সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবার পথে এগিয়ে যাওয়া আমাদের শক্তি ও আনন্দ দেয়

যিহোবার পথে এগিয়ে যাওয়া আমাদের শক্তি ও আনন্দ দেয়

জীবন কাহিনী

যিহোবার পথে এগিয়ে যাওয়া আমাদের শক্তি ও আনন্দ দেয়

বলেছেন লুইজি ডি. ভেলেনটিনো

“এই পথ, তোমরা এই পথেই চল,” যিহোবা উপদেশ দেন। (যিশাইয় ৩০:২১) ৬০ বছর আগে আমার বাপ্তিস্মের সময় থেকে এই উপদেশ আমার লক্ষ্য হয়ে এসেছে। ছোটবেলা থেকেই আমার বাবামার উদাহরণ দেখে আমি এই লক্ষ্য রেখেছিলাম, যারা ১৯২১ সালে ইতালি থেকে আমেরিকার ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডে স্থায়ীভাবে থাকতে এসেছিলেন। এখানেই তারা তিন ছেলেমেয়ে অর্থাৎ আমার দাদা মাইক, ছোট বোন লিডিয়া ও আমাকে বড় করে তুলেছিলেন।

 আমার বাবামা বিভিন্ন ধর্ম পরীক্ষা করে দেখেন কিন্তু হতাশ হয়ে শেষে হাল ছেড়ে দেন। এরপর ১৯৩২ সালের একদিন, বাবা ইতালি ভাষায় রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান শুনছিলেন। সেটা ছিল যিহোবার সাক্ষিদের অনুষ্ঠান আর বাবা যা শুনেছিলেন, তা তার ভাল লেগেছিল। তাই, আরও জানার জন্য তিনি সাক্ষিদেরকে চিঠি লেখেন আর যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় নিউ ইয়র্ক, ব্রুকলিন থেকে একজন ইতালিয় সাক্ষি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ভোর পর্যন্ত সুন্দর এক আলোচনার পর আমার বাবামা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হন যে তারা সত্য ধর্ম খুঁজে পেয়েছেন।

বাবামা খ্রীষ্টীয় সভাগুলোতে আসতে শুরু করেন আর ভ্রমণ অধ্যক্ষদের আমাদের বাড়িতে থাকতে দেন। যদিও আমি ছোট ছিলাম কিন্তু ভ্রমণ অধ্যক্ষরা আমাকে তাদের সঙ্গে প্রচারে নিয়ে যেতেন আর এর ফলে যিহোবাকে পূর্ণ-সময় সেবা করার কথা আমি চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম। এইরকমই একজন ছিলেন ক্যারি ডব্লিউ বারবার, যিনি এখন যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীর একজন সদস্য। এর অল্প কিছুদিন পর, ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৪ বছর বয়সে আমি বাপ্তিস্ম নিই আর ১৯৪৪ সালে ক্লিভল্যান্ডে একজন অগ্রগামী হিসেবে পরিচর্যার কাজ শুরু করি। মাইক এবং লিডিয়াও বাইবেলের সত্যের পথে চলতে শুরু করেছিল। মাইক মৃত্যু পর্যন্ত যিহোবাকে সেবা করে গেছে আর লিডিয়া তার স্বামী হ্যারোল্ড উইডনারের সঙ্গে ২৮ বছর ধরে ভ্রমণের কাজ করেছে। আজকে তারা পূর্ণ-সময়ের পরিচারক হিসেবে সেবা করছে।

