যেখানে দরকার ছিল সেখানেই আমি কাজ করেছি
জীবন কাহিনী
যেখানে দরকার ছিল সেখানেই আমি কাজ করেছি
বলেছেন জেমস বি. বেরি
সেই ১৯৩৯ সালের কথা। চরম অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমেরিকায় বেঁচে থাকাই দায় হয়ে উঠেছিল এবং ইউরোপে যুদ্ধ লাগবে লাগবে বলে সবাই আশঙ্কা করছিল। আমার ছোট ভাই বেনেট এবং আমি, কাজের খোঁজে আমাদের নিজের বাড়ি মিসিসিপি ছেড়ে টেক্সাসের হিউসটনে আসি।
গরমের শেষ দিকে একদিন রেডিয়োর ঘ্যারঘ্যার আওয়াজের মধ্যেও আমরা একটা নাটকীয় ঘোষণা শুনতে পাই যে, হিটলারের সৈন্যরা পোল্যান্ডে ঢুকে পড়েছে। এই ঘোষণা শুনে বেনেট চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “হর্মাগিদোন শুরু হয়ে গেছে!” সঙ্গে সঙ্গে আমরা চাকরি ছেড়ে দিই। আমরা আমাদের কাছের কিংডম হলে যাই এবং সেখানেই প্রথম সভায় যোগ দিই। কেন আমরা কিংডম হলে গিয়েছিলাম? তাহলে, আমাকে প্রথম থেকেই বলতে দিন।
১৯১৫ সালে মিসিসিপির হিব্রোনে আমার জন্ম। আমরা গ্রামাঞ্চলের দিকে থাকতাম। বাইবেল ছাত্ররা—যিহোবার সাক্ষিদের তখন এই নামেই ডাকা হতো—সেই এলাকায় বছরে একবার করে আসতেন এবং কোন একজনের বাড়িতে বক্তৃতা দিতেন। এই কারণেই আমার বাবামার কাছে বাইবেল বিষয়ক অনেক প্রকাশনা ছিল। ওই বইগুলোতে যা লেখা ছিল, তা বেনেট এবং আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি যেমন, নরক কোন অগ্নিময় জায়গা নয়, প্রাণ মারা যায়, ধার্মিক লোকেরা পৃথিবীতে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। কিন্তু, তখনও আমাদের আরও অনেক কিছু শেখার ছিল। স্কুল শেষ করার পর আমি এবং আমার ভাই কাজের খোঁজে টেক্সাসে যাই।
কিংডম হলে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে যখন আমাদের শেষ দেখা হয় তখন তারা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমরা অগ্রগামীর কাজ করতে চাই কি না। আমাদের কোন ধারণাই ছিল না যে, অগ্রগামী হল যিহোবার সাক্ষিদের একজন পূর্ণ-সময়ের পরিচারক। তারা তখন আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমরা প্রচার করতে চাই কি না। আমরা বলেছিলাম “অবশ্যই।” আমরা মনে করেছিলাম যে কীভাবে প্রচার করতে হয়,
তা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য তারা বোধ হয় আমাদের সঙ্গে কাউকে পাঠাবেন। কিন্তু তা না করে তারা আমাদের হাতে শুধু একটা এলাকার মানচিত্র ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “এই এলাকায় গিয়ে কাজ করুন!” কিন্তু, বেনেট এবং আমি জানতামই না যে কীভাবে প্রচার করতে হয় আর তাই প্রচারে গিয়ে সমস্যায় পড়তে পারি কথাটা মাথায় আসতেই আমাদের আর প্রচারে যেতে ইচ্ছে করেনি। শেষে আমরা যে মণ্ডলী থেকে সেই এলাকার মানচিত্র পেয়েছিলাম, সেটা সেখানে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য পোস্ট করে দিই এবং মিসিসিপিতে ফিরে যাই।বাইবেলের সত্যকে নিজের করে নেওয়া
বাড়ি ফিরে আসার পর আমরা প্রায় এক বছর ধরে রোজ সাক্ষিদের প্রকাশনাগুলো পড়েছি। আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না, তাই রাতের বেলায় আমরা আগুন জ্বালিয়ে সেই আলোতে সেগুলো পড়তাম। তখনকার দিনে ভ্রমণ অধ্যক্ষরা, ভাইবোনদেরকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করার জন্য যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোতে এবং যে বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে সাক্ষি ভাইবোনেরা থাকতেন সেখানে যেতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন টেড ক্লাইন। তিনি আমাদের মণ্ডলী পরিদর্শন করতে আসতেন এবং বেনেট আর আমার সঙ্গে ঘর-ঘরে প্রচারে যেতেন, প্রায়ই তিনি আমাদের দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে প্রচার করতেন। তিনি আমাদেরকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, অগ্রগামীর কাজ আসলে কী।
তার সঙ্গে কাজ করে আমরা ভাবতে শুরু করি যে ঈশ্বরের জন্য কীভাবে আমরা আরও বেশি কাজ করতে পারি। ১৯৪০ সালের ১৮ই এপ্রিল ভাই ক্লাইন আমাকে, বেনেটকে এবং আমাদের ছোট বোন ভেলভাকে বাপ্তিস্ম দেন। আমাদের বাপ্তিস্মের সময় বাবামা সেখানে ছিলেন এবং এতে তারা খুশি হয়েছিলেন। এর প্রায় দুবছর পর তারাও বাপ্তিস্ম নেন। ১৯৫৬ সালে বাবা এবং ১৯৭৫ সালে মা মারা যান আর মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা বিশ্বস্তভাবে ঈশ্বরের সেবা করে গেছেন।
ভাই ক্লাইন যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমি অগ্রগামীর কাজ করতে চাই কি না তখন আমি বলেছিলাম, আমি করতে চাই কিন্তু আমার কাছে টাকা বা জামাকাপড় কিছুই নেই। তিনি বলেছিলেন “এগুলো নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না, এগুলোর ব্যবস্থা আমি করব।” আর তিনি তা করেও ছিলেন। প্রথমে তিনি আমার অগ্রগামীর আবেদনপত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর আমাকে নিয়ে তিনি প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে নিউ অরলিয়েন্সে যান এবং কিংডম হলের পাশে সুন্দর সুন্দর কিছু আ্যপার্টমেন্ট আমাকে দেখান। সেগুলো অগ্রগামীদের জন্য ছিল। শীঘ্রিই আমি সেখানে চলে আসি এবং অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। নিউ অরলিয়েন্সের সাক্ষি ভাইবোনেরা অগ্রগামীদেরকে জামাকাপড়, টাকাপয়সা এবং খাবারদাবার দিয়ে সাহায্য করতেন। দিনের বেলায় খাবার এনে ভাইবোনেরা আমাদের জন্য তা দরজার কাছে বা ফ্রিজের মধ্যে রেখে যেতেন। কাছেই একজন ভাইয়ের রেস্টুরেন্ট ছিল আর রোজ দোকান বন্ধ করার সময় ওই দিনের রয়ে যাওয়া টাটকা খাবার যেমন মাংস, রুটি, ঝাল স্টু এবং পাই খাওয়ার জন্য আমাদেরকে যেতে বলতেন।
উত্তেজিত জনতার মুখে
কয়েকদিন পরে আমাকে অগ্রগামী হিসেবে মিসিসিপির জ্যাকসনে পাঠানো হয়। সেখানে আমি এবং আমার অল্পবয়সী অগ্রগামী সঙ্গী কয়েকবার উত্তেজিত জনতার মুখে পড়েছিলাম আর তাদের হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, স্থানীয় আইন বলবৎকারী সংস্থাগুলোই তাদেরকে উস্কে দিয়েছিল। আমাদের পরবর্তী কার্যভার মিসিসিপির কলম্বাসে গিয়েও আমাদেরকে একই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যেহেতু আমরা সমস্ত জাতির লোকেদের কাছে প্রচার করতাম, তাই কিছু সাদা চামড়ার লোকেরা আমাদেরকে ঘৃণা করত। অনেকে আমাদের দেশদ্রোহী বলে মনে করত। আ্যমেরিকান লিজিয়ন নামের দেশাত্মবোধক সংগঠনের স্থানীয় কমান্ডার, যিহোবার সাক্ষিদেরকে দেশদ্রোহী বলে মনে করত। বেশ কয়েকবার তিনি উত্তেজিত জনতাকে আমাদের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলেন।
