আপনি কেন ত্যাগ করবেন?
আপনি কেন ত্যাগ করবেন?
বিল একজন মাঝবয়সী সংসারী মানুষ। তিনি বিল্ডিং টেকনোলজির শিক্ষক। বছরের মধ্যে বেশ অনেক সপ্তা তিনি যিহোবার সাক্ষিদের জন্য কিংডম হলের নকশা তৈরি করা ও কিংডম হল বানানোয় সাহায্য করে কাটান। আর এই সবকিছুই তিনি খুশি মনে ও নিজের খরচায় করেন। এমার বয়স ২২ বছর। এমা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতী ও অবিবাহিতা। জীবনে বড় হওয়া ও শুধু নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কথাই না ভেবে সে মাসে ৭০ ঘন্টা প্রচার করে, লোকেদের বাইবেল বুঝতে সাহায্য করে। মোরিস ও বেটি, অবসর প্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রী। ঘরে বসে আরাম আয়াস না করে তারা অন্য দেশে গিয়েছেন যাতে সেখানকার লোকেদের ঈশ্বর ও তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে শেখাতে পারেন।
এই লোকেদের কেউই নিজেদের বিশেষ কিছু বলে মনে করেন না। তারা আমার আপনার মতোই সাধারণ মানুষ। আর তারা সেই কাজে লেগে আছেন যে কাজকে তারা ঠিক বলে মনে করেন। কিন্তু কেন তারা তাদের শক্তি, সময়, ক্ষমতা ও অর্থ অন্য লোকেদের জন্য দিয়ে দেন? কারণ তারা ঈশ্বরকে ও প্রতিবেশীদের ভালবাসেন। এই ভালবাসাই তাদের সবার মধ্যে ত্যাগ করার, অন্যের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা জাগায়।
অন্যের জন্য ত্যাগ করা বা নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া বলতে কী বোঝায়? এটা বোঝায় না যে আমরা জগৎ সংসার ছেড়ে সাধু সন্ন্যাসী হয়ে যাব। এটা এও বোঝায় না যে আমরা কৃচ্ছ্রসাধন করব বা সমস্ত হাসিখুশি, আমোদ আহ্লাদ থেকে নিজেদের বঞ্চিত কবর। কিন্তু এর মানে হল “নিজের কর্তব্য পালন করার জন্য বা অন্যদের ভাল করার জন্য আমাদের নিজেদের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, খুশি ও ইচ্ছাকে ত্যাগ করা,” দ্যা সর্টার অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি এভাবেই বলে।
যীশু খ্রীষ্ট—সবচেয়ে বড় উদাহরণ
আমাদের সামনে ত্যাগ করার বা নিজেকে অন্যের জন্য বিলিয়ে দেওয়ার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলেন ঈশ্বরের একজাত পুত্র যীশু খ্রীষ্ট। যীশু খ্রীষ্ট যখন স্বর্গে ছিলেন সমস্ত দিক দিয়ে তাঁর জীবন তৃপ্ত ছিল, তিনি সেখানে আনন্দে ছিলেন। পিতার সঙ্গে তাঁর এক নিবিড় সম্পর্ক ছিল, স্বর্গদূতদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল। এছাড়া তিনি একজন “কার্য্যকারী” ছিলেন যিনি অনেক কঠিন আর সুন্দর সুন্দর কাজে তাঁর দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। (হিতোপদেশ ৮:৩০, ৩১) সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিও এত খুশি ও এত ভাল জীবন কখনও দেখেনি। তিনি সারা পৃথিবীর মালিক যিহোবা ঈশ্বরের কাছে ছিলেন। আর স্বর্গে তাঁর সম্মানিত ও বড় পদ ছিল!
