সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ঈশ্বরের রাজ্য—পৃথিবীর নতুন শাসনব্যবস্থা

ঈশ্বরের রাজ্য—পৃথিবীর নতুন শাসনব্যবস্থা

ঈশ্বরের রাজ্য—পৃথিবীর নতুন শাসনব্যবস্থা

“তাহা [সেই রাজ্য] ঐ সকল রাজ্য চূর্ণ ও বিনষ্ট করিয়া আপনি চিরস্থায়ী হইবে।”দানিয়েল ২:৪৪.

১. কেন আমরা বাইবেলের ওপর ভরসা রাখতে পারি?

 বাইবেল হল মানুষের জন্য ঈশ্বরের বাক্য। এই বিষয়ে প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “আমাদের কাছে ঈশ্বরের বার্ত্তারূপ বাক্য প্রাপ্ত হইয়া তোমরা মনুষ্যদের বাক্য নয়, কিন্তু ঈশ্বরের বাক্য বলিয়া তাহা গ্রহণ করিয়াছিলে; তাহা ঈশ্বরের বাক্যই বটে।” (১ থিষলনীকীয় ২:১৩) ঈশ্বরের সম্বন্ধে আমাদের যতটুকু জানা দরকার তার সমস্তই বাইবেলে আছে, যেমন তিনি কীরকম ব্যক্তি, তাঁর কী কী উদ্দেশ্য রয়েছে এবং আমাদের কাছ থেকে তিনি কী চান। পারিবারিক ও রোজকার জীবনের জন্য এতে সবচেয়ে ভাল পরামর্শ রয়েছে। এছাড়াও এতে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে, যেগুলোর কিছু প্রাচীনকালে পূর্ণ হয়েছে, কিছু এখন পূর্ণ হচ্ছে ও বাকিগুলো ভবিষ্যতে পূর্ণ হবে। তাই, আমরা বলতে পারি যে “ঈশ্বর-নিশ্বসিত প্রত্যেক শাস্ত্রলিপি আবার শিক্ষার, অনুযোগের, সংশোধনের, ধার্ম্মিকতা সম্বন্ধীয় শাসনের নিমিত্ত উপকারী, যেন ঈশ্বরের লোক পরিপক্ব, সমস্ত সৎকর্ম্মের জন্য সুসজ্জীভূত হয়।”—২ তীমথিয় ৩:১৬, ১৭.

২. যীশু কীভাবে বাইবেলের মূল বিষয়বস্তুর ওপর জোর দিয়েছিলেন?

বাইবেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, স্বর্গীয় রাজ্যের মাধ্যমে ঈশ্বর তাঁর সার্বভৌমত্বকে (তাঁর শাসন করার অধিকারকে) প্রতিষ্ঠা করবেন। যীশু মূলত এই বিষয়েই প্রচার করেছিলেন। “যীশু প্রচার করিতে আরম্ভ করিলেন; বলিতে লাগিলেন, ‘মন ফিরাও, কেননা স্বর্গ-রাজ্য সন্নিকট হইল।’” (মথি ৪:১৭) ঈশ্বরের রাজ্যকে আমাদের জীবনে কোন্‌ জায়গায় রাখা উচিত সেই বিষয়ে তিনি বলেছিলেন: “তোমরা প্রথমে তাঁহার রাজ্য ও তাঁহার ধার্ম্মিকতার বিষয়ে চেষ্টা কর।” (মথি ৬:৩৩) এছাড়া এই রাজ্যের জন্য প্রার্থনা করতে শিখিয়েও তিনি দেখিয়েছিলেন যে এটা কতখানি জরুরি। তিনি শিষ্যদেরকে শিখিয়েছিলেন: “তোমার রাজ্য আইসুক, তোমার ইচ্ছা সিদ্ধ হউক, যেমন স্বর্গে তেমনি পৃথিবীতেও হউক।”—মথি ৬:১০.

পৃথিবীর নতুন শাসনব্যবস্থা

৩. ঈশ্বরের রাজ্য কেন আমাদের জন্য এত বেশি জরুরি?