কলম্বাসে প্রথম যখন উত্তেজিত জনতা আমাদের ওপর হামলা করে তখন আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে লোকেদেরকে পত্রিকা দিচ্ছিলাম। তারা আমাদেরকে ঠেলতে ঠেলতে একটা দোকানের কাঁচের জানালায় ঠেসে ধরে। কী হচ্ছে তা দেখার জন্য সেখানে লোকের ভিড় জমে যায়। শীঘ্রিই পুলিশ আসে এবং আমাদেরকে কোর্টে
নিয়ে যায়। উত্তেজিত জনতাও আমাদের পিছন পিছন কোর্টে আসে এবং সমস্ত কর্মকর্তাদের সামনে চিৎকার করে বলতে থাকে যে আমরা যদি বাঁচতে চাই, তাহলে নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে আমাদেরকে এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু, আমরা যদি নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে না যাই, তাহলে মৃত্যু অনিবার্য! কিছুদিনের জন্য এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়াই আমাদের কাছে ঠিক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু, কয়েক সপ্তা পর আমরা আবার সেখানে ফিরে যাই এবং প্রচার শুরু করি।কিছুদিন যেতে না যেতেই একদিন আট জনের একটা দল আমাদেরকে জোর করে তাদের দুটো গাড়িতে ঢোকায়। এরপর তারা গাড়ি চালিয়ে আমাদেরকে জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে যায় ও আমাদের কাপড় খুলে নেয় এবং আমার বেল্ট দিয়ে দুজনকেই ৩০টা করে বাড়ি মারে! তাদের কাছে বন্দুক এবং দড়িও ছিল আর সত্যি বলতে কী, আমরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি মনে করেছিলাম যে তারা বোধ হয় আমাদেরকে বেঁধে নদীতে ফেলে দেবে। তারা আমাদের সাহিত্যাদিগুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দেয় এবং আমাদের ফনোগ্রাফকে একটা গাছের গুঁড়িতে ছুঁড়ে মেরে টুকরো টুকরো করে ফেলে।
মারার পর তারা আমাদেরকে আবার কাপড় পরতে বলে এবং পিছন ফিরে না তাকিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে বলে। আমরা যখন হাঁটছিলাম তখন আমরা সত্যি সত্যি মনে করেছিলাম যে আমরা যদি পিছন ফিরে তাকাই তো আর রক্ষে নেই, তারা আমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলবে এবং নিশ্চিন্তে শাস্তি এড়িয়ে যাবে। কিন্তু, কয়েক মিনিট পর আমরা তাদের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই।
আরও একবার উত্তেজিত জনতা আমাদেরকে তাড়া করেছিল আর তাদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমরা আমাদের কাপড়চোপড় গলায় জড়িয়ে নিয়ে নদী সাঁতরে পার হয়েছিলাম। এর কিছু দিন পরেই দেশদ্রোহীর অভিযোগে আমাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতে মামলা যাওয়ার আগে আমরা তিন সপ্তা জেলে ছিলাম। আমাদের এই ঘটনার কথা সারা কলম্বাসে ছড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি সেই মামলা দেখার জন্য কাছের একটা কলেজের ছাত্রছাত্রীদেরকে নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছুটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল। বিচারের দিন কোর্টে এত লোক এসেছিল যে অনেক লোকেরা বসার জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সরকারি পক্ষের সাক্ষিদের মধ্যে দুজন প্রচারক, মেয়র এবং পুলিশ বাহিনী ছিল।