ফিলিপীয় ২:৭) তিনি স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে এই সমস্ত সুখ ত্যাগ করে মানুষ হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। আর শয়তান মানুষের যে ক্ষতি করেছে তা পূরণ করার জন্য তিনি নিজের জীবন দিয়েছিলেন। (আদিপুস্তক ৩:১-৭; মার্ক ১০:৪৫) তিনি স্বর্গ ছেড়ে এসে শয়তানের জগতে পাপী মানুষদের সঙ্গে থেকেছিলেন। (১ যোহন ৫:১৯) তিনি খুবই সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটিয়েছিলেন। এমনকি তাঁকে অনেক ধরনের দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু জীবনে যাই আসুক না কেন যীশু ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করার জন্য অটল ছিলেন। (মথি ২৬:৩৯; যোহন ৫:৩০; ৬:৩৮) এটা যীশুর প্রেম ও বিশ্বস্তার পরীক্ষা ছিল। তিনি কি এই পরীক্ষায় সফল হবেন, তিনি কী এতখানি ত্যাগ করবেন? উত্তরে প্রেরিত পৌল বলেছিলেন তিনি “আপনাকে অবনত করিলেন; মৃত্যু পর্য্যন্ত, এমন কি, ক্রুশীয় মৃত্যু পর্য্যন্ত আজ্ঞাবহ হইলেন।”—ফিলিপীয় ২:৮.
কিন্তু তা সত্ত্বেও ঈশ্বরের পুত্র “আপনাকে শূন্য করিলেন, দাসের রূপ ধারণ করিলেন, মনুষ্যদের সাদৃশ্যে জন্মিলেন।” (‘এই ভাব তোমাদিগেতেও হউক’
আমাদেরকে যীশু খ্রীষ্টের উদাহরণ মতো চলার জন্য বলা হয়। প্রেরিত পৌল আমাদের বলেন, “খ্রীষ্ট যীশুতে যে ভাব ছিল, তাহা তোমাদিগেতেও হউক।” (ফিলিপীয় ২:৫) আমরা কীভাবে তা করতে পারি? একটা উপায় হল শুধু ‘আপনার বিষয়ে নয়, কিন্তু পরের বিষয়েও লক্ষ্য রেখে।’ (ফিলিপীয় ২:৪) সত্যিকারের ভালাবাসা “স্বার্থ চেষ্টা করে না।”—১ করিন্থীয় ১৩:৫.
যারা অন্যদের দিকে লক্ষ্য রাখে, অন্যদের জন্য ভাবে তারা অন্যদের জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেয় ও ত্যাগ করে। কিন্তু আজকের পৃথিবী ঠিক এর উলটো। লোকেরা স্বার্থপর, তারা শুধু নিজেদের কথা ভাবে, তারা শুধু নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। আমাদের কিন্তু জগতের এই হাওয়া থেকে দূরে থাকা উচিত কারণ একবার যদি এর ছোঁয়া আমাদের লাগে, তাহলে আমরাও তাতে গা ভাসিয়ে দেব আর জগতের লোকেদের মতো স্বার্থপর হয়ে পড়ব। আর তখন আমরা সবকিছুই শুধু নিজেদের জন্য করতে চাইব। নিজেদের জন্যই আমরা বেঁচে থাকতে চাইব, আমাদের সময়, শক্তি ও অর্থ সবকিছু তখন শুধু আমাদের নিজেদের জন্যই। তাই এর থেকে সরে থাকার জন্য আমাদের সবরকম চেষ্টা করা দরকার।
কিন্তু কখনও কখনও ভাল পরামর্শও আমাদের ত্যাগ করার ইচ্ছাকে দমিয়ে দিতে পারে। যেমন পিতর জানতেন যে যীশুর ত্যাগের জীবনে শেষ পর্যন্ত কী ঘটতে চলেছে। তাই তিনি যীশুকে বলেছিলেন: “প্রভু, ইহা আপনা হইতে দূরে থাকুক।” (মথি ১৬:২২) পিতর মেনে নিতে পারছিলেন না যে তাঁর পিতার ইচ্ছা পালন ও মানুষকে পাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি মারা যেতে চান। তাই তিনি যীশুকে বাধা দিতে চেয়েছিলেন।
‘নিজেকে অস্বীকার করুন’
পিতরের এ কথা শুনে যীশু কী করেছিলেন? মার্ক বলেন: “তিনি মুখ ফিরাইয়া আপন শিষ্যগণের প্রতি দৃষ্টি করিয়া পিতরকে অনুযোগ করিলেন, বলিলেন, আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, শয়তান; কেননা যাহা ঈশ্বরের, তাহা নয়, কিন্তু যাহা মনুষ্যের, তাহাই তুমি ভাবিতেছ।” তারপর তিনি শিষ্যদের সঙ্গে লোকদেরকেও ডেকে বলেন, “কেহ যদি আমার পশ্চাৎ আসিতে ইচ্ছা করে, সে আপনাকে অস্বীকার করুক, আপন ক্রুশ তুলিয়া লউক, এবং আমার পশ্চাদ্গামী হউক।”—মার্ক ৮:৩৩, ৩৪.
