যিহোবার সেবায় এক সমৃদ্ধ জীবন
জীবন কাহিনী
যিহোবার সেবায় এক সমৃদ্ধ জীবন
বলেছেন রাসেল কারজেন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দিয়ে সেই উল্লেখযোগ্য যুগটা শুরু হওয়ার সাত বছর আগে অর্থাৎ ১৯০৭ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর আমার জন্ম হয়। আমাদের পরিবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল। আমাদের ইতিহাস সম্বন্ধে কিছুটা আপনি শুনলে, আমার মনে হয় আপনিও আমার সঙ্গে একমত হবেন।
একটা ছোট্ট মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, ঠাকুমা কারজেন ইতিমধ্যেই ঈশ্বর সম্বন্ধে সত্য খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কৈশরে পা দেওয়ার আগে, তিনি তার নিজের প্রাণবন্ত শহর, সুইজারল্যান্ডের স্পিজের বিভিন্ন গির্জায় যান। তার বিয়ের কিছু বছর পর, ১৮৮৭ সালে, কারজেন পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করার জন্য অভিবাসীদের দলের সঙ্গে সেখানে গিয়েছিলেন।
ওহাইওতে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করার পর, প্রায় ১৯০০ সালে, ঠাকুমা সেই সম্পদটা খুঁজে পান যেটাকে তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। জার্মান ভাষায় লেখা চার্লস টেইজ রাসেলের সময় সন্নিকট (ইংরেজি) নামক বইয়ে তিনি সেটা খুঁজে পান। শীঘ্রিই তিনি বুঝতে পারেন যে, সেই বইয়ে তিনি যা পড়েছেন তার মধ্যেই বাইবেলের সত্যের আলো রয়েছে। যদিও ঠাকুমা তেমন ভালভাবে ইংরেজি পড়তে পারতেন না তবুও, তিনি ইংরেজি প্রহরীদুর্গ পত্রিকার গ্রাহক হন। এভাবে তিনি বাইবেলের অন্যান্য সত্য সম্বন্ধে জানতে পারেন ও সেইসঙ্গে ইংরেজি ভাষাও শিখে ফেলেন। কিন্তু, আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোর ব্যাপারে ঠাকুরদা কখনোই তার স্ত্রীর মতো আগ্রহ দেখাননি।
ঠাকুমার ১১ জন ছেলেমেয়েদের মধ্যে দুই ছেলে, জন ও আ্যডল্ফ, তার খুঁজে পাওয়া আধ্যাত্মিক সম্পদের প্রতি উপলব্ধি দেখিয়েছিলেন। আমার বাবাই ছিলেন জন আর তিনি ১৯০৪ সালে মিসৌরীর সেন্ট লুইসে বাইবেল ছাত্রদের সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন। সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা এই নামে পরিচিত ছিলেন। যেহেতু অধিকাংশ বাইবেল ছাত্র গরিব ছিলেন, তাই সেন্ট লুইসে যখন ওয়ার্ল্ডস্ ফেয়ার হয়, তখন ওই সম্মেলন
রাখা হয়েছিল কারণ ওই সময়ে ট্রেনের ভাড়া কমিয়ে দেওয়ার বিশেষ সুযোগ থাকত। পরে, ১৯০৭ সালে, আমার কাকা আ্যডল্ফ নিউ ইয়র্কের নায়েগ্রা ফলস্ শহরের সম্মেলনে বাপ্তিস্ম নেন। আমার বাবা ও কাকা, বাইবেল থেকে যা শিখেছিলেন উদ্যোগের সঙ্গে তা প্রচার করেছিলেন আর শেষে দুজনেই পূর্ণ-সময়ের পরিচারক হয়েছিলেন (এখন অগ্রগামী বলা হয়)।তাই, ১৯০৭ সালে যখন আমার জন্ম হয়, তখন আমার পরিবার ইতিমধ্যেই বলতে গেলে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ ছিল। (হিতোপদেশ ১০:২২) ১৯০৮ সালে আমার বাবামা জন ও আইডা আমাকে নিয়ে যখন ওহাইওর পুট-ইন-বেতে “বিজয়ের দিকে” নামক সম্মেলনে যান, সেই সময় আমি একেবারে বাচ্চা ছিলাম। সেই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন জোসেফ এফ. রাদারফোর্ড, যিনি সেই সময়ে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষের কাজ করছিলেন। এর কয়েক সপ্তা আগে, তিনি ওহাইওর ডালটনে গিয়েছিলেন যেখানে তিনি আমাদের বাড়িতে আসেন ও স্থানীয় বাইবেল ছাত্রদের উদ্দেশে কয়েকটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
