সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যিহোবা আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে এবং অটল থাকতে শিখিয়েছেন

যিহোবা আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে এবং অটল থাকতে শিখিয়েছেন

জীবন কাহিনী

যিহোবা আমাদেরকে ধৈর্য ধরতে এবং অটল থাকতে শিখিয়েছেন

বলেছেন আরিসটটিলস্‌ আপোসটলিডিস

ককেশাস পর্বতের উত্তর পাদদেশে অবস্থিত রাশিয়ার পিয়াটিগ্রোস্ক শহর, প্রাকৃতিক ঝরনা এবং শান্ত প্রকৃতির জন্য বিখ্যাত। ১৯২৯ সালে এখানে আমি গ্রিক শরণার্থী হিসেবে জন্ম গ্রহণ করি। দশ বছর পর, স্ট্যালিনবাদীদের দ্বারা সন্ত্রাস এবং সম্প্রদায়ের বিলোপসাধনের দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে, আমরা আবারও শরণার্থী হয়ে পড়ি ও আমাদেরকে গ্রিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

 গ্রিসের পাইরিয়েসে চলে যাওয়ার পর, “শরণার্থী” শব্দটার মানে আমাদের জন্য পুরোপুরি নতুন ছিল। আমাদের তখন নিজেদেরকে পুরোপুরি বিদেশি বলে মনে হতো। যদিও দুজন বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক, সক্রেটিস এবং আ্যরিস্টটলের নাম অনুসারে আমার ভাই এবং আমার নাম রাখা হয়েছিল কিন্তু আমাদেরকে সেই নামে খুব কমই ডাকা হতো। সবাই আমাদেরকে ছোট্ট রাশিয়ান বলে ডাকত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পরেই আমার প্রিয় মা মারা যান। তিনি ছিলেন আমাদের ঘরের একমাত্র ভরসা আর তাই সেই বিচ্ছেদ অনেক কষ্টকর ছিল। বেশ কয়েকদিন ধরে অসুস্থ থাকায় তিনি আমাকে ঘরের অনেক কাজকর্ম শিখিয়েছিলেন। আর এই শিক্ষা পরবর্তী জীবনে অনেক কাজে এসেছিল।

যুদ্ধ এবং মুক্তি

যুদ্ধ, নাৎসি শাসন এবং মিত্র বাহিনীর প্রচণ্ড বোমাবাজির কারণে প্রতিটা দিনই জীবনের শেষ দিন বলে মনে হতো। সেই সময় চারিদিকে প্রচণ্ড দরিদ্রতা, ক্ষুধা এবং মৃত্যু ছিল। আমাদের তিনজনের ভরণপোষণের জন্য ১১ বছর বয়স থেকেই আমাকে বাবার সঙ্গে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। গ্রিক ভাষার ওপর ততটা দখল না থাকায় ও সেইসঙ্গে যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী অবস্থার কারণে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৪ সালের অক্টোবর মাসে গ্রিসে জার্মান শাসন শেষ হয়। এর কিছুদিন পরই যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই হতাশ এবং যন্ত্রণাপূর্ণ সময়ে ঈশ্বরের রাজ্যের অধীনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে বাইবেলের আশা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। (গীতসংহিতা ৩৭:২৯) এই পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে চিরকাল বেঁচে থাকা সম্বন্ধে ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা আমার ক্ষতের জন্য এক প্রকৃত ওষুধ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। (যিশাইয় ৯:৭) আমি এবং আমার বাবা ১৯৪৬ সালে যিহোবার কাছে আমাদের উৎসর্গীকরণের চিহ্ন হিসেবে বাপ্তিস্ম নিই।

