সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

“তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?”

“তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?”

জীবন কাহিনী

“তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?”

বলেছেন হার্বার্ট জেনিংগস্‌

“আমি যখন বন্দর-নগরী টেমা থেকে ঘানায় ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির শাখা অফিসে যাচ্ছিলাম, পথে এক যুবক ঘানা পর্যন্ত যাওয়ার জন্য লিফ্ট চায়। সে ট্রাকে ওঠে আর আমি সুযোগ পেয়ে তার কাছে প্রচার করতে শুরু করি। আমি ভেবেছিলাম যে আমি তার কাছে খুব ভাল করেই প্রচার করেছি! কিন্তু শহরে পৌঁছে যেখানে সেই যুবক নামতে চেয়েছিল সেখানে ট্রাক থামাতে না থামাতেই সে ট্রাক থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে পালিয়ে যায়।”

 সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হয় যে আমার জীবনে কিছু একটা অঘটন ঘটতে চলেছে। কিন্তু এর পর কী হয় তা বলার আগে আসুন আমি আপনাদের বলি যে কানাডার লোক হয়ে আমি কী করে ঘানায় এসে পড়ি।

সময়টা ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। কানাডার টরোন্টো শহরের উত্তরদিকের এক ছোট্ট শহর। আমরা সবেমাত্র বরফে ঢাকা শক্ত জমি খোঁড়া শেষ করেছি। নতুন একটা ঘরে জলের পাইপ বসানোর জন্য আমাদের কয়েক মিটার গভীর গর্ত করতে হয়েছিল। ঠাণ্ডায় আর ক্লান্তিতে আমরা সবাই যারা কাজ করছিলাম, আগুন পোহাতে পোহাতে গাড়ির অপেক্ষা করতে থাকি। হঠাৎ-ই আমাদের মধ্যে একজন কর্মী আর্নল্ড লোরটন “যুদ্ধের কথা ও যুদ্ধের জনরব,” “এই জগতের শেষ” ও এই ধরনের আরও অনেক কথা বলতে শুরু করে, যে কথাগুলো আমি আগে কখনও শুনিনি। তার কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে যায়। কেউ কেউ খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে আর কেউ আবার তার কথা শুনে খুব রেগে যায়। আমার মনে আছে যে আমি মনে মনে বলেছিলাম ‘এই লোকটার তো বেশ ভালই সাহস আছে! কেউই তার কথা শুনতে চায় না অথচ তার থামার নাম নেই।’ কিন্তু সে যা কিছু বলেছিল তা আমার মনে দাগ কাটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে কিন্তু এমন কথা আমি কখনোই আমাদের খ্রীষ্টাডেলফিয়ন ধর্মে বলতে শুনিনি, যে ধর্ম আমরা কয়েক পুরুষ ধরে করে আসছি। তাই আমি তার কথা খুব মন দিয়ে শুনেছিলাম ও তা আমার খুব ভাল লেগেছিল।

আর্নল্ডের কথা আমার এতটাই ভাল লেগেছিল যে আমি তার কাছে ফিরে যেতে দেরি করিনি। সেই দিনগুলোর কথা মনে করে আজকে আমি বুঝতে পারি যে আর্নল্ড ও তার স্ত্রী জিন আমার মতো একটা ১৯ বছরের অজ্ঞ ছেলেকে কত সহ্যই না করেছিলেন আর তারা আমাকে কত ভালই না বেসেছিলেন! আমি যখন তখন তাদের বাড়ি যেতাম। কিন্তু তারা কখনোই বিরক্ত হননি। আমার কিশোর মনে নীতি ও নৈতিকতা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ছিল তা মিটিয়ে ঠিক পথ দেখানোর পেছনে তাদের অনেক বড় হাত ছিল। রাস্তার ধারে বসে আগুন পোহানোর সেই দিন থেকে দশ মাস পরে ১৯৫০ সালের ২২শে অক্টোবর আমি বাপ্তিস্ম নিয়ে একজন যিহোবার সাক্ষি হই। আর আমি টরোন্টোর উত্তর ইয়র্ক শহরের উইলোডেল মণ্ডলীতে যোগ দিই।

অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে সত্যের পথে এগিয়ে যাওয়া

বাবা যখন জানতে পারে যে আমি নতুন শিক্ষায় অটল থাকা মনস্থ করেছি তখন ঘরে অশান্তি দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে। কিছুদিন আগেই বাবা এক দুর্ঘটনায় পড়ে। একটা গাড়ির চালক মদ খেয়ে গাড়ি চালানোয় বাবাকে এসে ধাক্কা দেয়। দুর্ঘটনায় বাবা মাথায় আঘাত পায় ও এই কারণে বাবা আরও বেশি খিটখিটে হয়ে ওঠে। আমার মা, দুই ভাই ও দুই বোনের জন্যও ঘরের অবস্থা একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। আমি সত্য শেখায় ঘরের ঝামেলা বেড়েই চলেছিল। তাই আমি ঠিক করি যে শান্তি রক্ষার জন্য ঘর ছেড়ে চলে যাওয়াই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কাজ আর এতে আমি “সত্যের পথে” এগিয়ে যেতে পারব।—২ পিতর ২:২.

১৯৫১ সালের গ্রীষ্মের মাঝামাঝি আমি এলবার্টার এক ছোট্ট শহর কোলম্যানে থাকতে শুরু করি। সেখানে দুজন যুবক ভাই রস হান্ট ও কিথ রবিন্স পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ করে যাচ্ছিলেন, যাদের নিয়মিত অগ্রগামী বলা হয়। তারা আমাকেও অগ্রগামীর কাজ করার জন্য উৎসাহ দেন। ১৯৫২ সালের ১লা মার্চ আমি নিয়মিত অগ্রগামীর কাজ শুরু করি।

এখনও আমার এ কথা মনে করে ভাল লাগে যে সেই সময়ে তারা আমাকে কত উৎসাহ দিয়েছিল। আমার অনেক কিছু শেখার ছিল। আর এই শহরেই আমার অগ্রগামী কাজের হাতেখড়ি হয়েছিল। সেখানে লেথব্রীজ মণ্ডলীতে এক বছর অগ্রগামীর কাজ করার পর হঠাৎ-ই একদিন আমি ভ্রমণ অধ্যক্ষের কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ পাই। কানাডার পূর্ব সমুদ্রতীরের নিউ ব্রান্সউইকের মোংটন থেকে কুইবেকের গ্যাঁসপে শহর পর্যন্ত যে যে মণ্ডলীগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেইসব মণ্ডলীর দেখাশোনার ভার আমাকে দেওয়া হয়।

মাত্র ২৪ বছর বয়স আর সত্যে নতুন হওয়ায় আমি নিজেকে খুবই অযোগ্য মনে করতাম। বিশেষ করে মণ্ডলীগুলোতে গিয়ে যখন অভিজ্ঞ ভাইদের সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হতো। এইজন্য পরের কিছু মাস আমি মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করি। এর কিছু সময় পর আরেক ঘটনা আমাকে একেবারে হকচকিয়ে দিয়েছিল।

গিলিয়ড স্কুল ও গোল্ড কোস্ট এলাকায় যাওয়া

১৯৫৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ২৬তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। আমার সঙ্গে এই ক্লাসে আরও প্রায় একশ জন ছাত্র ছিল। একটানা পাঁচ মাস ধরে আমরা সত্যের গভীর বিষয়গুলো শিখেছিলাম ও অধ্যয়ন করেছিলাম, ঠিক যা আমার দরকার ছিল। আমার ক্লাসের উৎসাহী ভাইবোনদের দেখে আর তাদের সঙ্গে থেকে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গিয়েছিল। এই সময় আমার জীবনে আরেক ঘটনা ঘটে যা আজ পর্যন্ত আমাকে সত্যে এগিয়ে চলতে সাহায্য করছে।

