। পিতর লিখেছিলেন: “সর্ব্বাপেক্ষা পরস্পর একাগ্র ভাবে প্রেম কর; কেননা ‘প্রেম পাপরাশি আচ্ছাদন করে।’”—১ পিতর ৪:৮.
২০. আমাদের মধ্যে যদি অহংকার থাকে, তাহলে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা কী করতে পারি?
২০ আমরা শিখেছি যে প্রজ্ঞা নম্রদিগের সহচরী। কিন্তু আপনার যদি মনে হয় যে আপনি নম্র নন বা অহংকারী তাহলে কী? মন খারাপ করবেন না। দায়ূদের মতো করে প্রার্থনা করুন: “দুঃসাহসজনিত [অহংকারপূর্ণ] পাপ হইতেও নিজ দাসকে পৃথক্ রাখ, সেই সকল আমার উপরে কর্ত্তৃত্ব না করুক।” (গীতসংহিতা ১৯:১৩) পৌল, গিদিয়ন এবং সর্বমহান পুরুষ যীশু খ্রীষ্টের মতো বিশ্বাসী বীর হয়ে আমরা এই কথাগুলো যে সত্যি তা বুঝতে পারব: “প্রজ্ঞাই নম্রদিগের সহচরী।”—হিতোপদেশ ১১:২.
[পাদটীকাগুলো]
^ যে গ্রিক শব্দকে “সেবক” অনুবাদ করা হয়েছে, তা একজন ক্রীতদাসকে বোঝাতে পারে। এই ক্রীতদাসেরা বড় বড় জাহাজের নিচের সারিতে বসে বৈঠা চালাত। কিন্তু “অধ্যক্ষ” বলতে আরও দায়িত্বশীল কাউকে বোঝাতে পারে। তারা হয়তো স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দেখাশোনা করত। তবে, বেশির ভাগ শাসকরাই অধ্যক্ষদেরকে জাহাজের ক্রীতদাসদের মতোই দেখতেন।
^ গিদিয়ন সাবধান হয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজটা করেছিলেন বলে তাকে কাপুরুষ বলা উচিত হবে না। কারণ ইব্রীয় ১১:৩২-৩৮ পদে যে বীরদের কথা বলা আছে, যারা ‘বলপ্রাপ্ত হয়েছিলেন’ ও ‘যুদ্ধে বিক্রান্ত হয়েছিলেন’ তাদের মধ্যে গিদিয়নের নামও আছে আর এর থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে তিনি সাহসী ছিলেন।
^ নম্রতা বলতে বোঝায় যে একজন তার সীমা জানেন। যিহোবাকে যদিও নম্র বলা যায় কিন্তু আমরা কখনোই বলতে পারি না যে তিনি তাঁর সীমা জানেন কারণ তাঁর কোন সীমা নেই।—গীতসংহিতা ১৮:৩৫.
আপনার কি মনে আছে?
• নম্রতা কী?
• আমরা কী করে পৌলের মতো নম্র হতে পারি?
• গিদিয়নের কাছ থেকে আমরা নম্রতা সম্বন্ধে কী শিখতে পারি?
• যীশু কীভাবে নম্রতা দেখানোর ব্যাপারে সবচেয়ে ভাল উদাহরণ রেখেছিলেন?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
[১৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
পৌল নম্রভাবে নিজেকে তার ভাইদের “সহকারী” মনে করেছিলেন
[১৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
গিদিয়ন বুদ্ধি খাটিয়ে ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে কাজ করেছিলেন
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
ঈশ্বরের পুত্র, যীশু তাঁর সমস্ত কাজে নম্রতা দেখান