“সময় উপস্থিত!”
“সময় উপস্থিত!”
“এই জগৎ হইতে পিতার কাছে আপনার প্রস্থান করিবার সময় উপস্থিত।”—যোহন ১৩:১.
১. নিস্তারপর্ব এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে যিরূশালেমের লোকেদের মুখে এখন শুধু কী কথা ও কেন?
সাধারণ কালের ২৯ সালে যীশু তাঁর কাজ শুরু করেন যা তাঁকে তাঁর মারা যাওয়া, আবার জীবিত হওয়া ও মহিমান্বিত হওয়ার ‘সময়ের’ কাছাকাছি নিয়ে যায়। এখন সা.কা. ৩৩ সালের বসন্তকাল। যিহুদি বিচারালয়, মহাসভা যীশুকে মেরে ফেলার মণ্ত্রণা করার পর মাত্র কয়েক সপ্তা কেটেছে। মহাসভার সদস্য নীকদীমের কাছ থেকে তাদের জল্পনা-কল্পনার কথা শুনে যীশু যিরূশালেম ছেড়ে যর্দন নদীর ওপারে প্রান্তরে চলে যান। নিস্তারপর্ব এগিয়ে আসছে, তাই আশেপাশের এলাকা থেকে লোকেরা যিরূশালেমে আসতে থাকে ও যিরূশালেম লোকে লোকে ভরে যেতে থাকে। তাদের মুখে এখন শুধু যীশুর কথা। লোকেরা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাদের কেমন বোধ হয়? তিনি কি পর্ব্বে আসিবেন না?” প্রধান যাজক ও ফরীশীরা এই বলে লোকেদের উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দেয় যে, তিনি কোথায় আছেন, তা যদি কেউ জানে, তাহলে যেন তাদের এসে খবর দেয়।—যোহন ১১:৪৭-৫৭.
২. মরিয়ম কী করায় শিষ্যরা তার সমালোচনা করে আর যীশুর উত্তর কীভাবে দেখায় যে তিনি ‘তাঁর সময়’ সম্বন্ধে জানতেন?
২ ৮ই নিশান, নিস্তারপর্বের ছদিন আগে যীশু যিরূশালেমের কাছাকাছি আসেন। তিনি বৈথনিয়াতে আসেন যেখানে তাঁর প্রিয় বন্ধু লাসার, মার্থা ও মরিয়ম থাকে। বৈথনিয়া যিরূশালেম থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে। এখন শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা আর যীশু সেখানে তাদের সঙ্গে বিশ্রামবার কাটান। পরের দিন সন্ধ্যেবেলায় যখন মরিয়ম দামি তেল দিয়ে যীশুর পা ধুইয়ে দেয় শিষ্যরা তার সমালোচনা করে। কিন্তু যীশু তাদেরকে বলেন: “আমার সমাধি-দিনের জন্য ইহাকে উহা রাখিতে দেও। কেননা তোমাদের কাছে দরিদ্রেরা সর্ব্বদাই আছে, কিন্তু আমাকে সর্ব্বদা পাইতেছ না।” (যোহন ১২:১-৮; মথি ২৬:৬-১৩) যীশু জানেন যে “এই জগৎ হইতে পিতার কাছে আপনার প্রস্থান করিবার সময় উপস্থিত।” (যোহন ১৩:১) আর মাত্র পাঁচদিন আর তারপর তিনি ‘অনেকের পরিবর্ত্তে আপন প্রাণ মুক্তির মূল্যরূপে দিবেন।’ (মার্ক ১০:৪৫) তাই এইসময় থেকে যীশু যা কিছুই করছেন ও শেখাচ্ছেন তা দেখায় যে তিনি তাঁর এই জরুরি সময়ের মূল্য বোঝেন। যীশু আমাদের জন্য কত ভাল এক উদাহরণ যেহেতু আমরাও শেষের একেবারে কাছাকাছি সময়ে বাস করছি! এর পরের দিনই যীশুর জীবনে কী ঘটে তা দেখুন।
যীশুর বিজয়ী প্রবেশ
৩. (ক) ৯ই নিশান রবিবার যীশু কীভাবে যিরূশালেমে আসেন আর বেশির ভাগ লোকেরা যারা সেখানে ছিল তারা কী করে? (খ) যখন ফরীশীরা লোকেদের চুপ করতে বলার জন্য যীশুকে বলে তখন তিনি তাদের কী উত্তর দিয়েছিলেন?