এই ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর লেখা পিতরের চিঠি থেকে বোঝা যায় যে তিনি ত্যাগ করার মানে বুঝেছিলেন। তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিতে শিখেছিলেন তাই তিনি তার ভাইদের আরাম আয়াসের জীবন নয় কিন্তু ত্যাগের জীবন, অন্যদের জন্য ভাল কাজ করার ও জগতের হাওয়ায় গা না ভাসিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে পরীক্ষা সত্ত্বেও তাদের ঈশ্বরের ইচ্ছা মতো চলা উচিত।—১ পিতর ১:৬, ১৩, ১৪; ৪:১, ২.
নিজেদের সবকিছু যিহোবার হাতে সঁপে দেওয়া, নিখুঁতভাবে যীশু খ্রীষ্টের মতো চলতে চেষ্টা করা ও যিহোবা যে পথ দেখান সেই পথে যাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধির কাজ। ২ করিন্থীয় ১২:১৫) পৌল তার সমস্ত কিছু, তার ক্ষমতা তার নিজের স্বার্থে নয় কিন্তু ঈশ্বরের সেবায় লাগিয়েছিলেন।—প্রেরিত ২০:২৪; ফিলিপীয় ৩:৮.
প্রেরিত পৌল এভাবে চলেছিলেন। যিহোবাকে কৃতজ্ঞতা দেখানোর জন্য ও যত বেশি লোকেদের পারা যায় সুসমাচার শোনানোর জন্য তিনি জগতের নাম ও যশকে ত্যাগ করেছিলেন যা হয়তো তাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা মতো চলতে বাধা দিত। তিনি বলেছিলেন, “আমি অতিশয় আনন্দের সহিত তোমাদের প্রাণের নিমিত্ত ব্যয় করিব, এবং ব্যয়িতও হইব।” (আমরাও কী প্রেরিত পৌলের মতো? উত্তর পাওয়ার জন্য আমরা নিজেদের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি। আমি কীসের পিছনে আমার সময়, শক্তি, ক্ষমতা ও অর্থ দিচ্ছি? নিজের জন্য, নিজের স্বার্থে বা অন্যদের সাহায্য করার জন্য? আমি কি অন্যদের কাছে সুসমাচার প্রচার করে তাদের জীবন বাঁচানোর কাজে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারি? যেমন আমি কি অগ্রগামীর কাজ করতে পারি? কিংডম হল বানানোর কাজ করতে পারি? যাদের দরকার আছে তাদের দিকে কি আমি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই? আমি কি যিহোবাকে আমার যথাসর্বস্ব দিই?—হিতোপদেশ ৩:৯.
