সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

নিষ্ঠাবান হওয়ার মানে কী?

নিষ্ঠাবান হওয়ার মানে কী?

নিষ্ঠাবান হওয়ার মানে কী?

 সাধারণ কাল পূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর যিহুদি খাসিদিমরা নিজেদেরকে প্রকৃত নিষ্ঠাবান বলে মনে করত। তাদের এই নাম এসেছে “নিষ্ঠা”-র জন্য ব্যবহৃত মূল ইব্রীয় শব্দ কাসিদ থেকে। এটা বিশেষ্য পদ কেসিদ থেকে নেওয়া হয়েছে, যেটাকে প্রায়ই “প্রেমপূর্ণ দয়া,” “একনিষ্ঠ প্রেম,” “দয়া,” “মঙ্গলভাব,” এবং “করুণা” হিসেবে অনুবাদ করা হয়। পুরনো নিয়মের ঈশ্বরতাত্ত্বিক শব্দকোষ (ইংরেজি) অনুসারে, কেসিদ “সক্রিয়ভাবে কিছু করা, পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ও সহ্য করাকে বোঝায় [এবং] তা শুধু মানুষের মধ্যে এই মনোভাব থাকাই নয় কিন্তু এই মনোভাবের জন্য করা কাজকেও বোঝায়। এই কাজ জীবনকে রক্ষা করে বা জীবনে উন্নতি নিয়ে আসে। দুর্দশা বা যন্ত্রণা ভোগ করছে এমন ব্যক্তির প্রতি হস্তক্ষেপ করা। এটা বন্ধুত্বের এক নিদর্শন।”

এটা স্পষ্ট যে, বাইবেলে এই ইব্রীয় শব্দটাকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, অনেক ভাষায় কোন শব্দই এটার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত পুরো অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। যে কোনভাবেই হোক, বাইবেলের ভাষায় নিষ্ঠার অর্থ বিশ্বস্ততার সঙ্গে কথা রাখার চেয়ে আরও বেশি কিছু। এর মানে অন্যদের উপকার করার জন্য প্রেমপূর্ণ অনুরাগ ও সেইসঙ্গে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া। প্রকৃত নিষ্ঠার মানে কী তা বোঝার জন্য অব্রাহাম, মোশি, দায়ূদ, ইস্রায়েল জাতি ও সমস্ত মানবজাতির প্রতি যিহোবা তা কীভাবে দেখিয়েছিলেন, তা বিবেচনা করে দেখুন।

যিহোবা নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন

যিহোবা তাঁর বন্ধু অব্রাহামকে বলেছিলেন: “আমিই তোমার ঢাল।” (আদিপুস্তক ১৫:১; যিশাইয় ৪১:৮) এই কথাগুলো যিহোবা শুধু মুখেই বলেননি। অব্রাহাম ও তার পরিবারকে ফরৌণ ও অবীমেলকের হাত থেকে যিহোবা রক্ষা করেছিলেন। তিনি চার জন রাজার চক্রান্ত থেকে লোটকে উদ্ধার করার জন্য অব্রাহামকে সাহায্য করেছিলেন। ১০০ বছর বয়সী অব্রাহাম ও ৯০ বছর বয়সী সারার সন্তান জন্ম দেওয়ার শক্তিকে যিহোবা আবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে তাদের মাধ্যমে প্রতিজ্ঞাত বীজ আসতে পারে। দর্শন, স্বপ্ন ও দূতেদের মাধ্যমে অব্রাহামের সঙ্গে যিহোবা নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। আসলে, অব্রাহাম যখন জীবিত ছিলেন এবং তিনি মারা যাওয়ার অনেক পরেও যিহোবা তাঁর প্রতি নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। শত শত বছর ধরে অব্রাহামের বংশধর, ইস্রায়েল জাতির স্বেচ্ছাচারিতা সত্ত্বেও, যিহোবা তাদের প্রতি তাঁর প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। অব্রাহামের সঙ্গে যিহোবার সম্পর্ক দেখিয়েছিল যে, প্রকৃত নিষ্ঠার মানে কী আর তা হল প্রেমকে কাজে পরিণত করা।—আদিপুস্তক ১২ থেকে ২৫ অধ্যায়।