আমাদের পক্ষে মামলায় লড়ার জন্য জি. সি. ক্লার্ক নামে একজন যিহোবার সাক্ষি উকিলকে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া, তার সঙ্গে আরেকজন উকিলকেও পাঠানো হয়েছিল। তারা আদালতে অনুরোধ করেছিলেন যাতে মামলাটা তুলে নেওয়া হয় কারণ তাদেরকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করার জন্য জোরালো কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ ছিল না। ভাই ক্লার্কের সঙ্গে যে উকিল কাজ করেছিলেন, তিনি যদিও একজন যিহোবার সাক্ষি ছিলেন না, তবুও আমাদের পক্ষে অনেক জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। একসময় তিনি বিচারককে বলেছিলেন, “লোকেরা বলে যে যিহোবার সাক্ষিরা পাগল। কিন্তু সত্যিই কি তারা পাগল? থমাস এডিসনকেও লোকেরা পাগল বলত!” এরপর তিনি একটা লাইট দেখিয়ে বলেন, “ওই লাইটাকে দেখুন!” লাইটের উদ্ভাবক এডিসনকে যদিও কিছু লোকেরা পাগল বলত কিন্তু তার মহৎ কীর্তিগুলো নিয়ে কেউই কোনরকম তর্ক করত না।
সাক্ষ্যপ্রমাণ শোনার পর ভ্রমণশীল আদালতের বিচারক, সরকারি পক্ষের উকিলকে বলেন: “আপনার কাছে এমন কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই, যা দিয়ে আপনি আসামীদেরকে দেশদ্রোহী প্রমাণ করতে পারেন আর এই কাজ করার অধিকার তাদের আছে। সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়া তাদেরকে আবার এই কোর্টে নিয়ে এসে সরকারের সময় ও টাকা অপচয় করবেন না আর আমার সময়ও নষ্ট করবেন না!” আমরাই জয়ী হয়েছিলাম!
কিন্তু, পরে বিচারক আমাদেরকে তার চেম্বারে ডেকে পাঠান। তিনি জানতেন যে পুরো শহরের লোকেরা তার রায়ের বিপক্ষে ছিল। তাই, তিনি আমাদেরকে সাবধান করে বলেন: “আমি যা বলেছি, তা আইন অনুযায়ীই বলেছি কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি আপনাদের দুজনকেই পরামর্শ দিচ্ছি, আপনারা এখান থেকে চলে যান নয়তো ওরা আপনাদেরকে মেরে ফেলবে!”
আমরা জানতাম যে তিনি ঠিকই বলেছেন, তাই আমরা শহর ছেড়ে চলে আসি।সেখান থেকে এসে বেনেট এবং ভেলভার সঙ্গে আমি যোগ দিই। তারা টেনেসির ক্লার্কস্ভিলে বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কাজ করছিল। কয়েক মাস পরে আমাদেরকে কেনটাকির প্যারিসে পাঠানো হয়। দেড় বছর পর আমরা যখন সবেমাত্র একটা নতুন মণ্ডলী গঠন করার জন্য সবকিছু ঠিক করে ফেলেছিলাম, ঠিক তখনই বেনেট ও আমি একটা বিশেষ আমন্ত্রণ পাই।
মিশনারি কাজে যাওয়া
ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়ডের দ্বিতীয় ক্লাসে যোগ দেওয়ার জন্য আমরা যখন আমন্ত্রণ পাই, তখন আমরা মনে করেছিলাম যে ‘তারা বোধ হয় ভুল করেছেন! নতুবা কেন তারা মিসিসিপির দুজন সাধারণ যুবককে স্কুলে ডেকে পাঠাবেন?’ আমরা মনে করেছিলাম যে তারা বোধ হয় শিক্ষিত লোক চান কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। সেই ক্লাসে ১০০ জন ছাত্রছাত্রী ছিলেন এবং ওই কোর্স শেষ হতে পাঁচ মাস সময় লেগেছিল। ১৯৪৪ সালের ৩১শে জানুয়ারি গ্র্যাজুয়েশন হয়েছিল এবং আমরা বিদেশে গিয়ে কাজ করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু, তখনকার দিনে পাসপোর্ট এবং ভিসা পেতে অনেক সময় লাগত, তাই ছাত্রছাত্রীদেরকে কিছুদিনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে পাঠানো হয়। আলবামা এবং জর্জিয়ায় কিছু দিন অগ্রগামী হিসেবে কাজ করার পর, বেনেট এবং আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারবাডোসে কাজ করার দায়িত্ব পাই।
তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং বারবাডোস সহ অনেক জায়গায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজ এবং সাহিত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেখানকার শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তারা আমাদের মালপত্র চেক করেন এবং সেখানে কিছু লুকানো সাহিত্যাদি খুঁজে পান। আমরা মনে করেছিলাম, ‘এখানেই আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে।’ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কিছু না করে একজন অফিসার শুধু বলেছিলেন: “আপনাদের মালপত্র খোলার জন্য আমরা দুঃখিত; এই সাহিত্যাদিগুলো বারবাডোসে নিষিদ্ধ।” কিন্তু, তারপরও আমাদেরকে তারা প্রত্যেকটা সাহিত্য নিয়ে বারবাডোসে ঢুকতে দিয়েছিলেন। পরে আমরা যখন সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে সাক্ষ্য দিই তখন তারা আমাদেরকে বলেছিলেন, কেন যে এই সাহিত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে, তা তারা জানেন না। কয়েক মাস পরে সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
বারবাডোসে আমাদের প্রচার অনেক ভাল চলছিল। আমরা দুজনে কমপক্ষে ১৫টা করে বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম এবং বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে বেশ উন্নতি করছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মণ্ডলীর সভায় আসছিল দেখে আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু, কিছু সময়ের জন্য যেহেতু সাহিত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল তাই কীভাবে সভা পরিচালনা করতে হয়, সে সম্বন্ধে ভাইদের কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু, শীঘ্রিই আমরা কয়েকজন ভাইকে দক্ষ করে তুলেছিলাম। প্রচার শুরু করার জন্য অনেক ছাত্রছাত্রীদের সাহায্য করতে পেরে এবং চোখের সামনে মণ্ডলীকে গড়ে উঠতে দেখে আমরা অনেক খুশি হয়েছিলাম।
আমার পরিবার
বারবাডোসে প্রায় ১৮ মাস কাজ করার পর আমার অপারেশন করার দরকার হয়েছিল আর তাই আমি আমেরিকায় ফিরে যাই। সেখানে গিয়ে আমি ডরথি নামে একজন যিহোবার সাক্ষিকে বিয়ে করি, যার সঙ্গে আমার চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। এরপর আমার স্ত্রী এবং আমি ফ্লোরিডার টালাহেসিতে অগ্রগামীর কাজ করি কিন্তু ছয় মাস পর আমরা কেনটাকির লুইসভিলে যাই,
যেখানে একজন সাক্ষি আমাকে একটা চাকরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার ভাই বারবাডোসে অনেক দিন কাজ করেছিল। পরে সে তার সহ মিশনারিকে বিয়ে করে এবং দ্বীপগুলোতে ভ্রমণের কাজ করে। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত অসুস্থতার জন্য তাদেরকে আমেরিকায় ফিরে আসতে হয়েছিল। ১৯৯০ সালে, ৭৩ বছর বয়সে বেনেট মারা যায় আর তার আগে পর্যন্ত তারা স্প্যানিশ মণ্ডলীগুলোতে ভ্রমণের কাজ করেছিল।১৯৫০ সালে আমাদের একটা মেয়ে হয় আর আমরা তার নাম রাখি ডেরেল। আমাদের মোট পাঁচজন ছেলেমেয়ে হয়েছিল। আমাদের দ্বিতীয় সন্তান ডেরিকের স্পাইনাল মেনিনজাইটিস হয়েছিল বলে আড়াই বছর বয়সে সে মারা যায়। পরে ল্যাজলি ১৯৫৬ সালে এবং এভারিট ১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করে। ছেলেমেয়েদেরকে বাইবেলের সত্যের পথে গড়ে তোলার জন্য ডরথি এবং আমি অনেক চেষ্টা করেছি। আমরা সপ্তায় একদিন পারিবারিক বাইবেল অধ্যয়ন করার এবং ছেলেমেয়েদের কাছে সেগুলোকে আনন্দদায়ক করে তোলার চেষ্টা