সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে যিহোবার প্রতি প্রেম গেঁথে দেওয়া

আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে যিহোবার প্রতি প্রেম গেঁথে দেওয়া

জীবন কাহিনী

আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে যিহোবার প্রতি প্রেম গেঁথে দেওয়া

বলেছেন ভেরনার মাত্‌সান

কয়েক বছর আগে আমার বড় ছেলে হান্স ভেরনার আমাকে একটা বাইবেল দেয়। প্রচ্ছদ পাতার ভিতরে সে লেখে: “প্রিয় বাবা, যিহোবার বাক্য আমাদেরকে পরিবারগতভাবে জীবনের পথে পরিচালিত করুক। কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, তোমার বড় ছেলে।” বাবামায়েরা বুঝবেন যে, ওই কথাগুলো আমার হৃদয়কে কৃতজ্ঞতায় ও আনন্দে কতটা ভরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ে আমি জানতাম না যে, সামনে আমাদের পরিবারকে কীধরনের কঠিন পরিস্থিতিগুলোর মুখোমুখি হতে হবে।

 জার্মানির হ্যামবার্গ বন্দর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হাস্টেনবেকে ১৯২৪ সালে আমার জন্ম হয় আর আমার মা ও দাদু আমাকে বড় করে তোলে। যন্ত্রপাতির প্রশিক্ষিত কারিগর হিসেবে কাজ করায় আমাকে ১৯৪২ সালে ভ্যারমাখ্‌ত সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় আমি যা অভিজ্ঞতা করেছিলাম তা এতটা ভয়াবহ ছিল যে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমার টাইফয়েড হয়েছিল কিন্তু চিকিৎসার পরেই আমাকে আবার যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের জানুয়ারি মাসে আমি পোল্যান্ডের লড্জে ছিলাম আর সেখানে খুবই গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলাম এবং আমাকে সেনাবাহিনীদের এক হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সময়েও আমি সেখানে ছিলাম। প্রথমে হাসপাতালে এবং পরে নলেনগামা বন্দি শিবিরে আমি গভীরভাবে চিন্তা করার সময় পেয়েছিলাম। এই প্রশ্নগুলো আমাকে চিন্তায় ফেলেছিল যেমন, ঈশ্বর বলে কি সত্যিই কেউ আছেন? যদি থাকেন, তা হলে এত নিষ্ঠুরতাকে তিনি কেন অনুমতি দেন?

বন্দি শিবির থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছু সময় পর, ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, আমি কার্লাকে বিয়ে করি। আমরা একই শহরে বড় হয়ে উঠেছিলাম, কার্লা ছিল একজন ক্যাথলিক কিন্তু আমি কোন ধর্ম পালন করতাম না। যে-পাদরি আমাদের বিয়ে দেন তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে, আমরা যেন প্রতি সন্ধ্যায় একসঙ্গে অন্তত প্রভুর প্রার্থনাটা করি। তার কথামতো আমরা তা করি যদিও জানতাম না যে, আসলে কীসের জন্য আমরা প্রার্থনা করছি।

এক বছর পর হান্স ভেরনারের জন্ম হয়। ঠিক একই সময় ভিলহেম আরেন্স নামে আমার একজন সহকর্মী আমাকে যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি বাইবেল থেকে আমাকে দেখান যে, একদিন যুদ্ধ শেষ হবে। (গীতসংহিতা ৪৬:৯) ১৯৫০ সালের শরৎকালে, আমি যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করি ও বাপ্তিস্ম নিই। এক বছর পর আমার প্রিয়তমা স্ত্রী যখন বাপ্তিস্ম নেয়, তখন আমি কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম!

যিহোবার পথে ছেলেমেয়েদের বড় করে তোলা

বাইবেলে আমি পড়েছিলাম যে, যিহোবা হলেন বিবাহের উদ্যোক্তা। (আদিপুস্তক ১:২৬-২৮; ২:২২-২৪) আমাদের ছেলেমেয়েদের—হান্স ভেরনার, কার্ল হাইন্স, মাইকেল, গেবরিয়েলে ও টমাসের—জন্মের সময় থাকা, এক ভাল স্বামী ও বাবা হওয়ার আমার অঙ্গীকারকে আরও মজবুত করেছে। আমাদের প্রত্যেক সন্তানের জন্মে কার্লা ও আমি খুব খুশি হয়েছি।

১৯৫৩ সালে, নুরেমবার্গে যিহোবার সাক্ষিদের সম্মেলন আমাদের পরিবারের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ ছিল। শুক্রবার দুপুরে “নতুন জগৎ সমাজে ছেলেমেয়েদের লালন-পালন করা” বিষয়বস্তুর ওপর বক্তৃতার সময়ে বক্তা যা বলেছিলেন, তা আমরা কখনোই ভুলিনি: “আমাদের সন্তানদের সবচেয়ে বড় যে-উত্তরাধিকার আমরা দিতে পারি তা হল, ঈশ্বরের সেবক হওয়ার আকাঙ্ক্ষা।” যিহোবার সাহায্যে কার্লা ও আমি ঠিক তা-ই করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কীভাবে?

এটা শুরু করার জন্য আমরা প্রতিদিন পরিবারগতভাবে প্রার্থনা করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম। এটা ছেলেমেয়েদেরকে প্রার্থনার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করেছিল। খুব অল্প বয়সেই প্রত্যেক সন্তান শিখে ফেলেছিল যে, খাবারের আগে আমরা প্রার্থনা করি। এমনকি একেবারে বাচ্চা অবস্থায়ও যখনই তারা তাদের দুধের বোতল দেখত, তারা মাথা নিচু করত ও দুহাত জোড় করত। আমার স্ত্রীর আত্মীয়রা যারা সাক্ষি ছিলেন না তাদের একজন আমাদেরকে একবার বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানের পর নববধূর বাবামা অতিথিদেরকে কিছু জলখাবারের জন্য তাদের বাড়িতে ডাকেন। প্রত্যেকে সঙ্গে সঙ্গে খেতে চায়। কিন্তু আমাদের পাঁচ বছর বয়সী কার্ল হাইন্স বুঝতে পারে যে, এমনটা করা ঠিক নয়। সে বলে, “দয়া করে প্রথমে প্রার্থনা কর।” এই কথা শুনে অতিথিরা প্রথমে তার দিকে, এরপর আমাদের দিকে এবং শেষে নিমন্ত্রণকর্তার দিকে তাকান। আর কোন অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ার আগে, আমি খাবারের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে প্রার্থনা করতে নিমন্ত্রণকর্তার অনুমতি চাই ও তাতে তিনি রাজি হন।

এই ঘটনা আমাকে যীশুর এই কথাগুলোকে মনে করিয়ে দিয়েছিল: “তুমি শিশু ও দুগ্ধপোষ্যদের মুখ হইতে স্তব সম্পন্ন করিয়াছ।” (মথি ২১:১৬) আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, আমাদের নিয়মিত ও আন্তরিক প্রার্থনা সন্তানদের যিহোবাকে তাদের প্রেমময় স্বর্গীয় পিতা হিসেবে দেখতে সাহায্য করেছিল।

যিহোবার প্রতি আমাদের দায়িত্ব

এ ছাড়া সন্তানদের ঈশ্বরকে ভালবাসতে শেখানোর জন্য নিয়মিত তাঁর বাক্য পড়ার ও অধ্যয়ন করার দরকার রয়েছে। এই কথা মনে রেখে প্রতি সপ্তায়, বেশির ভাগ সময় সোমবার সন্ধ্যায় আমরা পারিবারিক অধ্যয়ন করতাম। যেহেতু সবচেয়ে বড় ও ছোট সন্তানের মধ্যে নয় বছরের তফাত রয়েছে, সেইজন্য সন্তানদের চাহিদাগুলো বেশ আলাদা ছিল আর তাই আমরা সবসময় সবার সঙ্গে একই বিষয়বস্তু আলোচনা করতে পারতাম না।

উদাহরস্বরূপ, যে-সন্তানরা তখনও স্কুলে যেতে শুরু করেনি তাদের আমরা খুব সহজভাবে শিক্ষা দিতাম। কার্লা তাদের সঙ্গে বাইবেলের মাত্র একটা পদ আলোচনা করত অথবা বাইবেলের প্রকাশনাগুলোতে দেওয়া ছবিগুলো ব্যবহার করত। সেই সুন্দর স্মৃতিগুলোর কথা আমার এখনও মনে আছে, যখন ছোট্ট বাচ্চারা ভোরবেলা আমাদের বিছনায় চড়ে নতুন জগৎ * (ইংরেজি) বই থেকে তাদের প্রিয় ছবি দেখানোর জন্য আমাদেরকে জাগিয়ে তুলত।

যিহোবাকে ভালবাসার যে-বিভিন্ন কারণ আমাদের রয়েছে, সেই সম্বন্ধে ধৈর্য ধরে ছেলেমেয়েদেরকে শেখানোর এক কৌশল কার্লা রপ্ত করেছিল। শুনতে খুব সাধারণ ও সহজ বলে মনে হলেও, আসলে তা কার্লা ও আমার জন্য শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে এক পূর্ণ সময়ের চাকরির মতো ছিল। তবুও, আমরা হাল ছাড়িনি। তাদের কোমল হৃদয়ে, যিহোবাকে জানে না এমন ব্যক্তিদের প্রভাব পড়া শুরু হওয়ার আগে আমরা তা গেঁথে দিতে চেয়েছিলাম। এই কারণে বাচ্চারা বসতে শেখার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা তাদের পারিবারিক অধ্যয়নে উপস্থিত থাকার জন্য জোর করতাম।

বাবামা হিসেবে কার্লা ও আমি উপাসনার বিষয়ে আমাদের সন্তানদের সামনে সঠিক উদাহরণ স্থাপন করার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলাম। খাবারের, বাগানে কাজ করার বা পায়চারি দিতে যাওয়ার সময় আমরা যিহোবার সঙ্গে প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের সম্পর্ককে মজবুত করার চেষ্টা করতাম। (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬, ৭) প্রত্যেক সন্তানের একেবারে ছোট্ট বয়স থেকে নিজের নিজের বাইবেল আছে কি না, সেই বিষয়টা লক্ষ্য রেখেছিলাম। এ ছাড়া পত্রিকাগুলো পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেকটা কপিতে আমি পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের নাম লিখে দিতাম। এভাবে ছেলেমেয়েরা তাদের নিজের সাহিত্যাদি চিনতে শিখেছিল। ছেলেমেয়েদের সচেতন থাক! পত্রিকার নির্দিষ্ট কিছু প্রবন্ধ পড়ার দায়িত্ব দেওয়ার কথা আমাদের মাথায় আসে। রবিবার দুপুরের খাবারের পর তারা আমাদের ব্যাখ্যা করত যে সেই বিষয়বস্তু তারা কীভাবে বুঝেছে।

সন্তানদের দিকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেওয়া

অবশ্য পরিস্থিতি যে, সবসময়ই ভাল ছিল তা নয়। সন্তানরা যত বড় হতে থাকে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, তাদের হৃদয়ে ভালবাসা গেঁথে দেওয়ার জন্য তাদের হৃদয়ে আসলে কী রয়েছে, তা জানা প্রয়োজন। এর অর্থ তাদের কথা মন দিয়ে শোনা। আমাদের সন্তানরা মাঝে মধ্যে মনে করত যে, কিছু বিষয়ে তাদের অভিযোগ রয়েছে, তাই কার্লা ও আমি তাদের সঙ্গে বসে সেগুলো আলোচনা করতাম। পারিবারিক অধ্যয়নের শেষে বিশেষ করে আধ ঘন্টা আমরা এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য রাখতাম। যে-কেউ খোলাখুলিভাবে তাদের মনের কথা বলতে পারত।

উদাহরণ হিসেবে, আমাদের ছোট দুই সন্তান টমাস ও গেবরিয়েলে মনে করেছিল যে, বাবামা হিসেবে আমরা তাদের বড়দার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি। একবার তারা বলেই ফেলে: “বাবা আমাদের মনে হয় যে, মা ও তুমি, হান্স ভেরনারকে তার খুশি মতো চলতে দাও।” প্রথমে, আমি যেন নিজের কানকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কিন্তু বিষয়টাকে নিরপেক্ষভাবে বিবেচনা করার পর কার্লা ও আমাকে স্বীকার করতে হয়েছিল যে, টমাস ও গেবরিয়েলে ঠিকই বলেছে। তাই, আমরা সব সন্তানদের প্রতি একইরকম ব্যবহার করার চেষ্টা করি।

মাঝে মধ্যে, আমি না চিন্তা করে অথবা অন্যায়ভাবে ছেলেমেয়েদের শাস্তি দিতাম। সেই সময়ে বাবামা হিসেবে আমাদের ক্ষমা চাইতে শিখতে হয়েছিল। এরপরে আমরা যিহোবার কাছে প্রার্থনা করতাম। এটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, সন্তানরা বুঝুক তাদের বাবা যিহোবা ও তাদের অর্থাৎ ছেলেমেয়ের কাছে ক্ষমা চাইতে তৈরি আছে। এর ফলে, তাদের সঙ্গে আমাদের এক উষ্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তারা প্রায়ই আমাদের বলত, “তোমরা আমাদের প্রিয় বন্ধু।” তা শুনে আমরা অনেক খুশি হতাম।

পরিবারগতভাবে কাজ করা একতা নিয়ে আসে। এই জন্য ঘরে প্রত্যেকের কিছু না কিছু কাজ ছিল। হান্স ভেরনারের দায়িত্ব ছিল সপ্তায় একবার দোকানে গিয়ে জিনিসপাতি কিনে আনা আর এরজন্য তাকে যা যা কিনতে হবে সেগুলোর একটা তালিকা সহ কিছু পয়সা হাতে দেওয়া হতো। এক সপ্তায়, আমরা তাকে কোন তালিকা বা পয়সা দিইনি। সে তার মা-কে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে আর মা তাকে বলেন যে, এখন আমাদের হাতে কোন পয়সা নেই। এই কথা শুনে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে ফিশফিশ করতে শুরু করে এবং তারপর সবাই নিজের নিজের পয়সার বাক্স এনে টেবিলের ওপর ঢেলে ফেলে। তারা সবাই চিৎকার করে বলে ওঠে “মা, এখন আমরা কেনাকাটা করতে যেতে পারি!” হ্যাঁ, প্রয়োজনের সময় ছেলেমেয়েরা সাহায্য করতে শিখেছিল এবং তা পরিবারকে আরও একতাবদ্ধ করেছিল।

বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেরা মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করে। উদাহরণ হিসেবে, টমাস ১৬ বছর বয়সী এক সাক্ষি মেয়ের প্রতি খুব বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে। আমি তাকে বুঝিয়ে বলেছিলাম যে, সে যদি মেয়েটাকে সত্যিই পছন্দ করে, তা হলে সেই মেয়েকে বিয়ে করার এবং স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাকে যোগ্য হতে হবে। টমাস বুঝতে পেরেছিল যে, বিয়ে করার জন্য সে তখনও যোগ্য ছিল না কারণ তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর ছিল।

পরিবারগতভাবে উন্নতি করা

একেবারে অল্প বয়স থেকেই ছেলেমেয়েরা একে-একে ঐশিক পরিচর্যা বিদ্যালয়ে অংশ নিতে শুরু করেছিল। আমরা তাদের বক্তৃতাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর ঈশ্বরের প্রতি তাদের আন্তরিক ভালবাসা দেখে আমরা উৎসাহ পেতাম। সীমা ও জেলা অধ্যক্ষরা যারা মাঝে মধ্যে আমাদের সঙ্গে থাকতেন তারা নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা বলতেন বা বাইবেল থেকে পড়ে শোনাতেন। এই অধ্যক্ষ ও তাদের স্ত্রীরা আমাদের পরিবারের হৃদয়ে পূর্ণ-সময়ের সেবার প্রতি প্রেম গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন।

