বৃদ্ধ ও দীর্ঘ জীবনের পরিতৃপ্তি
জীবন কাহিনী
বৃদ্ধ ও দীর্ঘ জীবনের পরিতৃপ্তি
বলেছেন মিউরিয়্যাল স্মিথ
আমার সামনের দরজায় জোরে কড়া নাড়ার শব্দ শোনা যায়। প্রচার কাজে এক ব্যস্ত সকালের পর আমি সবেমাত্র দুপুরের খাবার খেতে ঘরে ফিরে এসেছি। আমার অভ্যাসমতো, আমি এক কাপ চায়ের জন্য জল ফুটাচ্ছিলাম এবং সাময়িক বিরতির জন্য সবেমাত্র প্রস্তুত হচ্ছিলাম। কড়া নাড়ার শব্দ হতেই থাকে আর তাই দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমি ভাবতে থাকি, এই সময় কে আসতে পারে। শীঘ্রই আমি তা জানতে পারি। দরজার সামনে দুজন লোক আর তারা নিজেদের পুলিশ কর্মচারী বলে পরিচয় দেন। তারা বলেন যে, আমার বাড়িতে তারা যিহোবার সাক্ষিদের —এক নিষিদ্ধ সংগঠন—দ্বারা প্রকাশিত সাহিত্যাদি খুঁজতে এসেছেন।
অস্ট্রেলিয়ায় যিহোবার সাক্ষিদের কাজের ওপর কেন নিষেধাজ্ঞা ছিল এবং কীভাবে আমি তাদের একজন হয়েছিলাম? এই সমস্তই ১৯১০ সালে, আমার যখন বয়স দশ বছর ছিল, তখন আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া একটা উপহার দিয়ে শুরু হয়েছিল।
আমার পরিবার উত্তর সিডনির উপকণ্ঠে ক্রোজ নেস্টে এক কাঠের বাড়িতে বাস করত। একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মা সামনের দরজায় একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন। স্যুট পরা ও বই ভরতি ব্যাগ নিয়ে এই অপরিচিত লোকটি কে, তা জানার জন্য আমি কৌতূহলী হয়ে উঠি। আমি একটু ইতস্তত করে আসতে আসতে ঘরের মধ্যে চলে যাই। কিন্তু, কয়েক মিনিট পর মা আমাকে ডাকেন। তিনি বলেন: “এই ভদ্রলোকের কাছে কিছু আগ্রহজনক বই রয়েছে আর সেগুলো সবই শাস্ত্র সম্বন্ধীয়। এখন, যেহেতু শীঘ্রই তোমার জন্মদিন আসতে যাচ্ছে, তাই তুমি একটা নতুন পোশাক অথবা এই বইগুলো নিতে পার। কোন্টা তুমি চাও?”
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “মা, আমি এই বইগুলো চাই।”
তাই দশ বছর বয়সেই, চার্লস টেজ রাসেলের লেখা শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন (ইংরেজি) বইয়ের প্রথম তিনটে খণ্ড আমার কাছে ছিল। ওই ভদ্রলোক মাকে বলেছিলেন যে, এই বইগুলো বোঝার জন্য তিনি যেন আমাকে সাহায্য করেন, কারণ সেগুলো বোঝা আমার জন্য হয়তো খুব শক্ত হবে। মা বলেছিলেন যে, তিনি তা করতে পেরে খুশিই হবেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই ঘটনার অল্প কয়েক দিন পরেই মা মারা যান। বাবা ভালভাবেই আমার ভাই, বোন ও আমার যত্ন নেন, তা সত্ত্বেও এখন আমাকে বাড়তি দায়দায়িত্ব বহন করতে হয় আর এগুলো আমাকে ভারগ্রস্ত করে তোলে। কিন্তু, সামনেই আরেকটা দুঃখজনক ঘটনা অপেক্ষা করছিল।
১৯১৪ সালে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় আর এর মাত্র এক বছর পর, আমাদের প্রিয় বাবাকে হত্যা করা হয়। তখন, আমার অনাথ ভাই ও বোনকে আত্মীয়দের সঙ্গে থাকতে পাঠানো হয় আর আমাকে একটা ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হয়। কখনও কখনও, একাকিত্বের জন্য আমি হতাশ হয়ে পড়তাম। তবুও, আমাকে আমার প্রিয় যন্ত্রসংগীত, বিশেষ করে পিয়ানো বাজানোর সুযোগ দেওয়ায় আমি কৃতজ্ঞ। এরপর বেশ কিছু বছর কেটে যায় এবং আমি বোর্ডিং স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েট হই। ১৯১৯ সালে, আমি রয় স্মিথকে বিয়ে করি, যিনি একজন বাদ্যযন্ত্র বিক্রেতা ছিলেন। ১৯২০ সালে, আমাদের একটা বাচ্চা হয় আর তাই আবারও আমি দৈনন্দিন জীবনের চিন্তায় ডুবে যাই। কিন্তু সেই বইগুলো সম্বন্ধে কী?