অবশ্য, সেই ঘটনাগুলোর কথা আমার মনে নেই কিন্তু ১৯১১ সালে মেরিল্যান্ডের, মাউন্টেন লেক পার্কে যে সম্মেলন হয়েছিল সেটার কথা আমার মনে আছে। সেখানে আমি ও আমার ছোট বোন এস্টার, চার্লস টেইজ রাসেলের সঙ্গে দেখা করেছিলাম, যিনি বাইবেল ছাত্রদের পৃথিবীব্যাপী প্রচার কাজগুলোর দেখাশোনা করতেন।
১৯১৪ সালের ২৮শে জুন, যে দিন সারাজেভোয় আর্চডিউক ফার্দিনান্দ ও তার স্ত্রীকে গুপ্তভাবে হত্যা করার কারণে সারা বিশ্বে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই দিনে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে ওহাইওর কলম্বাসে এক শান্তিপূর্ণ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলাম। সেই ছোটবেলা থেকেই যিহোবার লোকেদের বহু সম্মেলনগুলোতে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। কিছু সমাবেশ মাত্র একশ জন অথবা তার কিছু বেশি লোকেদের নিয়ে সংগঠিত হতো। এছাড়া অন্যান্য সমাবেশগুলো বড় আকারে ছিল, যেগুলো বিশ্বের বৃহত্তম স্টেডিয়ামগুলোর কয়েকটাতে হতো।
উপযুক্ত জায়গায় আমাদের বাড়ি
প্রায় ১৯০৮ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত, আমাদের বাড়ি পেনসিলভেনিয়ার পিটস্বার্গ ও ওহাইওর ক্লিভল্যান্ডের মাঝামাঝিতে অবস্থিত ডালটনে ছিল। আর সেখানে বাইবেল ছাত্রদের একটা ছোট মণ্ডলীর সভাগুলো হতো। আমাদের বাড়ি, অনেক ভ্রাম্যমাণ বক্তাদের জন্য এক ধরনের অতিথিসেবার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। আমাদের গোলাঘরের পিছনে তারা তাদের ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়িগুলো বেঁধে রাখতেন আর সেখানে যারা একত্রিত হতেন তাদেরকে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য আধ্যাত্মিক সত্যগুলো জানাতেন। সেগুলো কত উৎসাহের সময়ই না ছিল!
বাবা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক কিন্তু তিনি সবাইকে সর্বমহান
শিক্ষা দেওয়ার জন্যই বেশি আগ্রহী ছিলেন আর সেটা হল খ্রীষ্টীয় পরিচর্যা। তিনি তার পরিবারকে যিহোবার সম্বন্ধে শিক্ষা দিতেন আর প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা পরিবারগতভাবে একসঙ্গে প্রার্থনা করতাম। ১৯১৯ সালের বসন্তকালে, বাবা আমাদের ঘোড়া ও ঘোড়ার গাড়িটা বিক্রি করে দেন আর ১৭৫ ডলার দিয়ে ১৯১৪ ফোর্ড ব্যান্ডের একটা গাড়ি কেনেন, যাতে তিনি আরও বেশি লোকেদের কাছে প্রচার করতে পারেন। ১৯১৯ এবং ১৯২২ সালে সেই গাড়িতে করে আমরা ওহাইওর সিডার পয়েন্টে বাইবেল ছাত্রদের উল্লেখযোগ্য সম্মেলনগুলোতে গিয়েছিলাম।আমাদের পরিবারের সকলে অর্থাৎ মা, বাবা, এস্টার, আমার ছোট ভাই জন এবং আমি লোকেদের কাছে প্রচার কাজে অংশ নিয়েছিলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে প্রথমবার একজন গৃহকর্তা আমাকে বাইবেল থেকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলেন। তখন আমার বয়স প্রায় সাত বছর ছিল। সেই গৃহকর্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আরমাগিদোন মানে কী, বাবা?” বাবার কাছ থেকে একটু সাহায্য নিয়ে আমি তাকে বাইবেল থেকে উত্তর দিতে পেরেছিলাম।
পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা কাজ শুরু করা