পরের বছর পাইরিয়েসের দ্বিতীয় মণ্ডলীতে প্রচার দাস (পরে পত্রিকা দাস বলা হতো) হিসেবে আমার প্রথম দায়িত্ব পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। আমাদের এলাকা, পাইরিয়েস থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে ইলুসিস পর্যন্ত ছিল। সেই সময় আত্মায় অভিষিক্ত অনেক খ্রীষ্টানরা মণ্ডলীতে কাজ করতেন। তাদের সঙ্গে কাজ করার এবং তাদের কাছ থেকে শেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে আমি অনেক আনন্দ পেতাম কারণ প্রচার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টার প্রয়োজন, সেই সম্বন্ধে বলার মতো অসংখ্য অভিজ্ঞতা তাদের ছিল। তাদের জীবনযাপন থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে, বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করার জন্য অনেক ধৈর্য দেখানোর এবং অটল থাকার প্রয়োজন আছে। (প্রেরিত ১৪:২২) আমি কত খুশি যে বর্তমানে এখানে যিহোবার সাক্ষিদের ৫০টারও বেশি মণ্ডলী আছে!

এক অপ্রত্যাশিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা

কিছুদিন পর পেটরাস শহরে এক সুন্দরী ও উদ্যোগী খ্রীষ্টান যুবতী ইলিনির সঙ্গে আমার দেখা হয়। ১৯৫২ সালের শেষের দিকে আমাদের বাগ্‌দান হয়। কিন্তু, কয়েক মাস পর ইলিনি গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন যে তার ব্রেইন টিউমার হয়েছে এবং তার অবস্থা খুবই গুরুতর। তার সঙ্গে সঙ্গে অপারেশন করার দরকার হয়। অনেক চেষ্টার পর আমরা এথেন্সে একজন ডাক্তারের খোঁজ পাই, যিনি সেই সময় চিকিৎসা বিজ্ঞান ততটা উন্নত না থাকা সত্ত্বেও আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন এবং রক্ত ছাড়া চিকিৎসা করাতে রাজি হয়েছিলেন। (লেবীয় পুস্তক ১৭:১০-১৪; প্রেরিত ১৫:২৮, ২৯) অপারেশনের পর ডাক্তাররা আমার বাগ্‌দত্তার ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন ঠিকই কিন্তু সে যে আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে না, সেই নিশ্চয়তা তারা দেননি।

সেই পরিস্থিতিতে আমার কী করার দরকার ছিল? পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখে আমি কি বাগ্‌দান ভেঙে দিয়ে নিজেকে মুক্ত করব? না! বাগ্‌দানের মাধ্যমে আমি প্রতিজ্ঞা করেছি এবং আমি চাই আমার হ্যাঁ যেন হ্যাঁ-ই হয়। (মথি ৫:৩৭) এক মুহূর্তের জন্যও আমি অন্য কিছু ভাবিনি। ইলিনি তার বড় বোনের সেবাযত্নে কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠে এবং ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমরা বিয়ে করি।

তিন বছর পর ইলিনি আবারও অসুস্থ হয় এবং সেই একই ডাক্তার তার আরেকটা অপারেশন করেন। টিউমারটা পুরোপুরি বের করার জন্য এই সময় ডাক্তারকে মস্তিষ্কের অনেক গভীরে অপারেশন করতে হয়েছিল। এর ফলে আমার স্ত্রীর কিছু অংশ অবশ হয়ে যায় এবং তার মস্তিষ্কের যে অংশ বাক্‌শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে তা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন আমাদের দুজনের জন্য নতুন ধরনের গুরুতর সমস্যা শুরু হয়। এমনকি ছোটখাটো কাজও আমার প্রিয় স্ত্রীর জন্য অনেক বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার অবস্থা দিন-দিন আরও খারাপ হওয়ার কারণে আমাদের রোজকার জীবনে বিরাট পরিবর্তন করার দরকার দেখা দেয়। সর্বোপরি, এর জন্য প্রচুর ধৈর্য দেখানোর এবং অটল থাকার দরকার হয়।

আর এই মুহূর্তে আমি মার কাছ থেকে যে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলাম, তা খুবই কাজে আসে। রোজ ভোরবেলা আমি খাবারের জন্য সমস্ত কিছু জোগাড় করে দিতাম আর ইলিনি রান্না করত। প্রায়ই আমরা অতিথিদের নিমন্ত্রণ করতাম যাদের মধ্যে ছিল পূর্ণ-সময়ের পরিচারক, বাইবেল ছাত্র এবং মণ্ডলীর অভাবী ভাইবোনরা। খাবার খুবই সুস্বাদু হতো বলে তারা সবাই প্রশংসা করত! ইলিনি এবং আমি দুজনে মিলে ঘরের অন্যান্য কাজ করতাম যাতে আমাদের ঘর পরিষ্কার-পরিপাটী থাকে। এইরকম পরিস্থিতি ৩০ বছর ধরে চলেছিল।

অক্ষমতা সত্ত্বেও উদ্যোগ

কোন কিছুই যিহোবার প্রতি আমার স্ত্রীর ভালবাসা এবং তাঁর কাজের প্রতি তার উদ্যোগ কমাতে পারেনি দেখে আমি এবং অন্যেরা খুবই প্রেরণা পেয়েছিলাম। পরে এবং চেষ্টা করে চলার ফলে ইলিনি দুএকটা কথা বলে তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারত। বাইবেলের সুসমাচার নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় লোকেদের কাছে যেতে সে ভালবাসত। আমি যখন ব্যাবসার কাজে বাইরে যেতাম, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম এবং ব্যস্ত রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখতাম। সে গাড়ির জানালা খুলে তার পাশ দিয়ে যাওয়া লোকেদেরকে প্রহরীদুর্গসচেতন থাক! পত্রিকা নেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাত। একবার সে দুঘন্টায় ৮০টা পত্রিকা অর্পণ করেছিল। প্রায়ই সে এভাবে মণ্ডলীতে যে পুরনো পত্রিকাগুলো ছিল সেগুলো শেষ করে দিত। ইলিনি অন্যান্য উপায়েও নিয়মিত প্রচার করত।

অক্ষমতা সত্ত্বেও সেই বছরগুলোতে আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে প্রতিটা সভায় উপস্থিত হতো। সে কখনও কোন সম্মেলন বা অধিবেশন বাদ দেয়নি, এমনকি গ্রিসে যিহোবার সাক্ষিদেরকে তাড়না করার সময় যখন আমাদেরকে অন্য জায়গায় যেতে হয়েছিল, তখনও সে আমাদের সঙ্গে গিয়েছিল। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সে খুশিমনে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, সাইপ্রাস এবং অন্যান্য দেশের সম্মেলনগুলোতে যোগ দিয়েছিল। যিহোবার সেবায় এমনকি আমার দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার কারণে মাঝে মাঝে তাকে অসুবিধায় পড়তে হলেও ইলিনি কখনও কোন অভিযোগ করেনি বা দাবি করেনি।

এই পরিস্থিতি আমাকে ধৈর্য ধরার ও অটল থাকার এক চিরকালীন শিক্ষা দিয়েছিল। যিহোবা যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, তা আমি অনেক বার উপলব্ধি করেছি। যে-কোন উপায়ে সাহায্য করার জন্য ভাইবোনেরা প্রকৃত ত্যাগস্বীকার করেছিলেন এবং ডাক্তাররা সদয়ভাবে আমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন। সেই কষ্টকর বছরগুলোতে আমাদের কখনও জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব হয়নি, যদিও আমাদের কষ্টকর পরিস্থিতির জন্য আমি পূর্ণ-সময়ের চাকরি করতে পারিনি। যিহোবার আগ্রহ এবং সেবাকে সবসময় প্রথমে রেখেছিলাম।—মথি ৬:৩৩.

অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন যে সেই কষ্টকর সময়গুলোতে কী আমাদেরকে শক্তি জুগিয়েছিল। পিছনে ফিরে তাকালে আমি বুঝতে পারি যে ব্যক্তিগত বাইবেল অধ্যয়ন, যিহোবার কাছে আন্তরিক প্রার্থনা, নিয়মিত খ্রীষ্টীয় সভাগুলোতে উপস্থিত হওয়া এবং প্রচার কাজে উদ্যোগের সঙ্গে অংশ নেওয়া আমাদেরকে ধৈর্য ধরার এবং অটল থাকার জন্য শক্তি জুগিয়েছে। গীতসংহিতা ৩৭:৩-৫ পদে দেওয়া উৎসাহজনক কথাগুলোকে আমরা সবসময় মনে করতাম: “সদাপ্রভুতে নির্ভর রাখ, সদাচরণ কর, . . . সদাপ্রভুতে আমোদ কর, . . . তোমার গতি সদাপ্রভুতে অর্পণ কর, তাঁহাতে নির্ভর কর, তিনিই কার্য্য সাধন করিবেন।” আরেকটা পদ আমাদের কাছে মূল্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছিল আর সেটা হল গীতসংহিতা ৫৫:২২ পদ: “তুমি সদাপ্রভুতে আপনার ভার অর্পণ কর; তিনিই তোমাকে ধরিয়া রাখিবেন।” একটা ছোট বাচ্চা যেমন তার বাবার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখে, ঠিক তেমনই আমরা শুধু আমাদের ভার যিহোবার ওপর অর্পণই করিনি কিন্তু সেগুলো তাঁর ওপর ছেড়েও দিয়েছিলাম।—যাকোব ১:৬.

১৯৮৭ সালের এপ্রিল মাসের ১২ তারিখে আমার স্ত্রী আমাদের ঘরের সামনে যখন প্রচার করছিল, তখন একটা ভারি লোহার দরজা পিছন থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে ফুটপাতে পড়ে যায় এবং গুরুতরভাবে আহত হয়। এর ফলে পরের তিন বছর সে কোমায় থাকে। আর ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে সে মারা যায়।

আমার পুরো সামর্থ্য দিয়ে যিহোবাকে সেবা করা

১৯৬০ সালে, আমি পাইরিয়েসের নিকেয়ায় মণ্ডলীর দাস হিসেবে সেবা করার জন্য নিযুক্ত হই। তখন থেকে পাইরিয়েসের আরও অসংখ্য মণ্ডলীতে সেবা করার সুযোগ আমার হয়েছে। যদিও আমার নিজের কোন ছেলেমেয়ে ছিল না কিন্তু অনেক আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়েকে সত্যে দৃঢ় হতে সাহায্য করার আনন্দ আমার হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন মণ্ডলীর প্রাচীন, পরিচারক দাস, অগ্রগামী এবং বেথেল পরিবারের সদস্য হিসেবে কাজ করছে।

১৯৭৫ সালে গ্রিসে গণতন্ত্র শুরু হওয়ার পর, যিহোবার সাক্ষিরা তাদের সম্মেলনগুলো আর লুকিয়ে লুকিয়ে জঙ্গলে না করে স্বাধীনভাবে করার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিদেশে সম্মেলন সংগঠিত করার যে অভিজ্ঞতা আমাদের কয়েকজনের হয়েছিল, তা যথেষ্ট কাজে এসেছিল। তাই বহু বছর ধরে বিভিন্ন সম্মেলন কমিটিতে সেবা করার আনন্দ এবং সুযোগ আমি উপভোগ করেছি।

এরপর ১৯৭৯ সালে গ্রিসের এথেন্সের সীমান্তে প্রথম অধিবেশন হল তৈরি করার পরিকল্পনা করা হয়। এই বিরাট নির্মাণ প্রকল্পের বিভিন্ন কাজকে সংগঠিত ও শেষ করার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই কাজেও অনেক ধৈর্য দেখানোর এবং অটল থাকার প্রয়োজন ছিল। শত শত আত্মত্যাগী ভাইবোনদের সঙ্গে তিন বছর কাজ করার ফলে আমাদের মধ্যে ভালবাসার ও একতার দৃঢ় বন্ধন গড়ে উঠেছিল। এই প্রকল্পের স্মৃতিগুলো আমার মনে চিরকালের জন্য গেঁথে রয়েছে।

বন্দিদের আধ্যাত্মিক চাহিদাগুলো মেটানো

কয়েক বছর পর আরেকটা নতুন সুযোগ খুলে যায়। করিডালোসে আমার মণ্ডলীর এলাকার কাছাকাছি গ্রিসের সবচেয়ে বড় জেলাখানা ছিল। যিহোবার সাক্ষিদের একজন পরিচারক হিসেবে ১৯৯১ সালের এপ্রিল মাস থেকে প্রতি সপ্তায় এই জেলখানায় যাওয়ার জন্য আমাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। সেখানে আমাকে জেলের বন্দিদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন ও খ্রীষ্টীয় সভাগুলো পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে অনেকে বিরাট পরিবর্তন করেছিলেন আর এভাবে ঈশ্বরের বাক্যের অপরিমেয় ক্ষমতার প্রমাণ দেখিয়েছিলেন। (ইব্রীয় ৪:১২) এটা জেলের কর্মী ও সেইসঙ্গে অন্যান্য বন্দিদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আমি যে বন্দিদেরকে বাইবেল অধ্যয়ন করাতাম, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ছাড়া পেয়ে এখন সুসমাচারের প্রকাশক হয়েছেন।

কিছু দিনের জন্য আমি তিনজন কুখ্যাত মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে অধ্যয়ন করি। আধ্যাত্মিক উন্নতি করার ফলে গ্রিসের সবচেয়ে গরম সময় আগস্ট মাসের মাঝামাঝিতে তারা দাড়ি কামিয়ে, সুন্দরভাবে চুল আঁচড়িয়ে এবং ভাল শার্ট ও টাই পরে বাইবেল অধ্যয়ন করতে এসেছিলেন! এই অদ্ভুত ঘটনা নিজের চোখে দেখার জন্য জেলের পরিচালক, প্রধান রক্ষী এবং কিছু কর্মচারী তাদের অফিস থেকে দৌড়ে আসেন। তারা তাদের নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

আরেকটা উৎসাহজনক অভিজ্ঞতা জেলের মহিলা বিভাগে হয়েছিল। একজন মহিলার সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন শুরু হয়, খুনের দায়ে যার আজীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। তার বিদ্রোহাত্মক কাজকর্মের জন্য তিনি কুখ্যাত ছিলেন। কিন্তু, শীঘ্রিই বাইবেলের সত্য জেনে তিনি এত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করতে শুরু করেন যে, অনেকে মন্তব্য করেন, তিনি যেন সিংহ থেকে মেষে পরিণত হচ্ছিলেন! (যিশাইয় ১১:৬, ৭) খুব শীঘ্রিই তিনি জেলের পরিচালিকার সম্মান এবং আস্থা অর্জন করেন। তিনি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে খুব ভাল উন্নতি করায় এবং যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার যোগ্য হওয়ায় আমি অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম।

অক্ষম এবং বয়স্কদেরকে সাহায্য করা

আমার স্ত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতার সঙ্গে লড়াই করতে দেখা আমাকে, আমাদের মধ্যে থাকা অসুস্থ এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের চাহিদাগুলোর প্রতি আরও সচেতন করে তুলেছিল। এইধরনের ব্যক্তিদেরকে খুঁজে বের করার এবং তাদেরকে প্রেমের সঙ্গে সাহায্য করার জন্য উৎসাহ দিতে যতবার আমাদের প্রকাশনাগুলোতে এইধরনের প্রবন্ধগুলো আসে, ততবার আমার উৎসাহ আরও বেড়ে যায়। এই প্রবন্ধগুলোকে আমি সংগ্রহ করে রেখেছি। কয়েক বছর কেটে যাওয়ায় পর, আমি ১০০রও বেশি পৃষ্ঠার এমন একটা ফোল্ডার সংগ্রহ করি, যেটাতে সবচেয়ে প্রথমে ১৯৬২ সালের ১৫ই জুলাই প্রহরীদুর্গ-তে (ইংরেজি) পাওয়া “বয়স্ক এবং দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি বিবেচনা” প্রবন্ধটা রয়েছে। এইধরনের অনেক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল যে, অসুস্থ এবং বয়স্ক ব্যক্তিদেরকে সুসংগঠিতভাবে সাহায্য করতে পারাটা প্রতিটা মণ্ডলীর জন্য এক বিরাট সুযোগ।—১ যোহন ৩:১৭, ১৮.