মিশনারি হওয়ার এই ক্লাসে আইলিন স্টবস্‌ নামে এক বোনও ছিল। আইলিন ছিল খুব ধীরস্থির, আন্তরিক, নম্র ও হাসিখুশি স্বভাবের মেয়ে। আমার মনে হয় আমি যেদিন তাকে আমার মনের কথা জানিয়েছিলাম সেদিন সে খুবই ঘাবড়ে গিয়েছিল। তবে আইলিন অবশ্য আমাকে ফিরিয়ে দেয়নি! আমরা দুজনে আলোচনা করে ঠিক করেছিলাম যে আইলিন এখন তার মিশনারি কাজের জন্য কোসটা রিকা যাবে ও আমি পশ্চিম আফ্রিকার গোল্ড কোস্টে (আজ যেটা ঘানা) যাব।

১৯৫৬ সালের মে মাসের এক সকালে আমাকে ভাই নেথেন নরের নিউ ইয়র্ক ব্রুকলিনের দশ তলা অফিসে ডাকা হয়। তিনি তখন ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমাকে সেখানকার শাখা অধ্যক্ষ করে পাঠানো হয় যাতে আমি গোল্ড কোস্ট, টোগোল্যান্ড (আজ যেটা টোগো), আইভরি কোস্ট (আজ যেটা কোট ডিভোর), আপার ভোলটা (আজ যেটা বুরকিনা ফাসো) ও গ্যাম্বিয়াতে প্রচার কাজের দেখাশোনা করতে পারি।

আমার মনে হয় যে ভাই নর যেন গতকাল আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন “তাড়াহুড়ো করার কোন দরকার নেই, যতটা সময় চাও, তুমি নিতে পার। সেখানকার অভিজ্ঞ ভাইদের কাছ থেকে শেখ আর যখন তুমি নিজেকে শাখা অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেওয়ার মতো যোগ্য বলে মনে করবে তখন তুমি কাজ শুরু করতে পার। . . . এই রইল তোমার নিয়োগপত্র। পৌঁছানোর সাত দিন পর থেকে তুমি কাজ শুরু করবে।”

আমি ভেবেছিলাম ‘মাত্র সাত দিন।’ ‘তাহলে তিনি যে আমাকে এইমাত্র বললেন, “যতটা সময় চাও, তুমি নিতে পার” তার মানে কী?’ ভাই নরের সঙ্গে এই কথাবার্তা হওয়ার পর আমি বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে কী করব।

পরের কয়েকটা দিন যেন চোখের পলকে কেটে গিয়েছিল। দু এক দিন পরে আমি এক মালবাহী জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। সোসাইটির ব্রুকলিন শাখা অফিসের পাশ দিয়ে বয়ে চলা ইস্ট রিভারের ওপর দিয়ে জাহাজ ভেসে চলেছিল। এইভাবে গোল্ড কোস্ট যাওয়ার জন্য আমি ২১ দিনের যাত্রা শুরু করি।

আইলিন ও আমার কথাবার্তা শুধু চিঠিতেই হতো। ১৯৫৮ সালে আমাদের দেখা হয় আর ওই বছরের ২৩শে আগস্ট আমরা বিয়ে করি। এমন এক অতুলনীয় জীবনসাথীর জন্য আমি বার বার যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছি।

আফ্রিকায় আমি ১৯ বছর সোসাইটির শাখা অফিসে কাজ করি। এইসময় শাখা অফিসে মিশনারি ভাইবোন ও আফ্রিকার আরও অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যিই আনন্দিত। সেখানকার ছোট্ট বেথেল পরিবার সেই সময়ে বেড়ে ২৫ জন হয়। সেই দিনগুলো খুবই বিশেষ ছিল, আমরা অনেক দিক দিয়ে এগিয়ে চলেছিলাম। কিন্তু তবুও, সত্যি বলতে কী সেই দিনগুলো আমাদের জন্য খুব কঠিনও ছিল। সেখানকার গরম ও স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া আমার সহ্য হতো না। সেখানকার গরমে আমি খুব ঘামতাম, শরীরে সারাক্ষণই চটচটে ভাব, সত্যিই অসহ্য। কিন্তু তবুও, সেখানে কাজ করে আমি আনন্দ পেয়েছিলাম। ঘানায় ১৯৫৬ সালে প্রকাশকের সংখ্যা ছিল ৬,০০০, যা ১৯৭৫ সালে বেড়ে ২১,০০০ হয়েছিল। আর আজ সেখানে ৬০,০০০ সাক্ষিদের প্রচার কাজে ব্যস্ত দেখে আমার আনন্দ আরও বেড়ে যায়।