৩ ৯ই নিশান রবিবার যীশু বিজয়ীর মতো যিরূশালেমে আসেন। যখন তিনি গর্দ্দভীর শাবকে চড়ে নগরে ঢোকেন সেইসময় সখরিয় ৯:৯ পদের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়। বেশিরভাগ লোকেরা যারা সেখানে ছিল তারা পথের ওপর তাদের বস্ত্র পেতে দেয়। অন্য অনেকে গাছের ডাল কেটে পথে ছড়িয়ে দেয়। তারা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে থাকে “‘ধন্য সেই রাজা, যিনি প্রভুর নামে আসিতেছেন।’” কিছু ফরীশীরা লোকেদের চুপ করতে বলার জন্য তাঁকে বলে। কিন্তু যীশু উত্তর দেন: “আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, ইহারা যদি চুপ করিয়া থাকে, প্রস্তর সকল চেঁচাইয়া উঠিবে।”—লূক ১৯:৩৮-৪০; মথি ২১:৬-৯.
৪. যীশু যখন নগরে ঢোকেন তখন নগরময় কেন হুলস্থূলু পড়ে যায়?
৪ মাত্র কয়েক সপ্তা আগেই যীশু যখন লাসারকে জীবিত করে তুলেছিলেন তখন অনেক লোকেরা যারা তা দেখেছিল তারা আজকেও এই ভিড়ের মধ্যে আছে। তারা এখন অন্যদের যীশুর সেই অলৌকিক কাজ সম্বন্ধে বলছে। তাই যীশু যখন নগরে ঢোকেন তখন নগরময় হুলস্থূলু পড়ে যায়। সকলে জিজ্ঞেস করতে থাকে “উনি কে?” আর লোকেরা বলতে থাকে: “উনি সেই ভাববাদী, গালীলের নাসরতীয় যীশু।” যা কিছু ঘটে চলেছে তা দেখে ফরীশীরা চিন্তিত হয়ে বলে: “জগৎসংসার উহার পশ্চাদ্গামী হইয়াছে।”—মথি ২১:১০, ১১; যোহন ১২:১৭-১৯.
৫. যীশু মন্দিরে এলে কী ঘটে?
৫ যিরূশালেমে এসে মহান শিক্ষক তাঁর অভ্যাস মতো লোকেদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য মন্দিরে যান। যীশু মন্দিরে এলে কী ঘটে? সেখানে অন্ধ ও খঞ্জেরা তাঁর কাছে আসে ও তিনি তাদের সুস্থ করেন। যখন মহাযাজক ও অধ্যাপকেরা এসব দেখে ও শোনে যে বালকেরা “‘হোশান্না দায়ূদ-সন্তান,’” বলে ধর্মধামে চেঁচাচ্ছে তারা ভীষণ রেগে যায়। তারা যীশুকে বলে “শুনিতেছ, ইহারা কি বলিতেছে?” যীশু তাদের বলেন, “হাঁ; তোমরা কি কখনও পাঠ কর নাই যে, ‘তুমি শিশু ও দুগ্ধপোষ্যদের মুখ হইতে স্তব সম্পন্ন করিয়াছ’?” মন্দিরে শিক্ষা দিতে দিতে তিনি মন্দিরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে নেন যে সেখানে কী ঘটে চলেছে।—মথি ২১:১৫, ১৬; মার্ক ১১:১১.
৬. আগে যীশু যেভাবে যিরূশালেমে এসেছিলেন এখন তা তার থেকে কীভাবে আলাদা ও কেন?
৬ ছমাস আগে যীশু যেভাবে যিরূশালেমে এসেছিলেন এখন তা তার থেকে কতই না আলাদা! সেই সময়ে কুটিরবাস পর্বের জন্য তিনি যিরূশালেমে এসেছিলেন “প্রকাশ্যরূপে নয়, কিন্তু এক প্রকার গোপনে।” (যোহন ৭:১০) আর যখনই তিনি দেখেছেন যে তাঁর জীবন বিপদের মধ্যে তিনি সেখান থেকে সরে পড়েছেন। কিন্তু এখন তিনি সবার সামনে দিয়ে নগরে ঢুকছেন যেখানে তাঁকে ধরার জন্য লোকেদের বলা হয়েছে! তাছাড়া যীশু কখনই নিজেকে মশীহ হিসেবে জাহির করতে চাননি। (যিশাইয় ৪২:২; মার্ক ১:৪০-৪৪) তিনি চাননি যে লোকেরা তাঁকে নিয়ে খুব মাতামাতি করুক, তাঁর কথা লোকেদের মুখে মুখে ফিরুক বা লোকেরা তাঁর নামে মিথ্যে প্রচার করুক। কিন্তু এখন লোকেরা তাঁকে খোলাখুলিভাবে বলছে যে তিনি রাজা ও রক্ষাকর্তা—মশীহ। আর ধর্মীয় গুরুরা যখন শিষ্যদের চুপ করতে বলার জন্য তাঁকে বলেন তিনি তা শোনেননি! কেন সবকিছু এভাবে বদলে গেছে? কারণ যেমন যীশু এর পরের দিন বলেন এখন “সময় উপস্থিত, যেন মনুষ্যপুত্ত্র মহিমান্বিত হন।”—যোহন ১২:২৩.
সাহসী কাজ ও কিছু জীবনদায়ী শিক্ষা
৭, ৮. সাধারণ কাল ৩৩ সালের ১০ই নিশান সোমবার মন্দিরে যীশু যা করেছিলেন তা আমাদের কী করে সা.কা. ৩০ সালে নিস্তারপর্বের সময় মন্দিরে তিনি যা করেছিলেন তা মনে করিয়ে দেয়?
৭ ১০ই নিশান সোমবার যীশু মন্দিরে আসেন ও গতকাল সন্ধ্যেবেলায় তিনি যা দেখেছিলেন তার বিরুদ্ধে কাজ করেন। তিনি “যাহারা ধর্ম্মধামের মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করিতেছিল, তাহাদিগকে বাহির করিয়া দিতে লাগিলেন, এবং পোদ্দারদের মেজ, ও যাহারা কপোত বিক্রয় করিতেছিল, তাহাদের আসন সকল উল্টাইয়া ফেলিলেন। আর ধর্ম্মধামের মধ্য দিয়া কাহাকেও কোন পাত্র লইয়া যাইতে দিলেন না।” যারা এই অন্যায় কাজ করছিল তাদের ধমক দিয়ে তিনি বলেছিলেন: “ইহা কি লেখা নাই, ‘আমার গৃহকে সর্ব্বজাতির প্রার্থনা-গৃহ বলা যাইবে’? কিন্তু তোমরা ইহা ‘দস্যুগণের গহ্বর’ করিয়াছ।”—মার্ক ১১:১৫-১৭.
৮ মন্দিরে এসে এখন যীশু যা করেন তা আমাদের ৩ বছর আগে সাধারণ কালের ৩০ সালে তিনি যে কাজ করেছিলেন সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এখন তিনি পোদ্দারদের আরও কড়াভাবে ধমক দেন। তিনি তাদের ‘দস্যু’ বলেন। (লূক ১৯:৪৫, ৪৬; যোহন ২:১৩-১৬) আর তারা দস্যুই ছিল কারণ যারা বলি দেওয়ার জন্য পশুপাখি কিনত তাদের কাছ থেকে এরা আকাশছোঁয়া দাম নিত। যখন মহাযাজক, অধ্যাপক ও ফরীশীরা যীশু যা কিছু করছেন তা শুনতে পায় তখন তারা তাঁকে মেরে ফেলার সুযোগ খুঁজতে থাকে। কিন্তু তারা বুঝে উঠতে পারছে না যে কীভাবে তাঁকে একা পাওয়া যায় কারণ লোকেরা সবসময় তাঁর চারপাশে ভিড় করে আছে ও তারা তাঁর শিক্ষায় চমৎকৃত।—মার্ক ১১:১৮; লূক ১৯:৪৭, ৪৮.