এইরকম বলা হতো যে, “মনুষ্য যেমন মিত্রের সহিত আলাপ করে, তদ্রূপ সদাপ্রভু মোশির সহিত সম্মুখাসম্মুখি হইয়া আলাপ করিতেন।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (যাত্রাপুস্তক ৩৩:১১) সত্যিই, যীশু খ্রীষ্টের আগে অন্য কোন ভাববাদীর চেয়ে মোশির সঙ্গে যিহোবার সবচেয়ে কাছের সম্পর্ক ছিল। মোশির প্রতি যিহোবা কীভাবে নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন?

শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ৪০ বছর বয়স্ক মোশি, অহংকার করে নিজে নিজেই তার লোকেদের মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, তখনও সেই সময় আসেনি। তাই তার জীবন বাঁচাতে তাকে পালাতে হয়েছিল। ৪০ বছর ধরে তিনি মিদিয়নে মেষ পালন করেছিলেন। (প্রেরিত ৭:২৩-৩০) কিন্তু, যিহোবা তাকে পরিত্যাগ করেননি। যখন উপযুক্ত সময় আসে, তখন মোশির নেতৃত্বে ইস্রায়েলকে মিশর থেকে বের করে আনার জন্য তাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল।

একইভাবে, ইস্রায়েলের দ্বিতীয় বিখ্যাত রাজা দায়ূদের প্রতি যিহোবা নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। দায়ূদ যখন যুবক ছিলেন, তখন ভাববাদী শমূয়েলকে যিহোবা বলেছিলেন: “উঠ, ইহাকে অভিষেক কর, কেননা এ সেই ব্যক্তি।” সেই সময় থেকে যিহোবা দায়ূদকে নিষ্ঠার সঙ্গে রক্ষা করে ও পরিচালনা দিয়ে এসেছেন, যতক্ষণ না তিনি সম্পূর্ণ ইস্রায়েলের ভাবী রাজা হিসেবে পরিপক্ব হয়ে ওঠেন। যিহোবা তাকে “সিংহের থাবা ও ভল্লুকের থাবা হইতে” এবং পলেষ্টীয় বীর গলিয়াতের হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনি দায়ূদকে ইস্রায়েলের শত্রুদের ওপর একটার পর একটা জয় এনে দিয়েছিলেন এবং হিংসা ও ঘৃণায় ভরা শৌলের বড়শা থেকে দায়ূদকে বাঁচিয়েছিলেন।—১ শমূয়েল ১৬:১২; ১৭:৩৭; ১৮:১১; ১৯:১০.

অবশ্য, দায়ূদ একজন সিদ্ধ ব্যক্তি ছিলেন না। সত্যি বলতে কী, তিনি গুরুতর পাপ করেছিলেন। কিন্তু, যিহোবা তাকে পরিত্যাগ না করে বরং গভীরভাবে অনুতপ্ত দায়ূদের প্রতি নিষ্ঠাপূর্ণ প্রেম দেখিয়েছিলেন। দায়ূদের সারা জীবনে যিহোবা বারবার তাকে রক্ষা করেছিলেন ও তার জীবনে উন্নতি এনে দিয়েছিলেন। দুর্দশা ভোগ করছেন এমন একজন ব্যক্তির প্রতি তিনি হস্তক্ষেপ করেছিলেন। সত্যিই এটা ছিল প্রেমপূর্ণ দয়া!—২ শমূয়েল ১১:১-১২:২৫; ২৪:১-১৭.

