সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমার অমূল্য স্মৃতিগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ!

আমার অমূল্য স্মৃতিগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ!

জীবন কাহিনী

আমার অমূল্য স্মৃতিগুলোর জন্য আমি কৃতজ্ঞ!

বলেছেন ড্রুসিলা ক্যান

সময়টা ছিল ১৯৩৩ সাল আর মাত্র কিছুদিন হল জ্যানোয়া ক্যানের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে, যে আমার মতোই একজন কল্পটর অর্থাৎ পূর্ণ-সময়ের প্রচারক ছিল। মনে মনে আমি খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম এবং আমার স্বামীর সঙ্গে তার কাজে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু, সেই কাজ করার জন্য আমার একটা সাইকেলের প্রয়োজন ছিল আর অর্থনৈতিক মন্দার বছরগুলোতে এত দামি জিনিস কেনা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এখন আমি কী করতে পারি?

 আমার আর্থিক অবস্থার কথা শুনে আমার তিন দেবর আমার জন্য একটা সাইকেল বানিয়ে দিতে সেই এলাকার জঞ্জাল থেকে সাইকেলের পুরনো যন্ত্রপাতির অংশ খুঁজে বের করে। তারপর তারা সেগুলো একসঙ্গে জুড়ে সাইকেল তৈরি করে এবং সেটা কাজ করতেও শুরু করে! সাইকেল চালাতে শেখার সঙ্গে সঙ্গে, জ্যানোয়া ও আমি খুশিমনে সাইকেল চালিয়ে ওয়োস্টার ও হারফোর্ডের ইংলিশ কাউন্টিগুলোর মধ্যে দিয়ে যাই আর তখন আমরা যাদেরকেই পেয়েছিলাম তাদের সকলের কাছে সাক্ষ্য দিই।

আমি বুঝতেই পারিনি যে, বিশ্বাসের সামান্য ধাপই পরে আমাকে অনেক অনেক স্মৃতিতে পূর্ণ এক জীবনের দিকে নিয়ে যাবে। আমার জীবনের আধ্যাত্মিক ভিত্তি কিন্তু আমার প্রিয় বাবামা গেঁথেছিলেন।

মহাযুদ্ধের সময়কার কষ্টের বছরগুলো

১৯০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার জন্ম হয়। এর কিছু সময় পরেই আমার মা বিভিন্ন যুগ সম্বন্ধে ঐশিক পরিকল্পনা (ইংরেজি) নামে একটা বই পান এবং ১৯১৪ সালে বাবামা আমাকে “ফটো ড্রামা অফ ক্রিয়েশন” দেখাতে ওল্ডহ্যাম ল্যাংকশিয়ারে নিয়ে যান। (এই দুটো বিষয়ই আজকে যারা যিহোবার সাক্ষি নামে পরিচিত তারা তৈরি করেছিলেন।) যদিও আমি খুব ছোট ছিলাম কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, সেটা দেখে খুশিতে নাচতে নাচতে আমি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম! ফ্রাংক হিলে নামে একজন ব্যক্তি, আমরা যেখানে থাকতাম সেই রচডেলে বাইবেল অধ্যয়নের একটা দল গঠন করেছিলেন। পরিবারের সবাই মিলে এই অধ্যয়নে যোগ দেওয়ার ফলে আমরা শাস্ত্রের ওপর জ্ঞানকে বৃদ্ধি করতে পেরেছিলাম।

ওই বছরেই মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ায় আমাদের জীবনের শান্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, যেটাকে এখন আমরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলি। আমার বাবাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়েছিল কিন্তু তিনি নিরপেক্ষ ছিলেন। সেখানকার একটা খবরের কাগজ রিপোর্ট করেছিল যে, আদালতে তাকে “একজন অত্যন্ত ভদ্রলোক” বলা হয়েছিল এবং ‘বেশ কয়েকজন ভদ্রলোক’ তার সম্বন্ধে কয়েকটা চিঠি পেশ করেছিলেন ‘যেখানে তারা বলেছিলেন যে, তারা মনে করেন অস্ত্র হাতে না নেওয়ার ব্যাপারে তার আপত্তির ক্ষেত্রে তিনি আন্তরিক ছিলেন।’

কিন্তু, বাবাকে পুরোপুরি মুক্তি না দিয়ে “কেবল সেনাবাহিনী থেকে” রেহাই দেওয়া হবে বলে তার নাম তালিকাবদ্ধ করা হয়। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঠাট্টার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন আর মা ও আমার সঙ্গেও একই ব্যবহার করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তার কাজকে আবার বিবেচনা করে, তাকে কৃষি কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু কিছু কৃষকরা কেবল তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখেছিল ও তাকে তার কাজের জন্য সামান্য বা কোন বেতনই দেয়নি। পরিবারের ভরণপোষণে সাহায্য করার জন্য মা অল্প বেতনের একটা বেসরকারী লন্ড্রিতে অনেক ভারী কাজ করেন। কিন্তু, আজকে আমি বুঝতে পারছি যে যৌবনের ওই দিনগুলোতে এইধরনের কঠিন অবস্থাকে মোকাবিলা করা আমাকে কত শক্তিই না দিয়েছিল; এই অবস্থা আমাকে আরও গুরুত্বপূর্ণ আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাতে সাহায্য করেছিল।

ক্ষুদ্র আরম্ভ

খুব শীঘ্রিই ড্যানিয়েল হিয়ুজ নামে একজন মনোযোগী বাইবেল ছাত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। তিনি রুয়াবোন গ্রামে কয়লা খনিতে (কয়লাখনির শ্রমিক) কাজ করতেন। এই গ্রামটা ওসওয়েসট্রি থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে ছিল, যেখানে পরে আমাদেরকে চলে যেতে হয়েছিল। আমি তাকে ড্যান কাকু বলে ডাকতাম, তিনি সবসময় আমাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং যখনই তিনি আমাদেরকে দেখতে আসতেন, আমাদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলতেন। তিনি কখনও আজেবাজে কথা বলতেন না। ১৯২০ সালে ওসওয়েসট্রিতে বাইবেল অধ্যয়ন ক্লাস শুরু হয় এবং ১৯২১ সালে ড্যান কাকু আমাকে ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) নামে বইয়ের একটা কপি দেন। আমি এটাকে খুবই মূল্যবান বলে মনে করতাম কারণ এটা আমাকে বাইবেলের শিক্ষাগুলোকে সহজে বুঝতে অনেক সাহায্য করেছিল।

এছাড়া, তাদের মধ্যে প্রাইস হিয়ুজও * ছিলেন, যিনি পরে লন্ডনে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসের গৃহ অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তিনি তার পরিবারের সঙ্গে ওয়েলশ্‌ সীমান্তের কাছে ব্রোনিগার্থে থাকতেন ও তার বড় বোন সিসে আমার মায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হয়ে উঠেছিলেন।

১৯২২ সালে যখন ‘রাজা এবং রাজ্যের বিষয়ে ঘোষণা করার’ ডাক দেওয়া হয়েছিল, তখনকার রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথা আমার এখনও মনে আছে। পরের বছরগুলোতে যদিও আমি তখনও স্কুলে পড়তাম, তবুও আমি আগ্রহ নিয়ে ১৯২৪ সালে বিশেষ ট্র্যাক্টগুলো যেমন, পাদরিরা অভিযুক্ত (ইংরেজি) বিতরণ করেছিলাম। সেই দশকের দিকে ফিরে তাকালে মনে পড়ে অনেক বিশ্বস্ত ভাইবোনদের সঙ্গে মেলামেশা করার কত বড় সুযোগ আমার হয়েছিল, যেমন তাদের মধ্যে ছিলেন মড ক্লার্ক * ও তার সঙ্গী মেরি গ্রান্ট, * এডগার ক্লে, * রাবার্ট হেডলিংটন, কেটি রাবার্টস্‌, এডউইন স্কিনার * ও তার সঙ্গে পারসি চ্যাপম্যান ও জ্যাক নেথেন, * যারা দুজনেই সেখানকার কাজে সাহায্য করতে কানাডা গিয়েছিলেন।