আমরা সম্মেলনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। সন্তানদের মধ্যে ঈশ্বরের দাস হওয়ার আকাঙ্ক্ষা গেঁথে দেওয়ার আমাদের প্রচেষ্টাতে এগুলো এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। সম্মেলনে যাওয়ার আগে লেপেল কার্ড পরা সন্তানদের জন্য এক বিশেষ ব্যাপার ছিল। দশ বছর বয়সে হান্স ভেরনার যখন বাপ্তিস্ম নেয়, তখন আমরা খুবই খুশি হয়েছিলাম। অনেকে বলেছিল যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সে খুবই ছোট কিন্তু ৫০ বছর বয়সে সে আমাকে বলেছিল যিহোবাকে ৪০ বছর ধরে সেবা করতে পেরে সে কতই না কৃতজ্ঞ।

আমরা নিজেদের সন্তানদের দেখিয়েছি যে, যিহোবার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলা কত জরুরি কিন্তু আমরা কখনও তাদেরকে উৎসর্গীকৃত হতে জোর করিনি। কিন্তু আমরা খুশি হয়েছিলাম যখন অন্য সন্তানরা বাপ্তিস্ম নেওয়ার জন্য নিজে থেকে তৈরি হয়েছিল।

যিহোবার ওপর আমাদের ভার অর্পণ করতে শেখা

যখন ১৯৭১ সালে হান্স ভেরনার ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েড এর ৫১তম ক্লাসের এক সদস্য হিসেবে গ্র্যাজুয়েট হয় আর স্পেইনে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করার দায়িত্ব পায়, তখন আমাদের আনন্দের আর সীমা থাকে না। এ ছাড়া একএক করে অন্য সন্তানরাও কিছু সময়ের জন্য পূর্ণ সময়ের পরিচারকের কাজ করে, যা বাবামা হিসেবে আমাদের প্রচুর আনন্দ এনে দেয়। এই সময়ই হান্স ভেরনার আমাকে বাইবেল দিয়েছিল, যে-বিষয়ে এই প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে। পরিবারগতভাবে আমাদের পূর্ণ আনন্দ ছিল।

এরপর আমরা বুঝতে পেরেছিলাম যে, যিহোবার প্রতি আমাদের আরও ঘনিষ্ঠভাবে আসক্ত হওয়ার প্রয়োজন আছে। কেন? কারণ আমরা দেখি যে আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, যেগুলো তাদের বিশ্বাসের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের আদরের মেয়ে গেবরিয়েলে পরীক্ষা থেকে রেহাই পাইনি। ১৯৭৬ সালে লোটারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের কিছু সময় পরেই লোটার অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিনের পর দিন সে দুর্বল হতে থাকে আর মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত গেবরিয়েলে তার সেবাশুশ্রূষা করে। পরিবারের একজন সুস্থ মানুষকে অসুস্থ হতে ও মারা যেতে দেখা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, আমাদের যিহোবার প্রেমময় সাহায্যের কত প্রয়োজন রয়েছে।—যিশাইয় ৩৩:২.

যিহোবার সংগঠনে সেবা করার সুযোগ

১৯৫৫ সালে যখন আমাকে মণ্ডলীর সেবক (বর্তমানে পরিচালক অধ্যক্ষ বলা হয়) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল, তখন আমি ভেবছিলাম যে, সেই দায়িত্ব নেওয়ার যোগ্য আমি নই। অনেক কাজ করার ছিল এবং সেই দায়িত্বগুলো পালন করার একমাত্র উপায় ছিল মাঝে মধ্যে ভোর চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা আমাকে প্রচুর সাহায্য করেছিল আর সন্ধ্যাবেলা অনেক কাজ বাকি থাকলে তারা খেয়াল রাখত যে, আমি যেন বিরক্ত না হই।