করতাম। ডেরেল, ল্যাজলি এবং এভারিট যদিও অনেক ছোট ছিল, তবুও প্রতি সপ্তায় আমরা তাদেরকে কিছু প্রশ্ন দিতাম আর সেগুলো খুঁজে বের করে তারা পরের সপ্তায় উত্তর দিত। শুধু তাই নয়, কী করে ঘরে-ঘরে প্রচার করতে হয়, তা তারা অভিনয় করে দেখাত। কাপড়চোপড় রাখার রুমে গিয়ে একজন গৃহকর্তা সাজত আর আরেকজন বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নাড়ত। তারা একে অন্যকে ভয় দেখানোর জন্য নাটকের সংলাপের মতো শব্দ ব্যবহার করত কিন্তু এটা তাদেরকে প্রচারের প্রতি ভালবাসা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও, আমরা তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত প্রচারে বের হতাম।
১৯৭৩ সালে যখন আমাদের ছোট ছেলে এলটন জন্মগ্রহণ করে তখন ডরথির প্রায় ৫০ এবং আমার বয়স প্রায় ৬০ বছর ছিল। মণ্ডলীতে সবাই আমাদেরকে অব্রাহাম এবং সারা বলে ডাকত। (আদিপুস্তক ১৭:১৫-১৭) আমার বড় ছেলেরা প্রায়ই এলটনকে নিয়ে প্রচারে যেত। আমরা বুঝতে পারতাম, লোকেরা যখন দেখত যে পুরো পরিবার মিলে যেমন ভাইবোন, বাবামা এবং ছেলেমেয়ে সবাই একসঙ্গে অন্যদেরকে বাইবেলের সত্য জানাচ্ছে তখন তা তাদের কাছে এক বড় সাক্ষ্য দিত। এলটনের দাদারা একে একে তাকে তাদের কাঁধে বসিয়ে তার হাতে একটা ট্র্যাক্ট ধরিয়ে দিত। লোকেরা দরজা খুলে যখন দেখত যে একটা সুন্দর ছোট্ট বাচ্চা তার বড় দাদাদের কাঁধে বসে আছে তখন প্রায় সবাই তাদের কথা শুনত। এলটনকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যখন কারও সঙ্গে কথা শেষ হয়ে যাবে তখন সে যেন লোকটাকে অল্প কথায় কিছু বলে ট্র্যাক্টটা তার হাতে দেয়। আর এভাবেই সে প্রচার করতে শুরু করে।
বছরের পর বছর ধরে আমরা লোকেদেরকে যিহোবার সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করেছি। ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে আমরা লুইসভিল থেকে কেনটাকির শেলবিভিলে একটা মণ্ডলীতে সেবা করতে যাই, কারণ সেখানে সাহায্যের দরকার ছিল। সেখানে আমরা শুধু মণ্ডলীতে প্রকাশকদের সংখ্যা বাড়াতেই সাহায্য করিনি সেইসঙ্গে কিংডম হলের জন্য জমি এবং হল তৈরি করতেও সাহায্য করেছি। এরপর, আমাদেরকে সেই মণ্ডলী থেকে একটু দূরে আরেকটা মণ্ডলীতে পাঠানো হয়।
পারিবারিক জীবনে দুঃখজনক ঘটনা
আমি চেয়েছিলাম আমার সব ছেলেমেয়ে যিহোবার পথে থাকুক কিন্তু আমার সে আশা পূরণ হয়নি। বড় হয়ে তারা যখন ঘর থেকে দূরে চলে যায় তখন আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিন জনই সত্য থেকে সরে যায়। কিন্তু, এভারিট আমার উদাহরণ অনুসরণ করে পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ শুরু করেছিল। পরে সে নিউ ইয়র্কের প্রধান শাখা অফিসে কাজ শুরু করে এবং ১৯৮৪ সালে গিলিয়েডের ৭৭তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার ডাক পায়। গ্র্যাজুয়েশনের পর, তাকে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিয়নে পাঠানো হয়। ১৯৮৮ সালে সে বেলজিয়ামের অগ্রগামী মেরিয়ানকে বিয়ে করে। তখন থেকে তারা এখন পর্যন্ত মিশনারি হিসেবে কাজ করে চলেছে।