একজন প্রতিবেশী আধ্যাত্মিক সত্য জানান
এই কয়েক বছর ধরে, আমি “বাইবেলের বইগুলো”-কে সঙ্গে সঙ্গে রেখেছি। সত্যি বলতে কী, যদিও আমি কখনও সেগুলো পড়িনি কিন্তু মনে মনে আমি জানতাম যে, সেগুলোতে যে-বার্তা রয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এরপর, ১৯২০ দশকের শেষ দিকে একদিন, লিল বিমসান নামে আমাদের এক প্রতিবেশী দেখা করতে আসেন। আমরা বসার ঘরে গিয়ে বসি এবং চা খাই।
হঠাৎ অবাক হয়ে তিনি বলেন, “ওহ্, আপনাদের কাছে ওই বইগুলো রয়েছে!”
বুঝে উঠতে না পেরে আমি জিজ্ঞেস করি, “কোন্ বইগুলো?”
তিনি বইয়ের তাকে রাখা শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন বইগুলো দেখান। লিল সেগুলো ধার নেন এবং ঘরে নিয়ে গিয়ে আগ্রহের সঙ্গে সেগুলো পড়েন। তিনি যা পড়েছিলেন সে বিষয়ে তার উৎসাহ খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। লিল বাইবেল ছাত্রদের কাছ থেকে আরও সাহিত্য নেন, সেই সময় যিহোবার সাক্ষিরা এই নামে পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া, তিনি যা কিছু শিখছিলেন সে সমস্তই আমাদের না বলে থাকতে পারেননি। যে-বইগুলো তিনি নিয়েছিলেন, তার একটা ছিল ঈশ্বরের বীণা (ইংরেজি) আর শীঘ্রই সেটা আমাদের ঘরে চলে আসে। শেষে বাইবেল-ভিত্তিক এই প্রকাশনাটা পড়ার জন্য যখন আমি সময় করে নিয়েছিলাম, তখনই যিহোবার সেবায় আমার জীবন শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত, আমি সেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর পেয়েছিলাম যা আমার গির্জা আমাকে দিতে পারেনি।
আনন্দের বিষয় যে, রয় বাইবেলের বার্তার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন আর তাই আমরা দুজনেই বাইবেলের উৎসুক ছাত্র হয়ে উঠি। আগে, রয় ফ্রিম্যাসনের একজন সদস্য ছিলেন। তখন আমাদের পরিবার সত্য উপাসনায় একতাবদ্ধ আর তাই একজন ভাই পুরো পরিবারের সঙ্গে সপ্তাহে দুবার বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে শুরু করেন। বাইবেল ছাত্রদের আয়োজিত সভাগুলোতে যখন আমরা যোগ দিতে শুরু করেছিলাম, তখন আরও উৎসাহ পেয়েছিলাম। সিডনির যে-জায়গায় সভাগুলো হতো সেটা ছিল নিউটাউন উপকণ্ঠে ভাড়া করা একটা ছোট্ট হল। সেই সময়, সারা দেশে ৪০০-রও কম সাক্ষি ছিলেন, তাই অধিকাংশ ভাইদের সভাগুলোতে যোগ দিতে বেশ দূর থেকে আসতে হতো।
আমাদের পরিবারের জন্য, সভাগুলোতে যোগ দেওয়ার মানে ছিল নিয়মিত সিডনি হারবার পার হওয়া। ১৯৩২ সালে সিডনি হারবার ব্রিজ তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত, প্রতিবার ফেরি-নৌকা করে পার হতে হতো। এই যাত্রার পিছনে অনেকখানি সময় ও অর্থ চলে গেলেও, আমরা যিহোবার জোগানো এই আত্মিক খাবারের কোনটাকেই বাদ না দেওয়ার চেষ্টা করতাম। নিজেদের সত্যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়নি, কারণ শীঘ্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে চলেছিল আর তাই নিরপেক্ষ থাকার বিষয়টা আমাদের পরিবারের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে যাচ্ছিল।
পরীক্ষা ও আশীর্বাদের সময়