মানুষের জন্য ঈশ্বরের রাজ্য কেন এত বেশি জরুরি? কারণ শীঘ্রিই এটা এমন কিছু করবে, যার জন্য এই পৃথিবীর শাসনব্যবস্থা চিরতরে বদলে যাবে। দানিয়েল ২:৪৪ পদের ভবিষ্যদ্বাণী বলে: “সেই রাজগণের [যারা এখন পৃথিবীতে শাসন করছে] সময়ে স্বর্গের ঈশ্বর এক রাজ্য [স্বর্গীয় সরকার] স্থাপন করিবেন, তাহা কখনও বিনষ্ট হইবে না, এবং সেই রাজত্ব অন্য জাতির হস্তে সমর্পিত হইবে না; তাহা ঐ সকল রাজ্য [পৃথিবীর সরকারগুলোকে] চূর্ণ ও বিনষ্ট করিয়া আপনি চিরস্থায়ী হইবে।” ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্য যখন পৃথিবীর ওপর পুরোপুরিভাবে শাসন করবে তখন মানুষ আর কখনোই পৃথিবীকে শাসন করতে পারবে না। মানুষের শাসনব্যবস্থা চিরতরে শেষ হয়ে যাবে কারণ তাদের শাসনব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে অনৈক্য আর তা লোকেদের প্রয়োজন মেটাতে পারে না।

৪, ৫. (ক) ঈশ্বরের রাজ্যের রাজা হওয়ার জন্য কেন যীশুই সবচেয়ে বেশি যোগ্য ব্যক্তি? (খ) ভবিষ্যতে যীশু কোন্‌ কাজের ভার পাবেন?

যিহোবার পরে স্বর্গীয় রাজ্যের প্রধান শাসক হলেন যীশু খ্রীষ্ট আর প্রধান শাসক হওয়ার জন্য তিনিই সবচেয়ে বেশি যোগ্য। কারণ সমস্ত কিছু সৃষ্টি করার আগে ঈশ্বর তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন এবং পৃথিবীতে আসার আগে স্বর্গে তিনি ঈশ্বরের “[প্রধান] কার্য্যকারী” ছিলেন। (হিতোপদেশ ৮:২২-৩১) “ইনিই অদৃশ্য ঈশ্বরের প্রতিমূর্ত্তি, সমুদয় সৃষ্টির প্রথমজাত; . . . স্বর্গে ও পৃথিবীতে, . . . সকলই তাঁহার দ্বারা . . . সৃষ্ট হইয়াছে।” (কলসীয় ১:১৫, ১৬) আর ঈশ্বর যখন যীশুকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তখনও তিনি সবসময় ঈশ্বরের ইচ্ছা মেনে কাজ করেছিলেন। কঠিন পরীক্ষাগুলোর মধ্যেও তিনি ধৈর্য ধরেছিলেন এবং তাঁর পিতার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে মারা গিয়েছিলেন।—যোহন ৪:৩৪; ১৫:১০.

যীশু মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন বলে ঈশ্বর তাঁকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। ঈশ্বর তাঁকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন এবং স্বর্গীয় রাজ্যের রাজা হওয়ার অধিকার দিয়েছিলেন। (প্রেরিত ২:৩২-৩৬) রাজা যীশু খ্রীষ্টকে ঈশ্বর এক বিরাট কাজের ভার দেবেন। হাজার হাজার শক্তিশালী দূতেদের সঙ্গে নিয়ে পৃথিবী থেকে মানুষের শাসনব্যবস্থাকে যীশু চিরতরে ধ্বংস করবেন এবং সমস্ত দুষ্টতা দূর করে দেবেন। (হিতোপদেশ ২:২১, ২২; ২ থিষলনীকীয় ১:৬-৯; প্রকাশিত বাক্য ১৯:১১-২১; ২০:১-৩) সেই সময় ঈশ্বরের রাজ্যই হবে নতুন শাসনব্যবস্থা, যার রাজা হবেন যীশু খ্রীষ্ট এবং পুরো পৃথিবীতে এটাই হবে একমাত্র সরকার।—প্রকাশিত বাক্য ১১:১৫.

৬. ঈশ্বরের রাজ্যের শাসক কীভাবে শাসন করবেন বলে আমরা আশা করতে পারি?

