আপনি কি আপনার নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখবেন?
আপনি কি আপনার নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখবেন?
গতকাল কটা চড়ুই পাখি মারা গেছে? কেউ তা জানে না আর এত পাখি রয়েছে যে, সম্ভবত কম লোকই এদের বিষয় চিন্তা করে। কিন্তু, যিহোবা চিন্তা করেন। আপাতদৃষ্টিতে নগণ্য এই পাখিদের কথা বলতে গিয়ে যীশু তাঁর শিষ্যদের বলেছিলেন: “তোমাদের পিতার অনুমতি বিনা তাহাদের একটীও ভূমিতে পড়ে না।” তিনি আরও বলেছিলেন: “ভয় করিও না, তোমরা অনেক চড়াই পাখী হইতে শ্রেষ্ঠ।”—মথি ১০:২৯, ৩১.
শিষ্যরা পরে আরও ভাল করে বুঝেছিলেন যে, যিহোবা তাদের কত মূল্যবান মনে করেন। তাদের মধ্যে একজন, প্রেরিত যোহন লিখেছিলেন: “আমাদিগেতে ঈশ্বরের প্রেম ইহাতেই প্রকাশিত হইয়াছে যে, ঈশ্বর আপনার একজাত পুত্ত্রকে জগতে প্রেরণ করিয়াছেন, যেন আমরা তাঁহা দ্বারা জীবন লাভ করিতে পারি।” (১ যোহন ৪:৯) যিহোবা কেবল মুক্তির মূল্যের ব্যবস্থাই করেননি কিন্তু তিনি তাঁর দাসদের প্রত্যেককে এই আশ্বাসও দেন যে: “‘আমি কোন ক্রমে তোমাকে ছাড়িব না, ও কোন ক্রমে তোমাকে ত্যাগ করিব না।’”—ইব্রীয় ১৩:৫.
স্পষ্টত, যিহোবার লোকেদের জন্য তাঁর ভালবাসা হল অটল। কিন্তু, প্রশ্ন ওঠে, ‘আমরা কি যিহোবার প্রতি এতটাই অনুরক্ত যে, কখনও তাঁকে পরিত্যাগ করব না?’
আমাদের নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙার জন্য শয়তানের চেষ্টা
যিহোবা যখন শয়তানের কাছে ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা তুলে ধরেছিলেন, তখন শয়তান মুখের ওপর উত্তর দিয়েছিল: “ইয়োব কি বিনা লাভে তোমাকে উপাসনা করে?” (ইয়োব ১:৯, টুডেজ ইংলিশ ভারসন) সে বলেছিল যে, ঈশ্বরের প্রতি মানুষের আনুগত্য নির্ভর করে একমাত্র ‘এর থেকে যে-উপকার তারা পায়’ সেটার ওপর। এই কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে যথেষ্ট লোভনীয় প্রস্তাবে যেকোন খ্রীষ্টানই নীতিনিষ্ঠার বিষয়ে আপোশ করতে পারে।
ইয়োবের ক্ষেত্রে, শয়তান প্রথম দিকে দাবি করেছিল যে, ইয়োব যদি তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসগুলো হারান, তা হলে তিনি ঈশ্বরের প্রতি আর অনুগত থাকবেন না। (ইয়োব ১:১০, ১১) এই দাবি যখন মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছিল, তখন শয়তান অভিযোগ করেছিল: “প্রাণের জন্য লোক সর্ব্বস্ব দিবে।” (ইয়োব ২:৪) যদিও শয়তানের এই দাবি কারও কারও