পুরো ইস্রায়েল জাতি যখন সীনয় পর্বতে দেওয়া মোশির ব্যবস্থার নিয়মগুলোকে মেনে নিতে একমত হয়েছিল, তখন তারা যিহোবার কাছে উৎসর্গীকৃত জাতি হিসেবে এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিল। (যাত্রাপুস্তক ১৯:৩-৮) তাই, ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে যিহোবার এক বৈবাহিক সম্পর্ক আছে বলে বর্ণনা করা হয়। ইস্রায়েল জাতিকে বলা হয়েছিল: “সদাপ্রভু তোমাকে . . . স্ত্রীর ন্যায় . . . ডাকিয়াছেন।” আর ওই জাতিকে যিহোবা বলেছিলেন: “অনন্তকালস্থায়ী দয়াতে [“প্রেমপূর্ণ দয়া,” NW] তোমার প্রতি করুণা করিব।” (যিশাইয় ৫৪:৬, ৮) এই বিশেষ সম্পর্কে যিহোবা কীভাবে নিষ্ঠা দেখিয়েছিলেন?

ইস্রায়েলীয়দের চাহিদাগুলো পূরণ করার এবং তাঁর সঙ্গে তাদের বন্ধনকে আরও মজবুত করার জন্য যিহোবা নিজে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি তাদেরকে মিশর থেকে উদ্ধার করেছিলেন, একটা জাতি হিসেবে সংগঠিত করেছিলেন এবং তাদেরকে “দুগ্ধমধুপ্রবাহী দেশে” নিয়ে এসেছিলেন। (যাত্রাপুস্তক ৩:৮) যাজক, লেবীয়দের এবং যারাই ভাববাদী ও বার্তাবাহকের উত্তরাধিকারী হয়েছেন তাদের মাধ্যমে তিনি নিয়মিত আধ্যাত্মিক নির্দেশনা জুগিয়েছিলেন। (২ বংশাবলি ১৭:৭-৯; নহিমিয় ৮:৭-৯; যিরমিয় ৭:২৫) এই জাতি যখন অন্য দেবতাদেরকে সেবা করতে শুরু করেছিল, তখন যিহোবা তাদেরকে শুধরেছিলেন। তারা যখন অনুতপ্ত হয়েছিল, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করেছিলেন। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ‘স্ত্রী’ ইস্রায়েল জাতিকে সামলানো কঠিন ছিল। কিন্তু তবুও যিহোবা সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে পরিত্যাগ করেননি। অব্রাহামের কাছে করা তাঁর প্রতিজ্ঞার কারণে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তাঁর উদ্দেশ্যগুলো পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ইস্রায়েলীয়দের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। (দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৭-৯) আজকের দিনের বিবাহিত লোকেদের জন্য কত চমৎকার উদাহরণ!

এছাড়াও, যিহোবা ধার্মিক ও অধার্মিক সমস্ত মানুষের জন্য জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো জুগিয়ে সমস্ত মানবজাতির প্রতি নিষ্ঠা দেখান। (মথি ৫:৪৫; প্রেরিত ১৭:২৫) এর চেয়েও বড় কথা, তিনি তাঁর পুত্রের বলিদানের মাধ্যমে মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা করেছেন, যাতে সমস্ত মানবজাতি পাপ ও মৃত্যুর দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে পারে এবং পরমদেশ পৃথিবীতে সিদ্ধ অবস্থায় অনন্ত জীবন উপভোগ করার গৌরবময় আশা লাভ করতে পারে। (মথি ২০:২৮; যোহন ৩:১৬) মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থা ছিল জীবন রক্ষা করার ও উন্নতি এনে দেওয়ার চূড়ান্ত উপায়। সত্যিই এটা ছিল “দুর্দশা বা যন্ত্রণা ভোগ করছে এমন ব্যক্তির প্রতি হস্তক্ষেপ করা।”

