আপনার ভাবভঙ্গি আপনার সম্বন্ধে কী বলে?
আপনার ভাবভঙ্গি আপনার সম্বন্ধে কী বলে?
ভাবভঙ্গি বলতে অঙ্গভঙ্গি, চালচলন ও আচরণকে বোঝায়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি অন্যদের সঙ্গে ভাববিনিময় করেন। আপনার ভাবভঙ্গি দেখে কী বোঝা যায়? আপনার ভাবভঙ্গিতে কি অন্যের প্রতি সম্মান, নম্রতা ও আনন্দ প্রকাশ পায়? নাকি এর থেকে রাগ ও বিরক্তি প্রকাশ পায়? বাইবেলে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেগুলো থেকে বোঝা যায় যে, দেহভঙ্গি ও অঙ্গভঙ্গির জোরালো ক্ষমতা ও অর্থ ছিল। যদিও কোন কোন দেশে এমন লোকেরা আছে যারা তাদের অনুভূতিকে দমন না করে সবার সামনে তা প্রকাশ করে দেয়। কিন্তু বাইবেল লেখার সময়ে লোকেরা যে মনোভাব দেখাত, তা মন দিয়ে আলোচনা করে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি।
শ্রদ্ধাপূর্ণ দেহভঙ্গি
যিহোবার কাছে প্রার্থনা করা এক বিরাট সুযোগ আর তাই প্রার্থনা করার সময় শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব থাকা দরকার। ইস্রায়েলীয়দের ও প্রথম শতাব্দীর খ্রীষ্টানদের জন্য প্রার্থনা করার নির্দিষ্ট কোন ভঙ্গি ছিল না। অর্থাৎ হাতজোড় করে বা একে অন্যের হাত ধরে প্রার্থনা করবে কি না, তা নির্দিষ্ট করে বলা ছিল না। তবে যেভাবেই প্রার্থনা করা হোক না কেন, তাতে গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পেত। সেই সময় দাঁড়িয়ে ও হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করা প্রচলিত ছিল। বাপ্তিস্মের পর যীশু দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করেছিলেন এবং গেৎশিমানী বাগানে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছিলেন। (লূক ৩:২১, ২২; ২২:৪১) দাঁড়িয়ে বা হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করার সময় কখনও কখনও হয়তো স্বর্গের দিকে হাত ছড়িয়ে প্রার্থনা করা হতো বা বিনতি জানানোর সময় যেমন হাত উঠানো বা সামনের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, সেভাবে করা হতো। একজন ব্যক্তি স্বর্গের দিকে তাকিয়ে বা মুখ তুলে প্রার্থনা করতে পারতেন।—নহিমিয় ৮:৬; মথি ১৪:১৯; ইয়োব ২২:২৬.
আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে প্রার্থনা করার সময় কেউ কেউ হাঁটু গেড়ে পায়ের গোড়ালির ওপর বসতেন, মাথা নত করতেন অথবা এলিয়ের মতো ভূমির দিকে নত হয়ে দুহাঁটুর মধ্যে মুখ রাখতেন। (১ রাজাবলি ১৮:৪২) প্রচণ্ড দুঃখে বা অন্তরের একেবারে গভীর থেকে প্রার্থনা করার সময় কেউ কেউ হয়তো মুখ ভূমির দিকে নত করে শুয়েও প্রার্থনা করতে পারেন। যেভাবেই প্রার্থনা করা হোক না কেন, যীশু স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে প্রার্থনা অবশ্যই অন্তর থেকে করতে হবে; তিনি লোক দেখানো প্রার্থনা এবং দুঃখ ভাব বা অতি ধার্মিক দেখানোর ভান করাকে নিন্দা করেছিলেন।
একে অন্যের প্রতি সম্মান দেখাতে এবং বিশেষ করে উঁচু পদমর্যাদার ব্যক্তিদের কাছে কিছু চাওয়ার সময় প্রাচ্যের লোকেদের মনোভাব ও দেহভঙ্গি অনেকটা প্রার্থনা করার মতোই ছিল। বাইবেলে আমরা এমন উদাহরণ পাই যেখানে হাঁটু গেড়ে অন্যদের কাছে কিছু চাওয়া হয়েছিল। এই ভঙ্গি, যার সামনে হাঁটু গাড়া হয়েছে সেই ব্যক্তিকে উপাসনা করার সামিল ছিল না কিন্তু এর মাধ্যমে দেখানো হতো যে ওই ব্যক্তির পদ বা মর্যাদাকে গভীর সম্মানের সঙ্গে স্বীকার করা হচ্ছে। (মথি ১৭:১৪) সম্মান দেখানোর ব্যাপারে শাস্ত্র থেকে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি।
এক নম্র মনোভাব
বাইবেল লেখার সময়ে কারও স্যান্ডেলের ফিতে খুলে দেওয়া অথবা কারও স্যান্ডেল এগিয়ে দেওয়া চাকরদের কাজ ছিল আর তা করার মাধ্যমে প্রকাশ পেত যে একজন ব্যক্তি তার প্রভুর তুলনায় কত নিচে রয়েছে ও সে কত সামান্য। হাত দিয়ে খাওয়ার পর হাত ধোয়ার জন্য জল ঢেলে দেওয়া এবং কারও পা ধুয়ে দেওয়া অতিথিসেবা, সম্মান এবং কখনও কখনও ওই ব্যক্তির নিচু অবস্থানকে প্রকাশ করত। ইলীশায় “এলিয়ের হস্তের উপরে জল ঢালিতেন” কথাগুলো থেকে বোঝা গিয়েছিল যে, ইলীশায় এলিয়ের পরিচারক বা দাস ছিলেন। (২ রাজাবলি ৩:১১) তার ভাবভঙ্গি দেখিয়েছিল যে তিনি খুবই নম্র ছিলেন। যীশু তাঁর শিষ্যদেরকে নম্রতার বিষয়ে শেখাতে গিয়ে এবং একে অন্যের জন্য যে কাজ করা দরকার, তা বোঝাতে প্রাচ্যের একটা রীতিকে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের পা ধুয়ে দিয়ে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন।—যোহন ১৩:৩-১০.