“কল্যকার তত্ত্ব” নিয়ে আমরা কখনোই ভাবিনি

১৯৭০ সালের দিকে আমি এক অসুখে ভুগতে থাকি কিন্তু রোগ কিছুতেই ধরা পড়ছিল না। সমস্ত ডাক্তারি পরীক্ষা করেও কিছু ধরা পড়েনি আর ডাক্তাররা বলেছিলেন যে আমার কিছুই হয়নি আমি “একেবারে সুস্থ।” তাহলে আমি এত অসুস্থ বোধ করি ও ক্লান্ত হয়ে পড়ি কেন? কেনই বা আমার শরীরে এত অস্বস্তি? দুটো জিনিস থেকে আমি উত্তর পেয়েছিলাম আর তা আমাকে একেবারে হতবাক করে দিয়েছিল। আমার মনে হয়েছিল যাকোব যা লিখেছিলেন তা একেবারেই সত্যি: “তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?”—যাকোব ৪:১৪.

প্রথম জিনিসটা হল সেই ঘটনা যখন আমি ঘানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য এক যুবককে লিফ্ট দিয়েছিলাম ও তার কাছে প্রচার করেছিলাম। প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি যে আমি ফালতুই বকবক করছি। আর প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি ও হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কথা বলছি। শহরে এসে যেখানে সে নামতে চেয়েছিল সেখানে পৌঁছানো মাত্রই হুট করে গাড়ি থেকে নেমে সে দৌড়ে পালিয়েছিল। আমি একেবারে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ঘানার বেশির ভাগ লোকেরাই স্বভাবে খুব শান্তশিষ্ট হয় যারা কোন কিছুতেই তাড়াতাড়ি অধৈর্য হয়ে পড়েন না। কিন্তু এই যুবক ঠিক এর উলটোটাই করেছিল। আমি তখন বসে বসে ভাবতে থাকি আর আমি বুঝতে পারি যে আমার কিছু হয়েছে। কিন্তু কী হয়েছে তা আমি বুঝতে পারিনি কিন্তু কিছু নিশ্চয়ই হয়েছিল।

দ্বিতীয় জিনিসটা ছিল এই যে, আইলিন আর আমি গভীর আলোচনার পর সে আমাকে পরামর্শ দিয়েছিল: “সমস্যা যদি শরীরের নয়, তাহলে নিশ্চয়ই মনের।” তাই আমি আমার সমস্ত লক্ষণগুলো লিখি আর একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যাই। লক্ষণগুলো বলার পর তিনি আমাকে উত্তর দেন: “খুব কম লোকেরই এই রোগ হয়। আপনি চরম মানসিক অবসাদে ভুগছেন যাকে বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার বলে।”

শুনে আমি একেবারে চুপ মেরে গিয়েছিলাম! পরের বছরগুলোতে আমার অসুখ বেড়েই চলে। আমি সেরে ওঠার চেষ্টা চালাতেই থাকি। কিন্তু আমরা কেউই জানতাম না যে উপায় কী। আমাদের সব চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল!

