সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা আশীর্বাদ নিয়ে আসে

যিহোবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা আশীর্বাদ নিয়ে আসে

জীবন কাহিনী

যিহোবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করা আশীর্বাদ নিয়ে আসে

বলেছেন মারিয়া ডো সাও জেনারডি

“যিহোবা জানেন তিনি কী করছেন। তোমাকে যদি তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, তাহলে তোমার তা নম্রভাবে গ্রহণ করা উচিত।” প্রায় ৪৫ বছর আগে বলা বাবার এই কথাগুলো আমাকে যিহোবার সংগঠনের কাছ থেকে পূর্ণ-সময়ের পরিচারকের কাজ করার প্রথম আমন্ত্রণকে গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল। আজ, বাবার এই পরামর্শের জন্য আমি এখনও কৃতজ্ঞ, কারণ সেই আমন্ত্রণকে গ্রহণ করার ফলে আমি প্রচুর আশীর্বাদ পেয়েছি।

 বাবা ১৯২৮ সালে প্রহরীদুর্গ পত্রিকার গ্রাহক হন ও বাইবেলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যেহেতু তিনি মধ্য পোর্ত্তুগালে থাকতেন, তাই ঈশ্বরের মণ্ডলীর সঙ্গে তার যোগাযোগ করার একমাত্র মাধ্যম ছিল ডাকে পাওয়া সাহিত্যাদি এবং আমার ঠাকুরদার একটা বাইবেল। ১৯৪৯ সালে আমার যখন ১৩ বছর বয়স, সেই সময় আমাদের পরিবার আমার মায়ের দেশ ব্রাজিলে থাকার জন্য চলে আসে এবং রিও ডি জেনিরো শহরের সীমান্তে থাকতে শুরু করে।

আমাদের নতুন প্রতিবেশীরা তাদের গির্জায় যাওয়ার জন্য আমাদেরকে আমন্ত্রণ জানায় আর আমরা কয়েকবার সেখানে গিয়েছিলাম। বাবা তাদেরকে নরকাগ্নি, আত্মা ও পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে ভালবাসতেন কিন্তু তাদের কাছে এগুলোর কোন উত্তর ছিল না। বাবা বলতেন “আমাদের শুধু বাইবেলের প্রকৃত ছাত্রদের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।”

একদিন এক অন্ধ ব্যক্তি আমাদের ঘরে এসে প্রহরীদুর্গ এবং সচেতন থাক! পত্রিকা দিয়ে যান। বাবা তাকেও সেই একই প্রশ্নগুলো করেন এবং তিনি বাইবেল থেকে খুব জোরালো উত্তর দেন। পরের সপ্তায় আরেকজন যিহোবার সাক্ষি আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পর, তাকে “ক্ষেত্রের পরিচর্যায়” যেতে হবে বলে তিনি চলে যাওয়ার অনুমতি চান। বাবা যখন তার কথা বুঝতে পারেননি, তখন তিনি মথি ১৩:৩৮ পদ বাবাকে পড়ে শোনান: ‘ক্ষেত্র হল জগৎ।’ বাবা জিজ্ঞেস করেন: “আমিও কি যেতে পারি?” উত্তরে তিনি বলেন “নিশ্চয়ই।” বাইবেলের সত্যকে আবারও খুঁজে পেয়ে আমরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম! পরের সম্মেলনে বাবা বাপ্তিস্ম নেন আর তার কিছু সময় পর ১৯৫৫ সালের নভেম্বর মাসে আমি বাপ্তিস্ম নিই।

আমার প্রথম আমন্ত্রণকে গ্রহণ করা

দেড় বছর পর আমি রিও ডি জেনিরোতে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা দফতর থেকে একটা বড় খামে পূর্ণ-সময়ের প্রচার কাজ শুরু করার আমন্ত্রণ পাই। সেই সময়ে মা খুবই অসুস্থ ছিলেন, তাই বাবার কাছ থেকে আমি তার পরামর্শ চেয়েছিলাম। তিনি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন “যিহোবা জানেন তিনি কী করছেন। তোমাকে যদি তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, তাহলে তোমার তা নম্রভাবে গ্রহণ করা উচিত।” এই কথাগুলো থেকে উৎসাহ পেয়ে আমি ওই আবেদন পত্রটা পূরণ করেছিলাম এবং ১৯৫৭ সালের ১লা জুলাই থেকে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা কাজ শুরু করি। প্রথম যেখানে আমাকে এই কাজ শুরু করতে হয়েছিল সেটা ছিল রিও ডি জেনিরো প্রদেশের একটা শহর ট্র্যাস রিওস।