“লক্ষ লক্ষ লোক যারা বেঁচে আছেন, কখনও মারা যাবেন না” নামে বাইবেলের বক্তৃতাটা আমাদের বিরাট এলাকায় খুবই সময়োপযোগী এক সাক্ষ্য ছিল। ১৯২২ সালের ১৪ই মে প্রাইস হিয়ুজের এক আত্মীয় স্ট্যানলি রোজরস্‌ এই বক্তৃতাটা দেওয়ার জন্য লিভারপুল থেকে চার্ক নামে এক গ্রামে এসেছিলেন, যেটা আমাদের শহর থেকে ঠিক উত্তরে ছিল এবং পরে সেই সন্ধ্যায় তিনি ওসওয়েসট্রির সিনেমা হলে সেই বক্তৃতাটা দিয়েছিলেন। বিশেষ করে ওই অনুষ্ঠানের জন্য ছাপানো হ্যান্ডবিলগুলোর একটা কপি এখনও আমার কাছে আছে। এই সময়ে আমাদের ছোট দলগুলো হারবার্ট সিনিয়র, আ্যলবার্ট লয়েড এবং জন ব্লানি নামে তিনজন ভ্রমণ অধ্যক্ষের পরিদর্শনে বিশ্বাসে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। সেই সময় ভ্রমণ অধ্যক্ষদের আমরা ভ্রমণকারী বলতাম।

সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়

১৯২৯ সালে আমি বাপ্তিস্ম নেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত নিই। আমার বয়স তখন ১৯ বছর এবং সেই সময়েই আমি প্রথম সত্যিসত্যি পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এক যুবকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যার বাবা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। আমরা একে অন্যের প্রেমে পড়ে যাই ও সে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এক বছর আগে সরকার (ইংরেজি) বইটা প্রকাশ হয়েছিল, তাই আমি এর একটা কপি তাকে দিই। কিন্তু খুব শীঘ্রিই আমি বুঝতে পারি, এই বইয়ের মূল বিষয় অর্থাৎ স্বর্গীয় সরকারের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। আমি আমার অধ্যয়ন থেকে জেনেছিলাম যে, প্রাচীন ইস্রায়েলীয়দেরকে আজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল তারা যেন কোন অবিশ্বাসীদেরকে বিয়ে না করে এবং এই নীতি আজকে খ্রীষ্টানদের প্রতিও প্রযোজ্য। তাই এটা করা যদিও খুবই কঠিন ছিল, তবুও আমি তার প্রস্তাবে না বলেছিলাম।—দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৩; ২ করিন্থীয় ৬:১৪.

আমি প্রেরিত পৌলের এই কথাগুলো থেকে শক্তি পেয়েছিলাম: “আইস, আমরা সৎকর্ম্ম করিতে করিতে নিরুৎসাহ না হই; কেননা ক্লান্ত না হইলে যথাসময়ে শস্য পাইব।” (গালাতীয় ৬:৯) প্রিয় ড্যান কাকুও আমাকে এই লিখে উৎসাহ দিয়েছিলেন: “পরীক্ষা ছোট বা বড় যাই হোক না কেন, রোমীয় ৮ অধ্যায় ২৮ পদ কাজে লাগাও,” যেখানে বলা হয়েছে: “আমরা জানি, যাহারা ঈশ্বরকে প্রেম করে, যাহারা তাঁহার সঙ্কল্প অনুসারে আহূত, তাহাদের পক্ষে সকলই মঙ্গলার্থে একসঙ্গে কার্য্য করিতেছে।” এটা যদিও সহজ ছিল না কিন্তু আমি জানতাম যে আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেই বছর আমি এক কল্পটর হিসেবে নাম লিখিয়েছিলাম।

কঠিন অবস্থাকে মোকাবিলা করা

১৯৩১ সালে, আমরা যিহোবার সাক্ষি এই নতুন নাম পেয়েছিলাম এবং সেই বছর রাজ্য, জগতের আশা (ইংরেজি) নামের পুস্তিকাটা নিয়ে উদ্যোগের সঙ্গে প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রত্যেক রাজনীতিবিদ, পাদরি ও ব্যবসায়িকে এর একটা করে কপি দেওয়া হয়েছিল। আমার এলাকা ছিল ওসওয়েসট্রি থেকে রেক্সাম পর্যন্ত, যেটা প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে ছিল। এই এলাকা পুরো শেষ করা সত্যিই খুব কঠিন ছিল।