বাস্তব পদক্ষেপগুলো নিয়ে আপনার নিষ্ঠা প্রমাণ করুন

প্রেমপূর্ণ দয়া শব্দটার সঙ্গে নিষ্ঠা কথার মিল রয়েছে তাই নিষ্ঠা বলতে পরস্পরের মধ্যে দেওয়া-নেওয়াকে বোঝায়। আপনার প্রতি যদি প্রেমপূর্ণ দয়া দেখানো হয়, তাহলে এর বিনিময়ে একইরকম ব্যবহার আশা করা হতে পারে। নিষ্ঠার বদলে নিষ্ঠা দেখানো যায়। আসলে দায়ূদ কেসিদ এই শব্দের সঙ্গে জড়িত অর্থগুলোকে বুঝতে পেরেছিলেন, তা তার এই কথাগুলো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়: “তব পবিত্র মন্দিরের অভিমুখে প্রণিপাত করিব . . . তোমার নামের স্তব করিব।” কেন? “তব দয়া [“প্রেমপূর্ণ দয়া,” NW] ও তব সত্য প্রযুক্ত।” (গীতসংহিতা ১৩৮:২) যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়া পেয়েছিলেন বলেই দায়ূদ নিশ্চয়ই তাঁকে উপাসনা ও প্রশংসা করতে পরিচালিত হয়েছিলেন। তাই, আমাদের প্রতি যিহোবা যে প্রেমপূর্ণ দয়া দেখিয়েছেন সেটা নিয়ে যখন আমরা চিন্তা করি, তখন আমরাও কি নিষ্ঠা দেখাতে পরিচালিত হই? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যিহোবার নামের ওপর যদি নিন্দা আসে, তাহলে তাঁর সুনাম রক্ষা করার চিন্তা কি আপনাকে তাঁর পক্ষে কথা বলতে প্রেরণা দেয়?

সত্যে নতুন একজন খ্রীষ্টান ভাই ও তার স্ত্রীর বেলায় এমনটা হয়েছিল, যখন তারা তাদের একজন আত্মীয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, যিনি এক মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। এটা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না আর উপস্থিত প্রত্যেককে মৃত ব্যক্তির সম্বন্ধে কিছু বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। একজন বক্তা এই যুবক ব্যক্তির আকস্মিক মৃত্যুর জন্য ঈশ্বরকে দোষ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর চেয়েছেন যেন তিনি স্বর্গে থাকেন, তাই তিনি তাকে স্বর্গে নিয়ে গেছেন।’ আমাদের খ্রীষ্টান ভাই আর চুপ থাকতে পারেননি। যদিও তার কাছে বাইবেল বা কোন নোট ছিল না, তবুও তিনি মঞ্চে চলে যান। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনাদের কি মনে হয় যে, একজন করুণাময়, সহানুভূতিশীল, সর্বশক্তিমান ঈশ্বর এইরকম কিছু ঘটতে অনুমতি দেবেন?” এরপর তিনি শাস্ত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে দশ মিনিটের একটা বক্তৃতা দেন, যেটার জন্য তার আগে থেকে কোন প্রস্তুতি ছিল না ও কেন আমরা মারা যাই, মৃত্যু থেকে মানবজাতিকে উদ্ধার করার জন্য ঈশ্বর কী করেছেন এবং পরমদেশ পৃথিবীতে পুনরুত্থানের পর অনন্ত জীবনের এক চমৎকার আশা সম্বন্ধে তিনি ব্যাখ্যা করেন। এই কথা শুনে সেখানে উপস্থিত ১০০ জনেরও বেশি লোক অনেক সময় ধরে হাততালি দিয়েছিলেন। ওই ভাই পরে মনে করে বলেছিলেন: “আমি মনে মনে এতটা আনন্দ পেয়েছিলাম, যা এর আগে কখনও পাইনি। আমাকে তাঁর প্রজ্ঞায় জ্ঞানবান করার জন্য এবং তাঁর পবিত্র নামের পক্ষে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলাম।”