প্রথম প্রথম ট্যাস রিওসের বাসিন্দারা আমাদের সংবাদ শুনতে দ্বিধা করত কারণ আমরা ক্যাথলিক সংস্করণের বাইবেল ব্যবহার করতাম না। কিন্তু জেরালডু রামালিউ নামে একজন ক্যাথলিক ব্যক্তির সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করে আমরা সাহায্য পেয়েছিলাম। তার সাহায্যে আমি একটা বাইবেল পেয়েছিলাম যেটাতে স্থানীয় একজন পুরোহিতের সই ছিল। সেই সময় থেকে যখনই কেউ কোন আপত্তি জানাত আমি তাদেরকে সেই পুরোহিতের দস্তখত দেখাতাম আর এর ফলে কেউ আর কোন প্রশ্ন করত না। পরে জেরালডু বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।

আমি খুবই আনন্দিত হয়েছিলাম যখন ১৯৫৯ সালে, মধ্য ট্র্যাস রিওসে একটা সীমা অধিবেশন হয়েছিল। পুলিশের একজন প্রধান কর্মকর্তা যিনি সেই সময়ে বাইবেল অধ্যয়ন করছিলেন তিনি সমস্ত শহরে এই কার্যক্রমের বিষয়ে প্রচার করার জন্য এমনকি ব্যানার টাঙানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন। ট্র্যাস রিওসে তিন বছর কাজ করার পর আমাকে সাও পাওলো থেকে প্রায় ১১০ কিলোমিটার পশ্চিমে ইতুতে কাজ করার জন্য নতুন আমন্ত্রণ জানানো হয়।

লাল, নীল ও হলুদ বইগুলো

কিছুটা খোঁজাখুঁজি করার পর আমার অগ্রগামী সাথি ও আমি সেই শহরের কেন্দ্রস্থলে মারিয়া নামের একজন দয়ালু বিধবার ঘরে থাকার জন্য খুব ভাল একটা জায়গা পেয়েছিলাম। মারিয়া আমাদেরকে তার নিজের মেয়ের মতো দেখতেন। শীঘ্রিই ইতুর রোমান ক্যাথলিক বিশপ তার কাছে আসেন ও আমাদেরকে সেখান থেকে বের করে দেওয়ার জন্য বলেন কিন্তু তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন: “আমার স্বামী যখন মারা গিয়েছিল, তখন আপনারা কেউই আমাকে সান্ত্বনা দিতে আসেননি। কিন্তু এই যিহোবার সাক্ষিরা আমাকে সাহায্য করেছেন, যদিও আমি তাদের ধর্মের সদস্য নই।”

সেই সময়ে একজন মহিলা আমাদেরকে এই খবর দিয়েছিল যে, ইতুর ক্যাথলিক পুরোহিতরা “দিয়াবল সম্বন্ধে লাল বইটা” নিতে তাদের গির্জার লোকেদেরকে বারণ করেছেন। তারা বাইবেল সাহিত্যাদি “ঈশ্বর যেন সত্য হোন” (ইংরেজি) বইয়ের কথা বলছিলেন যেটা আমরা সেই সপ্তায় অর্পণ করছিলাম। যেহেতু লাল বইটা পুরোহিতরা “নিষেধ করেছিলেন” তাই আমরা নীল বই (‘নতুন আকাশ এবং নতুন পৃথিবী’) (ইংরেজি) অর্পণ করার জন্য উপস্থাপনা তৈরি করেছিলাম। পরে এই পরিবর্তনের বিষয়ে যখন পুরোহিতেরা জেনে ফেলেন, তখন আমরা হলুদ বই (মানবজাতির জন্য ধর্ম কী করেছে?) (ইংরেজি) ব্যবহার করি আর এভাবে চলতে থাকে। এটা খুব ভাল যে আমাদের কাছে নানা রঙের বই ছিল।

ইতুতে প্রায় এক বছর থাকার পর আমি রিও ডি জেনিরোতে যিহোবার সাক্ষিদের শাখা দফতর থেকে একটা টেলিগ্রাম পেয়েছিলাম, যেখানে আমাকে কিছু সময়ের জন্য জাতীয় অধিবেশন প্রস্তুতির কাজ করতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি তা খুশিমনে গ্রহণ করেছিলাম।

আরও দায়িত্ব ও কঠিন পরিস্থিতিগুলো

বেথেলে কাজের কোন কমতি ছিল না আর আমি যে কোন করে সাহায্য করতে খুশি ছিলাম। রোজ সকালে প্রতিদিনের শাস্ত্রপদ আলোচনা এবং প্রতি সোমবার সন্ধ্যায় পরিবারের প্রহরীদুর্গ অধ্যয়নে যোগ দেওয়া কত উপকারজনকই না ছিল! বেথেল পরিবারের সদস্য ওটো এসটালমান এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ সদস্যদের প্রাণবন্ত প্রার্থনা আমার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল।

জাতীয় অধিবেশনের পর ইতুতে ফিরে যাওয়ার জন্য আমি নিজের জিনিসপত্রগুলো গোছগাছ করি কিন্তু শাখা অধ্যক্ষ, গ্রান্ট মিলার যখন বেথেল পরিবারের স্থায়ী সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে আমার হাতে একটা চিঠি দিয়েছিলেন, তখন আমি খুবই অবাক হয়ে যাই। আমার সঙ্গে একই রুমে থাকতেন বোন হোসা ইয়াজেডজিয়েন, যিনি এখনও ব্রাজিল বেথেলে সেবা করছেন। সেই সময়ে বেথেল পরিবার খুব ছোট ছিল। সেখানে আমরা মাত্র ২৮ জন ছিলাম এবং সবাই খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম।

১৯৬৪ সালে জোয়াও জানারডি নামে একজন পূর্ণ-সময়ের যুবক পরিচারক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য বেথেলে আসেন। সেই সময়ে তাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ বা ভ্রমণ অধ্যক্ষ করে কাছাকাছি পাঠানো হয়। তিনি যখন তার রিপোর্ট জমা দিতে বেথেলে আসতেন, তখন কখনও কখনও আমাদের দেখা হতো। শাখা অধ্যক্ষ সোমবার সন্ধ্যা বেলায় পরিবারের অধ্যয়নে যোগ দিতে জোয়াওকে অনুমতি দিয়েছিলেন, তাই আমরা এক সঙ্গে অনেক সময় কাটাতে পেরেছিলাম। পরে ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে জোয়াও ও আমি বিয়ে করি। আমার স্বামীর সঙ্গে সীমার কাজে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণকে আমি আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম।

সেই সময়ে ব্রাজিলের মধ্যবর্তী অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। মিনাস গেরাইস প্রদেশের আ্যরনহা শহরের প্রকাশকদের একটা দলকে পরিদর্শন করতে যাওয়ার বিষয়টা আমি কখনও ভুলব না। কিছু দূর ট্রেনে গিয়ে বাকি পথটুকু আমাদেরকে হেঁটে যেতে হয়েছিল। আর আমাদের সঙ্গে কয়েকটা সুটকেস, টাইপরাইটার, স্লাইড প্রজেক্টার, প্রচারের ব্যাগ আর সাহিত্যাদি ছিল। আমাদের জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য সাহায্য করতে সবসময়ই স্টেশনে একজন বয়স্ক ভাই, লোওরিভাল চানতালকে অপেক্ষা করতে দেখে আমরা সত্যিই আনন্দিত হতাম।

আ্যরনহাতে সভাগুলো ভাড়া করা এক বাড়িতে হতো। সেই বাড়ির পিছনের একটা ছোট্ট রুমে আমাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল। রুমের এক ধারে আগুন ধরানো হতো যেখানে আমরা রান্না করতাম এবং জল গরম করতাম, যে জল ভাইয়েরা বালতিতে করে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। কাছাকাছি এক বাঁশ-বাগানের মাঝে মাটিতে একটা গর্ত করা হয়েছিল, যেটা টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। গুবরে-পোকাগুলো তাড়ানোর জন্য রাতে আমরা একটা হ্যাজাক ল্যাম্প জালিয়ে রাখতাম কারণ এগুলো স্যাগাস রোগ ছড়ায়। সকালে আমাদের নাক ধোঁয়াতে সবসময়ই কালো হয়ে থাকত। সত্যিই মজার এক অভিজ্ঞতা ছিল!

প্যারেনা প্রদেশে সীমার কাজ করার সময় আমরা আরেকবার শাখা দফতর থেকে বড় এক খামে চিঠি পাই। যিহোবার সংগঠন থেকে আরেকটা আমন্ত্রণ—এই বার পোর্ত্তুগাল কাজ করার আমন্ত্রণ! এই চিঠিতে লূক ১৪:২৮ পদের নীতিকে বিবেচনা করতে এবং দায়িত্ব নেওয়ার আগে এই কাজে যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে তা ভাল করে বিবেচনা করতে বলা হয় কারণ সেখানে আমাদের খ্রীষ্টীয় কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং পর্তুগিজ সরকার ইতিমধ্যে অনেক ভাইদের গ্রেপ্তার করেছিল।

আমরা কি সেই দেশে যাব যেখানে এইধরনের তাড়নার মুখোমুখি হতে পারি? জোয়াও বলেছিল “আমাদের পর্তুগিজ ভাইয়েরা যদি সেখানে থাকতে পারে ও যিহোবাকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না?” বাবার উৎসাহজনক সেই কথাগুলো মনে করে আমিও রাজি হয়ে বলেছিলাম: “যিহোবা যদি আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের তা গ্রহণ ও তাঁর ওপর নির্ভর করা উচিত।” এর কিছু পরেই আমরা আরও নির্দেশনা পেতে এবং সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের কাগজপত্র তৈরি করতে সাও পাওলোর বেথেলে চলে আসি।

জোয়াও মারিয়া এবং মারিয়া জোয়াও

১৯৬৯ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর আমাদের জাহাজ ইউজেনিও কে, সাও পাওলো প্রদেশের স্যানটোস বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। সমুদ্রে নয় দিন যাত্রা করার পর আমরা পোর্ত্তুগালে পৌঁছেছিলাম। প্রথমে লিসবনের পুরনো জেলার এলফামা ও মৌরারিয়ার সরু গলিগুলোতে আমরা কয়েক মাস অভিজ্ঞ ভাইদের সঙ্গে কাজ করি। তারা আমাদের সতর্ক হতে শিখিয়েছিলেন, যাতে আমরা পুলিশের হাতে সহজে ধরা না পড়ি।

মণ্ডলীর সভাগুলো সাক্ষিদের বাড়িতে বাড়িতে করা হতো। আমরা যে মুহূর্তে বুঝতে পারতাম যে প্রতিবেশীরা সন্দেহ করতে শুরু করছে, সঙ্গে সঙ্গে সভাগুলো অন্য জায়গায় করার ব্যবস্থা করা হতো যাতে সেই ঘরকে তল্লাশি করা না হয় বা ভাইদেরকে ধরা না হয়। লিসবনের সীমান্তে মোনস্যান্টো পার্ক ও উপকূলে বড় বড় গাছ রয়েছে এমন এলাকা কোস্টা ডা ক্যাপারিকাতে আমাদের অধিবেশনগুলো হতো, যেগুলোকে আমরা পিকনিক বলতাম। সেই উপলক্ষে আমরা সাধারণ জামা কাপড় পরতাম এবং নির্দিষ্ট জায়গাগুলোতে এক দল সতর্ক ভাইরা লক্ষ্য রাখতেন। যদি সন্দেহজনক কেউ আসত, তখন হঠাৎ করেই আমরা কোন খেলাধুলা বা পিকনিকের আয়োজন অথবা কোন একটা গান গাইতে শুরু করে দিতাম।