একজন ব্যক্তি যে নম্র ও পরিচর্যা করতে চান তা কাপড়ের শেষ অংশ কোমরের পিছনে গুঁজে দেখানো হতো। বাইবেল লেখার সময়ে কাজ করার, দৌড়ানোর বা এই জাতীয় অন্য কিছু করার সময়ে যাতে বাধা না আসে সেইজন্য লম্বা কাপড়ের অংশ কটিবদ্ধ করে বা বেল্ট দিয়ে বেঁধে নেওয়ার রীতি ছিল। হাত মেলানো বা অন্যের হাত ধরা, কোন বিষয়ে একমত হওয়া, কোন কাজ একসঙ্গে করা বা কোন কিছু একে অন্যের সঙ্গে ভাগ করে গালাতীয় ২:৯) ভাইয়েরা একে অন্যের সঙ্গে হাত মেলান দেখে আমাদের হৃদয় কত আনন্দে ভরে যায়!
নেওয়াকে প্রকাশ করত। (দুঃখ, লজ্জা ও রাগ
প্রাচীন কালে যিহোবার বিশ্বস্ত দাসেরা খোলাখুলিভাবে এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতেন। মাথায় ছাই বা ধুলো দিয়ে, কাপড় ছিঁড়ে, চট পরে, কেঁদে, দুঃখের সঙ্গে মাথা নত করে অথবা মাটিতে বসে দুঃখের ভাবকে দেখানো হতো। (ইয়োব ২:১২, ১৩; ২ শমূয়েল ১৩:১৯) কয়েকটা চুল ও দাড়ি ছিঁড়ে বা কেটে ফেলে, কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে, মাথায় হাত দিয়ে দুঃখ বা লজ্জা প্রকাশ করা হতো। (ইষ্রা ৯:৩; ইষ্টের ৬:১২; যিরমিয় ২:৩৭) কেউ কেউ মনে করেন, মাথার ওপর হাত দিয়ে বোঝানো হতো যে তার ওপর চরম দুঃখকষ্ট ঈশ্বরের কাছ থেকেই এসেছে। সত্য উপাসকরা দুঃখ বা লজ্জাকে হালকাভাবে নিতেন না বা সেগুলোর প্রতি উদাসীন মনোভাব দেখাতেন না।
উপবাস করেও দুঃখ এবং অনুতাপ দেখানো হতো। (২ শমূয়েল ১:১২; যোয়েল ১:১৩, ১৪) যীশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন কপট ব্যক্তিরা উপবাস করে “পবিত্র হওয়ার” ভান করার জন্য মুখ বিষণ্ণ ও মলিন করে রাখত। কিন্তু যীশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন, তারা যখন উপবাস করবে তখন যাতে মাথায় তেল দেয় ও তাদের মুখ ধোয় অর্থাৎ মানুষের সামনে তাদেরকে যেন স্বাভাবিক লাগে কারণ পিতা মানুষের হৃদয় দেখেন। (মথি ৬:১৬-১৮) কখনও কখনও খ্রীষ্টানরাও উপবাস করতেন, যাতে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর প্রতি তারা পূর্ণ মনোযোগ দিতে পারেন।—প্রেরিত ১৩:২, ৩.