পরের বছর বার্মিংহামে একটা সম্মেলনে ২৪ জন স্বেচ্ছাসেবককে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। উৎসাহের সঙ্গে আমরা ২৪ জন এই নতুন ধরনের পরিচর্যার জন্য নিজেদের নাম দিয়েছিলাম, যদিও জানতাম না যে কীধরনের কাজ। রাজ্য, জগতের আশা সেই একই পুস্তিকাটা বিতরণ করার জন্য দুজন করে ভাগ করে দুইদিকে ঝোলানো ভারী প্ল্যাকার্ড পরে যখন রাজ্যের বিষয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার কথা আমাদেরকে বলা হয়েছিল, তখন আমরা কতটা অবাক হয়েছিলাম তা একটু ভেবে দেখুন।

ক্যাথিড্রেলের সীমানায় কাজ করার সময় আমি কেমন যেন বিব্রত বোধ করতে থাকি কিন্তু নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিই যে, এই শহরের কেউ তো আমাকে চেনে না। কিন্তু, প্রথম যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে দেখা করে সে হল আমার স্কুলের এক পুরনো বান্ধবী, সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে চট করে বলে: “এইধরনের জামা পরে তুই এসব কী করছিস?” এই ঘটনাটা আমাকে আমার মধ্যে যে লোকভয় ছিল, তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল!

আরও দূরে যাওয়া

১৯৩৩ সালে জ্যানোয়ার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, যে একজন বিপত্নীক ও বয়সে আমার চেয়ে ২৫ বছরের বড় ছিল। তার প্রথম স্ত্রী একজন উদ্যোগী বাইবেল ছাত্রী ছিলেন এবং তার মৃত্যুর পরে জ্যানোয়া বিশ্বস্তভাবে তার কাজ করে গিয়েছিল। আমরা খুব শীঘ্রিই ইংল্যান্ড থেকে নিজেদের নূতন এলাকা নর্থ ওয়ল্‌সে চলে যাই, যেটা প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে ছিল। কাগজের বাক্স, সুটকেস ও আরও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র আমাদের সাইকেলের হ্যান্ডেলে, ক্রসবারে শক্ত করে আটকে দিই এবং পিছনের ক্যারিয়ার ভরতি করি, তবে শেষ পর্যন্ত আমরা নিরাপদে গন্তব্যে স্থলে গিয়ে পৌঁছাই! এই কাজে আমাদের সাইকেল ছিল অপরিহার্য কারণ এটাতে করে আমরা সব জায়গায় যেতে পারতাম, এমনকি ওয়েলশের প্রায় ৯০০ মিটার উঁচু ক্যাডের আইড্রিস পাহাড়ের প্রায় চূড়ার কাছেও যেতে পারতাম। “রাজ্যের এই সুসমাচার” শুনতে আগ্রহী ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া খুবই আনন্দ নিয়ে আসত।—মথি ২৪:১৪.

সেখানে যাওয়ার অল্প কিছুদিন পরই লোকেরা আমাদের বলে যে, টম প্রাইস নামে একজন ব্যক্তিও ঠিক আমাদের মতো তাদের কাছে প্রচার করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমরা ওয়েলশ্‌পুলের কাছে লংগ মাউন্টেনে টমকে খুঁজে পাই আর সেখানেই তিনি থাকতেন। তাকে দেখে কী অবাকই না আমরা হয়েছিলাম! আমি যখন প্রচার করতে শুরু করি সেই সময় পুনর্মিলিতকরণ (ইংরেজি) নামে বাইবেল অধ্যয়ন করার একটা বই তাকে দিয়েছিলাম। তিনি নিজে নিজেই এই বইটা পড়েছিলেন ও আরও সাহিত্যাদির জন্য লন্ডনে চিঠি লিখেছিলেন এবং সেই সময় থেকে তার নতুন বিশ্বাস সম্বন্ধে উদ্যোগের সঙ্গে লোকেদেরকে তিনি জানিয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় ধরে আমরা একে অন্যের সাহচর্য উপভোগ করি ও তিনজন পরস্পরকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রায় একসঙ্গে অধ্যয়ন করতাম।

এক দুর্ঘটনা আশীর্বাদ নিয়ে আসে

১৯৩৪ সালে নর্থ ওয়েলসের কাছেপিঠে যে সব কল্পটররা থাকতেন তাদের সবাইকে ধার্মিক শাসক (ইংরেজি) নামের পুস্তিকাটা বিতরণ করতে রেক্সাম শহরে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়। এই বিশেষ অভিযানের আগের দিন এক দুর্ঘটনা ঘটে, যা গোটা দেশকে প্রভাবিত করেছিল। রেক্সাম থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে গ্রেসফোর্ড কয়লা খনিতে একটা বিস্ফোরণ হওয়াতে সেখানকার ২৬৬ জন শ্রমিক মারা যায়। ২০০-রও বেশি বাচ্চা তাদের বাবাকে হারিয়েছিল এবং ১৬০ জন মহিলা বিধবা হয়ে গিয়েছিল।