৯. যীশু কোন্ শিক্ষা দেন আর মন্দিরে যারা তাঁর কথা শুনছিল তাদের তিনি কী বলেন?
৯ মন্দিরে শিক্ষা দেওয়ার সময় যীশু বলেন: “সময় উপস্থিত, যেন মনুষ্যপুত্ত্র মহিমান্বিত হন।” হ্যাঁ, তিনি জানেন যে পৃথিবীতে তাঁর জীবন আর মাত্র কয়েক দিনের জন্য। যেভাবে একটা গমের বীজ মরে গিয়ে তার থেকে অনেক চারাগাছ হয় তা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন যে সেইরকমই তাঁর মারা যাওয়া অনেক লোকেদের অনন্ত জীবন দেবে। তারপর যীশু মন্দিরে যারা তাঁর কথা শুনছিলেন তাদেরকে বলেন: “কেহ যদি আমার পরিচর্য্যা করে, তবে সে আমার পশ্চাদ্গামী হউক; তাহাতে আমি যেখানে থাকি, আমার পরিচারকও সেইখানে থাকিবে; কেহ যদি আমার পরিচর্য্যা করে, তবে পিতা তাহার সম্মান করিবেন।”—যোহন ১২:২৩-২৬.
১০. যীশুকে যে যন্ত্রণা সহ্য করে মারা যেতে হবে সে কথা ভেবে তিনি কী বলেন?
১০ আর মাত্র চারদিন পরে তাঁকে যে যন্ত্রণা সহ্য করে মারা যেতে হবে সে কথা ভেবে যীশু বলেন: “এখন আমার প্রাণ উদ্বিগ্ন হইয়াছে; ইহাতে কি বলিব? পিতঃ এই সময় হইতে আমাকে রক্ষা কর?” কিন্তু তাঁর জন্য যা ঘটতে চলেছে তা তিনি এড়াতে পারেন না। তাই তিনি বলেন: “কিন্তু ইহারই নিমিত্ত আমি এই সময় পর্য্যন্ত আসিয়াছি।” যীশুর এই কথা দেখায় যে তিনি যিহোবার এই সমস্ত ব্যবস্থাকে মেনে নিয়েছেন। তিনি চান যে তাঁর মারা যাওয়া পর্যন্ত যেন যিহোবা ঈশ্বরের ইচ্ছা মতোই সমস্ত কিছু ঘটে। (যোহন ১২:২৭) আমাদের জন্য তিনি কত ভাল উদাহরণই না রেখেছেন! তাই আমরাও যেন আমাদের জীবনে যিহোবার ইচ্ছা মতো সমস্ত কিছু ঘটতে দিই!
১১. যারা স্বর্গ থেকে এইমাত্র এক বাণী শুনেছে তাদেরকে যীশু কী বোঝান?
১১ তাঁর মারা যাওয়া কীভাবে তাঁর পিতার নামের ওপর ছাপ ফেলবে সে কথা চিন্তা করে যীশু বলেন: “পিতঃ, তোমার নাম মহিমান্বিত কর।” তখন সেখানে জড়ো হওয়া সমস্ত লোকেদের আশ্চর্য করে দিয়ে স্বর্গ থেকে এক বাণী ঘোষণা করে: “‘আমি তাহা মহিমান্বিত করিয়াছি, আবার মহিমান্বিত করিব।’” মহান শিক্ষক এরপর সেখানে জমা হওয়া লোকেদের যারা স্বর্গ থেকে এইমাত্র এক বাণী শুনেছে তাদের বোঝান যে কেন তারা এই বাণী শুনতে পেয়েছে, তিনি মারা যাওয়ার ফল কী হবে আর কেন তাদের তাতে বিশ্বাস করা দরকার। (যোহন ১২:২৮-৩৬) যীশুর গত দুদিন খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। কিন্তু সামনে সেই ভয়ানক দিন আসতে চলেছে।
ঘোষণার দিন
১২. ১১ই নিশান, মঙ্গলবার ধর্মীয় গুরুরা কীভাবে যীশুকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টায় থাকে ও তার ফল কী হয়?