জেল আমার এগিয়ে যাওয়ার সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে

যিশাইয় ২:৪ পদে খড়্গ ভেঙে লাঙ্গলের ফাল গড়ার কথা বলা আছে আর বাইবেল শিক্ষিত বিবেক অনুযায়ী এই কথাগুলো মেনে চলার জন্য আমাকে ১৯৪৫ সালের গোড়ার দিকে ওহাইওর চিলিকোথ ফেডারেল জেলে রাখা হয়েছিল। এক সময়ে, জেল কর্তৃপক্ষরা বন্দি সাক্ষিদের কাছে, যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত বাইবেলের কিছু সাহিত্যাদি রাখার অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু, কাছাকাছি একটা মণ্ডলীর সাক্ষিরা সাহায্য করেছিলেন। কখনও কখনও, তারা জেলের কাছে মাঠগুলোতে কিছু প্রকাশনা ফেলে রাখতেন। পরের দিন সকালে, বন্দিদেরকে যখন তাদের কাজের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হতো, তখন তারা সেই প্রকাশনাগুলো খুঁজতেন ও তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে কোনরকমে সেগুলোকে জেলের মধ্যে নিয়ে আসতেন। কিন্তু আমি যখন জেলে আসি, সেই সময় আমাদেরকে আরও বেশি করে সাহিত্যাদি রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তবুও, যিহোবা আমাদেরকে যে আধ্যাত্মিক খাদ্য জোগান তার মূল্য যে কতখানি, সেই সময়ে আমি তা জেনেছিলাম আর এখনও প্রহরীদুর্গ অথবা সচেতন থাক! পত্রিকার নতুন সংখ্যাটা যখনই হাতে পাই সঙ্গে সঙ্গে সেই কথা আমার মনে পড়ে যায়।

যদিও, আমাদেরকে জেলে মণ্ডলীর সভাগুলো করতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল কিন্তু যারা সাক্ষি ছিলেন না তাদেরকে সেখানে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তবুও, কিছু জেল অফিসার এবং কয়েদি লুকিয়ে লুকিয়ে সভায় আসতেন আর এমনকি কয়েকজন সত্য গ্রহণ করেছিলেন। (প্রেরিত ১৬:৩০-৩৪) ভাই এ. এইচ. ম্যাকমিলান যখন আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তখন তার কাছ থেকে আমরা অনেক সান্ত্বনা পেয়েছিলাম। তিনি সবসময়েই আমাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলতেন, যে সময়টা আমরা জেলে কাটিয়েছি তা ব্যর্থ হবে না কারণ তা আমাদেরকে ভবিষ্যতে কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সেই বয়স্ক প্রিয় ভাই আমার হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিলেন ও যিহোবার পথে আমার চলার সংকল্পকে আরও দৃঢ় করেছিলেন।

আমি একজন সাথি পাই

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর জেল থেকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয় আর তাই আমি পুনরায় পূর্ণ-সময়ের অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। কিন্তু ১৯৪৭ সালে আমার বাবা মারা যান। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য আমি চাকরি নিই আর চিকিৎসা সংক্রান্ত ম্যাসাজ কাজেও দক্ষ হয়ে উঠি—যে দক্ষতা, প্রায় ৩০ বছর পরে আমি ও আমার স্ত্রী যখন এক কঠিন সময়ের মধ্যে ছিলাম তখন আমাকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু আমি শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। আসুন, প্রথমে আমি আপনাদেরকে আমার স্ত্রীর কথা বলি।

১৯৪৯ সালের একদিন বিকেলবেলায়, আমি যখন কিংডম হলে ছিলাম তখন ফোনটা বেজে ওঠে। আমি ফোনটা তুলি আর এক মিষ্টি কণ্ঠস্বর শুনতে পাই: “আমার নাম ক্রিস্টিন গেনচার। আমি একজন যিহোবার সাক্ষি। আমি চাকরির খোঁজে ক্লিভল্যাণ্ডে এসেছি আর আমি কোন একটা মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করতে চাই।” সে যেখানে থাকত সেখান থেকে আমাদের কিংডম হল অনেকটা দূরে ছিল কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমার খুব ভাল লেগেছিল, তাই আমাদের কিংডম হলে কী করে আসতে হবে তা আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম আর সেই রবিবারেই তাকে আসার জন্য উৎসাহিত করেছিলাম, যেদিন জনসাধারণের বক্তৃতাটা আমারই দেওয়ার কথা। রবিবারে আমিই প্রথমে কিংডম হলে আসি কিন্তু না, অপরিচিত কোন বোনকে দেখতে পাইনি। পুরো বক্তৃতায় মাঝে মাঝে আমি দরজার দিকে তাকাচ্ছিলাম কিন্তু কেউই আসেনি। পরের দিন আমি তাকে ফোন করি আর সে বলে যে, কোন্‌ বাসে চড়ে কোথায় যেতে হয় তা সে ভাল করে তখনও জানে না। তাই, তাকে আরও ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমি যেচে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।

আমি জানতে পারি যে তার বাবামা, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে এখানে আসেন আর তারা মৃতেরা কোথায়? (ইংরেজি) পুস্তিকাটা পড়ার পর বাইবেল ছাত্রদের সঙ্গে মেলামেশা করতে শুরু করেন। তার বাবামা ১৯৩৫ সালে বাপ্তিস্ম নেন। ক্রিস্টিনের বাবা ১৯৩৮ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ক্লাইমার শহরে যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীর কোম্পানি সারভেন্ট (এখন যাকে পরিচালক অধ্যক্ষ বলা হয়) হন আর ১৯৪৭ সালে ১৬ বছর বয়সে ক্রিস্টিন বাপ্তিস্ম নেয়। আমি খুব শীঘ্রিই এই সুন্দরী, আধ্যাত্মিক-মনা বোনের প্রেমে পড়ে যাই। ১৯৫০ সালের ২৪শে জুন আমরা বিয়ে করি আর সেই সময় থেকে ক্রিস্টিন আমার বিশ্বস্ত সাথি হয়ে আছে, যে সবসময়ে ঈশ্বরের রাজ্যকে প্রথম স্থান দিয়েছে। আমি যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞ যে এই গুণবতী সাথি আমার জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে জড়াতে রাজি হয়েছিল।—হিতোপদেশ ৩১:১০.

এক বড় চমক

১৯৫১ সালের ১লা নভেম্বরে, আমরা দুজনে অগ্রগামীর কাজ শুরু করি। দুবছর পর, ওহাইওর টোলিডোরের এক সম্মেলনে ভাই হুগো রিইমার ও এলবার্ট শ্রোডার মিশনারি কাজে আগ্রহী এমন একটা অগ্রগামী দলের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা সেই দলে ছিলাম। আমাদেরকে ক্লিভল্যাণ্ডে অগ্রগামীর কাজ করে যেতে উৎসাহিত করা হয়েছিল কিন্তু পরের মাসেই আমাদের সামনে একটা বড় চমক এসেছিল—আমরা ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ২৩তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, যা ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল!

গাড়ি চালিয়ে গিলিয়েড স্কুলের দিকে যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ি যখন নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে ছিল, তখন ক্রিস্টিন এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে সে আমাকে বার বার বলতে থাকে “আস্তে চালাও!” আমি বলি, “ক্রিস্টিন, আমরা যদি এর চেয়েও আরও আস্তে গাড়ি চালাই, তাহলে আমাদের গাড়ি আর চলবে না।” যাইহোক ক্যামপাসে পৌঁছানোর পর আমরা স্বস্তি পাই। ভাই নেথেন নর ছাত্রদের দলকে স্বাগত জানান আর তিনি আমাদেরকে চারদিক ঘুরিয়ে দেখান। তিনি আরও বলেন যে কীভাবে আমরা জল ও বিদ্যুৎ বাঁচাতে পারি আর এইভাবে তিনি রাজ্যের আগ্রহের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য মিতব্যয়ি হওয়া যে এক ভাল গুণ, সেটার ওপর জোর দেন। তার সেই উপদেশ আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজও আমরা এই উপদেশ মেনে চলি।

প্লেনে চড়ে রিওতে যাওয়া

শীঘ্রিই আমরা গ্র্যাজুয়েট হই আর ১৯৫৪ সালের ১০ই ডিসেম্বর শীতকালে নিউ ইয়র্ক শহর থেকে একটা প্লেনে চড়ে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর উদ্দেশ্যে রওনা দিই আর সেই সময় আমাদের নতুন কাজে যাওয়ার জন্য খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। পিটার ও বিলি কারবেলো এই দুজন মিশনারি আমাদের সঙ্গে যাত্রা করেছিলেন। পুয়ের্টো রিকো, ভেনেজুয়েলা এবং উত্তর ব্রাজিলের বেলেমে থামার পর সেখানে পৌঁছাতে সব মিলিয়ে প্লেনে ২৪ ঘন্টা লাগার কথা ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনের গোলমালের জন্য, প্লেন থেকে রিও ডি জেনিরোকে দেখতে ৩৬ ঘন্টা লেগে গিয়েছিল। কী এক অপূর্ব দৃশ্য! অন্ধকারের মধ্যে শহরের বাতিগুলো যেন কালো মখমলের এক কারপেটের ওপর রাখা চকমকে হীরের মতো দেখাচ্ছিল আর চাঁদের রুপালি আলো যেন গুয়ানাবারা উপসাগরের জলের ওপর ঝিলিক মারছিল।

বেথেল পরিবারের কয়েকজন সদস্য আমাদের জন্য বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। আন্তরিক সম্ভাষণ জানানোর পর, তারা আমাদেরকে শাখা অফিসের দিকে নিয়ে যান আর ভোর প্রায় তিনটের সময় আমরা শুতে যাই। কয়েক ঘন্টা পর, জেগে ওঠার ঘন্টা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের মিশনারি কাজের প্রথম দিন শুরু হয়ে গেছে!

প্রথম শিক্ষা

শীঘ্রিই আমরা একটা ভাল শিক্ষা পেয়েছিলাম। এক সন্ধ্যায় আমরা এক সাক্ষি পরিবারের বাড়িতে সময় কাটিয়েছিলাম। আমরা যখন শাখা অফিসে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম তখন বাড়ির কর্তা বাধা দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা যেতে পারবেন না; এখন বৃষ্টি হচ্ছে” আর তিনি ঐ রাতে আমাদেরকে তার বাড়িতে থেকে যাওয়ার জন্য জোর করেছিলেন। “আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানেও বৃষ্টি হয়” এই বলে আমি তার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাই, আর কোন কথা না বলে আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম।

রিও-র চারপাশে পাহাড়-পর্বত থাকায়, বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে শহরে নেমে জমা হয়ে যায় আর এর ফলে সেখানে প্রায়ই বন্যা হয়। শীঘ্রিই আমাদেরকে হাঁটু পর্যন্ত জল পেরোতে হয়েছিল। শাখা অফিসের কাছাকাছি রাস্তাগুলো যেন নদীতে পরিণত হয়েছিল, প্রায় বুক সমান জল হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে ভিজে সপসপে হয়ে আমরা বেথেলে পৌঁছেছিলাম। পরের দিন ক্রিস্টিন খুব অসুস্থ বোধ করে ও পরে টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় আর এতে সে অনেক দিন ধরে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন মিশনারি হিসেবে আমাদের সেই স্থানীয় সাক্ষিদের কথা শোনা উচিত ছিল।

মিশনারি ও ভ্রমণ কাজের শুরু

এইরকম একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর, আমরা উৎসাহের সঙ্গে মিশনারি কাজ শুরু করেছিলাম। কোন পর্তুগীজ ভাষী লোকের সঙ্গে যখন আমাদের দেখা হতো আমরা তার কাছে একটা উপস্থাপনা পড়ে শোনাতাম আর সেই সঙ্গে পর্তুগীজ ভাষায় কথা বলাও শিখছিলাম। একজন গৃহকর্তা আমাকে দেখিয়ে ক্রিস্টিনকে বলেছিলেন, “আমি আপনার কথা বুঝতে পারি কিন্তু আমি ওনার কথা বুঝতে পারি না।” আবার আরেকজন গৃহকর্তা আমাকে বলেছিলেন, “আমি আপনার কথা বুঝতে পারি কিন্তু ওনার (ক্রিস্টিনের) কথা বুঝতে পারি না।” এইরকম হওয়া সত্ত্বেও, আমরা ওই প্রথম কয়েক সপ্তার মধ্যে ১০০টারও বেশি প্রহরীদুর্গ এর গ্রাহকভুক্তি পেয়ে আনন্দিত হয়েছিলাম। সত্যি বলতে কী, ব্রাজিলে আমাদের প্রথম বছরেই আমাদের বেশ কিছু বাইবেল ছাত্র বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন আর এভাবে মিশনারি কাজ যে কত ফলপ্রদ হতে পারে, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলাম।

১৯৫০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে, ব্রাজিলের অনেক মণ্ডলীতে যোগ্য ভাইয়েরা কম থাকায় সীমা অধ্যক্ষের ভ্রমণ হতো না। তাই যদিও তখনও পর্যন্ত আমি ভাষা শিখছিলাম এবং পর্তুগীজ ভাষায় জনসাধারণের বক্তৃতা দিইনি, তবুও ১৯৫৬ সালে আমাকে সাও পাওলোতে সীমার কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