আমরা শোকার্ত লোকেদের একটা তালিকা তৈরি করে ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে দেখা করি ও তাদের কাছে একটা করে পুস্তিকা ছেড়ে আসি। তাদের মধ্যে একজনের নাম আমাকে দেওয়া হয় আর তিনি ছিলেন মিসেস চডউইক, যিনি তার ১৯ বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়েছিলেন। আমি যখন তার কাছে গিয়েছিলাম, সেই সময় তার বড় ছেলে জ্যাক তার মাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিল। সেই যুবক আমাকে চিনতে পারে কিন্তু সে আমাকে তা বলেনি। পরে সে ওই পুস্তিকাটা পড়ে এবং শেষ যুদ্ধ (ইংরেজি) নামে অন্য পুস্তিকাটা খোঁজে, যেটা বেশ কয়েক বছর আগে আমি তাকে দিয়েছিলাম।

জ্যাক ও তার স্ত্রী মে, আমি কোথায় থাকি তা খুঁজে বের করে এবং আরও সাহিত্যাদি নেওয়ার জন্য সেখানে আসে। ১৯৩৬ সালে, রেক্সমে তাদের বাড়িতে সভা করার জন্য তারা রাজি হয়েছিল। ছমাস পরে আ্যলবার্ট লয়েডের পরিদর্শনের পর সেখানে একটা মণ্ডলী স্থাপিত হয় ও এর পরিচালক অধ্যক্ষ হন জ্যাক চডউইক। বর্তমানে রেক্সমে তিনটে মণ্ডলী আছে।

যাযাবরদের মতো ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে জীবন

এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে যেখানেই থাকার জায়গা পেয়েছি সেখানেই থেকেছি কিন্তু জ্যানোয়া ঠিক করে যে এখন আমাদের নিজের এমন একটা ঘর থাকা উচিত, যেটাকে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। আমার স্বামী একজন দক্ষ ছুতোর মিস্ত্রি ছিল আর এই দক্ষতা সে তার যাযাবর পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পেয়েছিল এবং সে আমাদের জন্য একটা ভ্রাম্যমাণ গাড়ি তৈরিও করেছিল। আমরা গাড়িটাকে এলিজাবেথ নাম দিয়েছিলাম আর এটা বাইবেলের একটা নাম যার মানে “প্রাচুর্যের ঈশ্বর।”

বিশেষ করে একটা জায়গার কথা আমার খুব ভাল মনে আছে যেখানে আমরা ছিলাম, সেই জায়গাটা ছিল একটা ফলবাগান আর তা নদীর ধারে ছিল। সেই জায়গাটা আমার জন্য পরমদেশের মতো ছিল! সেই গাড়িতে যদিও অল্প জায়গা ও আসবাবপত্র ছিল কিন্তু তবুও আমরা একসঙ্গে যত বছর সেটাতে কাটিয়েছি, কোন কিছুই আমাদের আনন্দকে নষ্ট করতে পারেনি। ঠাণ্ডার সময় বিছানার চাদরগুলোর ওপর বরফ জমে যেত ও গাড়ির দেওয়ালের সঙ্গে লেগে যেত এবং গাড়ির ভিতরে জল জমে যাওয়া রোজকার সমস্যা ছিল। কখনও কখনও অনেক দূর থেকে জল আনতে হতো কিন্তু আমরা এই সমস্যাকে একসঙ্গে কাটিয়ে উঠেছিলাম।

এক শীতের সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং আমাদের কাছে খুব অল্প খাবার ছিল আর কোন টাকাপয়সাও ছিল না। জ্যানোয়া বিছানায় বসে, তার হাতের ওপর আমার হাত নিয়ে গীতসংহিতা ৩৭:২৫ পদ পড়ে শোনায়: “আমি যুবক ছিলাম, এখন বৃদ্ধ হইয়াছি, কিন্তু ধার্ম্মিককে পরিত্যক্ত দেখি নাই, তাহার বংশকে খাদ্য ভিক্ষা করিতে দেখি নাই।” আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বলে: “যদি তাড়াতাড়ি কিছু না হয়, তাহলে আমাদের ভিক্ষা করতে হবে এবং আমার মনে হয় না যে, ঈশ্বর এমনটা হতে দেবেন!” তারপর সে প্রতিবেশীদের কাছে প্রচার করতে চলে যায়।