ঈশ্বরের বাক্য পৃথিবীর নতুন শাসক সম্বন্ধে বলে: “তাঁহাকে কর্ত্তৃত্ব, মহিমা ও রাজত্ব দত্ত হইল; লোকবৃন্দ, জাতি ও ভাষাবাদীকে তাঁহার সেবা করিতে হইবে।” (দানিয়েল ৭:১৪) যীশু যেহেতু ঈশ্বরের মতোই প্রেম দেখাবেন, তাই তাঁর রাজ্যে প্রজারা সুখে-শান্তিতে থাকবে। (মথি ৫:৫; যোহন ৩:১৬; ১ যোহন ৪:৭-১০) “তাঁর শাসনক্ষমতা বৃদ্ধির ও শান্তির সীমা থাকবে না, . . . তিনি ন্যায়বিচার ও সততা দিয়ে তা স্থাপন করবেন।” (যিশাইয় ৯:৭, রিভাইজড স্ট্যান্ডার্ড ভারসান) এইরকম একজন প্রেমময়, ন্যায়বিচারক ও সৎ শাসক পাওয়া কত বড় আশীর্বাদই না হবে! এই কারণেই ২ পিতর ৩:১৩ পদ ভবিষ্যদ্বাণী করে: “তাঁহার প্রতিজ্ঞা অনুসারে আমরা এমন নূতন আকাশমণ্ডলের [ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্য] ও নূতন পৃথিবীর [পৃথিবীতে নতুন মানবসমাজ] অপেক্ষায় আছি, যাহার মধ্যে ধার্ম্মিকতা বসতি করে।”

৭. আজকে মথি ২৪:১৪ পদ কীভাবে পূর্ণ হচ্ছে?

কোন সন্দেহ নেই যে যারা ন্যায়বিচার ভালবাসেন তাদের জন্য ঈশ্বরের রাজ্যই সবচেয়ে ভাল খবর। এই কারণেই দুষ্ট জগতের ‘শেষ কালের’ চিহ্ন হিসেবে যীশু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন: “সর্ব্ব জাতির কাছে সাক্ষ্য দিবার নিমিত্ত রাজ্যের এই সুসমাচার সমুদয় জগতে প্রচার করা যাইবে; আর তখন শেষ উপস্থিত হইবে।” (২ তীমথিয় ৩:১-৫; মথি ২৪:১৪) এই ভবিষ্যদ্বাণী আজকে পূর্ণ হচ্ছে কারণ আজকে আমরা প্রায় ষাট লাখ যিহোবার সাক্ষি, দ্বীপ ও দেশ মিলিয়ে ২৩৪টা জায়গায় প্রতি বছর একশ কোটিরও বেশি ঘন্টা ঈশ্বরের রাজ্যের বিষয়ে প্রচার করছি। সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় ৯০,০০০ মণ্ডলী রয়েছে আর আমরা যে জায়গায় উপাসনা করি সেই জায়গাকে সঠিকভাবেই কিংডম হল বলা হয়। কারণ এখানে লোকেরা নতুন সরকারের বিষয়ে শিখতে আসে।

সহশাসকেরা

৮, ৯. (ক) খ্রীষ্টের সঙ্গে যারা রাজত্ব করবেন তাদের কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে? (খ) রাজা ও তাঁর সঙ্গে যারা রাজত্ব করবেন, তাদের শাসন সম্বন্ধে আমরা কী নিশ্চিত থাকতে পারি?

ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্যে যীশু খ্রীষ্টের সঙ্গে আরও শাসকেরা থাকবেন। প্রকাশিত বাক্য ১৪:১-৪ পদে ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে যে ১,৪৪,০০০ জনকে ‘মনুষ্যদের মধ্য হইতে ক্রয় করা’ হবে ও তারা স্বর্গে পুনরুত্থিত হবেন। এদের মধ্যে সেইসব নম্র পুরুষ ও নারীরা রয়েছেন, যারা নিজেরা সেবা না চেয়ে বরং ঈশ্বর ও মানুষের সেবা করেন। “তাহারা ঈশ্বরের ও খ্রীষ্টের যাজক হইবে, এবং সেই সহস্র বৎসর তাঁহার সঙ্গে রাজত্ব করিবে।” (প্রকাশিত বাক্য ২০:৬) কিন্তু, তাদের সংখ্যা সেই লোকেদের চেয়ে অনেক কম, যারা ‘প্রত্যেক জাতির ও বংশের ও প্রজাবৃন্দের ও ভাষার বিস্তর লোক, যাহাদের গণনা করিতে সমর্থ কেহ ছিল না।’ এই বিস্তর লোকেরা জগতের ধ্বংস থেকে রক্ষা পাবেন। তারাও ‘দিবারাত্র ঈশ্বরের আরাধনা’ করেন তবে তারা স্বর্গে যাবেন না। (প্রকাশিত বাক্য ৭:৯, ১৫) ঈশ্বরের স্বর্গীয় রাজ্যের প্রজা হিসেবে তারা নতুন পৃথিবীর ভিত গঠন করেন।—গীতসংহিতা ৩৭:২৯; যোহন ১০:১৬.