প্রথমে যে মণ্ডলী আমরা পরিদর্শন করি সেখানে যেহেতু দুবছর যাবৎ কোন সীমা অধ্যক্ষ পরিদর্শন করেননি, তাই সকলেই জনসাধারণের বক্তৃতার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন। সেই বক্তৃতাটা প্রস্তুত করতে গিয়ে আমি পর্তুগীজ ভাষার প্রহরীদুর্গ এর প্রবন্ধগুলো থেকে অনুচ্ছেদগুলো কেটে সেই টুকরোগুলোকে কাগজে সেঁটে দিয়েছিলাম। ওই রবিবারে, কিংডম হল একেবারে ভরে গিয়েছিল। এমনকি লোকেরা স্টেজের ওপরেও বসেছিলেন, সকলেই সেই বক্তৃতাটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি বক্তৃতা, না এটাকে দেখে দেখে পড়া বললেই ভাল হয়, শুরু করেছিলাম। মাঝে মধ্যে আমি যখন চারদিকে তাকাচ্ছিলাম তখন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে সকলে, এমনকি বাচ্চারা পর্যন্ত চুপচাপ বসে শুনছে। সকলেরই দৃষ্টি আমার দিকে ছিল। আমি ভেবেছিলাম: ‘আরে, আমার পর্তুগীজ ভাষা এতই ভাল হয়েছে যে এরা এত মন দিয়ে শুনছে!’ কয়েক বছর পর, আমি যখন আবার সেই মণ্ডলী পরিদর্শন করি, একজন ভাই, যিনি আমার সেই প্রথম পরিদর্শনের সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি বলেছিলেন: “আপনি যে জনসাধারণের বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন সেটার কথা কি আপনার মনে পড়ে? আমরা তার একটা কথাও বুঝতে পারিনি।” আমি স্বীকার করেছিলাম যে এমনকি আমি নিজেও সেই বক্তৃতার অনেক কিছুই বুঝিনি।

সীমা কাজের সেই প্রথম বছরে, আমি প্রায়ই সখরিয় ৪:৬ পদটা পড়তাম। ‘বল দ্বারা নয়, কিন্তু আমার আত্মা দ্বারা,’ এই কথাগুলো আমাকে মনে করিয়ে দিত যে যিহোবার আত্মাই একমাত্র রাজ্যের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে। আর তাই আমাদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও এই কাজ এগিয়ে গিয়েছিল।

এগিয়ে চলার পথে কঠিন সমস্যা ও আশীর্বাদগুলো

সীমার কাজ করার মানে ছিল, এক সীমা থেকে আরেক সীমায় টাইপরাইটার, বইপত্রের বাক্স, সুটকেস ও ব্রিফকেসগুলোকে বয়ে নিয়ে যাওয়া। বুদ্ধি করে ক্রিস্টিন আমাদের জিনিসপত্রগুলো গুণে রাখত, যাতে তাড়াহুড়ো করে এক বাস থেকে আরেকটা বাসে চড়ার সময় একটাও ফেলে না যাই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর জন্য ধুলো রাস্তা দিয়ে ১৫ ঘন্টা বাসে করে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। মাঝে মাঝে খুবই ভয় লাগত যখন দুদিক থেকে আসা দুটো বাস ভাঙা ব্রিজের ওপর দিয়ে পাশাপাশি পার হয়ে যেত, বাস দুটো এতটাই গা ঘেষে যেত যে, তাদের মাঝখানে একটা টিস্যু পেপার ধারণ করার জায়গা থাকত না। এছাড়া আমরা ট্রেনে, জাহাজে এবং ঘোড়ার পিঠে চড়েও ভ্রমণ করেছি।