যিহোবার প্রতি নিষ্ঠা থাকা মানে, তাঁর বাক্য বাইবেলের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখা। কেন? কারণ বাইবেলের পাতায় পাতায় যিহোবা আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে, কীভাবে বেঁচে থাকতে হয়। সেখানে যে ব্যবস্থা ও নীতিগুলো রয়েছে সেগুলো সত্যিই জীবনের জন্য সর্বোত্তম ও সবচেয়ে উপকারী। (যিশাইয় ৪৮:১৭) অন্যদের কাছ থেকে কোন চাপ বা নিজের কোন দুর্বলতা যেন আপনাকে যিহোবার ব্যবস্থার প্রতি লেগে থাকার ক্ষেত্রে বাধা না দেয়। ঈশ্বরের বাক্যের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখুন।

ঈশ্বরের প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা মানে তাঁর সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখা। বছরের পর বছর ধরে প্রয়োজন মতো নির্দিষ্ট কিছু শাস্ত্র বোঝার ব্যাপারে আমাদের কিছু সংশোধনের ও রদবদলের দরকার হয়েছে। কিন্তু আসল বিষয়টা হল আমরা যতটা আধ্যাত্মিক খাবার পেয়ে থাকি, এইরকম আর কেউ পায় না। (মথি ২৪:৪৫-৪৭) কোন সন্দেহ নেই যে, যিহোবা তাঁর বর্তমান দিনের সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠাবান আছেন। আমরাও কি তা-ই থাকতে পারি না? এ. এইচ. ম্যাকমিলান থেকেছিলেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তিনি বলেছিলেন: “১৯০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তেইশ বছর বয়সে আমি যখন ঈশ্বরের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলাম, সেই সময় থেকে যিহোবার সংগঠন একেবারে ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে সারা পৃথিবী এক সুখী লোকেদের সমাজে যেভাবে পরিণত হয় তা দেখেছি, যারা উদ্যোগের সঙ্গে তাঁর সত্য ঘোষণা করছে। . . . আমি যখন দেখি যে পৃথিবীতে ঈশ্বরের প্রতি আমার সেবার কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে, তখন আমি আগের চেয়ে আরও বেশি দৃঢ় হয়েছি যে, যিহোবা তাঁর লোকেদেরকে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং তাদের যা যা দরকার তা উপযুক্ত সময়ে দিয়েছেন।” ভাই ম্যাকমিলান ১৯৬৬ সালের ২৬শে আগস্ট তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বিশ্বস্তভাবে ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রায় ৬৬ বছর সেবা করে গেছেন। তিনি ঈশ্বরের দৃশ্যত সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠার এক উত্তম উদাহরণ ছিলেন।

সংগঠনের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখা ছাড়াও আমরা কি একে অন্যের প্রতি নিষ্ঠাবান হব? নির্মম তাড়নার হুমকির মুখোমুখি হলেও আমরা কি আমাদের ভাইবোনদের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেদারল্যান্ডে আমাদের ভাইয়েরা নিষ্ঠা বজায় রাখার এক সুন্দর উদাহরণ রেখেছিলেন। গ্রোনিনগেন মণ্ডলীর একজন প্রাচীন ক্লাস ডি ভ্রিস নাৎসি গোয়েন্দা পুলিশদের নিষ্ঠুর ও নির্দয় জেরার শিকার হয়েছিলেন, ১২ দিন ধরে শুধু একটু রুটি ও জল দিয়ে তাকে একাকী বন্দি করে রাখা হয়েছিল এবং পরে আবারও তাকে জেরা করা হয়েছিল। তার দিকে পিস্তল ঠেকিয়ে ও মৃত্যুর হুমকি দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ভাইয়েরা কোথায় আছেন ও সেইসঙ্গে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য জানানোর জন্য তাকে দুমিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উত্তরে ক্লাস শুধু এটুকুই বলেছিলেন: “আমার মুখ থেকে আপনারা এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলাতে পারবেন না। . . . আমি বিশ্বাসঘাতকতা করব না।” পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে তিনবার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গোয়েন্দা পুলিশরা হাল ছেড়ে দিয়েছিল ও ক্লাসকে অন্য আরেকটা জেলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তিনি কখনও তার ভাইদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি।