১৯৩০ দশকের প্রথমদিকটা আমার ও আমার পরিবারের জন্য খুবই আনন্দের ছিল। ১৯৩০ সালে আমি বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম আর তাই ১৯৩১ সালে সেই স্মরণীয় সম্মেলনে আমি উপস্থিত ছিলাম, যখন আমরা সকলে উঠে দাঁড়িয়ে যিহোবার সাক্ষি এই সুন্দর নামটা গ্রহণ করেছিলাম। সংগঠন উৎসাহিত করেছিল এমন সব ধরনের প্রচার ও অভিযানগুলোতে অংশ নিয়ে আমি ও রয় এই নামের সঙ্গে মিল রেখে চলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। উদাহরণ হিসেবে, ১৯৩২ সালে আমরা এক বিশেষ পুস্তিকা অভিযানে অংশ নিয়েছিলাম, যা সিডনি হারবার ব্রিজের উদ্বোধন দেখতে আসা লোকেদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। লাউডস্পীকার লাগানো গাড়ির ব্যবহার ছিল আমাদের কাছে এক লক্ষণীয় বিষয় আর আমরা আমাদের পরিবারের গাড়িতে সাউন্ড সিস্টেম লাগানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। এই প্রযুক্তির সাহায্যে, আমরা সিডনির প্রতিটা রাস্তায় ভাই রাদারফোর্ডের দেওয়া রেকর্ড করা বাইবেলের বক্তৃতাগুলো বাজিয়ে শুনিয়েছিলাম।
কিন্তু, পরিস্থিতি আবার পালটে যেতে থাকে এবং দিন-দিন আরও কঠিন হয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালের চরম অর্থনৈতিক মন্দা অস্ট্রেলিয়ার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে, তাই রয় ও আমি সাদাসিধে জীবনযাপন করার সিদ্ধান্ত নিই। যে-একটা উপায়ে আমরা তা করেছিলাম তা ছিল মণ্ডলীর কাছাকাছি চলে এসে আর এইভাবে আমরা আমাদের যাতায়াতের খরচ অনেকটা কমিয়ে ছিলাম। কিন্তু, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক যখন বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল, তখন অর্থনৈতিক চাপ খুবই তুচ্ছ হয়ে উঠেছিল।
জগতের অংশ না হওয়ার বিষয়ে যীশুর আদেশের বাধ্য হওয়ার কারণে, সারা পৃথিবীতে যিহোবার সাক্ষিরা নির্যাতনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিলেন আর অস্ট্রেলিয়া এর ব্যতিক্রম ছিল না। যুদ্ধের উন্মাদনায়, কেউ কেউ আমাদের সাম্যবাদী বলে আখ্যা দেয়। এই বিরোধীরা মিথ্যাভাবে দাবি জানায় যে, যিহোবার সাক্ষিরা অস্ট্রেলিয়াতে তাদের নিজস্ব চারটে রেডিও স্টেশন ব্যবহার করে জাপানি সৈন্যদের কাছে সংবাদ পাঠাচ্ছে।
যে-যুবক ভাইদের সৈন্যদলে কাজ করার জন্য ডাকা হয়েছিল, আপোশ করার জন্য তাদের অনেক চাপ দেওয়া হয়েছিল। আমি এ কথা বলতে পেরে আনন্দিত যে, আমাদের তিন ছেলেই তাদের বিশ্বাসের পক্ষে পদক্ষেপ নিয়েছিল এবং নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল। আমাদের বড় ছেলে, রিচার্ডের ১৮ মাসের জেল হয়েছিল। আমাদের মেজো ছেলে, কেভিন নিরপেক্ষ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আমাদের ছোট ছেলে স্টুয়ার্ট নিরপেক্ষতার বিষয় সম্বন্ধে আদালতের জবাবদিহি শেষ করে ফেরার পথে এক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। এই দুঃখজনক ঘটনা অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। কিন্তু, রাজ্য এবং পুনরুত্থান সম্বন্ধে যিহোবার প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর দৃষ্টি আমাদের তা সহ্য করতে সাহায্য করেছিল।
তারা সত্যিকারের পুরস্কার হারিয়েছিলেন
১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে, অস্ট্রেলিয়ায় যিহোবার সাক্ষিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু, যীশুর প্রেরিতরা যেমন করেছিলেন, তেমনই আমি ও রয় মনুষ্যদের অপেক্ষা বরং ঈশ্বরের আজ্ঞার বাধ্য হয়েছিলাম আর তাই আড়াই বছর ধরে আমরা গোপনে কাজ করে গিয়েছিলাম। আর সেই সময়ই সাদা পোশাক পরা দুজন পুলিশ আমার দরজায় কড়া নেড়েছিলেন, যেটার বিষয়ে আমি আগে উল্লেখ করেছি। এরপর কী ঘটেছিল?
আমি তাদের ভিতরে ডাকি। তারা যখন ঘরে ঢোকেন, তখন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনারা ঘর তল্লাশি করার আগে আমি যদি আমার চা-টা শেষ করি, তা হলে আপনারা কি কিছু মনে করবেন?” অবাক হওয়ার মতো বিষয় হল যে, তারা রাজি হয়েছিলেন আর তাই যিহোবার কাছে প্রার্থনা করার জন্য আমি রান্না ঘরে যাই ও শান্তভাবে চিন্তা করতে থাকি। যখন আমি ফিরে আসি, তখন একজন পুলিশ আমাদের অধ্যয়নের জায়গায় ঢোকেন এবং সেখানে প্রহরীদুর্গ ছাপ সমেত যা কিছু দেখতে পেয়েছিলেন সমস্তই নিয়ে নেন, যার মধ্যে আমার প্রচারের ব্যাগে থাকা সাহিত্য এবং আমার বাইবেলও ছিল।
এরপর তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি পিজ্বোর্ডের বাক্সগুলোতে আরও কোন সাহিত্য লুকিয়ে রাখেননি তো? আমরা খবর পেয়েছি যে, আপনারা প্রত্যেক সপ্তাহে এই রাস্তার শেষে একটা হলে সভায় যোগ দিতে যান আর সেখান থেকে অনেক সাহিত্য নিয়ে আসেন।’
আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘এ কথা সত্যি কিন্তু এখন তা এখানে নেই।’
তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা তা জানি, মিসেস স্মিথ। আমরা এও জানি যে, এই অঞ্চলের চারপাশে লোকেদের ঘরে-ঘরে সাহিত্য মজুত রাখা আছে।’
আমাদের ছেলের শোবার ঘরে, তারা পাঁচটা পিজ্বোর্ডের বাক্স খুঁজে পেয়েছিলেন যেগুলোর মধ্যে স্বাধীনতা অথবা রোমান ক্যাথলিকবাদ (ইংরেজি) পুস্তিকার কপিগুলো ছিল।
তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কি নিশ্চিত যে, গ্যারাজের মধ্যে আর কোন কিছু নেই।”
আমি বলেছিলাম, “না, সেখানে আর কিছু নেই।”
এরপর তিনি খাবার ঘরে একটা আলমারি খোলেন। সেটার মধ্যে তিনি কিছু খালি ফর্ম দেখতে পান, যেগুলো মণ্ডলীর রিপোর্টের জন্য ব্যবহৃত হতো। তিনি সেগুলো নেন আর তারপর গ্যারাজ তল্লাশি করার জন্য জোর করেন।
আমি বলেছিলাম, “তা হলে এই দিক দিয়ে আসুন।”
আমার পিছন পিছন তারা গ্যারাজের দিকে আসেন এবং সেটা তল্লাশি করার পর তারা চলে যান।
সেই পুলিশরা মনে করেছিলেন যে, ওই বাক্স পাঁচটাতে তারা এক অপূর্ব পুরস্কার পেয়েছেন! কিন্তু, তারা সত্যিকারের পুরস্কার ছেড়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়, আমি মণ্ডলীর সচিব হিসেবে সেবা করছিলাম আর তাই ঘরে মণ্ডলীর প্রকাশকদের তালিকা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিল। কৃতজ্ঞ হওয়ার বিষয় যে, এইরকম তল্লাশির জন্য প্রস্তুত থাকতে ভাইরা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন আর তাই আমি সাবধানে এই কাগজপত্রগুলো লুকিয়ে রাখতে পেরেছিলাম। আমি সেগুলোকে খামগুলোর মধ্যে ঢুকিয়ে খামগুলোকে আমার চা, চিনি ও ময়দার টিনের নিচে রেখে দিয়েছিলাম। এ ছাড়া, আমার পাখির খাঁচায় কিছু রেখে দিয়েছিলাম, যেটা গ্যারাজের কাছেই ছিল। তাই পুলিশরা যে-তথ্য জানতে চেয়েছিলেন, তারা ঠিক এর একেবারে কাছ দিয়েই চলে গিয়েছিলেন।
পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করা