স্বর্গে খ্রীষ্টের সঙ্গে রাজত্ব করার জন্য যিহোবা সেই সমস্ত বিশ্বস্ত লোকেদের বেছে নিয়েছেন, যারা জীবনে সবরকমের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। পৃথিবীতে এমন কোন সমস্যা নেই, যা এই রাজা ও যাজকেরা ভোগ করেননি। এইরকম অভিজ্ঞতা থাকায় তারা মানুষের ওপর ভালভাবে শাসন করতে পারবেন। এমনকি যীশু নিজেও “দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে বাধ্যতা শিখেছিলেন।” (ইব্রীয় ৫:৮, প্রেমের বাণী) তাঁর সম্বন্ধে প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “আমরা এমন মহাযাজককে পাই নাই, যিনি আমাদের দুর্ব্বলতাঘটিত দুঃখে দুঃখিত হইতে পারেন না, কিন্তু তিনি সর্ব্ববিষয়ে আমাদের ন্যায় পরীক্ষিত হইয়াছেন, বিনা পাপে।” (ইব্রীয় ৪:১৫) ঈশ্বরের নতুন জগতে প্রেমময় ও সহানুভূতিশীল রাজা এবং যাজকেরা মানুষের ওপর শাসন করবেন জেনে কত সান্ত্বনাই না আমরা পাই!

ঈশ্বরের উদ্দেশ্যের মধ্যে কি রাজ্য ছিল?

১০. ঈশ্বরের আদি উদ্দেশ্যের মধ্যে কেন স্বর্গরাজ্য ছিল না?

১০ ঈশ্বর যখন আদম ও হবাকে সৃষ্টি করেছিলেন তখন তাঁর উদ্দেশ্যের মধ্যে কি স্বর্গরাজ্য ছিল? আদিপুস্তকে সৃষ্টির বিবরণে কোথাও এমন কোন রাজ্যের কথা বলা নেই, যা মানুষের ওপর শাসন করবে। যিহোবা নিজে তাদের শাসক ছিলেন এবং যতদিন তারা যিহোবার কথা শুনেছিল ততদিন আর অন্য কোন শাসনব্যবস্থার দরকার হয়নি। আদিপুস্তক ১ অধ্যায় থেকে জানা যায় যে যিহোবা স্বর্গ থেকে সম্ভবত তাঁর প্রথমজাত পুত্রের মাধ্যমে আদম ও হবার সঙ্গে কথা বলতেন। কারণ এই বইতে “ঈশ্বর কহিলেন” ও “ঈশ্বর আরও কহিলেন” এই কথাগুলো পাওয়া যায়।—আদিপুস্তক ১:২৮, ২৯; যোহন ১:১.

১১. মানুষের শুরু কীরকম ছিল?

১১ বাইবেল বলে: “ঈশ্বর আপনার নির্ম্মিত বস্তু সকলের প্রতি দৃষ্টি করিলেন, আর দেখ, সে সকলই অতি উত্তম।” (আদিপুস্তক ১:৩১) এদন বাগানের সবকিছুই একেবারে নিখুঁত ছিল। আদম-হবা পরমদেশে বাস করত। তাদের শরীর ও মন সিদ্ধ ছিল। তারা তাদের সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারত এবং সৃষ্টিকর্তাও তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তারা সিদ্ধ সন্তান জন্ম দিতে পারত। আর এর ফলে নতুন স্বর্গীয় সরকারের কোন দরকার হতো না।

১২, ১৩. সিদ্ধ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলেও ঈশ্বর কেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন?