১২ ১১ই নিশান, মঙ্গলবার যীশু শিক্ষা দেওয়ার জন্য আবারও মন্দিরে যান। তাঁর শত্রুরা সেখানে হাজির আছে। গতকাল তিনি যে কাজ করেছেন সে কথা বলে প্রধান যাজকেরা ও লোকেদের প্রাচীনবর্গ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন: “তুমি কি ক্ষমতায় এই সকল করিতেছ? আর কেই বা তোমাকে এই ক্ষমতা দিয়াছে?” মহান শিক্ষক তাঁর উত্তরে তাদের মুখ বন্ধ করে দেন আর তিনটে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেন। তার মধ্যে দুটো দ্রাক্ষাক্ষেত্র সম্বন্ধে ও একটা বিবাহ ভোজ সম্বন্ধে। আর তা দেখায় যে তাঁর বিরোধীরা কত কপট। যীশুর কথায় রেগে গিয়ে ধর্মীয় গুরুরা তাঁকে তখনই ধরার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তারা লোকেদের ভয় পায় কারণ লোকেরা তাঁকে একজন ভাববাদী বলে মানে। তাই তারা তাঁর কথায় তাঁকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টায় থাকে যাতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়। কিন্তু যীশু যে উত্তর তাদের দেন তাতে তাদের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।—মথি ২১:২৩–২২:৪৬.
১৩. যারা তাঁর কথা শুনছিল, অধ্যাপক ও ফরীশীদের বিষয়ে যীশু তাদেরকে কী বলেন?
১৩ যেহেতু ঈশ্বরের ব্যবস্থা শিক্ষা দেওয়াই ছিল ফরীশী ও অধ্যাপকদের পেশা তাই যারা তাঁর কথা শুনছিল যীশু তাদেরকে বলেন: “তাহারা তোমাদিগকে যাহা কিছু বলে, তাহা পালন করিও, মানিও, কিন্তু তাহাদের কর্ম্মের মত কর্ম্ম করিও না; কেননা তাহারা বলে, কিন্তু করে না।” (মথি ২৩:১-৩) সবার সামনে কত জোরালো ঘোষণা! কিন্তু যীশু তাঁর ঘোষণা এখনও শেষ করেননি। মন্দিরে এটাই তাঁর শেষ দিন আর তিনি সাহসের সঙ্গে একের পর এক তাদের মুখোশ খুলে দিচ্ছেন আর তা যেন তাদের গায়ে চাবুকের মতো লাগছে।
১৪, ১৫. অধ্যাপক ও ফরীশীদের নিন্দা করে যীশু কোন্ কড়া কথাগুলো ঘোষণা করেন?
১৪ “হা অধ্যাপক ও ফরীশীগণ, কপটীরা, ধিক্ তোমাদিগকে!” ছবার যীশু তাদের নিন্দা করে এ কথা বলেন। তারা সত্যিই কপটী কারণ তারা লোকেদের সামনে স্বর্গরাজ্যের পথ রুদ্ধ করে রাখে, যারা সেখানে যেতে চায় তাদের যেতে দেয় না। এই কপটীরা একজনকে যিহুদি ধর্মে নিয়ে আসার জন্য সারা পৃথিবী ও সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায় আর শেষে তাকেও তাদের মতোই ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তারা ব্যবস্থার ছোট ছোট বিষয়গুলো মেনে চলে, সব জিনিসের দশমাংশ দেয় কিন্তু ‘ব্যবস্থার মধ্যে গুরুতর বিষয় ন্যায়বিচার, দয়া ও বিশ্বাস-পরিত্যাগ করে।’ তারা আসলে “পানপাত্র ও ভোজনপাত্র বাহিরে পরিষ্কার করিয়া থাক, কিন্তু সেগুলির ভিতরে দৌরাত্ম্য ও অন্যায় ভরা।” আর এর মানে হল যে তারা বাইরে থেকে ভক্তি দেখায় কিন্তু তাদের মন ছলনা ও কপটতায় ভরা। তারা ভাববাদীদের কবর গাঁথে ও তা শোভিত করে যাতে অন্যেরা তাদের নাম করে কিন্তু আসলে তারা “যাহারা ভাববাদিগণকে বধ করিয়াছিল, . . . তাহাদেরই সন্তান।”—মথি ২৩:১৩-১৫, ২৩-৩১.