নিরাপত্তার দায়িত্বে যে পুলিশেরা রয়েছে তারা যাতে সহজে আমাদেরকে চিনতে না পারে তাই আমরা নিজেদের আসল নাম ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতাম। ভাইয়েরা আমাদেরকে জোয়াও মারিয়া এবং মারিয়া জোয়াও নামে চিনত। আমাদের নাম কোন চিঠিপত্রে বা রেকর্ডে ব্যবহার করা হতো না। বরং আমাদের নম্বর দেওয়া হয়েছিল। ভাইদের ঠিকানাগুলোকে মনে না রাখার জন্য আমি দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এভাবে, আমি যদি ধরাও পড়ি, তাহলে তাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

বিভিন্ন বাধা সত্ত্বেও জোয়াও এবং আমি সাক্ষ্য দেওয়ার প্রতিটা সুযোগ ব্যবহার করব বলে ঠিক করেছিলাম কারণ আমরা জানতাম, যে কোন সময়ে আমরা হয়তো প্রচার করার স্বাধীনতাকে হারাতে পারি। আমরা আমাদের স্বর্গীয় পিতা যিহোবার ওপর নির্ভর করতে শিখেছিলাম। আমাদের রক্ষক হিসেবে, তিনি তাঁর দূতেদের এমনভাবে ব্যবহার করেছিলেন যে, আমাদের মনে হয়েছিল ‘যিনি অদৃশ্য তাঁহাকে যেন দেখিয়াছি।’—ইব্রীয় ১১:২৭.

এক সময় পোর্টোতে ঘরে-ঘরে প্রচার করার সময় আমাদের এমন এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়, যিনি আমাদেরকে ঘরের ভিতরে আসতে জোর করেছিলেন। যে বোনের সঙ্গে আমি কাজ করছিলাম তিনি কোন দ্বিধা না করে যেতে রাজি হয়ে যান আর তার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিল না। ঘরে ঢোকার সময় আমি সৈনিকের ইউনিফর্ম পরা কারও ছবি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এবার কী করব? গৃহকর্তা আমাদেরকে বসতে বলেন ও তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করেন: “আপনার ছেলেকে যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য ডাকা হয়, তাহলে কি আপনি তাকে যেতে দেবেন?” এমন একটা পরিস্থিতি উপস্থিত হয় যখন কৌশলে কথা বলার দরকার ছিল। মনে মনে প্রার্থনা করে শান্তভাবে আমি উত্তর দিয়েছিলাম: “আমার কোন ছেলেমেয়ে নেই আর আমি একেবারে নিশ্চিত যে অনুমান করে উত্তর দিতে হবে এমন প্রশ্ন যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, তাহলে আপনিও আমাকে একই উত্তর দেবেন।” তিনি চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। তাই আমি আরও বলি: “এবার আমাকে যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন যে ভাই বা বাবা মারা গেলে কেমন লাগে, তাহলে আমি উত্তর দিতে পারব কারণ আমার বাবা ও ভাই দুজনেই মারা গেছেন।” আমি যখন এই কথাগুলো বলছিলাম আমার চোখে জল চলে আসে আর আমি লক্ষ্য করি যে তিনিও কাঁদোকাঁদো হয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন যে কিছুদিন আগে তার স্ত্রী মারা গিয়েছেন। আমি যখন পুনরুত্থানের আশা সম্বন্ধে জানাই তিনি খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। এরপর আমরা ভদ্রভাবে তার কাছ থেকে বিদায় নিই ও যিহোবার হাতে সবকিছু ছেড়ে নিরাপদে সেখান থেকে বেরিয়ে আসি।

নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও, সৎহৃদয়ের লোকেদেরকে সত্যের জ্ঞান লাভ করার জন্য সাহায্য করা হয়েছিল। আমার স্বামী পোর্টোতে ওরাসিও নামে একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে অধ্যয়ন শুরু করেন, যিনি খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি করেছিলেন। পরে তার ছেলে এমিলিও যিনি খুব ভাল একজন ডাক্তার, যিহোবার পক্ষ নেন ও বাপ্তিস্মিত হন। সত্যিই যিহোবার পবিত্র আত্মাকে কেউ রুখতে পারে না।