১৯৩১ সালে, আমাদের পরিবারের সবাই ওহাইওর কলম্বাসের সম্মেলনে গিয়েছিলাম, যেখানে যিহোবার সাক্ষি নামটা গ্রহণ করতে পেরে আমরা খুবই রোমাঞ্চিত হই। জন এতটাই রোমাঞ্চিত হয়েছিল যে সে ঠিক করে ফেলেছিল যে সে ও আমি অগ্রগামীর কাজ শুরু করব। * আমরা দুজনে ও সেইসঙ্গে মা, বাবা ও এস্টারও তাই করেছিল। কত বড় সম্পদই না আমাদের ছিল—ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচারের আনন্দপূর্ণ কাজে একতাবদ্ধ এক পরিবার! এই আশীর্বাদের জন্য আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিতে কখনও ভুলে যাই না। যদিও আমরা খুব সুখী ছিলাম কিন্তু আমাদের জন্য আরও আনন্দ অপেক্ষা করে ছিল।
১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, আমি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে (যেটাকে বেথেল বলা হয়) কাজ শুরু করি। কয়েক সপ্তা পরে জন সেখানে আমার সঙ্গে যোগ দেয়। ১৯৫৩ সালে, সে তার প্রিয়তমা স্ত্রী জেসিকে বিয়ে করার আগে পর্যন্ত আমরা দুজনে একসঙ্গে থাকতাম।
জন ও আমি বেথেলে যাওয়ার পর, বাবামা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অগ্রগামী কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন আর এস্টার ও তার স্বামী জর্জ রিড তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। ১৯৬৩ সালে পৃথিবীতে তাদের জীবন শেষ করার আগে পর্যন্ত বাবামা অগ্রগামীর কাজ করে গেছেন। এস্টার ও তার স্বামী এক সুন্দর পরিবার গড়ে তুলেছে আর অনেক ভাগনে-ভাগনিদের পেয়ে আমি আশীর্বাদ পেয়েছি, যাদেরকে আমি খুব ভালবাসি।
বেথেলে কাজ ও মেলামেশা করা
বেথেলে জন তার প্রযুক্তি দক্ষতাকে কাজে লাগায় এবং আরও অন্যান্য বেথেলকর্মীদের সঙ্গে পোর্টেবল ফনোগ্রাফ তৈরির প্রকল্পে একসঙ্গে কাজ করে। হাজার হাজার যিহোবার সাক্ষিরা তাদের ঘরে-ঘরে পরিচর্যার কাজে এগুলোকে ব্যবহার করতেন। এছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে গ্রাহকদের কাছে যে পত্রিকাগুলো ডাকে পাঠানো হয় সেগুলোকে মোড়ানো ও লেবেল করার মেশিনের নকশা আঁকা ও তৈরি করার কাজেও জন সাহায্য করেছিল।
বই বাঁধানোর কাজ দিয়ে আমার বেথেল পরিচর্যা শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে ফ্যাক্টরিতে অন্যান্য যে যুবকদের সঙ্গে আমি কাজ করেছিলাম তারা এখনও বিশ্বস্তভাবে বেথেলে কাজ করছেন। তারা হলেন ক্যারি বারবার এবং রবার্ট হাজফেল্ড। অন্যান্যদের মধ্যে যাদেরকে আমার খুব মনে পড়ে অথচ যারা মারা গেছেন তারা হলেন, নেথেন নর, কার্ল ক্লাইন, লিম্যান সুইংগেল, ক্লস জেনসেন, গ্র্যান্ট সুইটার, জর্জ গানগাস, ওরিন হিবার্ড, জন সিওরাস, রবার্ট পেইন, চার্লস ফেকেল, বেন্নো বারকিক ও জন পেরি। তারা বছরের পর বছর ধরে বিশ্বস্তভাবে কাজ করে গেছেন, কখনও অভিযোগ করেননি অথবা “পদোন্নতির” আশা করেননি। তবুও, সংগঠন যতই বাড়তে থাকে আত্মায়-অভিষিক্ত এই অল্প সংখ্যক নিষ্ঠাবান ব্যক্তিদের ওপর বড় বড় কাজের দায়িত্বগুলো এসে পড়ে। এদের কেউ কেউ এমনকি যিহোবার সাক্ষিদের পরিচালক গোষ্ঠীতে কাজ করেছেন।
এই আত্মত্যাগী ভাইদের সঙ্গে কাজ করে আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছি। যারা চাকরি করেন তাদেরকে তাদের কাজের জন্য মাসিক বেতন দেওয়া হয়। সেটা হল তাদের পুরস্কার। বেথেলে কাজ করে অনেক আধ্যাত্মিক আশীর্বাদ পাওয়া যায় আর কেবল আধ্যাত্মিকমনা নারী পুরুষরাই এর মূল্য বোঝেন এবং এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ।—১ করিন্থীয় ২:৬-১৬.