কাছে হয়তো সত্যি মনে হতে পারে কিন্তু ইয়োব তার নীতিনিষ্ঠার বিষয়ে আপোশ করতে অস্বীকার করেছিলেন। ঐতিহাসিক বিবরণ প্রমাণ দেয় যে, ইয়োব তার নীতিনিষ্ঠা বজায় রেখেছিলেন। (ইয়োব ২৭:৫; ৪২:১০-১৭) আপনিও কি একইরকম আনুগত্য দেখান? নাকি আপনি শয়তানকে আপনার নীতিনিষ্ঠা ভাঙার সুযোগ দেবেন? প্রত্যেক খ্রীষ্টানই জড়িত রয়েছেন এমন কিছু সত্য বিষয় পরীক্ষা করে দেখার সময় নিজের সম্বন্ধে চিন্তা করুন।
প্রেরিত পৌল বিশ্বাস করতেন যে, সত্যিকারের খ্রীষ্টীয় আনুগত্য খুবই দৃঢ় হতে পারে। তিনি লিখেছিলেন: “আমি নিশ্চয় জানি, কি মৃত্যু, কি জীবন, . . . কি উপস্থিত বিষয় সকল, কি ভাবী বিষয় সকল, . . . কি অন্য কোন সৃষ্ট বস্তু কিছুই আমাদের প্রভু খ্রীষ্ট যীশুতে অবস্থিত ঈশ্বরের প্রেম হইতে আমাদিগকে পৃথক্ করিতে পারিবে না।” (রোমীয় ৮:৩৮, ৩৯) যিহোবার প্রতি আমাদের ভালবাসা যদি দৃঢ় হয়, তা হলে আমরাও একই নিশ্চয়তা রাখতে পারি। এরকম ভালবাসা হল এক ধ্বংসাতীত বন্ধন, যেটাকে এমনকি মৃত্যুও পরাজিত করতে পারে না।
ঈশ্বরের সঙ্গে যদি আমাদের এরকম সম্পর্ক থাকে, তা হলে আমরা কখনও জিজ্ঞেস করব না, ‘কয়েক বছর পরেও কি ২ করিন্থীয় ৪:১৬-১৮) আমরা যদি আমাদের সমস্ত হৃদয় দিয়ে যিহোবাকে ভালবাসি, তা হলে আমরা কখনও তাঁকে দুঃখ দেব না।—মথি ২২:৩৭; ১ করিন্থীয় ১৩:৮.
আমি যিহোবাকে সেবা করে যাব?’ এরকম অনিশ্চয়তা ইঙ্গিত দেয় যে, ঈশ্বরের প্রতি আমাদের আনুগত্য আমাদের জীবনকালে আমাদের প্রতি হয়তো যা কিছু ঘটতে পারে, সেগুলোর ওপর নির্ভর করে। প্রকৃত নীতিনিষ্ঠা বাহ্যিক পরিস্থিতিগুলোর দ্বারা প্রভাবিত হয় না। এটা নির্ভর করে, ভিতরে আমরা কেমন ব্যক্তি সেটার ওপর। (কিন্তু, আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, শয়তান আমাদের নীতিনিষ্ঠা ভাঙার জন্য সবসময় চেষ্টা করে চলেছে। সে হয়তো আমাদের মাংসের অভিলাষের প্রলোভনে ফেলতে পারে, সঙ্গী-সাথিদের চাপের কাছে হার মানাতে পারে অথবা কোন দুর্দশাকে সত্য পরিত্যাগ করার কারণ হতে দিতে পারে। যদিও আমাদের নিজ অসিদ্ধতাগুলো শয়তানের কাজকে আরও সহজ করে দেয় কিন্তু ঈশ্বর থেকে বিচ্ছিন্ন এই জগৎ হল এই আক্রমণে শয়তানের প্রধান মিত্র। (রোমীয় ৭:১৯, ২০; ১ যোহন ২:১৬) তবুও, এই যুদ্ধে আমাদের কিছু সুযোগসুবিধা রয়েছে আর এর সবচেয়ে বড় সুবিধাটা হল, শয়তানের পরিকল্পনাগুলো সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত নই।—২ করিন্থীয় ২:১১.
শয়তানের পরিকল্পনাগুলো কী কী? ইফিষীয়দের উদ্দেশে পৌল তার চিঠিতে সেগুলোকে ‘নানাবিধ চাতুরী’ বলে বর্ণনা করেছেন। (ইফিষীয় ৬:১১) আমাদের নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙার জন্য শয়তান আমাদের পথে চতুর কলাকৌশলগুলো রাখে। আনন্দের বিষয় যে, এই কলাকৌশলগুলো আমরা বুঝতে পারি, কারণ আমাদের জন্য দিয়াবলের পন্থাগুলো ঈশ্বরের বাক্যে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। যীশু ও ইয়োবের নীতিনিষ্ঠাকে নষ্ট করার জন্য শয়তানের আক্রমণ এইরকম কয়েকটা উপায়কে প্রকাশ করে, যার মাধ্যমে সে আমাদের খ্রীষ্টীয় নীতিনিষ্ঠাকেও ভাঙার চেষ্টা করে।
যীশুর নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙা যায়নি
যীশুর পরিচর্যার শুরুতে, শয়তান ঈশ্বরের পুত্রকে পাথরকে রুটিতে পরিণত করার প্রতিদ্বন্দ্বিতা জানিয়ে তাঁকে আক্রমণ করার স্পর্ধা দেখিয়েছিল। কতই না কৌশলী! যীশু ৪০ দিন ধরে কিছু খাননি, তাই নিঃসন্দেহে তিনি খুব ক্ষুধার্ত ছিলেন। (লূক ৪:২, ৩) শয়তান প্রস্তাব দিয়েছিল যে, যীশু যেন তখনই তাঁর স্বাভাবিক ক্ষুধা মেটান কিন্তু এমনভাবে যা যিহোবার ইচ্ছার বিপরীত ছিল। একইভাবে আজকে, জগতের অপপ্রচারগুলো পরিণতির বিষয়ে সামান্য ভেবে বা মাথা না ঘামিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে উৎসাহ দেয়। মূল কথা হল, ‘আপনার এখনই এটা দরকার’ বা সহজ কথায়, ‘এখনই তা করুন!’
যীশু যদি পরিণতির কথা না ভেবে ক্ষুধার যন্ত্রণা মেটাতেন, তা হলে যীশুকে তাঁর নীতিনিষ্ঠার বিষয়ে আপোশ করানোর ব্যাপারে শয়তান সফল হতো। যীশু বিষয়গুলোকে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছিলেন আর তাই তিনি দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন: “লেখা আছে, ‘মনুষ্য কেবল রুটীতে বাঁচিবে না।’”—লূক ৪:৪; মথি ৪:৪.
এরপর শয়তান তার ফন্দি পালটায়। যীশু যেখান থেকে উদ্ধৃতি করছিলেন, সেই শাস্ত্রপদগুলোকে ভুলভাবে প্রয়োগ করে, দিয়াবল যীশুকে মন্দিরের চূড়ার ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়তে উৎসাহ দিয়েছিল। শয়তান দাবি করেছিল, ‘একজন দূত তোমাকে রক্ষা করিবেন।’ যীশুর কেবল নিজের প্রতি মনোযোগ আনার জন্য তাঁর পিতার কাছ থেকে অলৌকিক সুরক্ষা দাবি করার ইচ্ছা ছিল না। তাই যীশু বলেছিলেন, “‘তুমি আপন ঈশ্বর প্রভুর [“যিহোবার,” NW] পরীক্ষা করিও না।’”—মথি ৪:৫-৭; লূক ৪:৯-১২.
শয়তান শেষ যে-ফন্দিটা কাজে লাগিয়েছিল সেটা আরও বেশি সরাসরি ছিল। কেবল ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করার বিনিময়ে যীশুকে মথি ৪:৮-১১; লূক ৪:৫-৮.
সমস্ত জগৎ ও এর গৌরব দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে সে যীশুর সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেছিল। শয়তান মূলত তার সমস্ত কিছুই দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু, যীশু তাঁর পিতার প্রধান শত্রুর সামনে কীভাবে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করতে পারেন? ভাবাই যায় না! তাই, যীশু উত্তর দিয়েছিলেন, “‘তোমার ঈশ্বর প্রভুকেই [“যিহোবাকেই,” NW] প্রণাম করিবে, কেবল তাঁহারই আরাধনা করিবে।’”—আক্রমণ করার তিনটে চেষ্টাই ব্যর্থ হলে, শয়তান ‘কিয়ৎকালের জন্য যীশুর নিকট হইতে চলিয়া গেল।’ (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (লূক ৪:১৩) এটা ইঙ্গিত করে যে, যীশুর নীতিনিষ্ঠাকে পরীক্ষায় ফেলার জন্য শয়তান সবসময় সুযোগ খুঁজে বেড়িয়েছিল। প্রায় আড়াই বছর পর, এরকম একটা সময় এসেছিল যখন যীশু তাঁর আসন্ন মৃত্যুর জন্য তাঁর শিষ্যদের প্রস্তুত করতে শুরু করেছিলেন। প্রেরিত পিতর বলেছিলেন: “প্রভু, ইহা আপনা হইতে দূরে থাকুক, ইহা আপনার প্রতি কখনও ঘটিবে না।”—মথি ১৬:২১, ২২.