দুপুরে জ্যানোয়া যখন আমাকে পানীয় জাতীয় কিছু খাওয়ানোর জন্য ঘরে আসে, তখন তার জন্য একটা খাম অপেক্ষা করছিল। সেটার মধ্যে ৫০ পাউন্ড ছিল, যেটা তার বাবা পাঠিয়েছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে জ্যানোয়াকে টাকাপয়সা আত্মসাৎ করার মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল কিন্তু কিছুদিন আগে সে নির্দোষ বলে প্রমাণিত হয়। এই উপহারটা তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। কত উপযুক্ত সময়েই না তা এসেছিল!

এক উপকারজনক শিক্ষা

কখনও কখনও আমরা কোন একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার বেশ কয়েক বছর পর সেটার শিক্ষাটা বুঝতে পারি। উদাহরণস্বরূপ: ১৯২৭ সালে স্কুল ছাড়ার আগে আমি একজনকে ছাড়া ক্লাসের সব বন্ধুদের ও শিক্ষকদের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছিলাম। আর যাকে আমি কিছু জানাইনি তিনি ছিলেন আমার শিক্ষিকা লাভিনিয়া ফেয়ারক্লাফ। যেহেতু আমি আমার জীবন সম্বন্ধে কী পরিকল্পনা করেছি সেই বিষয়ে কেউ আগ্রহী ছিল না এবং আমার শিক্ষিকা ফেয়ারক্লাফের সঙ্গে আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল না, তাই আমি ঠিক করেছিলাম যে তার কাছে প্রচার করব না। প্রায় ২০ বছর পর আমার মা যখন আমাকে বলেন যে, ওই শিক্ষিকা তার সব পুরনো বন্ধু ও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলতে এসেছিলেন যে তিনি এখন একজন যিহোবার সাক্ষি, তখন আমি কত অবাক হয়েছিলাম ও আনন্দ পেয়েছিলাম সেই কথা একটু ভেবে দেখুন!

আমাদের যখন দেখা হয়, তখন তাকে আমি বলেছিলাম যে কেন আমি তাকে সেই সময় আমার বিশ্বাস ও ক্যারিয়ার সম্বন্ধে কিছু জানাইনি। তিনি চুপচাপ আমার কথা শুনে বলেছিলেন: “আমি সবসময়ই সত্য খুঁজছিলাম। আমার জীবনে এটাকেই আমি অনুসন্ধান করছিলাম!” এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য এক উপকারজনক শিক্ষা ছিল আর তা হল, যাদের সঙ্গেই আমার দেখা হয় তাদের কারও কাছে প্রচার করতে পিছুপা হব না এবং আগে থেকে কাউকে বিচার করব না।

আরেকটা যুদ্ধ ও এর পরের কিছু ঘটনা

১৯৩০ দশকের শেষ দিকে যুদ্ধের মেঘ আবার ঘনীভূত হতে থাকে। আমার ছোট ভাই ডেনিস, যে আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট তাকে সেনাবাহিনীর কাজ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এই শর্তে যে, সে তার চাকরি করে যাবে। সত্যের প্রতি কখনোই সে তেমন আগ্রহ দেখায়নি, তাই আমি ও আমার স্বামী সেখানকার অগ্রগামী রুপার্ট ব্রাডবারি ও তার ছোট ভাই ডেভিডকে, জিজ্ঞেস করি যে তারা আমার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন কি না। তারা দেখা করেন ও তার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯৪২ সালে ডেনিস বাপ্তিস্ম নেয় ও পরে অগ্রগামীর কাজ শুরু করে এবং ১৯৫৭ সালে তাকে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।

