সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

যুদ্ধের পর সম্প্রসারণের কাজে অংশ নেওয়ার এক সুযোগ

যুদ্ধের পর সম্প্রসারণের কাজে অংশ নেওয়ার এক সুযোগ

জীবন কাহিনী

যুদ্ধের পর সম্প্রসারণের কাজে অংশ নেওয়ার এক সুযোগ

বলেছেন ফিলিপ এস. হফম্যান

উনিশ পঁয়তাল্লিশ সালের মে মাসে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে নেথেন এইচ. নর, যিনি তখন সারা পৃথিবীর যিহোবার সাক্ষিদের প্রচার কাজ দেখাশোনা করছিলেন, তিনি তার ২৫ বছর বয়সী সচিব মিলটন জি. হেনশেলের সঙ্গে ডেনমার্কে আসেন। দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষিত এই পরিদর্শনের জন্য একটা বিরাট হল ভাড়া করা হয়েছিল। আমাদের যুবকদের জন্য ভাই হেনসেলের বক্তৃতা বিশেষ উৎসাহের ছিল কারণ তিনি আমাদের বয়সী ছিলেন এবং তার বক্তৃতার জন্য তিনি এই বিষয়টা বেছে নিয়েছিলেন: “আর তুমি যৌবনকালে আপন সৃষ্টিকর্ত্তাকে স্মরণ কর।”—উপদেশক ১২:১.

 সেই পরিদর্শনের সময় আমরা জেনেছিলাম যে, সারা পৃথিবীতে প্রচার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রোমাঞ্চকর বিষয়গুলো ঘটছে আর আমরা হয়তো এতে অংশ নিতে পারি। (মথি ২৪:১৪) উদাহরণ হিসেবে, অল্পবয়সী পুরুষ ও মহিলাদের মিশনারি কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে একটা নতুন স্কুল খোলা হয়েছিল। ভাই নর জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, আমাদের যদি আমন্ত্রণ জানানো হয়, তা হলে আমরা “কেবল যাওয়ার টিকিট” পাব আর শেষ পর্যন্ত কোথায় আমাদের কার্যভার দেওয়া হবে, তা আমরা জানব না। তবুও, আমরা কয়েকজন আবেদন পাঠাই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের অভিজ্ঞতাগুলো বলার আগে আসুন ১৯১৯ সালে আমার জন্মের সময়কার অভিজ্ঞতা বলি। যুদ্ধের আগে ও যুদ্ধের সময়ে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যা আমার জীবনকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছিল।

একজন কুলাঙ্গারের কাছ থেকে বাইবেলের সত্য পাওয়া

আমি—মায়ের প্রথম সন্তান—যখন তার গর্ভে ছিলাম, তখন তিনি প্রার্থনা করেছিলেন যে আমি যদি ছেলে হই, তা হলে আমি যেন মিশনারি হতে পারি। তার ভাই একজন বাইবেল ছাত্র ছিলেন, যে-নামে যিহোবার সাক্ষিদের সেই সময়ে ডাকা হতো কিন্তু মায়ের পরিবার তাকে এক কুলাঙ্গার মনে করত। আমাদের বাড়ি কোপেনহেগেনের কাছে ছিল এবং সেখানে যখন বাইবেল ছাত্রদের বার্ষিক সম্মেলনগুলো হতো, তখন মা টমাস মামাকে আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ডাকতেন, কারণ তিনি একটু দূরে থাকতেন। ১৯৩০ সালের মধ্যে তার চমৎকার বাইবেলের জ্ঞান ও যুক্তি মাকে একজন বাইবেল ছাত্রী হতে দৃঢ়প্রত্যয় জুগিয়েছিল।

মা বাইবেল ভালবাসতেন। দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৭ পদের আজ্ঞানুসারে তিনি ‘গৃহে বসিবার, পথে চলিবার, শয়ন কিম্বা গাত্রোত্থান কালে’ আমার বোন ও আমাকে শিক্ষা দিতেন। একটা সময় আসে যখন আমি ঘরে-ঘরে প্রচারে অংশ নিতে শুরু করেছিলাম। আমি আত্মার অমরত্ব ও নরকাগ্নির মতো বিষয়গুলো যা গির্জায় শিক্ষা দেওয়া হতো, সেগুলো আলোচনা করতে ভালবাসতাম। আমি দক্ষতার সঙ্গে বাইবেল থেকে দেখাতে পারতাম যে এই শিক্ষাগুলো ভুল।—গীতসংহিতা ১৪৬:৩, ৪; উপদেশক ৯:৫, ১০; যিহিষ্কেল ১৮:৪, NW.

আমাদের পরিবার একতাবদ্ধ হয়েছিল

১৯৩৭ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের পরে, যিহোবার সাক্ষিদের ডেনমার্ক শাখা দপ্তরের সাহিত্য কেন্দ্রে কিছু সময়ের জন্য সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আমি এক বাণিজ্যিক কলেজে মাত্র কিছু সময় আগে পড়াশোনা শেষ করেছিলাম আর আমার কোন দায়িত্ব ছিল না, তাই সেই কেন্দ্রে সাহায্য করার জন্য আমি ইচ্ছা প্রকাশ করি। সেই কেন্দ্রের কাজ যখন শেষ হয়েছিল, তখন আমাকে শাখা দপ্তরে সাহায্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এর কিছু পরেই আমি বাড়ি ছেড়ে কোপেনহেগেনের শাখা দপ্তরে চলে আসি, যদিও তখনও আমি বাপ্তিস্ম নিইনি। প্রতিদিন পরিপক্ব খ্রীষ্টানদের সঙ্গে মেলামেশা আমাকে আধ্যাত্মিভাবে উন্নতি করতে সাহায্য করেছিল। পরের বছর ১৯৩৮ সালের ১লা জানুয়ারি যিহোবা ঈশ্বরের কাছে আমার জীবনকে উৎসর্গের প্রতীক হিসেবে আমি জলে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম।

১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এরপর ১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল জার্মানির সৈন্যবাহিনী ডেনমার্ক দখল করেছিল। যেহেতু ডেনমার্কের অধিবাসীদের ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট স্বাধীনতা দেওয়া হতো, তাই আমরা আমাদের প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

এরপর একটা চমৎকার ঘটনা ঘটেছিল। বাবা একজন সক্রিয় অনুগত সাক্ষি হওয়ায় আমাদের পরিবারের আনন্দ পূর্ণ হয়েছিল। তাই, আরও চারজন ডেনমার্কের অধিবাসীর সঙ্গে আমাকে যখন গিলিয়েড স্কুলের অষ্টম ক্লাসের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়, তখন আমার পরিবারের সবাই আমাকে উৎসাহ দিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাঁচ মাস ব্যাপী স্কুল কোর্স নিউ ইয়র্ক প্রদেশের সাউথ ল্যানসিঙ্গে এক মনোরম ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

গিলিয়েড ও গিলিয়েডের পরের প্রশিক্ষণ

গিলিয়েড অনেক নতুন বন্ধু বানানোর সুযোগ খুলে দিয়েছিল। একদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসের মধ্যে ইংল্যান্ডের হ্যারাল্ড কিং এর সঙ্গে যখন পায়চারি করছিলাম, তখন আমরা আলোচনা করছিলাম যে, আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর আমাদের কোথায় পাঠাতে পারে। হ্যারাল্ড বলেছিলেন, “আমি বিশ্বাস-ই করি না যে, ডোভারের শ্বেত চূড়া শেষবারের মতো আমার দেখা হয়ে গেছে।” তিনি ঠিকই বলেছিলেন, সেই চূড়া আবার দেখতে তার ১৭ বছর লেগে গিয়েছিল এবং এর মধ্যে সাড়ে চার বছর তিনি চিনের কারাগারে সলিটারি কনফাইনমেন্টে কাটিয়েছিলেন! *

আমাদের গ্র্যাজুয়েশনের পর আমাকে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোকে আধ্যাত্মিকভাবে সাহায্য করার জন্য পরিদর্শন করতে পাঠানো হয়। আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল। টেক্সাসের ভাইদের জন্য সবেমাত্র গিলিয়েড স্কুল থেকে আসা একজন ইউরোপীয় যুবক ব্যক্তিকে পাওয়া আগ্রহের বিষয় ছিল। কিন্তু, টেক্সাসে মাত্র সাত মাস থাকার পর আমাকে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে ডেকে পাঠানো হয়। সেখানে ভাই নর আমাকে অফিসের কাজ করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন ও বেথেলের সমস্ত দপ্তরের কার্যাবলি শেখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর আমি যখন ডেনমার্কে ফিরে এসেছিলাম, তখন আমার শেখা বিষয়গুলো কাজে লাগাতে হয়েছিল এবং ব্রুকলিনে যেভাবে করা হয় ঠিক সেভাবে সমস্ত কিছু হচ্ছে কি না, সেই বিষয় নিশ্চিত হতে হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল আরও কার্যকারী হওয়ার জন্য পৃথিবীব্যাপী শাখাগুলোর কাজে সমন্বয়সাধন করা। পরে ভাই নর আমাকে জার্মানিতে স্থানান্তরিত করেছিলেন।