১৯৬১ সালে আমরা জেলার কাজ করা শুরু করি, এক মণ্ডলী থেকে আরেক মণ্ডলীতে ভ্রমণ করার পরিবর্তে এক সীমা থেকে আরেক সীমায় ভ্রমণ করি। এক সপ্তায় কয়েকটা সন্ধ্যায় আমরা যিহোবার সংগঠনের দ্বারা নির্মিত চলচ্চিত্র দেখিয়েছিলাম—প্রতিবার আলাদা আলাদা জায়গায়। স্থানীয় পাদরিরা এই চলচ্চিত্র দেখানোতে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করত কিন্তু তারা যাতে তা না করতে পারে তার জন্য প্রায়ই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হতো। একবার একটা শহরে, পাদরিরা একটা হলের মালিককে ভয় দেখিয়ে আমাদের সঙ্গে তার লেনদেন বাতিল করে দিয়েছিল। কিছুদিন ধরে খোঁজাখুঁজি করার পর, আমরা আরেকটা জায়গা পাই কিন্তু সে কথা আমরা কাউকে না জানিয়ে সকলকে আগের জায়গায় আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে, ক্রিস্টিন সেই হলে গিয়ে যারা ছবি দেখতে চেয়েছিলেন তাদেরকে নীরবে নতুন জায়গা দেখিয়ে দিয়েছিল। ওই সন্ধ্যায় ১৫০ জন ছবিটা দেখেছিলেন, যার শিরোনাম ছিল নতুন জগতের সমাজ কার্যকর (ইংরেজি)।

কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে ভ্রমণের কাজ করা যদিও কঠিন ছিল, তবুও সেখানকার নম্র ভাইয়েরা আমাদের পরিদর্শনকে এতখানি উপলব্ধি করতেন ও তাদের সেই কুঁড়ে ঘরে আমাদের থাকতে দিয়ে এতখানি আতিথেয়তা দেখাতেন যে আমরা সবসময়ে যিহোবাকে ধন্যবাদ জানাতাম যেন আমরা তাদের সঙ্গে থাকতে পারি। তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমাদের জন্য অনেক আশীর্বাদ নিয়ে এসেছিল। (হিতোপদেশ ১৯:১৭; হগয় ২:৭) তাই, ২১ বছরের বেশি সময় ধরে ব্রাজিলে কাজ করার পর যখন মিশনারি কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল তখন আমরা কতই না দুঃখ পেয়েছিলাম!

একটা সংকটের সময় যিহোবা আমাদের পথ দেখিয়েছিলেন

১৯৭৫ সালে ক্রিস্টিনের অস্ত্রোপচার হয়েছিল। এরপর আমরা আবার ভ্রমণের কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু ক্রিস্টিনের শরীর আরও খারাপ হতে থাকে। তাই তার চিকিৎসার জন্য আমেরিকাতে ফিরে যাওয়াই ভাল বলে মনে হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে, আমরা ক্যালিফোর্নিয়ার লং বিচে এসে পৌঁছাই আর সেখানে আমরা আমার মায়ের সঙ্গে থাকি। বিশ বছর ধরে বিদেশে থাকায়, আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে কীভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করব। আমি ম্যাসাজ করার কাজ শুরু করেছিলাম আর এর থেকে যা আয় করতাম তা দিয়ে জীবন চালাতাম। ক্যালিফোর্নিয়ার সরকার ক্রিস্টিনকে একটা হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় কিন্তু সেখানে সে প্রতিদিন আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল কারণ ডাক্তাররা রক্ত ছাড়া তার চিকিৎসা করতে অস্বীকার করেছিলেন। তাই মরিয়া হয়ে আমরা যিহোবার নির্দেশনার জন্য প্রার্থনা করি।

একদিন বিকেলে আমি যখন প্রচারে গিয়েছিলাম, আমি একটা ডাক্তারের চেম্বার দেখতে পাই আর হঠাৎ করেই আমি ভিতরে যাব বলে ঠিক করি। যদিও বাড়ি যাওয়ার জন্য ডাক্তার তৈরি হচ্ছিলেন কিন্তু তিনি আমাকে তার চেম্বারে ডেকেছিলেন আর আমরা দুঘন্টা ধরে কথা বলেছিলাম। এরপর তিনি বলেছিলেন: “আমি আপনাদের মিশনারি কাজের মূল্য বুঝেছি, আমি আপনার স্ত্রীকে বিনাপয়সায় ও রক্ত ছাড়া চিকিৎসা করব।” তার কথাগুলো আমি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

এই দয়ালু ডাক্তার, যিনি একজন সম্মানীয় বিশেষজ্ঞে পরিণত হয়েছিলেন তিনি ক্রিস্টিনকে সেই হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন, যেখানে তিনি কাজ করেন আর তার তত্ত্বাবধানে ক্রিস্টিন ভাল হয়ে উঠতে থাকে। ওই সংকটের সময়ে আমাদেরকে পথ দেখানোর জন্য আমরা যিহোবার কাছে কতই না কৃতজ্ঞ!