যীশুর শিষ্যদের মধ্যে একজনের কাছ থেকে এসেছে বলে কি এরকম সদুদ্দেশ্যপূর্ণ অথচ ভ্রান্ত পরামর্শ তাঁর কাছে ভাল লাগতে পারে? যীশু সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওই কথাগুলো আসলে যিহোবার নয় কিন্তু শয়তানের চিন্তাধারাকে প্রতিফলিত করেছিল। তাই, খ্রীষ্ট দৃঢ়ভাবে উত্তর দিয়েছিলেন: “আমার সম্মুখ হইতে দূর হও, শয়তান, তুমি আমার বিঘ্নস্বরূপ; কেননা যাহা ঈশ্বরের, তাহা নয়, কিন্তু যাহা মনুষ্যের, তাহাই তুমি ভাবিতেছ।”—মথি ১৬:২৩.
যিহোবার প্রতি যীশুর অশেষ ভালবাসা থাকায় শয়তান তাঁর নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙতে পারেনি। দিয়াবলের আয়ত্তে ছিল এমন কোনকিছুই, কোন পরীক্ষা, তা সেটা যত চরমই হোক না কেন, স্বর্গীয় পিতার প্রতি যীশুর নীতিনিষ্ঠাকে দুর্বল করতে পারেনি। বিভিন্ন পরিস্থিতি যখন আমাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখাকে কঠিন করে তোলে, তখন আমরাও কি একইরকম সংকল্প রাখব? ইয়োবের উদাহরণ আমাদের আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যে, আমরা কীধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোর মুখোমুখি হতে পারি।
দুর্দশার মুখোমুখি হয়েও আনুগত্য দেখানো
ইয়োব যেমন দেখেছিলেন, আমাদের ওপর যেকোন সময়ে বিভিন্ন দুর্দশা ঘটতে পারে। দশ ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি একজন সুখী বিবাহিত ব্যক্তি ছিলেন এবং তার এক ভাল আধ্যাত্মিক তালিকা ছিল। (ইয়োব ১:৫) কিন্তু ইয়োবের অজান্তে, ঈশ্বরের প্রতি তার নীতিনিষ্ঠা স্বর্গীয় আদালতে একটা বিচার্য বিষয় হয়ে উঠেছিল আর যেকোনভাবেই হোক শয়তান ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল।
শীঘ্রই, ইয়োব তার ধনসম্পত্তি হারিয়েছিলেন। (ইয়োব ১:১৪-১৭) কিন্তু, পরীক্ষার মধ্যেও ইয়োবের নীতিনিষ্ঠা দৃঢ় থাকে কারণ তিনি কখনও টাকাপয়সার ওপর তার আস্থা রাখেননি। যখন ইয়োব ধনী ছিলেন সেই সময়ের কথা মনে করে তিনি বলেছিলেন: “আমি যদি স্বর্ণকে আশাভূমি করিয়া থাকি, . . . যদি আনন্দ করিয়া থাকি, সম্পদ বাড়িয়াছে বলিয়া, . . . তবে তাহাও . . . অপরাধ হইত, কেননা তাহা হইলে ঊর্দ্ধ্ববাসী ঈশ্বরকে অস্বীকার করিতাম।”—ইয়োব ৩১:২৪, ২৫, ২৮.