আমরা কি আমাদের নিকটতম আত্মীয়—আমাদের বিবাহ সঙ্গীর প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখব? যিহোবা যেমন তাঁর চুক্তির লোক ইস্রায়েল জাতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে সম্মান দেখিয়েছিলেন, তেমনই আমরা কি আমাদের বিয়ের অঙ্গীকারগুলোর প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখি? আপনার সঙ্গীর প্রতি শুধু বিশ্বস্ত থাকাই নয় কিন্তু তার সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখুন। বিয়েকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপনি নিজে পদক্ষেপ নিন। একসঙ্গে সময় কাটান, একে অন্যের সঙ্গে সবসময় কথা বলুন ও খোলাখুলিভাবে কথা বলুন, একে অন্যকে সাহায্য করুন ও উৎসাহ দিন, একে অন্যের কথা শুনুন, সুখদুঃখের সময়গুলোতে একসঙ্গে থাকুন, একসঙ্গে মজা করুন, মিলিতভাবে যে লক্ষ্যগুলো রেখেছেন সেগুলোতে পৌঁছানোর জন্য একসঙ্গে কাজ করুন, একে অন্যকে খুশি করুন, দুজনে দুজনার বন্ধু হোন। অন্য কারও প্রতি রোমান্টিক অনুভূতি গড়ে তোলার ব্যাপারে সাবধান হোন। বিয়ের বাইরে অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও এমনকি অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যদিও উপযুক্ত ও তাতে দোষের কিছু নেই কিন্তু রোমান্টিক অনুভূতি শুধু আপনার বিবাহ সঙ্গীর প্রতিই থাকা উচিত। আপনার ও আপনার সঙ্গীর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের মাঝে অন্য আর কাউকে আসতে দেবেন না।—হিতোপদেশ ৫:১৫-২০.

আপনার বিশ্বাসী বন্ধুবান্ধবদের ও আপনার পরিবারের সদস্যদের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখুন। সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে ভুলে যাবেন না। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, চিঠি লিখুন, ফোন করুন, তাদের কাছে বেড়াতে যান। জীবনে যে কোন পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তাদেরকে দুঃখ দেবেন না। এমন ব্যবহার করুন যেন তারা এই কথা বলে আনন্দ পায় যে, তারা আপনাকে চেনে ও আপনার আত্মীয়। তাদের প্রতি নিষ্ঠা বজায় রাখা আপনাকে যা সঠিক, তা করার জন্য শক্তিশালী করবে এবং তা আপনার জন্য উৎসাহের এক উৎস হবে।—ইষ্টের ৪:৬-১৬.

হ্যাঁ, প্রকৃত নিষ্ঠা বলতে মূল্যবান সম্পর্ককে বজায় রাখার জন্য বাস্তব পদক্ষেপগুলো নেওয়াকে বোঝায়। যিহোবার প্রেমপূর্ণ দয়ার প্রতিদানে আপনি যা কিছু করতে পারেন, তা-ই করুন। খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীর, আপনার বিবাহসঙ্গীর, পরিবারের সদস্যদের ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি ব্যবহার করার সময় যিহোবার নিষ্ঠাকে অনুকরণ করুন। যিহোবার সদ্‌গুণের কথা আপনার প্রতিবেশীদের কাছে নিষ্ঠার সঙ্গে ঘোষণা করুন। উপযুক্তভাবেই গীতরচক এই কথাগুলো বলেছিলেন: “আমি চিরকাল সদাপ্রভুর বহুবিধ দয়া [“প্রেমপূর্ণ দয়া,” NW] গাহিব, আমি নিজ মুখে তোমার বিশ্বস্ততা পুরুষপরম্পরার কাছে ব্যক্ত করিব।” (গীতসংহিতা ৮৯:১) এইধরনের এক ঈশ্বরের কাছে কি আমরা আসতে চাই না? সত্যি “তাঁহার দয়া [“প্রেমপূর্ণ দয়া,” NW] অনন্তকালস্থায়ী।”—গীতসংহিতা ১০০:৫.

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

এ. এইচ. ম্যাকমিলান