১৫ তাদের মনে ঈশ্বরের নীতি ও শিক্ষার জন্য একেবারেই কোন জায়গা নেই দেখে যীশু তাদের বলেন: “হা অন্ধ পথ-দর্শকেরা, ধিক্ তোমাদিগকে!” তারা এতখানিই অন্ধ ছিল যে মন্দির যা ঈশ্বরের উপাসনার জায়গা তা ছেড়ে তারা মন্দিরের সোনাকে বেশি গুরুত্ব দিত। তাই যীশু তাদের নিন্দা করে এই কড়া কথাগুলো ঘোষণা করেন: “সর্পেরা, কালসর্পের বংশেরা, তোমরা কেমন করিয়া বিচারে নরকদণ্ড এড়াইবে?” যীশু তাদের বলেন যে তাদের ভীষণ মন্দতার জন্য তারা চিরকালের মতো ধ্বংস হয়ে যাবে। (মথি ২৩:১৬-২২, ৩৩) আসুন আমরাও যীশুর মতো সাহসের সঙ্গে ঈশ্বরের রাজ্য প্রচার করি এমনকি তাতে যদি আমাদের মিথ্যা ধর্মের মুখোশ খুলে দিতে হয়।
১৬. জৈতুন পর্বতে বসে যীশু শিষ্যদের কাছে কোন্ ভবিষ্যদ্বাণী করেন?
১৬ যীশু মন্দির থেকে চলে যান। বিকেলের পড়ন্ত বেলায় এখন তিনি তাঁর শিষ্যদের নিয়ে জৈতুন পর্বতে উঠছেন। সেখানে বসে তিনি শিষ্যদের কাছে মন্দিরের ধ্বংস, তাঁর আগমনের ও যুগান্তের চিহ্নের বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেন। আজকে আমাদের দিনের জন্যও যীশু এই কথাগুলো বলেছিলেন। সেই সন্ধ্যেতে যীশু তাঁর শিষ্যদের আরও বলেছিলেন: “তোমরা জান, দুই দিন পরে নিস্তারপর্ব্ব আসিতেছে, আর মনুষ্যপুত্ত্র ক্রুশে [যাতনা দণ্ডে] বিদ্ধ হইবার জন্য সমর্পিত হইতেছেন।”—মথি ২৪:১-১৪; ২৬:১, ২.
যীশু “তাহাদিগকে শেষ পর্য্যন্ত প্রেম করিলেন”
১৭. (ক) ১৪ই নিশান নিস্তারপর্ব পালন করার সময় যীশু তাঁর ১২ জন প্রেরিতকে কোন্ জরুরি শিক্ষা দেন? (খ) ঈষ্কোরিয়োতীয় যিহুদা চলে যাওয়ার পর যীশু কোন্ সভা পালন করেন?
১৭ পরের দুদিন ১২ ও ১৩ই নিশান যীশু মন্দিরে যান না। ধর্মীয় নেতারা তাঁকে মারার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে নিস্তারপর্ব পালন করতে চান আর তাতে কোন বাধা আসুক তা তিনি চান না। বৃহস্পতিবার সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে ১৪ই নিশান শুরু হয়। এটাই পৃথিবীতে যীশুর জীবনের শেষ দিন। সন্ধ্যেবেলা যীশু তাঁর প্রেরিতদের নিয়ে নিস্তারপর্ব পালন করার জন্য যিরূশালেমের এক উপরের কুঠরিতে জমা হন। এই সময়ে শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়ে তাদের নম্র হওয়ার জন্য এক জরুরি শিক্ষা দেন। ঈষ্কোরিয়োতীয় যিহুদা সেখান থেকে চলে যায়। সে মাত্র ত্রিশ রৌপ্যমুদ্রা নিয়ে তার প্রভুকে ধরিয়ে দিতে রাজি হয়েছে। মোশির ব্যবস্থায় যা কিনা শুধু এক দাসের দাম ছিল। যিহুদা চলে যাওয়ার পর যীশু তাঁর মৃত্যুর স্মরণার্থক সভা পালন করেন।—যাত্রাপুস্তক ২১:৩২; মথি ২৬:১৪, ১৫, ২৬-২৯; যোহন ১৩:২-৩০.