“দান করা ধন্য হইবার বিষয়”
কিন্তু প্রশ্ন ওঠে যে ত্যাগ করা বা নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কি সত্যিই বুদ্ধির কাজ? হ্যাঁ, অবশ্যই বুদ্ধির কাজ! প্রেরিত পৌল তার নিজের জীবন দিয়ে দেখেছিলেন যে তা কত সত্যি। তিনি অনেক আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তিনি খুশি ছিলেন, তৃপ্ত ছিলেন। আর এ কথাই তিনি ইফিষিয়ের প্রাচীন ভাইদের বলেছিলেন যখন মিলিতা দ্বীপে তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। পৌল বলেছিলেন: “সকল বিষয়ে আমি তোমাদিগকে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছি যে, এই প্রকারে পরিশ্রম [ত্যাগ] করিয়া দুর্ববলদিগের সাহায্য করিতে হইবে, এবং প্রভু যীশুর বাক্য স্মরণ করা উচিত, কেননা তিনি আপনি বলিয়াছেন, গ্রহণ করা অপেক্ষা বরং দান করা ধন্য হইবার বিষয়।” (প্রেরিত ২০:৩৫) লক্ষ লক্ষ লোকেরা বলেন যে ত্যাগের জীবন আজও অনেক আনন্দ নিয়ে আসে। আর আমরা জানি যে এটা আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও আনন্দ নিয়ে আসবে কারণ আজকে যারা নিজেদের চেয়ে বেশি সময় যিহোবার সেবায় ও অন্যদের সাহায্য করার জন্য দেন তাদের যিহোবা আশীর্বাদ করবেন।—১ তীমথিয় ৪:৮-১০.
বিল্ডিং টেকনোলজির শিক্ষক বিলকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে কেন তিনি কিংডম হল বানানোর কাজে সাহায্য করেন উত্তরে তিনি বলেছিলেন: “ছোট ছোট মণ্ডলীগুলোকে এভাবে সাহায্য করতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমার যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়ে অন্যদের জন্য কাজ করতে বা তাদের কাজে আসতে আমি ভালবাসি।” শিক্ষিতা মেয়ে
এমা কেন অন্যদের বাইবেল শেখানোর জন্য এত খাটাখাটনি করে? সে বলে “এটাই আমার জীবন। অন্য কিছু করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। আমার বয়স অল্প আর আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে যিহোবার সেবা করতে চাই, অন্যদের সাহায্য করতে চাই। আরাম আয়াস ত্যাগ করা এমন কিছু বড় কথা নয়। যিহোবা আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন। তার তুলনায় দেখতে গেলে আমি কিছুই করছি না।”মোরিস আর বেটিরও কোন দুঃখ নেই যে এতবছর খাটাখাটনি করে সংসারধর্ম করার পর এখন আরাম করার বদলে তারা যিহোবার কাজ করছেন। এখন তারা অবসর জীবন কাটাচ্ছেন আর তাদের হাতে এখন অফুরন্ত সময় আছে। তারা তাদের এই সময়কে ভাল কাজে লাগাতে চান। তারা বলেন, “আমরা এখন শুধু শুয়ে বসে কাটাতে চাই না। অন্য দেশে গিয়ে লোকেদের ঈশ্বরের সম্বন্ধে শেখানো আমাদের ভাল কাজ করার সুযোগ দেয়।”
এই লোকেদের মতো আপনিও কি ত্যাগ করতে চান? এটা ঠিক যে ত্যাগের জীবন হয়তো খুব সহজ হবে না। আমাদের অসিদ্ধতা আমাদের যিহোবাকে সেবা করার ইচ্ছাকে পিছনে সরিয়ে দিতে পারে। (রোমীয় ৭:২১-২৩) কিন্তু আমরা যদি যিহোবার দেখানো পথে চলি, তাহলে যিহোবার সেবা করা আমাদের জন্য ততখানি কঠিন হবে না। (গালাতীয় ৫:১৬, ১৭) তিনি আমাদের সেবা ও ত্যাগকে মনে রাখবেন ও আমাদের অনেক আশীর্বাদ করবেন। হ্যাঁ, যিহোবা ‘আকাশের দ্বার সকল মুক্ত করিয়া আমাদের প্রতি অপরিমেয় আশীর্ব্বাদ বর্ষণ করিবেন।’—মালাখি ৩:১০; ইব্রীয় ৬:১০.
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু খ্রীষ্ট ত্যাগ করেছিলেন। আপনি কি করেন?
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
পৌল সুসমাচার প্রচার করার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন