ঈশ্বরীয় ভক্তি অভ্যাস করায় পুরস্কৃত
জীবন কাহিনী
ঈশ্বরীয় ভক্তি অভ্যাস করায় পুরস্কৃত
বলেছেন উইলিয়াম আইহিনরিয়া
বাবার পুরনো ব্যথার গোঙানিতে মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তিনি তার পেট ধরে মেঝেতে গড়াগড়ি করছিলেন। মা, আমার দিদি ও আমি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকি। ব্যথা কিছুটা কমে এলে তিনি সোজা হয়ে বসেন, লম্বা শ্বাস নেন এবং বলেন: “এই পৃথিবীতে একমাত্র যিহোবার সাক্ষিরাই শান্তিতে আছেন।” এই মন্তব্যটা শুনে আমি কেমন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলাম, তবে এই কথা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল কারণ আমি আগে কখনও যিহোবার সাক্ষিদের কথা শুনিনি। আমি ভাবছিলাম যে, তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন।
সেই ঘটনাটা ঘটে ১৯৫৩ সালে, যখন আমার বয়স ছয় বছর। আমার বাবার কয়েকজন স্ত্রী ছিল আর আমার বাড়ি ছিল ইয়োসায়, যা মধ্যপশ্চিম নাইজেরিয়ার এক কৃষিপ্রধান গ্রাম। আমি ছিলাম দ্বিতীয় সন্তান কিন্তু বাবার ৩ জন স্ত্রী ও ১৩ জন সন্তানের পরিবারে আমি ছিলাম প্রথম ছেলে। আমরা আমার দাদুর গোলপাতায় ছাওয়া, চারকক্ষের মাটির বাড়িতে থাকতাম। এ ছাড়া, বাড়িতে ঠাকুমা ও বাবার তিনজন ভাই ও তাদের পরিবারও থাকত।
আমার ছেলেবেলা খুবই দুঃখে কেটেছিল। এর এক বিশেষ কারণ ছিল বাবার খারাপ স্বাস্থ্য। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পেটের ব্যথায় ভুগছিলেন আর বেশ কয়েক বছর তার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন। আফ্রিকার কৃষক পরিবারের সাধ্যে কুলোয় এমন কোন চিকিৎসাই—আয়ুর্বেদি ও অর্থোডক্স—তার এই অজ্ঞাত রোগকে সারিয়ে তুলতে পারেনি। এমন অনেক রাতও কেটেছে যখন বাবা যন্ত্রণায় মাটিতে গড়াগড়ি করেছেন আর আমরা পরদিন ভোরে মোরগ ডাকার আগে পর্যন্ত সারারাত তার পাশে বসে বসে কেঁদেছি। এই রোগের চিকিৎসার খোঁজে তিনি প্রায়ই আমাকে ও আমার ভাইবোনদের ঠাকুমার কাছে রেখে মাকে নিয়ে নানান জায়গায় যেতেন।
আমাদের পরিবার মিষ্টি আলু, ক্যাসাভা এবং কোলা নাট
বিক্রি করে কোনরকমে জীবনযাপন করত। এ ছাড়া, আমাদের স্বল্প আয়ে সহযোগিতা করার জন্য আমরা রবারের চাষ করতাম। আমাদের প্রধান খাদ্য ছিল মিষ্টি আলু। আমরা সকালে মিষ্টি আলু খেতাম, দুপুরে মিষ্টি আলুর ভর্তা খেতাম আর রাতে আবারও সেই মিষ্টি আলুই খেতাম। মাঝে মাঝে আমাদের খাবারে কিছুটা বৈচিত্র্য আসত, যখন আমরা ঝলসানো কাঁচকলা খেতাম।পূর্বপুরুষদের উপাসনা ছিল আমাদের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমাদের পরিবার লাঠির মধ্যে কৌড়ি শামুক বেঁধে সেগুলোর কাছে খাবার রাখত। এ ছাড়া, বাবা মন্দ আত্মা ও ডাইনিদের তাড়ানোর জন্য একটা দেবতাকে পুজো করতেন।
আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন আমরা কিছুদিনের জন্য আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে একটা আবাদি জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। সেখানে বাবা গিনি ওয়র্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যা তার পেটের যন্ত্রণার সঙ্গে আরেকটা বাড়তি সমস্যা ছিল। তিনি দিনের বেলা কাজ করতে পারতেন না আর রাতে তলপেটের ব্যথায় কষ্ট পেতেন। আমার জিগার বা স্যান্ডফ্লি রোগ হয়েছিল, যা অনেকটা টাইফাস রোগের মতো। ফলে, আমরা আমাদের যৌথ পরিবারের সদস্যদের সাহায্য পেয়ে বেঁচে থাকতাম। দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়ে না মরতে আমরা আমাদের গ্রাম ইয়োসায় ফিরে গিয়েছিলাম। বাবা চেয়েছিলেন আমি অর্থাৎ তার প্রথম ছেলে যেন কৃষকের চেয়ে ভালভাবে জীবিকা অর্জন করি। তিনি ভেবেছিলেন যে, ভাল শিক্ষা আমাকে পরিবারের জীবনযাপনের মানকে উন্নত করতে এবং আমাদের ভাইবোনদের দেখাশোনা করতে সাহায্য করবে।
বিভিন্ন ধর্মের সঙ্গে যোগাযোগ
আমাদের গ্রামে ফিরে আমি স্কুলে যেতে শুরু করেছিলাম। এর ফলে আমি খ্রীষ্টীয়জগতের ধর্মগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলাম। ১৯৫০ এর দশকে পাশ্চাত্যের শিক্ষাকে কেউ ঔপনিবেশিক প্রভুদের ধর্ম থেকে আলাদা করতে পারত না। যেহেতু আমি ক্যাথলিক প্রাথমিক স্কুলে পড়তাম, তাই আমাকে রোমান ক্যাথলিক হতে হয়েছিল।
১৯৬৬ সালে আমার ১৯ বছর বয়সে আমি ইয়োসা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ইয়োহিনমি শহরের পিলগ্রিম ব্যাপ্টিস্ট সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হই। সেখানে আমার ধর্মীয় শিক্ষা বদলে গিয়েছিল। যেহেতু আমি তখন প্রটেস্টান্ট স্কুলে যাচ্ছিলাম, তাই ক্যাথলিক যাজকরা আমাকে রবিবারের মিশায় যেতে বাধা দিয়েছিলেন।
এই ব্যাপ্টিস্ট স্কুলে পড়ার সময়ই আমি প্রথম বাইবেল পড়তে পেরেছিলাম। যদিও আমি ক্যাথলিক গির্জায় যাওয়া চালিয়ে গিয়েছিলাম, তবুও আমি প্রতি রবিবার ক্যাথলিক গির্জার পর নিজে নিজে বাইবেল পড়তাম। যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষাগুলো আমাকে আকৃষ্ট করেছিল আর আমার মধ্যে ঈশ্বরীয় ভক্তির এক অর্থপূর্ণ জীবনযাপন করার ইচ্ছা জাগিয়ে তুলেছিল। যত বেশি আমি বাইবেল পড়েছিলাম, কিছু ধর্মীয় নেতার কপটতা এবং গির্জার অনেক সদস্যদের অনৈতিক জীবনযাপনের প্রতি আমার বিরক্তি তত প্রগাঢ় হয়েছিল। এই নামধারী খ্রীষ্টানদের মাঝে আমি যা দেখেছিলাম, তা যীশু ও তাঁর শিষ্যরা যা কিছু শিখিয়েছিলেন ও করেছিলেন, সেগুলোর চেয়ে একেবারেই আলাদা ছিল।
বিশেষ করে কয়েকটা ঘটনা আমাকে প্রচণ্ড আঘাত দিয়েছিল। একবার আমি একজন খ্রীষ্টীয় মিশনারির দোকানে একটা রোজারি কিনতে যাই আর সেখানে গিয়ে দেখি যে, দোকানের দরজায় জুজু দেবতার এক কবচ ঝুলানো আছে। আরেকবার ব্যাপ্টিস্ট স্কুলের অধ্যক্ষ আমাকে যৌন হয়রানি করার চেষ্টা করেছিলেন। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তিনি একজন সমকামী ব্যক্তি আর অন্যদেরও তিনি একইভাবে যৌন হয়রানি করেছেন। আমি এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করেছিলাম, নিজেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘যে-ধর্মগুলোর সদস্যরা ও এমনকি নেতারা পর্যন্ত জঘন্য পাপের জন্য কোন নিকাশ দেয় না, তাদের কি ঈশ্বর অনুমোদন করেন?’
ধর্ম পরিবর্তন
তাসত্ত্বেও, বাইবেলে আমি যা কিছু পড়েছিলাম সেগুলো আমার ভাল লাগত আর আমি নিয়মিত তা পড়ে চলার সিদ্ধান্ত প্রকাশিত বাক্য ১৪:৩) যেহেতু আমি স্বর্গে যেতে চেয়েছিলাম, তাই আমি ভেবেছিলাম যে, এই সংখ্যা আদৌ আমার জন্মের আগেই সম্পূর্ণ হয়ে গেছে কি না।
নিয়েছিলাম। তখনই আমি প্রায় ১৫ বছর আগে বাবার বলা এই কথাগুলো নিয়ে চিন্তা করেছিলাম: “এই পৃথিবীতে একমাত্র যিহোবার সাক্ষিরাই শান্তিতে আছেন।” কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম কারণ আমার স্কুলে যুবক সাক্ষিদের প্রায়ই উপহাস করা হতো আর মাঝে মাঝে আমাদের সকালের উপাসনায় যোগ না দেওয়ার কারণে তাদের শাস্তি দেওয়া হতো। আর তাদের কিছু কিছু শিক্ষা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হতো। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হতো যে, মাত্র ১,৪৪,০০০ জন ব্যক্তি স্বর্গে যাবেন। (সাক্ষিরা তাদের আচরণ ও মনোভাবে বেশ আলাদা ছিল। স্কুলের অন্যান্য যুবক-যুবতীদের মতো তারা অনৈতিক ও হিংস্র কাজকর্মে জড়িত হতো না। আমার কাছে তারা সত্যিসত্যি জগতের চেয়ে আলাদা ছিল যেমন আমি বাইবেল থেকে পড়েছিলাম যে, যারা সত্য ধর্ম মানে তাদের সেরকমই হতে হবে।—যোহন ১৭:১৪-১৬; যাকোব ১:২৭.
আমি আরও অনুসন্ধান করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি “যে সত্য অনন্ত জীবনে লইয়া যায়” বইটা পেয়েছিলাম। পরের মাসে একজন অগ্রগামী, যিহোবার সাক্ষিদের পূর্ণ-সময়ের একজন পরিচারক, আমার সঙ্গে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। প্রথম অধ্যয়নে অনুপ্রাণিত হয়ে আমি শনিবার রাতে সত্য বইটা পড়তে শুরু করেছিলাম আর পরের দিন দুপুরের মধ্যে সেটা পড়ে শেষ করেছিলাম। আমি যে-অপূর্ব বিষয়গুলো পড়েছিলাম, তা সঙ্গে সঙ্গে আমার সহপাঠীদের কাছে জানিয়েছিলাম। ছাত্র ও শিক্ষকরা ভেবেছিলেন যে, আমার নতুন বিশ্বাস আমাকে পাগল করে ফেলছিল। কিন্তু আমি জানতাম যে, আমি পাগল হচ্ছি না।—প্রেরিত ২৬:২৪.
নতুন ধর্ম প্রচারের বিষয়টা আমার বাবামার কানে পৌঁছেছিল। তারা আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ফিরে আসার জন্য বলেছিলেন, যাতে আমার সমস্যাটা কী ছিল তা তারা বের করতে পারেন। এমন কেউ ছিল না, যার কাছে আমি পরামর্শের জন্য যেতে পারি কারণ সব সাক্ষি তখন ইলেশায় জেলা সম্মেলনে চলে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে আমি বিভিন্ন প্রশ্নে নাজেহাল হয়েছিলাম এবং আমার মা ও অন্য আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে বিদ্রূপ সহ্য করেছিলাম। বাইবেল থেকে আমি যা শিখছিলাম সেগুলোকে সমর্থন করার জন্য আমি সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলাম।—১ পিতর ৩:১৫.
যিহোবার সাক্ষিরা মিথ্যা শিক্ষক তা প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টার পর আমার কাকা ভিন্নভাবে আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি আমাকে আকুলভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলেন: “মনে রাখবে যে, তুমি স্কুলে পড়ালেখা করতে গেছ। তুমি যদি পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে প্রচারে যাও, তা হলে কখনোই আর পড়ালেখা শেষ করতে পারবে না। তাই নতুন ধর্মে যোগ দেওয়ার আগে তোমার পড়াশোনাটা শেষ করে নাও না কেন।” সেই সময়ে এই কথা আমার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছিল, তাই আমি সাক্ষিদের সঙ্গে অধ্যয়ন করা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে আমার গ্র্যাজুয়েশনের পর সঙ্গে সঙ্গে কিংডম হলে গিয়েছিলাম আর তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি যিহোবার সাক্ষিদের সভাগুলোতে যোগ দিয়ে আসছি। ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট আমি ঈশ্বরের প্রতি আমার উৎসর্গীকরণের চিহ্ন হিসেবে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম। এতে কেবল আমার বাবামা নয় কিন্তু পুরো সমাজ অবাক হয়েছিল। তারা বলেছিলেন যে, আমি তাদের দুঃখ দিয়েছি কারণ ইয়োসা গ্রামে আমিই ছিলাম সরকারের কাছ থেকে বৃত্তি পাওয়া প্রথম ব্যক্তি। আমাকে নিয়ে অনেকের বড় বড় স্বপ্ন ছিল। তারা আশা করেছিলেন যে, আমি হয়তো সমাজের উন্নতির জন্য আমার শিক্ষাকে কাজে লাগাব।
ধর্ম পালটানোর বিভিন্ন পরিণতি
আমার পরিবার ও সমাজের বয়স্ক কিছু ব্যক্তি আমার কাছে কয়েকজনকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন, যাতে তারা আমাকে আমার বিশ্বাস অস্বীকার করার জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করেন। চেষ্টা করার সময় তারা অনেক অভিশাপও দিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, ‘যদি তুমি এই ধর্ম ত্যাগ না কর, তা হলে তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তুমি কোন চাকরি পাবে না। তুমি নিজে কোন বাড়ি বানাতে পারবে না। তুমি বিয়ে করতে পারবে না এবং তোমার নিজের পরিবার হবে না।’
তাদের বিভিন্ন অশুভ ভবিষ্যদ্বাণী সত্ত্বেও, স্কুল শেষ করার দশ মাস পর আমি শিক্ষক হিসেবে একটা চাকরি পেয়েছিলাম। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে আমি আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ভেরনিকাকে বিয়ে করি। পরে সরকার আমাকে একজন কৃষি সম্প্রসার প্রতিনিধি হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। আমি আমার প্রথম গাড়ি কিনি এবং আমাদের বাড়ি বানাতে শুরু করি। ১৯৭৩ সালের ৫ই নভেম্বর আমাদের প্রথম মেয়ে ভিকট্রির জন্ম হয় এবং পরের বছরগুলোতে লিডিয়া, উইলফ্রেড এবং জোনের জন্ম হয়। ১৯৮৬ সালে আমাদের শেষ সন্তান মাইকার জন্ম হয়। তারা সকলেই মূল্যবান সন্তান, যিহোবার কাছ থেকে এক উত্তরাধিকার হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।—গীতসংহিতা ১২৭:৩.