১৮. পরে তাঁর ১১ জন বিশ্বস্ত প্রেরিতকে যীশু আর কী শেখান ও তাদের ছেড়ে চলে যাবেন বলে তিনি তাদের কীভাবে তৈরি করেন?
১৮ স্মরণার্থক সভা শেষ হতে না হতেই প্রেরিতদের মধ্যে কে বড় এই নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। তাদের বকার বদলে যীশু নম্রভাবে শেখান যে অন্যদের সেবা করার ইচ্ছা থাকা কত জরুরি। পরীক্ষার মধ্যেও যে শিষ্যরা তাঁর সঙ্গে থেকেছে সে কথা বলে যীশু তাদের সঙ্গে রাজ্যের বিষয়ে এক নতুন চুক্তি করেন। (লূক ২২:২৪-৩০) যীশু তাদেরকে এক আজ্ঞাও দেন, তিনি তাদের একে অন্যকে ভালবাসতে বলেন যেমন তিনি তাদের ভালবেসেছেন। (যোহন ১৩:৩৪) সেই কুঠরিতেই তারা আরও কিছুক্ষণ থাকেন। আর এখন প্রেরিতদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় খুবই কাছে আসায় যীশু তাদেরকে তৈরি করেন। তিনি তাদের নিশ্চয়তা দেন যে তিনি সবসময় তাদের মিত্র হয়ে থাকবেন, তাদেরকে পবিত্র আত্মা পাঠাবেন তাই তাদের বিশ্বাস যেন কমে না যায়। (যোহন ১৪:১-১৭; ১৫:১৫) উপরের কুঠরি থেকে বেরনোর আগে যীশু তাঁর পিতার কাছে বিনতি করেন: “সময় উপস্থিত হইল; তোমার পুত্ত্রকে মহিমান্বিত কর, যেন পুত্ত্র তোমাকে মহিমান্বিত করেন।” যীশু তাঁর প্রেরিতদের তৈরি করেছেন আর তিনি তাদের সত্যিই “শেষ পর্য্যন্ত প্রেম করিলেন।”—যোহন ১৩:১; ১৭:১.
১৯. গেৎশিমানী বাগানে যীশু কেন মর্মভেদী দুঃখ পান?
১৯ এখন মাঝরাত। যীশু তাঁর ১১ জন প্রেরিতের সঙ্গে গেৎশিমানী বাগানে আসেন। এর আগেও অনেকবার তিনি তাঁর শিষ্যদের সঙ্গে এখানে এসেছেন। (যোহন ১৮:১, ২) আর কয়েক ঘন্টার মধ্যেই যীশুকে একজন জঘন্য অপরাধীর মতো মারা যেতে হবে। তাঁর মারা যাওয়া ও তা তাঁর পিতার নামের ওপর কীভাবে নিন্দা আনতে পারে সে কথা ভেবে তিনি এতই মর্ম্মভেদী দুঃখ পান যে যখন তিনি একাগ্রভাবে প্রার্থনা করছিলেন তখন তাঁর ঘাম যেন রক্তের ঘণীভূত বড় বড় ফোঁটা হয়ে ভূমিতে পড়তে থাকে। (লূক ২২:৪১-৪৪) এরপর যীশু তাঁর প্রেরিতদের বলেন, “সময় উপস্থিত, . . . এই দেখ, যে ব্যক্তি আমাকে সমর্পণ করিতেছে, সে নিকটে আসিয়াছে।” তিনি যখন এ কথা বলছিলেন সেই সময় ঈষ্কোরিয়োতীয় যিহুদা এগিয়ে আসে আর তার সঙ্গে খড়্গ, লাঠি ও মশাল নিয়ে একদল লোক। তারা যীশুকে গ্রেপ্তার করার জন্য এসেছে। তিনি তাদেরকে বাধা দেন না কারণ “তাহা করিলে কেমন করিয়া শাস্ত্রীয় এই বচন সকল পূর্ণ হইবে যে, এরূপ হওয়া আবশ্যক?”—মার্ক ১৪:৪১-৪৩; মথি ২৬:৪৮-৫৪.