বিভিন্ন শাখায় নির্দেশনাগুলো কাজে লাগানো

১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে আমি যখন জার্মানির উইসবেডেনে গিয়ে পৌঁছাই, তখনও পর্যন্ত জার্মানির বেশ কয়েকটা শহর ধ্বংসাত্মক অবস্থায় ছিল। প্রচার কাজে যে-পুরুষরা নেতৃত্ব দিচ্ছিল তারা ছিল সেই ব্যক্তি, যারা ১৯৩৩ সালে হিটলারের শাসনের শুরু থেকে তাড়িত হচ্ছিল। কয়েকজন আট থেকে দশ বছর অথবা আরও বেশি সময় কারাগারে ও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ছিল! আমি যিহোবার সেই দাসদের সঙ্গে সাড়ে তিন বছর কাজ করেছিলাম। তাদের অনুপম উদাহরণ আমাকে জার্মানির ইতিহাসবেত্তা গাব্রিয়েলা ইয়োনানের এক মন্তব্য মনে করিয়ে দেয়, যিনি লিখেছিলেন: “জাতীয় সমাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসনাধীনে এই দৃঢ় খ্রীষ্টীয় দলের উদাহরণ ছাড়া, আমাদের—আউশভিটজ্‌ ও হত্যাকাণ্ডের পর—সন্দেহ প্রকাশ করতেই হবে যে, যীশু খ্রীষ্টের শিক্ষাগুলোকে মেনে চলা আদৌ সম্ভব ছিল কি না।”

এই শাখায় আমার কাজ ডেনমার্কের মতোই ছিল: সাংগঠনিক ব্যাপারগুলো পরিচালনা করতে এক নতুন, সংগতিপূর্ণ উপায়ের সূত্রপাত করা। জার্মানির ভাইয়েরা যখনই বুঝতে পারে যে, এই রদবদলগুলো কোনভাবে তাদের কাজের সমালোচনা করে না—কিন্তু বিভিন্ন শাখা ও প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করে কাজ করার সময় এসে গেছে—তখন তারা উৎসাহিত হয়েছিল ও সহযোগিতা করার এক উত্তম মনোভাব তাদের মধ্যে জেগে উঠেছিল।

১৯৫২ সালে ভাই নরের দপ্তর থেকে আমি একটা চিঠি পাই, যেখানে আমাকে সুইজারল্যান্ডের বার্ন শাখায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। আমাকে সেখানে ১৯৫৩ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে শাখা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল।

সুইজারল্যান্ডে নতুন আনন্দ

সুইজারল্যান্ডে পৌঁছাবার কিছু সময় পরে এক সম্মেলনে এস্থেরের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এবং খুব শীঘ্রই আমরা বিয়ে করব বলে ঠিক করেছিলাম। ১৯৫৪ সালের আগস্ট মাসে ভাই নর আমাকে ব্রুকলিনে আসার জন্য নির্দেশনা দিয়েছিলেন, যেখানে এক নতুন ধরনের চমৎকার কাজ সম্বন্ধে আমাকে জানানো হয়েছিল। যেহেতু সারা পৃথিবীতে শাখা দপ্তরগুলোর সংখ্যা ও আকার খুবই বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাই এক নতুন ব্যবস্থার সূত্রপাত করা হয়। পৃথিবী বিভিন্ন জোনে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, যেটার প্রত্যেকটা অংশে একজন জোন অধ্যক্ষ কাজ করবেন। এই জোনের দুটো অংশে আমাকে কাজ করতে দেওয়া হয়েছিল: ইউরোপ ও ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চল।

ব্রুকলিনে কিছু সময় থাকার পর আমি সুইজারল্যান্ডে ফিরে গিয়েছিলাম এবং জোন পরিদর্শনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম। এস্থের ও আমি বিয়ে করি আর সে সুইজারল্যান্ডের শাখা দপ্তরে কাজ করার জন্য আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। আমার প্রথম যাত্রায় আমি মোট ১৩টা দেশ—ইতালি, গ্রিস, সাইপ্রাস, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং উত্তর আফ্রিকার সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলগুলো আর স্পেন ও পর্তুগালের মিশনারি হোম ও শাখাগুলোতে গিয়েছিলাম। বার্নে কিছু সময় থেকে যাওয়ার পর লৌহ-যবনিকার পশ্চিমে ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোতে আমার পরিভ্রমণ অব্যাহত ছিল। আমাদের বিয়ের প্রথম বছরে, খ্রীষ্টীয় ভাইদের সেবা করার উদ্দেশ্যে আমি ছয় মাস ঘরের বাইরে ছিলাম।

পরিস্থিতির পরিবর্তন

১৯৫৭ সালে এস্থের বুঝতে পারে যে, সে গর্ভবতী আর যেহেতু শাখায় বাচ্চা সহ বাবামারা থাকতে পারে না, তাই আমরা ডেনমার্কে চলে যাওয়া স্থির করি, যেখানে আমার বাবা তার সঙ্গে আমাদের থাকতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এস্থের আমাদের মেয়ে রাকেল ও আমার বাবা উভয়েরই যত্ন নিত আর আমি নতুন তৈরি হওয়া শাখা দপ্তরের কাজে সাহায্য করতাম। মণ্ডলীর অধ্যক্ষদের জন্য কিংডম মিনিস্ট্রি স্কুলের প্রশিক্ষক হিসেবে আমি কাজ করতাম ও সেইসঙ্গে একজন জোন অধ্যক্ষ হিসেবেও কাজ করে গিয়েছিলাম।

জোন পরিদর্শন করার অর্থ ছিল অনেক দীর্ঘ সময় ধরে যাত্রা করা, যার ফলে আমাদের মেয়েকে অনেক দিন ধরে ছেড়ে থাকতে হয়েছিল। এর পরিণাম দেখা গিয়েছিল। একবার আমি কিছু সময় প্যারিসে কাটাই যেখানে আমরা এক ছোট্ট ছাপাখানা খুলেছিলাম। এস্থের ও রাকেল ট্রেনে করে আমাকে দেখতে এসেছিল এবং গার ডিউ নরে পৌঁছেছিল। শাখা থেকে ল্যাউপল জংটা ও আমি তাদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। রাকেল ট্রেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল, সে আগে ল্যাউপলকে তারপর আমাকে এবং আবার ল্যাউপলকে দেখে তাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল!

আরেকটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে যখন ৪৫ বছর বয়সে আমি আমার পরিবারকে সাহায্য করতে চাকরি করার জন্য পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যা ছেড়ে দিয়েছিলাম। যিহোবার সাক্ষিদের একজন পরিচারক হওয়ার অভিজ্ঞতা থাকায় আমি একজন এক্সপোর্ট ম্যানেজারের চাকরি পেয়েছিলাম। সেই একই কোম্পানিতে প্রায় নয় বছর ধরে কাজ করার ও রাকেলের স্কুলের পড়াশোনা শেষ হওয়ার পর আমরা সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার জন্য স্থির সংকল্প হয়েছিলাম যে, যেখানে রাজ্য প্রচারকদের বেশি প্রয়োজন সেখানে চলে যাব।

নরওয়েতে সুযোগের সন্ধান করার পর আমি এক এমপ্লোয়মেন্ট এজেন্সিকে চাকরির সম্ভাবনা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উত্তর উৎসাহজনক ছিল না। একজন ৫৫ বছর বয়সী ব্যক্তির জন্য আশা খুব কম ছিল। তা সত্ত্বেও, আমি ওসলোর শাখা দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আর তারপর ড্রুবাক শহরের কাছে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম এই ভেবে যে, একটা চাকরির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একটা চাকরি পেয়েছিলাম আর পরে নরওয়েতে উপভোগ্য রাজ্যের কাজ করার সময় এসেছিল।

সবচেয়ে ভাল সময় এসেছিল যখন আমাদের মণ্ডলীর অধিকাংশ ব্যক্তি উত্তরাঞ্চলের অনির্ধারিত এলাকায় কাজ করার জন্য গিয়েছিল। শিবির স্থলে আমরা কুটির ভাড়া নিয়েছিলাম এবং এই অপূর্ব পাহাড়গুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খামারের ঘরগুলোতে প্রতিদিন সাক্ষাৎ করতে যেতাম। এইধরনের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ঈশ্বরের রাজ্য সম্বন্ধে বলা অভূতপূর্ব আনন্দ নিয়ে এসেছিল। অনেক সাহিত্য দেওয়া হয়েছিল কিন্তু পুনর্সাক্ষাৎগুলো করার জন্য আরেক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। তবুও, লোকেরা আমাদের ভুলে যায়নি! এস্থের ও রাকেলের এখনও সেই সময়টার কথা মনে আছে, যখন আমরা ফিরে এসেছিলাম ও দীর্ঘ দিন ধরে বিচ্ছিন্ন থাকা পরিবারের সদস্যরা একে অন্যকে আলিঙ্গন করেছিলাম। নরওয়েতে তিন বছর থাকার পর আমরা ডেনমার্কে ফিরে গিয়েছিলাম।