নেথেন নর, যিনি ১৯২৩ সালে একজন কিশোর হিসেবে
বেথেলে এসেছিলেন, তিনি ১৯৩০ এর দশকে ফ্যাক্টরি অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। তিনি প্রতিদিন ফ্যাক্টরির মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসতেন এবং কর্মীদেরকে শুভেচ্ছা জানাতেন। বেথেলে আমরা যারা নতুন ছিলাম সবাই এইরকম ব্যক্তিগত আগ্রহ দেখানোর জন্য কৃতজ্ঞ ছিলাম। ১৯৩৬ সালে জার্মানি থেকে আমরা একটা নতুন ছাপার যন্ত্র পাই আর সেটাকে ঠিকভাবে বসাতে কিছু যুবক ভাইদেরকে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছিল। তাই ভাই নর এক জোড়া কাজের পোশাক পরেন আর এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তাদের সঙ্গে কাজ করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সেটা চালানো শুরু করতে পেরেছিলেন।ভাই নর এত কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন যে আমরা কেউ-ই তার সঙ্গে পেরে উঠতাম না। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি এও জানতেন যে কীভাবে আমোদপ্রমোদ উপভোগ করতে হয়। ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্বব্যাপী কাজকর্ম দেখাশোনা করার দায়িত্ব পাওয়ার পরও, তিনি মাঝে মাঝে বেথেল পরিবারের সদস্য এবং গিলিয়েড মিশনারি স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে নিউ ইয়র্কের সাউথ ল্যানসিংয়ের কাছে এক ক্যাম্পাসে বেস-বল খেলতেন।
১৯৫০ সালের এপ্রিল মাসে, বেথেল পরিবার নিউ ইয়র্ক, ব্রুকলিনে ১২৪ কলম্বিয়া হাইটস্-এ নির্মিত এক নতুন দশ-তলা বিশিষ্ট বাসভবনে চলে আসে। খাবারের নতুন ঘরটাতে আমরা সকলেই খাবারের জন্য একসঙ্গে বসতে পারি। প্রায় তিন বছর ধরে এই বাসভবন নির্মাণ কাজ চলার সময়, আমরা আমাদের সকালের উপাসনার কার্যক্রম করতে পারতাম না। তাই সেই কার্যক্রম যখন আবার শুরু হয়েছিল, তখন সেটা কতই না আনন্দের সময় ছিল! ভাই নর আমাকে সভাপতির টেবিলে তার সঙ্গে বসতে দিয়েছিলেন, যাতে আমি আমাদের পরিবারের নতুন সদস্যদের নামগুলো তাকে মনে করিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারি। ৫০ বছর যাবৎ সকালের উপাসনা ও জলখাবারের জন্য আমি সেই একই আসনে বসেছি। এরপর ২০০০ সালের ৪ঠা আগস্ট সেই খাবারের ঘরটা বন্ধ হয়ে যায় আর আমাকে পুরনো টাওয়ারস্ হোটেলে নতুন করে নির্মিত খাবার ঘরগুলোর একটাতে বসতে দেওয়া হয়।
১৯৫০ এর দশকে কিছু সময়ের জন্য, আমি ফ্যাক্টরিতে টাইপগুলোর লাইন তৈরি করতে লাইনোটাইপ মেশিনে কাজ করি আর টাইপগুলোকে একটার পর একটা লাইনে সাজিয়ে পৃষ্ঠা তৈরি করতাম, যেটা ছাপানোর প্লেট তৈরি প্রক্রিয়ার এক অংশ ছিল। সেই কাজ আমার প্রিয় ছিল না কিন্তু এই মেশিনগুলোকে যিনি দেখাশোনা করতেন সেই উইলিয়াম পিটারসন আমার এত প্রিয় ছিলেন যে, যেভাবেই হোক আমি সেখানে আনন্দেই আমার সময় কাটিয়েছিলাম। এরপর, ১৯৬০ সালে ১০৭ কলম্বিয়া হাইটস্ এর নতুন নির্মিত বাসভবনটা রং করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকের দরকার পড়ে। বেড়ে চলা বেথেল পরিবারের জন্য এই নতুন বিল্ডিংগুলোকে তৈরি করার কাজে সাহায্য করতে নিজেকে সঁপে দিতে পেরে আমি আনন্দিত হয়েছিলাম।
১০৭ কলম্বিয়া হাইটস্ বিল্ডিংয়ের রং করার কাজ শেষ হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আমাকে যখন বেথেলে অভ্যাগতদের স্বাগত জানানোর কাজ দেওয়া হয়, তখন আমি খুবই অবাক ও খুশি হয়েছিলাম। গত ৪০ বছর ধরে বেথেলে একজন রিসেপসনিস্ট হিসেবে কাজ করা এত চমৎকার যে, অন্য আর কোন কাজে আমি এত আনন্দ পাইনি। অতিথি অথবা বেথেল পরিবারের কোন নতুন সদস্য যেই বেথেলে এসেছেন, তারাই হলেন রাজ্যের কাজের বৃদ্ধির এক প্রমাণ এবং যারা বেথেলে কাজ করছেন কোন না কোনভাবে এই বৃদ্ধির পিছনে তাদেরও অবদান রয়েছে।
বাইবেলের আগ্রহী ছাত্ররা
আমাদের বেথেল পরিবার আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী কারণ এর সদস্যরা বাইবেলকে ভালবাসেন। আমি যখন প্রথম বেথেলে আসি, তখন আমি আ্যমা হামিলটন, যিনি প্রুফরিডার হিসেবে কাজ করতেন, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তিনি কতবার বাইবেল পড়ে শেষ করেছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘পঁয়ত্রিশবার পড়ার পর আমি আর গুনিনি।’ এনটন কোয়ারবার, আরেকজন পরিশ্রমী খ্রীষ্টান যিনি আ্যমা যে সময়ে ছিলেন প্রায় একই সময়ে বেথেলে কাজ করতেন তিনি বলতেন: “বাইবেল সবসময় আমাদের হাতের নাগালে থাকা উচিত।”
১৯১৬ সালে ভাই রাসেলের মৃত্যুর পর, জোসেফ এফ. রাদারফোর্ড সংগঠন দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, যেগুলো ভাই রাসেল করতেন। রাদারফোর্ড ছিলেন একজন বলিষ্ঠ, সফল বক্তা, যিনি একজন আইনবিদ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টে যিহোবার সাক্ষিদের পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। ১৯৪২ সালে ভাই রাদারফোর্ডের মৃত্যুর পর, তার জায়গায় ভাই নর কাজ করেন এবং জনসাধারণের বক্তা হিসেবে রাদারফোর্ডের মতো দক্ষতা গড়ে তোলার জন্য খুব পরিশ্রম করেন। যেহেতু আমি তার রুমের কাছেই থাকতাম, তাই প্রায়ই আমি তাকে তার বক্তৃতাগুলোকে বারবার অভ্যাস করতে শুনতে পেতাম। এইধরনের আপ্রাণ চেষ্টার ফলেই তিনি জনসাধারণের একজন ভাল বক্তা হয়েছিলেন।
১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভাই নর বেথেলে সমস্ত ভাইদের শিক্ষা ও বক্তৃতা দেওয়ার দক্ষতায় উন্নতি করতে সাহায্য করার জন্য এক স্কুল কার্যক্রম প্রবর্তন করতে সাহায্য করেছিলেন। এই স্কুল বাইবেল গবেষণা করা ও জনসাধারণের বক্তা হওয়ার ওপর জোর দিয়েছিল। প্রথম প্রথম, আমাদের প্রত্যেককে বাইবেলের চরিত্রগুলোর ওপর ছোট ছোট বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়েছিল। আমার প্রথম বক্তৃতাটা মোশির সম্বন্ধে ছিল। ১৯৪৩ সালে, যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোতে একইধরনের স্কুল আরম্ভ হয়েছিল আর তা আজ পর্যন্ত হয়ে আসছে। বেথেলে এখনও বাইবেলের জ্ঞান অর্জন করা এবং শিক্ষা দেওয়ার কার্যকারী পদ্ধতিগুলো গড়ে তোলার ওপর জোর দেওয়া হয়।