আজকেও, রাতারাতি আমরা সমস্ত কিছু হারাতে পারি। একজন যিহোবার সাক্ষি ব্যবসায়ী প্রচুর পরিমাণ টাকার দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন, তিনি বলতে গেলে প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি অকপটে স্বীকার করেন: “আমার প্রায় হার্ট আ্যটাক হওয়ার দশা হচ্ছিল। আসলে আমার মনে হয় যে, আমার তা-ই হতো কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল বলেই তা হয়নি। যাইহোক, এই অভিজ্ঞতা আমাকে এই বিষয়টাকে গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে যে, আমার জীবনে আধ্যাত্মিক মূল্য প্রথম স্থানে ছিল না। টাকা কামানোর শিহরণ সবকিছুকে ঢেকে দিয়েছিল।” তখন থেকে এই সাক্ষি তার ব্যাবসার কাজকে কমিয়েছেন আর তিনি একজন নিয়মিত সহায়ক অগ্রগামী হিসেবে খ্রীষ্টীয় পরিচর্যায় মাসে ৫০ ঘন্টা অথবা তারও বেশি ঘন্টা ব্যয় করেন। কিন্তু, একজনের ধনসম্পত্তি হারানোর চেয়ে অন্যান্য সমস্যাগুলো আরও বেশি কষ্টকর হতে পারে।
ইয়োব যখন তার দশ ছেলেমেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন, তখন তার ধন হারানোর সংবাদ একেবারেই তুচ্ছ হয়ে উঠেছিল। তবুও, তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন: “সদাপ্রভুর নাম ধন্য হউক।” (ইয়োব ১:১৮-২১) আমরা যদি হঠাৎ করে আমাদের পরিবারের কিছু সদস্যকে হারাই, তা হলে আমরা কি আমাদের নীতিনিষ্ঠা বজায় রাখব? ফ্রান্সিসকো স্পেনের একজন খ্রীষ্টান অধ্যক্ষ, এক মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় তার দুই সন্তানকে হারিয়েছিলেন। যিহোবার আরও কাছে এসে এবং খ্রীষ্টীয় পরিচর্যায় তার কাজকে বাড়িয়ে তিনি সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন।
এমনকি শোচনীয়ভাবে তার ছেলেমেয়েদের হারানোর পরও, ইয়োব ২:৯, ১০) তার নীতিনিষ্ঠা তার পরিবারের সমর্থনের ওপর নয় কিন্তু যিহোবার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করেছিল।
ইয়োবের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়নি। শয়তান তাকে এক বিরক্তিকর, যন্ত্রণাদায়ক রোগে আক্রান্ত করেছিল। সেই সময়, ইয়োব তার স্ত্রীর কাছ থেকে ভুল পরামর্শ পেয়েছিলেন। তার স্ত্রী তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, “ঈশ্বরকে জলাঞ্জলি দিয়া প্রাণত্যাগ কর।” ইয়োব তার পরামর্শকে অগ্রাহ্য করেছিলেন আর তাই তিনি “আপন ওষ্ঠাধরে পাপ” করেননি। (ফ্লোরা, যার স্বামী ও বড় ছেলে দশ বছরেরও বেশি আগে খ্রীষ্টীয় পথ ত্যাগ করেছে, তিনি নিশ্চয়ই ইয়োবের অনুভূতি বুঝতে পারেন। তিনি স্বীকার করেন, ‘আপনি যখন হঠাৎ করে আপনার পরিবারের সমর্থন হারান, তখন তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হতে পারে। কিন্তু আমি জানতাম যে, যিহোবার সংগঠনের বাইরে আমি সুখ খুঁজে পাব না। তাই, একজন উত্তম স্ত্রী ও মা হওয়ার চেষ্টা করার সময় আমি অটল ছিলাম এবং যিহোবাকে প্রথম স্থানে রেখেছিলাম। আমি অবিরত প্রার্থনা করেছিলাম আর যিহোবা আমাকে শক্তি দিয়েছিলেন। আমি একজন সুখী ব্যক্তি কারণ, আমার স্বামীর প্রচণ্ড বিরোধিতা সত্ত্বেও, আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে শিখেছি।’
ইয়োবের নীতিনিষ্ঠাকে ভাঙার জন্য শয়তানের পরের ফন্দিতে ইয়োবের তিন বন্ধু জড়িত ছিল। (ইয়োব ২:১১-১৩) তারা যখন তার সমালোচনা করতে শুরু করেছিল, তখন সেটা কতই না কষ্টদায়ক ছিল। তিনি যদি তাদের যুক্তিতর্কগুলো মেনে নিতেন, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই যিহোবা ঈশ্বরের ওপর তার আস্থা হারিয়ে ফেলতেন। তাদের নিরুৎসাহজনক পরামর্শ তাকে দুঃখ দিতে ও তার নীতিনিষ্ঠাকে ভেঙে দিতে পারত আর এভাবে শয়তানের পরিকল্পনা সফল হতো।