১২ এখন প্রশ্ন আসে যে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে ঈশ্বর তাদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতেন? আকাশের তারাদের কথা চিন্তা করুন। এগুলো মহাকাশে দল বেঁধে থাকে আর তারাদের এই সমাবেশকে ছায়াপথ বলে। কিছু ছায়াপথে প্রায় একশ কোটি তারা রয়েছে। আবার কিছু ছায়াপথে এক লক্ষ কোটি তারা রয়েছে। আর বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আমরা মহাকাশের যতটুকু দেখতে পাই তাতে প্রায় দশ হাজার কোটি ছায়াপথ রয়েছে! কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বলেন: “ঊর্দ্ধ্বদিকে চক্ষু তুলিয়া দেখ, ঐ সকলের সৃষ্টি কে করিয়াছে? তিনি বাহিনীর ন্যায় সংখ্যানুসারে তাহাদিগকে বাহির করিয়া আনেন, সকলের নাম ধরিয়া তাহাদিগকে আহ্বান করেন; তাঁহার সামর্থ্যের আধিক্য ও শক্তির প্রাবল্য প্রযুক্ত তাহাদের একটাও অনুপস্থিত থাকে না।”—যিশাইয় ৪০:২৬.

১৩ যেহেতু ঈশ্বর আকাশের তারাদের গতিবিধি জানতে পারেন, তাই আমাদের মনে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে তারাদের চেয়ে সংখ্যায় হাজার গুণ কম মানুষের ওপর নজর রাখা তার কাছে কোন ব্যাপারই হতো না। আজকে তাঁর লাখ লাখ দাসেরা রোজ তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। তাদের প্রার্থনা সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে যায়। তাই, সিদ্ধ মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে তাঁর কোন অসুবিধাই হতো না। মানুষের ওপর নজর রাখার জন্য ঈশ্বরের কোন স্বর্গীয় রাজ্যের দরকার হতো না। কত অপূর্ব শাসনব্যবস্থাই না তা হতো যেখানে যিহোবা শাসন করতেন, মানুষেরা তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারত এবং অনন্ত কাল ধরে পরমদেশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারত!

“মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়”

১৪. কেন মানুষদের চিরকাল যিহোবার শাসন দরকার?

১৪ মানুষ সিদ্ধ হলেও তাদের চিরকাল যিহোবার শাসনের দরকার হতো। কেন? কারণ যিহোবা মানুষকে তাঁর শাসন থেকে স্বাধীন হয়ে ভালভাবে বেঁচে থাকার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেননি। এটা মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য যা ভাববাদী যিরমিয় স্বীকার করেছিলেন: “হে সদাপ্রভু আমি জানি, মনুষ্যের পথ তাহার বশে নয়, মনুষ্য চলিতে চলিতে আপন পাদবিক্ষেপ স্থির করিতে পারে না। হে সদাপ্রভু আমাকে শাসন কর।” (যিরমিয় ১০:২৩, ২৪) তাই, মানুষ যদি ভাবত যে যিহোবাকে ছাড়া তারা নিজেরাই ঠিকমতো শাসন করতে পারবে, তাহলে সেটা হতো বোকামি। তাদেরকে যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেটা হতো তাদের স্বভাবের বিপরীত। যিহোবার শাসনকে মেনে না নিলে স্বার্থপরতা, ঘৃণা, নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা, যুদ্ধ ও মৃত্যু আসত। মানুষ ‘এক জন অন্যের উপরে তাহার অমঙ্গলার্থে কর্ত্তৃত্ব করত।’—উপদেশক ৮:৯.

১৫. আমাদের প্রথম বাবামা যা করেছিলেন তার ফল কী হয়েছিল?

১৫ কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আমাদের প্রথম বাবামা ভেবেছিল যে তাদের ঈশ্বরের শাসন দরকার নেই আর এইজন্যই তারা ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হতে চেয়েছিল। ফলে ঈশ্বর তাদেরকে আর সিদ্ধ থাকতে দেননি। তখন তাদের দশা, শক্তির উৎস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্রের মতো হয়েছিল। ওই যন্ত্রের মতো তাদের জীবনের গতি ধীরে ধীরে কমে গিয়েছিল এবং একসময় চিরদিনের মতো থেমে গিয়েছিল অর্থাৎ তারা মারা গিয়েছিল। সেইসময় তারা এমন একটা নকশার মতো হয়েছিল, যেটাতে খুঁত ছিল আর তাদের ঘরে যে সন্তানরা এসেছিল তাদের দশাও একই হয়েছিল। (রোমীয় ৫:১২) “[যিহোবা] শৈল, তাঁহার কর্ম্ম সিদ্ধ, কেননা তাঁহার সমস্ত পথ ন্যায্য; . . . ইহারা তাঁহার সম্বন্ধে ভ্রষ্টাচারী, তাঁহার সন্তান নয়, এই ইহাদের কলঙ্ক।” (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪, ৫) এটা ঠিক যে বিদ্রোহী দূত শয়তান প্রলোভন দেখিয়ে আদম-হবাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল কিন্তু তারা সিদ্ধ ছিল আর তাই ইচ্ছা করলে তারা শয়তানের দেওয়া কুবুদ্ধিকে অগ্রাহ্য করতে পারত।—আদিপুস্তক ৩:১-১৯; যাকোব ৪:৭.