আমরা সবসময় চেয়েছিলাম যে এই পূর্ণ-সময়ের সেবা আমরা কোন মতেই ছেড়ে দেব না। আমাদের সামনে আরও অনেক কিছু করার ছিল। যিহোবার কাছে আমি কতবার এই বলে প্রার্থনা করেছি: “‘প্রভুর ইচ্ছা হইলেই আমরা বাঁচিয়া থাকিব, এবং এ কাজটী বা ও কাজটী করিব।’” (যাকোব ৪:১৫) কিন্তু তা হওয়ার ছিল না। তাই কঠিন বাস্তবকে মেনে নিয়ে ১৯৭৫ সালের জুন মাসে আমাদের ঘানার বন্ধুবান্ধবদের বিদায় জানিয়ে কানাডায় ফিরে যেতে হয়েছিল।

যিহোবা তাঁর লোকেদের দিয়ে সাহায্য করেন

খুব তাড়াতাড়িই আমি জানতে পারি যে আমার রোগ এমন কিছু নয় যে, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না বা শুধু আমি একলাই এই রোগে ভুগছি। আমার জন্য ১ পিতর ৫:৯ পদের কথাগুলোর খুব গভীর মানে ছিল যেখানে বলা আছে: “তোমরা জান, জগতে অবস্থিত তোমাদের ভ্রাতৃবর্গেও সেই প্রকার নানা দুঃখভোগ সম্পন্ন হইতেছে।” আমি দেখেছিলাম যে আমাদের ওপর যিহোবার কত আশীর্বাদ আছে তিনি আমাদের জীবনে আসা পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছিলেন। কতভাবে ‘আমাদের ভ্রাতৃবর্গেরা’ আমাদের সাহায্য করেছিলেন!

যদিও আমাদের টাকাপয়সার অভাব ছিল কিন্তু যিহোবা আমাদের কখনও ছেড়ে দেননি। আমাদের ঘানার বন্ধুরা টাকাপয়সা দিয়ে ও অন্যভাবে সাহায্য করেছিল। তাই সুখদুঃখের অনুভূতি সঙ্গে করে আমরা আমাদের নতুন ‘কল্যকার’ জন্য রওনা শুরু করি।

কানাডায় আইলিনের বড় বোন লেনোরা ও তার স্বামী এলভিন ফ্রেশেন বেশ কয়েক মাস তাদের বাড়িতে আমাদের থাকতে দিয়েছিলেন ও আমাদের খাওয়াপরা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। একজন নামকরা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আমাকে ভরসা দিয়ে বলেছিলেন: “ছমাসের মধ্যে আপনি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবেন।” তিনি হয়তো আমাকে আশা দেওয়ার জন্য কথাগুলো বলেছিলেন কিন্তু আমি ছমাস কেন ছবছরেও ঠিক হইনি। আজও আমি সেই একই রোগ বাইপোলার মুড ডিসওর্ডারে ভুগছি। আমার রোগের নামটা যদিও শুনতে খুব ভাল কিন্তু যারা এই রোগে ভোগেন তারা জানেন যে এই রোগে ভোগা কত কষ্টের।

ইতিমধ্যে ভাই নরও অসুখে ভুগছিলেন আর ১৯৭৭ সালের জুন মাসে তিনি মারা যান। অসুস্থ থাকলেও সময় দিয়ে ও শক্তি করে তিনি আমাকে লম্বা চিঠি লিখে সান্ত্বনা ও পরামর্শ দিতে ভুলতেন না। চিঠিগুলোকে এখনও আমি খুব যত্ন করে রেখেছি। তার চিঠিগুলো আমাকে দমে যাওয়ার ভয় থেকে বাঁচাত যা আমাকে সবসময়ই কুরে কুরে খেত।

১৯৭৫ সালের শেষের দিকে আমাদের পূর্ণ-সময়ের অগ্রগামীর কাজ ছেড়ে দিতে হয় যাতে করে আমি আমার স্বাস্থ্যের দিকে বেশি করে নজর দিতে পারি। দিনের আলোতে আমার চোখে যন্ত্রণা হতো। হঠাৎ খুব জোরে আওয়াজ শুনতে পেলে আমার মনে হতো যেন আমি গুলির আওয়াজ শুনছি। বেশি ভিড়ভাট্টা আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই খ্রীষ্টীয় সভাগুলোতে যাওয়া আমার জন্য খুব কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ভাইবোনদের সঙ্গে মেলামেশা করার মূল্য আমি বুঝতাম। তাই আমি কিংডম হলে সবাই বসে যাওয়ার পর যেতাম আর সভা শেষ হতে না হতে উঠে চলে আসতাম।