নতুন কাজের দায়িত্ব

ক্রিস্টিন যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, আমরা অগ্রগামী হিসেবে সেবা করি এবং লং বিচে কিছুজনকে যিহোবার উপাসক হতে সাহায্য করতে পারায় আনন্দিত হই। ১৯৮২ সালে আমাদেরকে আমেরিকাতে সীমার কাজ করার কথা বলা হয়েছিল। আমাদেরকে আবারও ভ্রমণের কাজে ব্যবহার করার জন্য যিহোবাকে আমরা প্রতিদিন ধন্যবাদ জানাই কারণ এই মিশনারির কাজকে আমরা ভালবাসি। আমরা ক্যালিফোর্নিয়া ও এরপর নিউ ইংল্যাণ্ডে সেবা করি, যে সীমায় কিছু পর্তুগীজ ভাষী মণ্ডলী ছিল। এছাড়া পরে বারমুডায়ও আমরা কাজ করি।

আনন্দের সঙ্গে চার বছর কাজ করার পর, আমাদেরকে অন্য আরেকটা কাজ দেওয়া হয়েছিল। আমরা যেখানে চাই সেখানে গিয়ে বিশেষ অগ্রগামীর কাজ করার জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। যদিও ভ্রমণের কাজ ছাড়তে হবে বলে আমরা দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু আমাদের নতুন কাজ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ ছিলাম। কিন্তু কোথায়? ভ্রমণের কাজ করার সময় আমরা লক্ষ্য করেছিলাম যে নিউ বেডফোর্ডের ম্যাসাচুসেটসের পর্তুগীজ মণ্ডলীকে সাহায্য করা দরকার, তাই আমরা নিউ বেডফোর্ডের দিকে রওনা হয়েছিলাম।

আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছিলাম, মণ্ডলী আমাদেরকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। সেখানে যে আমাদের কতখানি দরকার ছিল, তা আমরা বুঝেছিলাম! আমরা কেঁদে ফেলেছিলাম। অল্পবয়স্ক এক দম্পতি যাদের দুটো বাচ্চা ছিল তারা যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা থাকার ঘর পেয়েছিলাম, তাদের ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছিলেন। সত্যিই যিহোবা এই বিশেষ অগ্রগামীর কাজকে এতখানি আশীর্বাদ করেছিলেন, যা আমরা আশা করিনি। ১৯৮৬ সাল থেকে আমরা এই শহরে প্রায় ৪০ জন বিভিন্ন ব্যক্তিকে সাক্ষি হতে সাহায্য করেছি। তারা আমাদের আধ্যাত্মিক পরিবার। এছাড়া, পাঁচজন স্থানীয় ভাইকে পালের দেখাশোনার কাজে বেড়ে উঠতে দেখার আনন্দ আমার আছে। এটা ফলপ্রদ মিশনারি কাজে সেবা করার মতো।

যখন আমরা অতীতের দিনগুলোর দিকে তাকাই, তখন আমাদের মন এই ভেবে আনন্দে ভরে যায় যে আমরা অল্পবয়স থেকে যিহোবাকে সেবা করে এসেছি এবং সত্যকে আমাদের জীবনের পথ করে নিয়েছি। এ কথা সত্যি যে, এখন আমাদের বয়স হয়েছে এবং আমরা আগের মতো আর এতটা করতে পারি না কিন্তু যিহোবার পথে এগিয়ে যাওয়া এখনও আমাদের শক্তি ও আনন্দ দেয়।

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

রিও ডি জেনিরোতে সবেমাত্র পৌঁছানো

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের আধ্যাত্মিক পরিবার, নিউ বেডফোর্ডের ম্যাসাচুসেটসে