১৯৪৭ সালে, আমাদের ছেলেরা তাদের নিজস্ব সংসার শুরু করে। এই সময়, রয় ও আমি পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই। দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রগুলোতে প্রয়োজন ছিল, তাই আমরা আমাদের বাড়ি বিক্রি করে একটা ভ্রাম্যমাণ গাড়ি অথবা ট্রেলর কিনি, যেটাকে আমরা নাম দিয়েছিলাম মিস্পা আর এর মানে ছিল “ওয়াচটাওয়ার।” এইধরনের জীবন ধারা আমাদের দূরবর্তী এলাকাগুলোতে প্রচার করার সুযোগ করে দিয়েছিল। প্রায়ই, আমরা অনির্ধারিত গ্রাম্য এলাকায় কাজ করতাম। সেই সময়ের অনেক প্রিয় স্মৃতি আমার রয়েছে। আমি যাদের সঙ্গে অধ্যয়ন পরিচালনা করতাম তাদের মধ্যে বেভারলি নামে একজন যুবতী ছিল। বাপ্তিস্ম নেওয়ার মতো উন্নতি করার আগেই, সে এলাকা ছেড়ে চলে যায়। অনেক বছর পর, একটা সম্মেলনে যখন একজন বোন আমার কাছে এগিয়ে এসে নিজেকে বেভারলি বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল, তখন আমার সেই আনন্দের কথা একবার কল্পনা করুন! পরে তাকে তার স্বামী ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যিহোবার সেবা করতে দেখা আমার জন্য কী আনন্দের বিষয়ই না ছিল।
১৯৭৯ সালে, আমার অগ্রগামীদের পরিচর্যা স্কুলে যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেই স্কুলে একটা বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল আর তা ছিল, অগ্রগামীর পরিচর্যা করে চলতে হলে একজনের ব্যক্তিগত অধ্যয়নের ভাল রুটিন থাকা দরকার। আমি অবশ্যই তা সত্যি মনে করেছি। সারা জীবন আমি অধ্যয়ন, সভা এবং পরিচর্যা করেছি। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে একজন নিয়মিত অগ্রগামী হিসেবে সেবা করে যাওয়াকে আমি একটা সুযোগ বলে মনে করি।
স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোর সঙ্গে মোকাবিলা করা
কিন্তু, বিগত কয়েক দশকে আমার বিশেষ কয়েকটা সমস্যা হয়েছিল। ১৯৬২ সালে চোখ পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, আমার
চোখে গ্লোকোমা হয়েছে। সেই সময়ে, চিকিৎসার ভাল ব্যবস্থা ছিল না আর তাই আমার দৃষ্টিশক্তি খুব তাড়াতাড়ি কমে আসে। রয়ের স্বাস্থ্যও ভেঙে পড়েছিল আর ১৯৮৩ সালে তিনি খুব গুরুতর স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছিলেন, যার ফলে তার শরীর আংশিকভাবে অবশ হয়ে গিয়েছিল ও তিনি কথা বলতে পারতেন না। ১৯৮৬ সালে তিনি মারা যান। আমার পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যার সময় তিনি আমাকে অনেক ব্যবহারিক সাহায্য জুগিয়েছিলেন আর তাই প্রচণ্ডভাবে আমি তার অভাব বোধ করি।এই সব বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও, আমি এক ভাল আধ্যাত্মিক রুটিন বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। আমি একটা মজবুত গাড়ি কিনেছিলাম, যেটা আমাদের মফস্বল এলাকায় ক্ষেত্রের পরিচর্যার জন্য উপযুক্ত আর আমার মেয়ে জয়েসের সাহায্যে অগ্রগামীর পরিচর্যা করে চলি। আমার দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে খারাপ হতে থাকে আর শেষ পর্যন্ত একটা চোখ পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। ডাক্তারেরা এর জায়গায় একটা কাঁচের চোখ বসান। তবুও, ম্যাগনিফাইং গ্লাস এবং বড় অক্ষরে ছাপানো সাহিত্য ব্যবহার করে আমার এক চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি দিয়ে আমি তিন থেকে পাঁচ ঘন্টা অধ্যয়নের পিছনে ব্যয় করতে পেরেছি।