প্রচারে যাওয়াটা ছিল আরেকটা কঠিন কাজ। প্রচারে গিয়ে কোন ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েও দরজার ঘন্টি বাজাতে আমার ভয় করত। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি কারণ আমি জানতাম যে শুধু প্রচার করেই আমরা নিজেদের ও যারা আমাদের কথা শোনেন তাদের বাঁচাতে পারি। (১ তীমথিয় ৪:১৬) কিছুক্ষণ পরে আমি নিজেকে সামলে নিয়ে পরের ঘরে যেতাম ও আবারও চেষ্টা করতাম। আর প্রচার করা ছাড়িনি বলে আমি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছিলাম ও তা আমাকে আমার রোগের সঙ্গে লড়াই করে যেতে শক্তি জুগিয়েছিল।

বাইপোলার মুড ডিসওর্ডার যেহেতু আমার দীর্ঘদিনের অসুখ, তাই আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে আমার এই রোগ জগতের এই বিধিব্যবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দূর হবে না। ১৯৮১ সালে সচেতন থাক! পত্রিকায় সুন্দর কয়েকটা ধারাবাহিক প্রবন্ধ ছাপানো হয়েছিল। * এই প্রবন্ধগুলো পড়ে আমি আরও ভালভাবে বুঝেছিলাম যে আমার অসুখটা আসলে কী ও জানতে পারি যে এই অসুখের সঙ্গে লড়াই করে যাওয়ার আরও কী ভাল উপায় আছে।

নিজেকে সামলাতে শেখা

এই সমস্ত কিছু সম্ভব হয়েছিল আমার স্ত্রীর জন্য। আইলিন অনেক ত্যাগস্বীকার করেছিল, অনেক মানিয়ে নিয়েছিল। আপনি যদি কখনও এইরকম কোন রোগীর দেখাশোনা করেন, তাহলে আইলিনের এই কথাগুলো আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন:

“মুড ডিসওর্ডার যে মানুষকে কতখানি বদলে দেয় তা এই রোগীদের না দেখলে বোঝা যায় না। একজন হাসিখুশি, আমুদে, ভাবুক লোক কয়েক ঘন্টার মধ্যে একেবারে উদাস, খিটখিটে লোকে বদলে যেতে পারে। কেউ যদি না জানে যে এটা একটা অসুখ, তাহলে খুব সহজেই সে বিরক্ত হতে পারে বা আঘাত পেতে পারে। তাই এই রোগীর দেখাশোনা যিনি করছেন তার কোন পরিকল্পনা করা চলবে না, হতাশ হলে চলবে না ও খারাপ ব্যবহারে দুঃখ পেলে চলবে না।”

আমার নিজের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, আমার যখন বেশ ভাল লাগে তখনই আমি ভয় পাই। আমি যেন আগে থেকে বুঝতে পারি যে আমার এই “ভাল” লাগার পিছনেই “দুঃখ” লুকিয়ে আছে। “দুঃখের” দিনই আমার জন্য ভাল কারণ সেই সময়ে আমি বেশ কিছুদিন ধরে একেবারেই কথাবার্তা বলি না, সবসময় চুপচাপ বসে থাকি। আর তাই উলটো-পালটা কোন কাজ করে ফেলার ভয় আমার থাকে না। তাই যখনই আমি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠি আইলিন আমাকে সতর্ক করে দেয় যেন আমি বেশি উত্তেজিত না হয়ে পড়ি আর যখন আমি হতাশ থাকি সেই সময় সে আমাকে সান্ত্বনা ও সাহস দেয়।