১৬. ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পরিণতি যে খারাপ তার কোন্‌ প্রমাণ আমরা ইতিহাস থেকে পাই?

১৬ ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পরিণতি যে কতটা খারাপ হয়েছে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বিভিন্ন রকমের শাসনব্যবস্থা চালু করেছে, অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নের জন্য যতরকমের পদ্ধতি আছে সব কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু, পরিস্থিতি “দিন দিন আরও খারাপ” হয়েছে। (২ তীমথিয় ৩:১৩, প্রে.বা.) বিংশ শতাব্দীই হল তার বড় প্রমাণ। এই শতাব্দীতে সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ হয়েছে, মানুষ মানুষকে ঘৃণা করেছে, আরও বেশি লোকেরা গরিব হয়েছে এবং নানারকমের কষ্ট ভোগ করেছে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও মানুষ মারা যাচ্ছে। (উপদেশক ৯:৫, ১০) মানুষ নিজে নিজে চলার চেষ্টা করে নিজেদের ওপর শয়তান ও তার সঙ্গী মন্দ দূতেদেরকে এত বেশি কর্তৃত্ব করার সুযোগ করে দিয়েছে যে বাইবেলে শয়তানকে “এই যুগের দেব” বলা হয়েছে।—২ করিন্থীয় ৪:৪.

স্বাধীন ইচ্ছা

১৭. ঈশ্বরের দেওয়া স্বাধীন ইচ্ছাকে মানুষ কীভাবে কাজে লাগাতে পারত?

১৭ যিহোবা কেন মানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে দিয়েছেন? কারণ তিনি মানুষকে এক অপূর্ব উপহার দিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে স্বাধীন ইচ্ছা অর্থাৎ বেছে নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রেরিত পৌল বলেছিলেন: “যেখানে প্রভুর আত্মা, সেইখানে স্বাধীনতা।” (২ করিন্থীয় ৩:১৭) কেউই রোবটের মতো হতে চায় না। কেউই চায় না যে সে কী বলবে বা কী করবে, তা অন্য কেউ ঠিক করে দিক। যদিও যিহোবা মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন মানুষ যেন সেই ইচ্ছাকে ঠিকভাবে কাজে লাগায় আর তাঁর ইচ্ছা মেনে চলা ও তাঁর বাধ্য থাকা যে বুদ্ধিমানের কাজ, তা বুঝতে পারে। (গালাতীয় ৫:১৩) তাই বলা যায় যে ঈশ্বর মানুষকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দেননি। যদি দিতেন, তাহলে তার ফল হতো বিশৃঙ্খলা। ঈশ্বরের উপকারী নিয়মগুলো মেনে চলেও মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছাকে কাজে লাগাতে পারত।

১৮. মানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে দিয়ে ঈশ্বর কী প্রমাণ করেছেন?

১৮ মানুষকে স্বাধীনভাবে চলতে দিয়ে ঈশ্বর প্রমাণ করেছেন যে আমাদের সবসময় তাঁর শাসনের দরকার। একমাত্র তাঁর শাসনব্যবস্থা অর্থাৎ তাঁর সার্বভৌমত্বই হল সঠিক পদ্ধতি। তাঁর শাসন থেকেই সুখ-শান্তি, পরিতৃপ্তি ও সমৃদ্ধি আসে। কারণ যিহোবা আমাদের শরীর ও মনকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে তাঁর নিয়ম মেনে চললে তা সবচেয়ে ভালভাবে কাজ করবে। “আমি সদাপ্রভু তোমার ঈশ্বর, আমি তোমার উপকারজনক শিক্ষা দান করি, ও তোমার গন্তব্য পথে তোমাকে গমন করাই।” (যিশাইয় ৪৮:১৭) ঈশ্বরের নিয়মের মধ্যে থেকে স্বাধীন ইচ্ছাকে কাজে লাগানো কঠিন হতো না বরং এর ফলে প্রত্যেকের নিজ নিজ ঘর থাকত, প্রচুর খাবার থাকত, তারা নানারকমের সৃজনশীল কাজ করতে ও গানবাজনা করতে পারত। স্বাধীন ইচ্ছাকে সঠিকভাবে কাজে লাগালে পরমদেশ পৃথিবীতে মানুষ জীবনকে উপভোগ করতে পারত।