১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গিলিয়েড মিশনারি স্কুলের প্রথম ক্লাস শুরু হয়। এখন, সবেমাত্র ১১১তম গিলিয়েড ক্লাসের গ্র্যাজুয়েট পর্ব শেষ হয়েছে! ৫৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে, এই স্কুল ৭,০০০ এরও বেশি জনকে সারা পৃথিবীতে মিশনারি হিসেবে কাজ করার জন্য শিক্ষা দিয়েছে। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল এই যে, ১৯৪৩ সালে যখন এই স্কুল আরম্ভ হয়েছিল, সেই সময় সারা পৃথিবীতে মাত্র ১,০০,০০০ যিহোবার সাক্ষি ছিলেন। এখন, ৬০,০০,০০০ লক্ষেরও বেশি সাক্ষি আছেন, যারা ঈশ্বরের রাজ্যের সুসমাচার প্রচারে অংশ নিচ্ছেন!
আমার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের জন্য আমি কৃতজ্ঞ
গিলিয়েড স্কুল স্থাপন হওয়ার কিছু আগে, বেথেল থেকে আমাদের মধ্যে তিনজনকে পুরো যুক্তরাষ্ট্রের মণ্ডলীগুলোকে পরিদর্শন করতে বলা হয়। এই মণ্ডলীগুলোকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে শক্তিশালী করে তোলার জন্য সেখানে একদিন, দু-তিনদিন অথবা এমনকি এক সপ্তা করে থেকেছিলাম। আমাদেরকে তখন ভাইদের দাস বলা হতো, যে উপাধিটা পরে বদলে সীমা দাস অথবা সীমা অধ্যক্ষ হয়েছিল। কিন্তু, গিলিয়েড স্কুল চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফিরে এসে কিছু কোর্স শেখাতে বলা হয়। গিলিয়েডের ২য় থেকে ৫ম ক্লাস পর্যন্ত আমি একজন নিয়মিত শিক্ষক হিসেবে কাজ করি এবং একজন নিয়মিত শিক্ষকের বদলে আমি কাজ করি ও ১৪তম ক্লাসে শিক্ষা দিই। যিহোবার সংগঠনের আধুনিক দিনের ইতিহাসের প্রথম দিকের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো—অনেক বিষয় আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা
থেকে—ছাত্রদের সঙ্গে পুনরালোচনা করতে পারা আমাকে আমার সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারকে পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল।বছরের পর বছর ধরে আরেকটা যে বিশেষ সুযোগ আমি উপভোগ করেছি তা হল, যিহোবার লোকেদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে যোগ দেওয়া। ১৯৬৩ সালে, আমি “অনন্তকালীন সুসমাচার” সম্মেলনগুলোতে যোগ দেওয়ার জন্য ৫০০-রও বেশি অন্যান্য প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভ্রমণ করেছি। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সম্মেলনগুলো যেগুলোতে আমি যোগ দিয়েছিলাম সেগুলো ছিল ১৯৮৯ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারসোতে; ১৯৯০ সালে জার্মানির বার্লিনে এবং ১৯৯৩ সালে রাশিয়ার মস্কোতে। প্রতিটা সম্মেলনে, আমাদের সেই সব প্রিয় ভাইবোনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমার হয়েছিল যারা নাৎসি শাসন, সাম্যবাদী সরকার অথবা উভয়েরই অধীনে দশকের পর দশক ধরে তাড়না সহ্য করেছিলেন। ওই অভিজ্ঞতাগুলো বিশ্বাসকে কতই না মজবুত করেছিল!