তবুও, পরিবারগতভাবে আমরা যতটা সম্ভব অবসর সময় একসঙ্গে কাটাতাম। কখনও সখনও, আমার কর্মকর্তা তার নিজের গাড়ি ব্যবহার করার জন্য আমাকে দিতেন, যাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি বাইরে ঘুরতে যেতে পারি। আমরা যখন জঙ্গলে গিয়ে প্রহরীদুর্গ অধ্যয়ন করতাম, তখন সন্তানরা খুবই আনন্দ পেত। আমরা একসঙ্গে পাহাড়ে চড়তাম, কখনও কখনও জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমার হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতাম।

১৯৭৮ সালে, আমাকে বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ (ভ্রমণ পরিচারক) হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ভারগ্রস্ত হয়ে আমি প্রার্থনা করি: “যিহোবা এটা করার যোগ্য আমি আছি বলে আমি মনে করি না। কিন্তু তুমি যদি চাও যে, আমি চেষ্টা করে দেখি, তা হলে আমি আমার যথাসাধ্য চেষ্টা করব।” দুবছর পর ৫৪ বছর বয়সে আমি আমার ছোটখাটো ব্যাবসা আমাদের ছোট ছেলে টমাসের হাতে দিয়ে দিই।

আমাদের সব সন্তান বড় হয়ে গেছে আর সেই কারণে কার্লা ও আমি যিহোবার জন্য আরও বেশি কিছু করার সুযোগ পেয়েছি। ওই বছরই আমাকে সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং হ্যামবার্গের কিছু অংশ ও সমগ্র শ্লেসভিগ-হোল্সটিন অঞ্চলে আমাকে কার্যভার দেওয়া হয়। এক পরিবার প্রতিপালন করার অভিজ্ঞতা থাকায় আমরা বিশেষভাবে বাবামা ও তাদের ছেলেমেয়েদের অবস্থা বুঝতে পারতাম। অধিকাংশ ভাইরা আমাদের তাদের সীমার বাবামা বলে ডাকতেন।

সীমার কাজে আমার সঙ্গে দশ বছর ধরে সঙ্গ দেওয়ার পর কার্লার একটা অপারেশন করার দরকার হয়ে পড়ে। সেই বছরই ডাক্তাররা জানায় যে, আমার ব্রেইন টিউমার হয়েছে। তাই, আমি সীমা অধ্যক্ষের কাজ ছেড়ে দিই আর অপারেশন করাই। তিন বছর পর, আমি বিকল্প সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে আবারও কাজ শুরু করি। কার্লা ও আমার বয়স এখন ৭০ এর কোঠায় এবং ভ্রমণ কাজ আমরা আর করি না। যিহোবা আমাদের বুঝতে সাহায্য করেছেন যে, যে-কাজ করার সাধ্য আমার আর নেই সেটা করে যাওয়ার কোন অর্থ হয় না।

আগের কথা চিন্তা করে কার্লা ও আমি যিহোবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে, তিনি আমাদের সন্তানদের হৃদয়ে সত্যের প্রতি প্রেম গেঁথে দিতে সাহায্য করেছেন। (হিতোপদেশ ২২:৬) বছরের পর বছর ধরে, যিহোবা আমাদেরকে দায়িত্বগুলো পালন করতে আমাদের পরিচালনা ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। যদিও আমাদের বয়স হয়েছে ও দুর্বল হয়ে পড়েছি কিন্তু যিহোবার প্রতি আমাদের প্রেম চির যৌবন ও জীবন্ত থাকবে।—রোমীয় ১২:১০, ১১.

[পাদটীকা]

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন পাওয়া যায় না।

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৬৫ সালে, হ্যামবার্গে আমাদের পরিবার এলবে নদীর ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৯৮ সালে, পরিবারের কয়েকজন সদস্য বার্লিনে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে

[২৯ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী কার্লার সঙ্গে