অসুখ বেড়ে গেলে একজন ব্যক্তি নিজের বিষয়ে এত বেশি চিন্তা করতে শুরু করে যে অন্যের জন্য তার আর কোন খেয়াল থাকে না। একেবারে হতাশ হয়ে সে কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না, অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চায়। সেই সময়ে সে এক পাগলের মতো ব্যবহার করতে শুরু করে যে অন্যের মন বা ইচ্ছার ব্যাপারে তার কোন জ্ঞান থাকে না। প্রথম প্রথম এটা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হতো যে আমি একজন মানসিক রোগী। আমি ভাবতাম যে আমার অসুস্থতার কারণ শরীরের ভিতরে নয় কিন্তু শরীরের বাইরে যেমন কোন কাজে ব্যর্থ হওয়া বা অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল না থাকায় আমি হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়ি। কিন্তু বার বার আমার নিজেকে বোঝাতে হয়েছে যে ‘আমার আশেপাশের কিছুই পালটায়নি। আমার অসুস্থতা আমার মনে, শরীরে নয়।’ ধীরে ধীরে আমি নিজেকে তা বোঝাতে পেরেছিলাম।

গত কয়েক বছর ধরে আমরা দুজনেই বুঝেছি যে আমরা দুজন দুজনকে সব কথা খুলে বলেছি ও সত্যকে লুকাবার চেষ্টা করিনি। এমনকি বাইরের লোকেদের কাছেও আমরা আমার অসুস্থতার কথা লুকাইনি। অসুখকেই আমরা জীবনে একটা বড় জায়গা দখল করে নিতে দিইনি বরং আশা নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়েছি।

আশায় ভরা ‘কল্য’

আমাদের অন্তর থেকে করা প্রার্থনা আর প্রাণপণ চেষ্টার জন্য যিহোবা আমাদের আশীর্বাদ করেছেন ও শক্তি দিয়েছেন। আজ আমরা দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি। এখনও আমাকে ওষুধ খেয়ে চলতে হয়, যদিও সেগুলো খুব কড়া ওষুধ নয় কিন্তু নিয়মিতভাবে খেতে হয়। এখন আমার স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল আছে। যিহোবার সেবা করার জন্য আমাদের যে কোন কাজই করতে দেওয়া হয় তা আমরা খুশি মনে করি। আমি এখন মণ্ডলীর একজন প্রাচীন। মণ্ডলীর প্রত্যেককে আমরা সাহায্য করার চেষ্টা করি।

যাকোব ৪:১৪ পদের কথাগুলো কতই না সত্যি যেখানে বলা আছে: “তোমরা ত কল্যকার তত্ত্ব জান না; তোমাদের জীবন কি প্রকার?” আর এই জগতের বিধি ব্যবস্থা যতদিন চলতে থাকবে এ কথা ততদিন সত্যি হয়ে থাকবে। এর পাশাপাশি যাকোব ১:১২ পদের কথাগুলোও সত্যি যা বলে: “ধন্য সেই ব্যক্তি, যে পরীক্ষা সহ্য করে; কারণ পরীক্ষাসিদ্ধ হইলে পর সে জীবনমুকুট প্রাপ্ত হইবে, তাহা প্রভু তাহাদিগকেই দিতে অঙ্গীকার করিয়াছেন, যাহারা তাঁহাকে প্রেম করে।” তাই আসুন আমরা সবাই আজ বিশ্বস্ত থাকি ও যিহোবা আমাদের সামনে আশায় ভরা যে কাল রেখেছেন তার অপেক্ষা করি।

[পাদটীকা]

^ ১৯৮১ সালের সচেতন থাক! (ইংরেজি) পত্রিকার ৮ই আগস্টের “আপনি জীবনের মোকাবিলা করে বেঁচে থাকতে পারেন,” ১৯৮১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বরের (ইংরেজি) “হতাশার সঙ্গে আপনি কীভাবে লড়তে পারেন,” ও ১৯৮১ সালের ২২শে অক্টোবরের (ইংরেজি) “গভীর হতাশাকে শেষ করা” প্রবন্ধগুলো দেখুন।

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আর্ট স্টুডিওতে আমি একলা বসে

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী আইলিনের সঙ্গে

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬৩ সালে ঘানার টেমায় “অনন্তকালীন সুসমাচার” অধিবেশনে আমি