কিন্তু বিপরীতে, ইয়োব দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন: “প্রাণ থাকিতে আমি আপন সিদ্ধতা [“নীতিনিষ্ঠা,” NW] ত্যাগ করিব না।” (ইয়োব ২৭:৫) তিনি এ কথা বলেননি যে, ‘আমি তোমাদের আমার নীতিনিষ্ঠা ভেঙে দেওয়ার সুযোগ দেব না!’ ইয়োব জানতেন যে, তার নীতিনিষ্ঠা নির্ভর করেছিল তার নিজের এবং যিহোবার প্রতি তার ভালবাসার ওপর।
নতুন শিকার ধরার জন্য এক চক্রান্ত
শয়তান এখনও বন্ধুবান্ধব এবং সহ বিশ্বাসীদের কাছ থেকে ভ্রান্ত পরামর্শ অথবা অবিবেচনাপূর্ণ মন্তব্যগুলোকে কাজে লাগায়। মণ্ডলীর বাইরে থেকে তাড়নার চাইতে মণ্ডলীর মধ্যে থেকে নিরুৎসাহ সহজেই আমাদের আস্থাকে দুর্বল করে দিতে পারে। একজন খ্রীষ্টান প্রাচীন, যিনি আগে একজন সৈনিক হিসেবে সৈন্যদলে যুদ্ধ করেছিলেন, তিনি ওই বিষয়টাকে কিছু সহ খ্রীষ্টানদের অবিবেচনাপূর্ণ কথাবার্তা ও কাজের দরুন যে-কষ্ট ভোগ করেছিলেন তার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। পরে তিনি বলেছিলেন: “আমার অভিজ্ঞতায় এটাই ছিল সবচেয়ে কঠিন বিষয়।”
আরেকটা দিক দিয়ে, আমরা আমাদের সহ বিশ্বাসীদের অসিদ্ধতার কারণে এত বেশি বিরক্ত হতে পারি যে, আমরা নির্দিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই অথবা এমনকি খ্রীষ্টীয় সভাগুলোতে আসা বাদ দিতে শুরু করি। আমাদের মনের ক্ষতকে সারিয়ে তোলা হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে হতে পারে। কিন্তু অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা এবং অন্যরা কী করে অথবা বলে সেগুলোর দ্বারা আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ অর্থাৎ যিহোবার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে দুর্বল হতে দেওয়া কতই না দুঃখের বিষয়। আমরা যদি তা হতে দিই, তা হলে আমরা শয়তানের পুরনো চক্রান্তগুলোর একটাতে আটকা পড়ব।
এটা ঠিক যে, খ্রীষ্টীয় মণ্ডলীতে আমরা উচ্চ মানগুলো আশা করি। কিন্তু আমরা যদি আমাদের মতোই অসিদ্ধ সহ উপাসকদের কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করি, তা হলে নিশ্চিতভাবেই আমরা হতাশ হব। বিপরীতে, যিহোবা তাঁর দাসদের কাছ থেকে যা আশা করেন তা বাস্তবধর্মী। আমরা যদি তাঁর উদাহরণ অনুকরণ করি, তা হলে আমরা তাদের অসিদ্ধতাগুলো ক্ষমা করার জন্য তৈরি থাকব। (ইফিষীয় ৪:২, ৩২) প্রেরিত পৌল এই পরামর্শ দিয়েছিলেন: “ক্রুদ্ধ হইলে পাপ করিও না; সূর্য্য অস্ত না যাইতে যাইতে তোমাদের কোপাবেশ শান্ত হউক; আর দিয়াবলকে স্থান দিও না।”—ইফিষীয় ৪:২৬, ২৭.
বাইবেল যেমন স্পষ্টভাবে দেখায়, শয়তান নানাধরনের চতুর কলাকৌশলগুলো ব্যবহার করে এটা দেখার জন্য যে—যদি পারে—একজন খ্রীষ্টানের নীতিনিষ্ঠা ভাঙার জন্য সে কোন্ উপায়টাকে ব্যবহার করতে পারে। তার কিছু চক্রান্ত পাপপূর্ণ মাংসের কাছে আকর্ষণীয় বলে মনে হয়, অন্যগুলো যন্ত্রণার উৎস হয়। আগের আলোচনা থেকে আপনি দেখতে পারেন যে, কেন আপনার কখনও অসতর্ক হওয়া উচিত নয়। আপনার হৃদয়ে দৃঢ়ভাবে ঈশ্বরের প্রতি ভালবাসা নিয়ে দিয়াবলকে মিথ্যাবাদী বলে প্রমাণ করার সংকল্প নিন এবং যিহোবার হৃদয়কে আনন্দিত করুন। (হিতোপদেশ ২৭:১১; যোহন ৮:৪৪) মনে রাখবেন, আমাদের পথে যে-পরীক্ষাই আসুক না কেন, সত্যিকারের খ্রীষ্টীয় নীতিনিষ্ঠার বিষয়ে যেন কখনও আপোশ করা না হয়।