১৯৩৮ সালে আমাদের মেয়ে এলিজাবেথের জন্ম হয় এবং পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য জ্যানোয়া আমাদের গাড়িটাকে আরও বড় করে। ১৯৪২ সালে যখন আমাদের দ্বিতীয় মেয়ে ইউনিসের জন্ম হয়েছিল তখন একটা স্থায়ী ঘর খোঁজাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হয়েছিল। এই কারণে জ্যানোয়া কয়েক বছরের জন্য অগ্রগামীর কাজ বন্ধ করে দেয় এবং রেক্সামে আমরা এক ছোট্ট ঘরে থাকতে শুরু করি। পরে আমরা চেসাইরের কাছেপিঠে মিডলিজ শহরে স্থায়ীভাবে থাকা শুরু করি। সেখানে ১৯৫৬ সালে আমার প্রিয়তম স্বামী মারা যায়।

আমাদের দুমেয়েই পূর্ণ-সময়ের প্রচারিকা হয়েছে এবং দুজনেই বিয়ে করে সুখে আছে। ইউনিস ও তার স্বামী—যে একজন প্রাচীন—এখনও লন্ডনে বিশেষ অগ্রগামীর কাজ করে। এলিজাবেথেরব স্বামীও মণ্ডলীর একজন প্রাচীন এবং আমার জন্য এটা আনন্দের বিষয় যে তারা, তাদের ছেলেমেয়েরা ও আমার চারজন নাতিনাতনীদের ছেলেমেয়েরা ল্যাংকশিয়ারের প্রিসটনে আমার কাছাকাছি থাকে।

আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে, আমার আ্যপার্টমেন্ট থেকে হেঁটে হেঁটে আমি রাস্তার ওপারে কিংডম হলে যেতে পারি। কয়েক বছর ধরে আমি যে গুজরাটি ভাষী দলের সঙ্গে মেলামেশা করছি, তারাও এই কিংডম হলে আসেন। ওই ভাষা শেখা খুব সহজ নয় কারণ আমি এখন একটু কম শুনতে পাই। অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা যেভাবে চট করে কথার স্বরের সূক্ষ্মতাকে ধরতে পারে সেভাবে বোঝা আমার পক্ষে কখনও কখনও খুব কঠিন হয়। কিন্তু এই কঠিন কাজটা সত্যিই খুব আগ্রহজনক।

এখনও আমি ঘরে-ঘরে প্রচার করতে পারি ও আমার ঘরে বাইবেল অধ্যয়ন করতে পারি। বন্ধুরা যখন আমাকে দেখতে আসে সেই সময় আমার পুরনো অভিজ্ঞতাগুলো তাদের সঙ্গে বলে সত্যিই অনেক আনন্দ পাই। প্রায় ৯০ বছর ধরে যিহোবার লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি যে আশীর্বাদগুলো পেয়েছি, সেই অমূল্য স্মৃতিগুলোর জন্য আমি সত্যিই খুব কৃতজ্ঞ।

[পাদটীকাগুলো]

^ ১৯৬৩ সালের ১লা এপ্রিলের প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি)-এ প্রাইস হিয়ুজের জীবন কাহিনী, “বিশ্বস্ত সংগঠনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা” প্রকাশ হয়েছিল।

^ যিহোবার এই বিশ্বস্ত সেবকদের জীবন কাহিনী প্রহরীদুর্গ এর আগের প্রবন্ধগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে।

^ যিহোবার এই বিশ্বস্ত সেবকদের জীবন কাহিনী প্রহরীদুর্গ এর আগের প্রবন্ধগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে।

^ যিহোবার এই বিশ্বস্ত সেবকদের জীবন কাহিনী প্রহরীদুর্গ এর আগের প্রবন্ধগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে।

^ যিহোবার এই বিশ্বস্ত সেবকদের জীবন কাহিনী প্রহরীদুর্গ এর আগের প্রবন্ধগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে।

^ যিহোবার এই বিশ্বস্ত সেবকদের জীবন কাহিনী প্রহরীদুর্গ এর আগের প্রবন্ধগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে।

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

“লক্ষ লক্ষ লোক যারা বেঁচে আছেন, কখনও মারা যাবেন না” বক্তৃতাটার কথা যে হ্যান্ডবিলে জানানো হয়েছিল, সেই বক্তৃতাটা আমি ১৯২২ সালের ১৪ই মে শুনেছিলাম

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৩৩ সালে জ্যানোয়ার সঙ্গে বিয়ের কিছু সময় পর

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্বামীর তৈরি ভ্রাম্যমাণ গাড়ি “এলিজাবেথ” এর পাশে দাঁড়িয়ে