“আপনারা জানেন না যে যিহোবা কী করবেন”

১৯৭৩ সালে জোয়াও আর আমাকে বেলজিয়ামের ব্রাসেলস্‌-এ “ঐশিক বিজয়” আন্তর্জাতিক অধিবেশনে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। স্পেন ও বেলজিয়াম থেকে হাজার হাজার ভাইয়েরা উপস্থিত হয়েছিলেন ও সেই সঙ্গে মোজাম্বিক, আ্যংগোলা, কেপ ভেরডে, ম্যাডিরা ও আ্যজোরেস থেকেও প্রতিনিধিরা ছিলেন। নিউ ইয়র্কের প্রধান কার্যালয় থেকে আসা ভাই নর তার শেষ মন্তব্যে জোর গলায় বলেছিলেন: “যিহোবাকে বিশ্বস্তভাবে সেবা করে চলুন। আপনারা জানেন না যে যিহোবা কী করবেন। কে জানে, আপনারা হয়তো পোর্ত্তুগালেই পরের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দেবেন!”

পরের বছর পোর্ত্তুগালে প্রচার কাজ করার আইনগত স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছিল। আর ভাই নরের কথা সত্যি হয় যখন ১৯৭৮ সালে লিসবনে আমরা আমাদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন করেছিলাম। প্ল্যাকার্ড, পত্রিকার মাধ্যমে সাক্ষ্য দেওয়া ও জনসাধারণের বক্তৃতার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য লিসবনের রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা কী এক উত্তম সুযোগই না ছিল! এক স্বপ্ন সত্যি হয়েছিল।

পর্তুগিজ ভাইদের প্রতি আমাদের ভালবাসা বেড়ে গিয়েছিল আর এদের অনেকেই তাদের খ্রীষ্টীয় নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য জেলে গিয়েছিলেন ও মার খেয়েছিলেন। পোর্ত্তুগালেই সেবা করে যাওয়া আমাদের ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। ১৯৮২ সালে জোয়াওয়ের গুরুতর হৃদরোগ হয় আর তাই শাখা দফতর পরামর্শ দেয় যে আমরা যেন ব্রাজিলে ফিরে যাই।

এক কঠিন সময়

ব্রাজিল শাখা দফতরের ভাইয়েরা খুবই সাহায্যকারী ছিলেন এবং আমাদেরকে সাও পাওলো প্রদেশের তৌবাটে শহরের কিউরিরিম মণ্ডলীতে সেবা করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জোয়াওর স্বাস্থ্য খুব তাড়াতাড়ি খারাপ হতে থাকে এবং শীঘ্রিই এমন হয় যে সে ঘর থেকে আর বেরতে পারে না। আগ্রহী ব্যক্তিরা বাইবেল অধ্যয়ন করতে আমাদের বাড়িতে আসত এবং প্রতিদিন প্রচারে যাওয়ার আগের সভাগুলো ও সেইসঙ্গে সপ্তার বই অধ্যয়নও আমাদের বাড়িতেই হতো। এই ব্যবস্থাগুলো আমাদের আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যকে ভাল রাখতে সাহায্য করেছিল।

১৯৮৫ সালের ১লা অক্টোবর তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জোয়াও যিহোবার সেবায় তার যথাসাধ্য করে গেছে। আমি খুবই দুঃখিত ও কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু আমার দায়িত্ব পালন করার জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে আরেকটা দুর্ঘটনা ঘটে যখন আমার বাড়িতে চোর সিঁদ কেটে ঢুকে প্রায় সবকিছুই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। আমার জীবনে এই প্রথমবারের মতো আমি নিজেকে নিঃসঙ্গ ভাবি এবং ভয় পেয়ে যাই। কিছু সময়ের জন্য এক দম্পতি ভালবাসা দেখিয়ে তাদের সঙ্গে আমাকে থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আর এর জন্য আমি খুবই কৃতজ্ঞ।