প্রাচীনরা ভাইবোনদের একটা দল গঠন করেন, যারা আমাদের মণ্ডলীর অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের প্রয়োজনগুলোর সময় দেখাশোনা করার জন্য সময় দেন। আমরা স্বেচ্ছাসেবকদেরকে বিভিন্ন দলে ভাগ করে দিই, যেমন যারা দিনের বেলায়, যারা রাতের বেলায়, যারা যানবাহনের ব্যবস্থা করতে এবং যারা ২৪ ঘন্টাই সাহায্য করতে পারবেন। শেষের দলের লোকেরা কাজ করার জন্য দ্রুতগামী দলের মতো তৈরি হয়েছিলেন।

এইধরনের চেষ্টার ফল সত্যিই উৎসাহজনক হয়েছিল। উদাহরণ হিসেবে, রোজ দেখতে যেতে হতো এমন একজন একাকি ও অসুস্থ বোনকে একবার মেঝেতে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আমরা একজন বোনকে খবর দিই, যিনি কাছেই থাকতেন এবং যার একটা গাড়ি ছিল। তিনি সেই অসুস্থ বোনকে খুব দ্রুত, মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে কাছের একটা হাসাপাতালে নিয়ে যান! ডাক্তার বলেছিলেন যে, এটা তার জীবন বাঁচিয়েছে।

অক্ষম এবং বয়স্ক ব্যক্তিরা সেই দলের সদস্যদের প্রতি যে কৃতজ্ঞতা দেখিয়েছিলেন, তা অনেক পরিতৃপ্তিদায়ক ছিল। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ঈশ্বরের নতুন বিধিব্যবস্থায় এইধরনের প্রেমময় ভাইবোনদের সঙ্গে একসঙ্গে বেঁচে থাকার আশা সত্যিই হৃদয়কে আনন্দিত করে। আর তাদের কষ্টের সময় তারা যে সাহায্য পেয়েছেন তার মাধ্যমে তাদেরকে ধৈর্য ধরতে সাহায্য করা হয়েছে জানা আরেকটা পুরস্কার।

অটল থাকা পুরস্কার নিয়ে আসে

আমি এখন পাইরিয়েসের একটা মণ্ডলীতে প্রাচীন হিসেবে কাজ করছি। বয়স হয়ে যাওয়ায় এবং অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও আমি সুখী যে, মণ্ডলীর কাজকর্মগুলোতে আমি এখনও সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারছি।

বছরের পর বছর ধরে কষ্টকর পরিস্থিতি, কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং দুর্ঘটনাগুলোর জন্য প্রচুর সাহস ও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়েছে। কিন্তু, এই সমস্যাগুলো মোকাবিলা করার জন্য যিহোবা সবসময় আমাকে প্রয়োজনীয় শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন। প্রায়ই আমি গীতরচকের এই কথাগুলোর সত্যতা উপলব্ধি করেছি: “যখন আমি বলিতাম, আমার চরণ বিচলিত হইল, তখন, হে সদাপ্রভু, তোমার দয়া আমাকে সুস্থির রাখিত। আমার আন্তরিক ভাবনার বৃদ্ধিকালে তোমার দত্ত সান্ত্বনা আমার প্রাণকে আহ্লাদিত করে।”—গীতসংহিতা ৯৪:১৮, ১৯.

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫৭ সালে, আমার স্ত্রী ইলিনির দ্বিতীয় অপারেশনের পর তার সঙ্গে

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬৯ সালে, জার্মানির নুরেমবার্গে এক সম্মেলনে

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

ভাইবোনদের দল, যারা অসুস্থ এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের সাহায্য করেছিলেন