পিছনের কথা ভেবে আমি বলতে পারি যে, আমার ক্ষেত্রে সমাজের সমস্ত অভিশাপ, শাপে বর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছিল। সেইজন্যই আমি আমার প্রথম মেয়ের নাম রেখেছিলাম ভিকট্রি। সম্প্রতি, সমাজের লোকেরা আমাকে লিখেছেন: “ঈশ্বর আপনাকে আশীর্বাদ করছেন, তাই আমরা চাই আপনি দয়া করে বাড়ি ফিরে আসবেন এবং আমাদের সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন।”
ঈশ্বরের পথে সন্তানদের মানুষ করে তোলা
আমার স্ত্রী ও আমি জানতাম যে, আমরা একই সঙ্গে সন্তানদের মানুষ করে তোলার বিষয়ে ঈশ্বরের কাছ থেকে পাওয়া দায়িত্ব ও ধনসম্পদের পিছনে ছুটতে পারব না। তাই আমাদের সাদাসিধে জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে শিখতে হয়েছিল। ভিন্ন জীবনধারা বেছে নেওয়ার সম্ভাব্য পরিণতিগুলোর মুখোমুখি হওয়ার বদলে আমরা এভাবে বেঁচে থাকাই বেছে নিয়েছিলাম।
বিশ্বের এই অঞ্চলের দেশগুলোতে অন্য পরিবারগুলোর সঙ্গে একই বিল্ডিংয়ে থাকা সাধারণ, যেখানে একই স্নানঘর, রান্নাঘর ও আরও অন্যান্য বিষয় ব্যবহার করা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আমরা খুশি ছিলাম যে, সরকারি কর্মচারী হিসেবে যেকোন শহরেই আমাকে বদলি করা হয়েছিল, সব জায়গায়ই আমরা নিজেরা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে পেরেছিলাম। এটা ঠিক যে, এইরকম থাকার জায়গাগুলো বেশ দামি ছিল কিন্তু তা আমাদের সন্তানদের খারাপ প্রভাবগুলো থেকে রক্ষা করেছিল। আমি যিহোবাকে ধন্যবাদ দিই যে, বছরের পর বছর ধরে আমরা আমাদের সন্তানদের আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানুষ করতে পেরেছিলাম।
এ ছাড়া, আমার স্ত্রী সন্তানদের সঙ্গে থেকে তাদের দেখাশোনা করার জন্য ঘরেই ছিল। আমার কাজের শেষে আমরা চেষ্টা করি যাতে পরিবারগতভাবে কাজ করতে পারি। আমরা যা কিছুই করি না কেন, একটা দল হিসেবে তা করি। এর মধ্যে রয়েছে পারিবারিক বাইবেল অধ্যয়ন, মণ্ডলীর সভার জন্য প্রস্তুতি ও তাতে যোগ দেওয়া, খ্রীষ্টীয় পরিচর্যায় অংশ নেওয়া ও সেইসঙ্গে সামাজিক কাজকর্মে যুক্ত হওয়া।
দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৬, ৭ পদের পরামর্শ মেনে চলার জন্য আমরা চেষ্টা করেছি, যেখানে ছেলেমেয়েদের শুধু ঘরেই নয় কিন্তু প্রতিটা সুযোগে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বাবামাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সন্তানেরা বাইরে নয় কিন্তু ভিতরেই তাদের সাহচর্য বা বন্ধু খুঁজেছে। আমাদের উদাহরণের মাধ্যমে তারা তাদের মেলামেশায় সতর্ক হতে শিখেছে কারণ ভেরনিকা ও আমি সেই ব্যক্তিদের সঙ্গে অযথা সময় কাটাই না, যারা কিনা আমাদের বিশ্বাসে বিশ্বাসী নয়।—হিতোপদেশ ১৩:২০; ১ করিন্থীয় ১৫:৩৩.
এটা ঠিক যে, কেবল আমাদের নির্দেশনা ও শিক্ষাই আমাদের সন্তানদের জীবনে একমাত্র ইতিবাচক প্রভাব ছিল না। আমাদের ঘর আগেও ছিল এবং এখনও উদ্যোগী খ্রীষ্টান, যেমন যিহোবার সাক্ষিদের ভ্রমণ অধ্যক্ষদের জন্য খোলা রয়েছে। এই পরিপক্ব খ্রীষ্টানরা আমাদের পরিবারের সঙ্গে যে-সময় কাটিয়েছেন, তা আমাদের সন্তানদের তাদের আত্মত্যাগমূলক জীবনের পথ সম্বন্ধে দেখতে ও শিখতে সুযোগ করে দিয়েছিল। এটা আমাদের শিক্ষাকে মজবুত করেছিল এবং সন্তানেরা সত্যকে নিজের করে নিয়েছিল।
ঈশ্বরীয় ভক্তির জন্য পুরস্কৃত