মনুষ্যপুত্র মহিমান্বিত হন!
২০. (ক) যীশুকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়? (খ) কেন মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে যীশু চিৎকার করে বলেন “সমাপ্ত হইল”?
২০ যীশুকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর নামে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়া হয়, ধর্মীয় নেতারা তাঁকে দোষী করে, পন্তীয় পীলাত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন, যাজকেরা ও জনতা তাঁকে ঠাট্টা করে, সৈনিকেরা তাঁর গায়ে থুতু দেয় ও তাঁর মুখে ঘুষি মারে। (মার্ক ১৪:৫৩-৬৫; ১৫:১, ১৫; যোহন ১৯:১-৩) শুক্রবার দুপুরের মধ্যে যীশুকে যাতনাদণ্ডে পেরেক বিদ্ধ করা হয়। যাতনাদণ্ডকে খাড়া করা হলে যখন তাঁর সমস্ত দেহের ভার হাত ও পায়ের পেরেক বেঁধা জায়গায় গিয়ে পড়ে তখন তিনি অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করেন। (যোহন ১৯:১৭, ১৮) বেলা প্রায় ৩টের সময় মারা যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে যীশু চিৎকার করে বলেন “সমাপ্ত হইল।” হ্যাঁ, তিনি সেই সমস্ত কিছু করেছেন যা করতে তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। ঈশ্বরের কাছে তাঁর প্রাণ সমর্পণ করে তিনি মাথা নুয়ান আর মারা যান। (যোহন ১৯:২৮, ৩০; মথি ২৭:৪৫, ৪৬; লূক ২৩:৪৬) তৃতীয় দিনে যিহোবা তাঁর পুত্রকে আবার জীবিত করেন। (মার্ক ১৬:১-৬) আবার জীবিত হয়ে ওঠার চল্লিশ দিন পরে তিনি স্বর্গে যান ও মহিমান্বিত হন।—যোহন ১৭:৫; প্রেরিত ১:৩, ৯-১২; ফিলিপীয় ২:৮-১১.
২১. আমরা কীভাবে যীশুর মতো চলতে পারি?
২১ আমরা কীভাবে ‘যীশুর মত চলতে’ পারি? (১ পিতর ২:২১, প্রেমের বাণী) তাঁর মতো আসুন আমরাও জোরকদমে, উৎসাহ নিয়ে প্রচার ও শিষ্য তৈরির কাজ করি। অন্যদেরকে সাহসের সঙ্গে ঈশ্বরের বাক্য বলি। (মথি ২৪:১৪; ২৮:১৯, ২০; প্রেরিত ৪:২৯-৩১; ফিলিপীয় ১:১৪) সময়ের ধারায় আমরা কোথায় আছি সে কথা যেন আমরা কখনও ভুলে না যাই। আর আমরা যেন প্রেম দেখিয়ে ও ভাল কাজ করে একে অন্যকে উৎসাহিত করতেও না ভুলি। (মার্ক ১৩:২৮-৩৩; ইব্রীয় ১০:২৪, ২৫) আমাদের জীবনের সমস্ত কিছু যেন আমরা ঈশ্বরের ইচ্ছা মতো হতে দিই। আর আমরা এমনভাবে কাজ করি যে তা দেখায় আমরা জানি যে আমরা ‘শেষ কালে’ বাস করছি।—দানিয়েল ১২:৪.
আপনি কী উত্তর দেবেন?
• যীশু জানতেন যে তাঁর মারা যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে আর তা কীভাবে যিরূশালেম মন্দিরে তাঁর শেষ শিক্ষার ওপর ছাপ ফেলে?
• কী দেখায় যে যীশু “তাহাদিগকে শেষ পর্য্যন্ত প্রেম করিলেন”?
• যীশুর জীবনের শেষ কিছু ঘন্টার ঘটনা তাঁর সম্বন্ধে কী বলে?
• প্রচার করার সময় আমরা কীভাবে যীশুর মতো চলতে পারি?
[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]
[১৮ পৃষ্ঠার চিত্র]
যীশু “তাহাদিগকে শেষ পর্য্যন্ত প্রেম করিলেন”