অধ্যয়নের সময় আমার কাছে সবসময়ই মূল্যবান ছিল। তাই, একদিন বিকেলে অধ্যয়ন করার সময় হঠাৎ করে যখন আমি চোখে কিছুই দেখতে পাই না, তখন সেটা কীরকম প্রচণ্ড এক আঘাত ছিল তা আপনারা কল্পনা করতে পারেন। মনে হয়েছিল কেউ যেন বাতি নিভিয়ে দিয়েছে। আমার দৃষ্টিশক্তি এখন একেবারেই চলে গেছে। কীভাবে আমি অধ্যয়ন চালিয়ে গিয়েছি? এমনকি যদিও আমি এখন কানে ভাল শুনতে পাই না, তবুও আধ্যাত্মিকভাবে আমাকে শক্তিশালী রাখার জন্য আমি অডিওক্যাসেট ও আমার পরিবারের প্রেমময় সাহায্যের ওপর নির্ভর করি।
শেষ পর্যন্ত ধৈর্য ধরা
এখন, একশ বছরেরও বেশি বয়সী এক ব্যক্তি হিসেবে, আমার স্বাস্থ্যে আরও কিছু সমস্যা রয়েছে আর তাই আমার জীবনের গতি অনেকটা কমে এসেছে। কখনও কখনও, আমি সবকিছু তালগোল তাকিয়ে ফেলি। বস্তুত, এখন আমি একেবারেই দেখতে পাই না, কখনও কখনও আমি রাস্তা হারিয়ে ফেলি! আমি আবারও কিছু বাইবেল অধ্যয়ন করাতে চাই কিন্তু আমার বর্তমান স্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আর বাইরে যেতে ও তাদের খুঁজে বের করতে পারি না। প্রথমে, এটা আমাকে হতাশ করেছিল। আমাকে আমার সীমাবদ্ধতাগুলোকে মেনে নিতে ও আমার ক্ষমতা অনুয়ায়ী কাজ করে সন্তুষ্ট থাকতে শিখতে হয়েছে। এটা সহজ ছিল না। তবুও, প্রত্যেক মাসে আমাদের মহান ঈশ্বর যিহোবার সম্বন্ধে কথা বলে কিছু সময় কাটানোর রিপোর্ট দিতে পারা আমার জন্য কতই না আনন্দের! আমার কাছে যখনই বাইবেল সম্বন্ধে কথা বলার সুযোগগুলো আসে, যেমন যখন নার্স, মিস্ত্রি ও অন্যেরা আমার বাড়িতে আসে, আমি দেরি না করে তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা নিই—অবশ্য কৌশলে।
আমার সবচেয়ে বড় তৃপ্তিদায়ক আশীর্বাদ হল আমার পরিবারের চারপুরুষকে বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করতে দেখা। এদের কেউ কেউ অগ্রগামী পরিচারক হিসেবে, যেখানে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেখানে গিয়ে সেবা করেছে, প্রাচীন হিসেবে অথবা পরিচারক দাস হিসেবে এবং বেথেলে সেবা করেছে। অবশ্যই, আমার বংশের অনেকের মতো আমিও আশা করেছিলাম যে, এই বিধিব্যবস্থার শেষ খুব শীঘ্রই আসবে। কিন্তু আমার সত্তর বছরের পরিচর্যার সময় কত বৃদ্ধিই না আমি দেখেছি! এরকম মহৎ কিছুতে রত থাকা আমাকে অনেক পরিতৃপ্তি এনে দেয়।
যে-নার্সরা আমাকে দেখতে আসে তারা বলে যে, নিশ্চয় আমার বিশ্বাসের জন্য আমি এতদিন বেঁচে আছি। আমি তাদের সঙ্গে একমত। যিহোবার সেবায় সক্রিয় থাকা জীবনের সবচাইতে উত্তম অধ্যায়। রাজা দায়ূদের মতো, আমি সত্যিই বলতে পারি যে, আমি বৃদ্ধা এবং দীর্ঘ জীবনে পরিতৃপ্ত।—১ বংশাবলি ২৯:২৮, NW.
(২০০২ সালের ১লা এপ্রিলে বোন মিউরিয়্যাল স্মিথ মারা যান যখন এই প্রবন্ধটা শেষ করা হচ্ছিল। ১০২ বছর বয়স হতে মাত্র এক মাস বাকি ছিল, বিশ্বস্ততা ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে তিনি সত্যিই উদাহরণযোগ্য ছিলেন।)
[২৪ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আমার বয়স যখন পাঁচ বছর ছিল এবং ১৯ বছর বয়সে, যখন আমার স্বামী রয়ের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল
[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]
আমাদের গাড়ি এবং ক্যারাভ্যান যেটাকে আমরা মিস্পা নাম দিয়েছিলাম
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
১৯৭১ সালে আমার স্বামী, রয়ের সঙ্গে