যে কোন বাবামাই বুঝতে পারেন যে যখন আমাদের তিন ছেলেমেয়েই জীবনের পথ, যা কিনা এখনই তাদের সুখী করতে পারত এবং ভবিষ্যতে পরমদেশ পৃথিবীতে অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিত, সেখান থেকে দূরে সরে গিয়েছে তখন আমাদের কতখানি খারাপ লেগেছিল। মাঝে মাঝে আমি নিজেকে দোষ দিই। কিন্তু আমি এই ভেবে সান্ত্বনা পাই, এমনকি যিহোবার আত্মিক পুত্রদের অর্থাৎ দূতেদের মধ্যেও কেউ কেউ তাঁকে সেবা করা বন্ধ করে দিয়েছিল যদিও যিহোবা প্রেম এবং করুণা দেখিয়ে তাদেরকে শাসন করেন এবং কখনও কোন ভুল করেন না। (দ্বিতীয় বিবরণ ৩২:৪; যোহন ৮:৪৪; প্রকাশিত বাক্য ১২:৪, ৯) এটা আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে যে, বাবামা যত মনপ্রাণ দিয়েই ছেলেমেয়েদেরকে যিহোবার পথে গড়ে তোলার চেষ্টা করুক না কেন, তারপরও কেউ কেউ হয়তো সত্যকে নিজের করে নিতে চায় না।
একটা গাছকে যেমন প্রচণ্ড বেগে আসা দমকা হাওয়া সহ্য করতে হয়, ঠিক তেমনই আমাদের জীবনে যে সমস্ত কষ্ট এবং সমস্যা এসেছিল, তার সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হয়েছে। এত বছর কাজ করে আমি বুঝতে পেরেছি যে, নিয়মিত বাইবেল অধ্যয়ন এবং সভাতে উপস্থিত হওয়াই আমাকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে দৃঢ় এবং সজীব থাকতে শক্তি জুগিয়েছে। এই বুড়ো বয়সে আমি যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা যাকোব ১:২, ৩.
করি যে আমি কী কী ভুল করেছিলাম তখন সেই ভুলগুলো থেকে আমি কী শিখেছি, তা বের করার চেষ্টা করি। আমরা যদি বিশ্বস্ত থাকি, তাহলে এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাদেরকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এগুলো থেকে আমরা যদি কিছু শিখি, তাহলে জীবনের দুঃখজনক ভুলগুলো থেকেও আমাদের গঠনমূলক কিছু শেখার থাকে।—ডরথি এবং আমার শরীর দুর্বল হয়ে গেছে এবং শক্তিও ফুরিয়ে এসেছে, যে কারণে আমরা যিহোবার কাজ যতটা করতে চাই ততটা করতে পারি না। কিন্তু আমাদের প্রিয় খ্রীষ্টান ভাইবোনেরা আমাদেরকে যে সাহায্য করে যাচ্ছেন, তার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। প্রায় প্রতিটা সভায়ই ভাইবোনেরা আমাদের বলেন যে আমরা সভাতে আসাতে তারা অনেক আনন্দিত। আর আমাদের সাহায্য করার জন্য তারা যথাসাধ্য করেন যেমন, কখনও কখনও তারা আমাদের বাড়ি এবং গাড়ি মেরামত করতেও সাহায্য করেন।
মাঝে মাঝে আমরা অগ্রগামীর কাজ করি আর আগ্রহী ব্যক্তিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করি। আর আমাদের আরেকটা আনন্দের উৎস হল, আফ্রিকায় আমাদের ছেলের কাছ থেকে আমরা সবসময় খবরাখবর পাই। যদিও আমরা মাত্র দুজন, তবুও এখনও আমরা পারিবারিক বাইবেল অধ্যয়ন করি। বহু বছর ধরে যিহোবার কাজ করতে পেরেছি বলে আমরা অনেক আনন্দিত। তিনি আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন, ‘তাঁর নামের জন্য আমরা যে কাজ করেছি ও প্রেম দেখিয়েছি তা তিনি ভুলে যাবেন না।’—ইব্রীয় ৬:১০.
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৪০ সালের ১৮ই এপ্রিল ভেলভা, বেনেট এবং আমাকে ভাই টেড ক্লাইন বাপ্তিস্ম দিচ্ছেন
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১৯৪০ দশকের প্রথম দিকে এবং ১৯৯৭ সালে আমার স্ত্রী ডরথির সঙ্গে
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
বারবাডোস শহরের একটা বাসে জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতা “শান্তিরাজ” এর বিজ্ঞাপন
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
মিশনারি হোমের সামনে আমার ভাই বেনেট