সাধারণত কথা ও বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রচণ্ড রাগ, শত্রুতা, ঠাট্টা, নিন্দা, ঘৃণা, উপহাস ও এই জাতীয় অন্যান্য বিষয় প্রকাশ পেত। সেগুলোর মধ্যে মুখ দিয়ে বিভিন্ন ভঙ্গি করা, মাথা বা হাত নাড়ানো, চড় মারা, ধুলো ছড়িয়ে দেওয়া এবং পা দিয়ে আঘাত করাও ছিল। (যিহিষ্কেল ২৫:৬; গীতসংহিতা ২২:৭; সফনিয় ২:১৫; মথি ৫:৩৯; ২ শমূয়েল ১৬:১৩) কোন বিদ্রোহী, ঘোর শত্রু অথবা বিরোধীর ওপর খারাপ কিছু ঘটলে আনন্দ দেখানোর জন্যও হয়তো এগুলো ব্যবহার করা হতো। খ্রীষ্টানরাও হয়তো দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন এবং কোন পাপ করলে তারা হয়তো লজ্জাও প্রকাশ করতে পারেন কিন্তু তাদের ভাবভঙ্গিতে যেন কারও প্রতি কোন রাগ বা ঘৃণা প্রকাশ না পায় সেই দিকে তাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।
বন্ধুত্ব এবং আনন্দ প্রকাশ করা
বাইবেলে যে দেশগুলোর কথা বলা আছে সেখানে খুব আন্তরিকভাবে বন্ধুত্ব দেখানো হতো। চুমু দিয়ে ও কখনও কখনও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলে গলা ধরে চুমু দিয়ে ও কেঁদে বন্ধুত্ব দেখানো হতো। (আদিপুস্তক ৩৩:৪; প্রেরিত ২০:৩৭, ৩৮) যীশু যখন পৃথিবীতে ছিলেন সেই সময় হেলান দিয়ে খাবার খাওয়া, কারও কোলে হেলান দিয়ে বসা অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বা ভালবাসাকে প্রকাশ করত আর তা কোলে বসা বলে পরিচিত ছিল। (যোহন ১৩:২৩, ২৫) লূক ১৬:২২, ২৩ পদের দৃষ্টান্তে এই রীতিটাই ছিল মূল বিষয়। কারও সঙ্গে বসে তারই খাবার খাওয়া সেই লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সদ্ভাবকে বোঝাত। কিন্তু পরে সেই লোকের ক্ষতি করা এক বিরাট বিশ্বাসঘাতকতা ছিল।—গীতসংহিতা ৪১:৯.
হাততালি দিয়ে এবং নাচগান করে আনন্দ প্রকাশ করা হতো। কাজের সময় যেমন, বাগান থেকে আঙুর ফল তোলার সময় জোরে কথা বলে ও গান করে আনন্দ বা উল্লাস প্রকাশ করা হতো। (গীতসংহিতা ৪৭:১; বিচারকর্ত্তৃগণের বিবরণ ১১:৩৪; যিরমিয় ৪৮:৩৩) আজকে যিহোবার আনন্দিত দাসেরা তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃসমাজের বন্ধুত্বকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করেন, ‘যিহোবার আনন্দকে’ তাদের আশ্রয়স্থল করেন এবং উদ্যমের সঙ্গে ঈশ্বরের প্রশংসা গান করেন।
গমনাগমন করা ও দৌড়ানো
কোন একটা নির্দিষ্ট পথে চলা বোঝাতে গিয়ে বাইবেলে “গমনাগমন” শব্দটা ব্যবহার করা হয়, যেমন বলা আছে “নোহ ঈশ্বরের সহিত গমনাগমন করিতেন।” (আদিপুস্তক ৬:৯) যারা ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন করতেন, তারা ঈশ্বর যেরকম জীবনধারার কথা বলেছিলেন সেভাবে জীবনযাপন করতেন ও তাঁর সুনজরে ছিলেন। এই একই অভিব্যক্তি ব্যবহার করে খ্রীষ্টান গ্রিক শাস্ত্রে ঈশ্বরের দাস হওয়ার আগের ও পরের দুরকমের বিপরীত জীবনধারার কথা তুলে ধরা হয়েছে। (ইফিষীয় ২:২, ১০) একইভাবে, ‘দৌড়’ দিয়ে রূপকভাবে একটা পথকে বোঝানো হয়েছে। ঈশ্বর বলেছিলেন যে যিহূদার ভাববাদীদের তিনি পাঠাননি কিন্তু তারা ‘দৌড়িয়াছে;’ ঈশ্বরের কাছ থেকে কোন অধিকার ছাড়াই তারা মিথ্যে ভবিষ্যদ্বাণী বলেছিল। ‘দৌড়ানো’ শব্দ দিয়ে পৌল খ্রীষ্টীয় পথকে বুঝিয়েছেন। তিনি এটাকে এমন এক দৌড়ের সঙ্গে তুলনা করেন, যেখানে পুরস্কার পাওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে নিয়মকানুন মেনে দৌড়াতে হবে।—যিরমিয় ২৩:২১; ১ করিন্থীয় ৯:২৪.
অতএব, আমাদের ভাবভঙ্গি অনেক কিছু বলে। আমাদের ভাবভঙ্গিতে রাগ বা বিরক্তি নয় বরং সবসময় অন্যের প্রতি যেন সম্মান, নম্র মনোভাব এবং বন্ধুত্ব ও আনন্দ প্রকাশ পায়। আর এভাবে ‘ঈশ্বরের সঙ্গে গমনাগমন’ করে চলে আমরা অনন্ত জীবনের পথের ‘দৌড়ে’ সফল হব।