যিহোবার সেবায় আমার জীবন সত্যিই সমৃদ্ধ হয়েছে! আধ্যাত্মিক আশীর্বাদগুলোর জোগান কখনও শেষ হয় না। এছাড়া আমরা যত বেশি এই মূল্যবান বিষয়গুলো কাজে লাগাই, আমাদের সম্পদ তত বেশি বাড়তে থাকে, যা বস্তুগত ধনসম্পদের ব্যাপারে ঘটে না। আমি খুব কমই কাউকে এ কথা বলতে শুনি যে, যিহোবার সাক্ষি হিসেবে বেড়ে না উঠলে ভালই হতো। তারা বলে যে, যদি তারা ঈশ্বরের সংগঠনের বাইরে জীবন কেমন তা প্রথমে অভিজ্ঞতা করত, তাহলে বাইবেলের সত্যগুলোকে তারা আরও বেশি করে উপলব্ধি করত বলে মনে হয়।
যুবক-যুবতীদেরকে এইরকম কথা বলতে শুনে আমি কিছুটা বিরক্ত হই কারণ তারা আসলে বলছে যে যিহোবার পথ সম্বন্ধে জ্ঞান না নিয়ে বড় হয়ে ওঠা অনেক ভাল। কিন্তু, সেই সমস্ত খারাপ অভ্যাস ও কলুষিত চিন্তাধারাগুলোর বিষয়ে চিন্তা করুন, যেগুলো লোকেরা বাইবেলের সত্য খুঁজে পাওয়ার পর তাদেরকে ছাড়তে হয়। আমার বাবামা আমাদের তিনজন ভাইবোনকে ধার্মিকতার পথে মানুষ করে তুলেছেন বলে আমি সবসময় খুব কৃতজ্ঞ। ১৯৮০ সালের জুলাই মাসে জনের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে যিহোবার একজন বিশ্বস্ত দাস ছিল আর এস্টার এখনও পর্যন্ত একজন বিশ্বস্ত সাক্ষি হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্বস্ত খ্রীষ্টান ভাইবোনদের সঙ্গে যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব আমি উপভোগ করেছি, সে কথাগুলো মনে করতে আমার খুব ভাল লাগে। আমি ৬৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে বেথেলে অপূর্ব সময় উপভোগ করছি। যদিও আমি বিয়ে করিনি কিন্তু আমার অনেক আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়ে ও সেইসঙ্গে আধ্যাত্মিক নাতিনাতনী আছে। সারা পৃথিবীতে আমাদের আধ্যাত্মিক পরিবারের যে নতুন প্রিয় সদস্যদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়নি, তাদের সকলের কথা মনে করে আমি আনন্দিত হই, তারা প্রত্যেকেই মূল্যবান। এই কথাগুলো কতই না সত্য: “সদাপ্রভুর আশীর্ব্বাদই ধনবান করে”!—হিতোপদেশ ১০:২২.
[পাদটীকা]
^ আমি ১৯৩২ সালের ৮ই মার্চ বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। তাই আসলে অগ্রগামীর কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরই আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।
[২০ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাঁদিক থেকে ডানদিকে: বাবা, আমার ভাই জন তার কোলে, এস্টার, আমি এবং আমার মা
[২৩ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
১৯৪৫ সালে একটা গিলিয়েড ক্লাসে শিক্ষা দিচ্ছি
ওপরে ডানদিকে: গিলিয়েড স্কুল শিক্ষকেরা এডুয়ারডো কেলার, ফ্রেড ফ্রাঞ্জ, আমি এবং আ্যলবার্ট শ্রোডার
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]
যিহোবার সেবায় আমার সমৃদ্ধ জীবন নিয়ে চিন্তা করছি