১৯. মানুষ যেন আবারও ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারে, তার জন্য তিনি কীসের ব্যবস্থা করেছিলেন?

১৯ কিন্তু, মানুষেরা তাদের স্বাধীন ইচ্ছাকে ভুলভাবে কাজে লাগিয়েছিল আর এর ফলে তারা যিহোবার কাছ থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, অসিদ্ধ হয়েছিল, তাদের মর্যাদা হারিয়েছিল এবং মারা যেতে শুরু করেছিল। তাই, এই দুঃখজনক পরিণতি থেকে তাদের মুক্ত হওয়ার এবং সন্তান হিসেবে ঈশ্বরের সঙ্গে আবারও সম্পর্ক গড়ে তোলার দরকার হয়েছিল। আর তা করার জন্য ঈশ্বর রাজ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন ও যীশু খ্রীষ্টকে মুক্তিদাতা করে পাঠিয়েছিলেন। (যোহন ৩:১৬) যারা যীশুর বলা দৃষ্টান্তের অপব্যয়ী পুত্রের মতো সত্যি সত্যি মন থেকে অনুতপ্ত হবেন, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা ঈশ্বরের সঙ্গে আবারও সম্পর্ক গড়তে পারবেন এবং তাঁর সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন।—লূক ১৫:১১-২৪; রোমীয় ৮:২১; ২ করিন্থীয় ৬:১৮.

২০. ঈশ্বরের উদ্দেশ্য কী করে রাজ্যের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে?

২০ এই পৃথিবীতে যিহোবার ইচ্ছা পূর্ণ হবেই হবে। (যিশাইয় ১৪:২৪, ২৭; ৫৫:১১) ঈশ্বর তাঁর রাজ্য, যে রাজ্যের রাজা হলেন খ্রীষ্ট, সেটার মাধ্যমে সার্বভৌম প্রভু হিসেবে তাঁর অধিকারকে প্রতিষ্ঠা (যথার্থতা প্রতিপাদন বা প্রমাণ) করবেন। এই রাজ্য পৃথিবীর ওপর থেকে মানুষ ও শয়তানের শাসনকে দূর করবে এবং স্বর্গ থেকে এক হাজার বছর ধরে একাই রাজত্ব করবে। (রোমীয় ১৬:২০; প্রকাশিত বাক্য ২০:১-৬) এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে ওই সময় যিহোবার শাসনব্যবস্থাই যে শ্রেষ্ঠ, তা কীভাবে প্রমাণ হবে? আর হাজার বছরের রাজত্বের পরেই বা ওই রাজ্য কী করবে? পরের প্রবন্ধে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়া হবে।

পুনরালোচনার বিষয়বস্তু

• বাইবেলের বিষয়বস্তু কী?

• পৃথিবীর নতুন শাসনব্যবস্থার মধ্যে কারা রয়েছেন?

• ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে মানুষ কেন কখনোই ভালভাবে শাসন করতে পারবে না?

• স্বাধীন ইচ্ছাকে কীভাবে কাজে লাগাতে হবে?

[অধ্যয়ন প্রশ্নাবলি]

[১০ পৃষ্ঠার চিত্র]

রাজ্য সম্বন্ধে যীশু যে শিক্ষা দিয়েছিলেন, তাতে ঈশ্বরের শাসনব্যবস্থাই মূল বিষয় ছিল

[১২ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

সারা পৃথিবীতে যিহোবার সাক্ষিদের মূল শিক্ষা হল ঈশ্বরের রাজ্য

[১৪ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ঈশ্বরের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পরিণতি যে কতটা খারাপ হয়েছে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায়

[সৌজন্যে]

WWI সৈনিক: U.S. National Archives photo; কনসেনট্রেশন ক্যাম্প: Oświęcim Museum; শিশু: UN PHOTO ১৮৬১৫৬/J. Isaac