জোয়াওর মৃত্যু ও সেইসঙ্গে চুরির ঘটনাটা যিহোবার প্রতি আমার সেবার ওপর ছাপ ফেলেছিল। আমি কোনভাবেই পরিচর্যা চালিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। শাখা দফতরকে এই সমস্যা সম্বন্ধে লিখে জানানোর পর আমাকে কিছু সময়ের জন্য বেথেলে থাকার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাতে আমি আবার মানসিক ভারসাম্য ফিরে পেতে পারি। সেই সময়টা আমাকে কত শক্তিই না জুগিয়েছিল!

আমার মনের অবস্থা একটু ভাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি সাও পাওলো প্রদেশের ইপোয়া শহরে কাজ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলাম। প্রচার কাজ আমাকে ব্যস্ত রেখেছিল কিন্তু কখনও কখনও আমি একটু নিরুৎসাহিত হয়ে পড়তাম। সেই সময়গুলোতে আমি কিউরিরিমের ভাইদেরকে ফোন করতাম আর একেকটা পরিবার কিছু দিনের জন্য আমার সঙ্গে দেখা করতে আসত। তাদের সেই আসা সত্যিই উৎসাহজনক ছিল! ইপোয়াতে থাকার সময় প্রথম বছরে ৩৮ জন ভাইবোনেরা আমার সঙ্গে দেখা করতে অনেক দূর থেকে এসেছিলেন।

জোয়াওর মৃত্যুর ছবছর পর ১৯৯২ সালে আমি যিহোবার সংগঠন থেকে আরেকটা আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এবার আমাকে সাও পাওলো প্রদেশের ফ্র্যাঙ্কা শহরে যেতে বলা হয়েছিল, যেখানে আমি একজন পূর্ণ-সময়ের পরিচারক হিসেবে এখনও কাজ করছি। এখানকার প্রচারের এলাকা খুবই ফলপ্রসূ। ১৯৯৪ সালে আমি একজন মেয়রের সঙ্গে অধ্যয়ন শুরু করি। সেই সময়ে তিনি ব্রাজিলের এক কংগ্রেস সদস্য হওয়ার জন্য প্রচার অভিযান চালাচ্ছিলেন কিন্তু তার খুব ব্যস্ত জীবন থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রতি সোমবার দুপুরে অধ্যয়ন করতাম। আর এই সময়ে কোন কিছু যাতে ব্যাঘাত না জন্মায়, তাই তিনি তার ফোন বন্ধ করে রাখতেন। ধীরে ধীরে তার রাজনীতি থেকে সরে আসা এবং সত্যের সাহায্যে তার বিবাহ বন্ধনকে আবার গড়ে তুলতে দেখে আমি কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম! তিনি ও তার স্ত্রী ১৯৯৮ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছেন।

বিগত জীবনের দিকে তাকালে, আমি বলতে পারি যে একজন পূর্ণ-সময়ের পরিচারক হিসেবে আমার জীবনে অনেক আশীর্বাদ ও সুযোগ পেয়েছি। যিহোবা তাঁর সংগঠনের মাধ্যমে আমাকে যে আমন্ত্রণগুলো পাঠিয়েছেন সেগুলোকে গ্রহণ করা সত্যিই আমার জন্য অনেক মূল্যবান আশীর্বাদ এনে দিয়েছে। আর ভবিষ্যতে যে আমন্ত্রণগুলোই আসুক না কেন, স্বেচ্ছায় সেগুলোকে গ্রহণ করার ইচ্ছা আমার মধ্যে এখনও প্রবল আছে।

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

১৯৫৭ সালে যখন আমি পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যার কাজ শুরু করি আর এখন

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬৩ সালে ব্রাজিলের বেথেল পরিবারের সঙ্গে

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে আমাদের বিয়ে

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞার সময় পোর্ত্তুগালে একটা অধিবেশন

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৭৮ সালে “বিজয়ী বিশ্বাস” আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময়ে লিসবনে রাস্তায় রাস্তায় সাক্ষ্যদান