আজকে আমি ও আমার স্ত্রী এবং সেইসঙ্গে আমাদের চার সন্তান পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যায় রত আছি। আমি প্রথমে ১৯৭৩ সালে অগ্রগামীর কাজ করতে শুরু করেছিলাম। মাঝে মাঝে কয়েক বছর আমাকে অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যার কাজ ছাড়তে হয়েছিল। এ ছাড়া, সময়ে সময়ে আমার কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুলে শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ হয়েছে, যে-স্কুল যিহোবার সাক্ষিদের খ্রীষ্টান অধ্যক্ষদের প্রশিক্ষিত করে তোলে। বর্তমানে আমি হসপিটাল লিয়েইজন কমিটির সদস্য ও সেইসঙ্গে উহনমরা শহরের অধ্যক্ষ হিসেবে সুযোগ উপভোগ করছি।
আমার প্রথম দুই মেয়ে ভিকট্রি ও লিডিয়া দুজন উত্তম খ্রীষ্টান প্রাচীনকে বিয়ে করে সুখে আছে। তারা ও তাদের স্বামীরা নাইজেরিয়ার ইগেডুমায় যিহোবার সাক্ষিদের শাখা অফিসের সদস্য হিসেবে সেবা করছে। আমাদের বড় ছেলে উইলফ্রেড মণ্ডলীতে পরিচারক দাস হিসেবে সেবা করছে এবং ছোট ছেলে মাইকা মাঝে মাঝে সহায়ক অগ্রগামীর কাজ করে। ১৯৯৭ সালে জোন তার উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেছে এবং নিয়মিত অগ্রগামীর পরিচর্যা গ্রহণ করেছে।
আমার জীবনের সবচেয়ে পুরস্কারজনক অভিজ্ঞতা হল অন্যদের যিহোবা ঈশ্বরকে সেবা করতে সাহায্য করা। এই ব্যক্তিদের মধ্যে আমাদের যৌথ পরিবারের কিছু সদস্য রয়েছে। আমার বাবা যিহোবাকে সেবা করার জন্য চেষ্টা করেছেন কিন্তু বহু স্ত্রী থাকার বিষয়টা তাকে পিছিয়ে দিয়েছে। যৌবনকাল থেকেই আমি লোকেদের ভালবেসে এসেছি। যখন আমি দেখি যে, অন্যেরা কষ্ট পাচ্ছে, তখন আমার মনে হয় যেন আমার সমস্যাগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার মনে হয় তারা আমাকে লক্ষ করে যে, আমি তাদের আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে চাই আর এই বিষয়টা তাদেরকে আমার সঙ্গে কথা বলা সহজ করে দেয়।
যাদের আমি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যগুলো সম্বন্ধে জ্ঞান দিতে সাহায্য করেছি তাদের মধ্যে একজন হল শয্যাশায়ী এক যুবক। সে বিদ্যুৎ কোম্পানির এক কর্মী ছিল আর তার চাকরির জায়গায় ভয়ানক বৈদ্যুতিক শক্ খেয়ে বুক থেকে শরীরের নিচের অংশ অবশ হয়ে গিয়েছিল। সে বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হয়েছিল এবং যা শিখেছিল ধীরে ধীরে সেই অনুযায়ী কাজও করেছিল। ১৯৯৫ সালের ১৪ই অক্টোবর আমাদের বাড়ির কাছে এক জলাশয়ে তার বাপ্তিস্মের জন্য সে গত ১৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো বিছানা থেকে নেমে এসেছিল। সে বলেছিল যে, এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন। সে এখন মণ্ডলীতে একজন পরিচারক দাস হিসেবে সেবা করছে।
আমি হলফ করে বলতে পারি যে, প্রায় ৩০ বছর আগে যিহোবার একতাবদ্ধ, উৎসর্গীকৃত লোকেদের সঙ্গে তাঁকে সেবা করা বেছে নিয়েছিলাম বলে আমার একটুও দুঃখ নেই। আমি তাদের মাঝে প্রকৃত প্রেম দেখেছি। এমনকি যিহোবার বিশ্বস্ত দাসদের পুরস্কারের মধ্যে যদি অনন্ত জীবনের পুরস্কার না-ও যুক্ত হয়, তবুও আমি ঈশ্বরীয় ভক্তি অনুযায়ী জীবনযাপন করতে চাই। (১ তীমথিয় ৬:৬; ইব্রীয় ১১:৬) এটা হল সেই পথ, যা আমার জীবনকে গঠন করেছে ও জীবনে স্থিরতা এনে দিয়েছে এবং আমার ও আমার পরিবারে আনন্দ, পরিতৃপ্তি এবং সুখ নিয়ে এসেছে।
[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৯০ সালে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে ও দুই জামাইয়ের সঙ্গে