পারিবারিক জীবনের আনন্দ

শীঘ্রই রাকেলের, নিল্স হোইও নামে একজন উদ্যোগী পূর্ণ-সময়ের অগ্রগামী পরিচারকের সঙ্গে বাগ্‌দান হয়। তাদের বিয়ের পর, বাচ্চা হওয়ার আগে পর্যন্ত নিল্স ও রাকেল অগ্রগামী হিসেবে কাজ করেছিল। নিল্স একজন ভাল স্বামী ও উত্তম বাবা ছিল, পরিবারের প্রতি তার প্রকৃত আগ্রহ ছিল। একদিন সকালে সে তার ছেলেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য সাইকেলে করে সমুদ্রতীরে নিয়ে যায়। একজন প্রতিবেশী সেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিল তোমরা সেখানে গিয়ে কী করলে। সে উত্তর দিয়েছিল: “আমরা যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম।”

কয়েক বছর পর এস্থের ও আমি আমাদের দুজন বড় নাতিনাতনি বেনইয়ামিন ও নাদিয়ার বাপ্তিস্ম দেখেছিলাম। নিল্সও দর্শকদের মধ্যে ছিল, যে হঠাৎ আমার মুখোমুখি হয়। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “প্রকৃত পুরুষরা কাঁদে না।” কিন্তু পরমুহূর্তে আমরা দুজনে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম। এমন এক জামাই পাওয়া কতই না আনন্দের বিষয়, যার সঙ্গে আপনি হাসতে ও সেইসঙ্গে কাঁদতেও পারেন!

পরিস্থিতির সঙ্গে এখনও মানিয়ে চলা

আরেক ধরনের আশীর্বাদ আসে যখন এস্থের ও আমাকে ডেনমার্ক শাখা দপ্তরে কাজ করার জন্য ফিরে আসতে বলা হয়েছিল। অবশ্য ততদিনে হোলবেকে আরও অনেক বড় শাখা দপ্তরের নির্মাণ কাজ চলছিল। নির্মাণ কাজ দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমি পেয়েছিলাম, যেটার সমস্ত কিছু স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের দ্বারা হয়েছিল। ১৯৮২ সালের শেষের দিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা পড়া সত্ত্বেও, এই প্রকল্পটা শেষ হয়েছিল এবং আমরা সবাই এক বড়, বাড়তি সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন দপ্তরে যাওয়ার জন্য খুব আনন্দিত ছিলাম!

আমি খুব শীঘ্রই অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম, যেটা আমাকে প্রচুর সন্তুষ্টি এনে দিয়েছিল আর এস্থের টেলিফোনের সুইচবোর্ড নিয়ন্ত্রণের কাজ করত। কিন্তু, এর কিছুদিন পরেই তাকে হিপ রিপ্লেসমেন্ট অপারেশন করাতে হয়েছিল এবং এর দেড় বছর পর তার পিত্তথলির অপারেশনও হয়েছিল। শাখা অধ্যক্ষরা আমাদের প্রতি বিবেচনা দেখানো সত্ত্বেও, আমরা স্থির করি যে এটাই সবার জন্য ভাল হবে যদি আমরা শাখা থেকে চলে যাই। আমরা সেই মণ্ডলীতে চলে যাই যেখানে আমাদের মেয়ে ও পরিবার যোগ দিত।

বর্তমানে এস্থেরের শরীর খুব একটা ভাল নেই। তবুও, আমি সত্যি করে বলতে পারি যে পরিস্থিতির পরিবর্তন সত্ত্বেও একসঙ্গে সেবা করার এই বছরগুলোতে সে এক চমৎকার সমর্থন জুগিয়েছে ও সহকারিণী থেকেছে। স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া সত্ত্বেও আমরা দুজনেই প্রচার কাজে অল্প হলেও অংশ নিই। আমার জীবন নিয়ে চিন্তা করলে আমি গীতরচকের এই কথাগুলো কৃতজ্ঞতার সঙ্গে মনে করি: “হে ঈশ্বর, তুমি বাল্যকালাবধি আমাকে শিক্ষা দিয়া আসিতেছ।”—গীতসংহিতা ৭১:১৭.

[পাদটীকা]

^ ১৯৬৩ সালের ১৫ই জুলাই প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) এর ৪৩৭-৪২ পৃষ্ঠা দেখুন।

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৪৯ সালে যখন জার্মানি শাখার নির্মাণ কাজ চলছিল, সেখানে সাহিত্যগুলো নামানো হচ্ছে

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার সহকর্মীদের মধ্যে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে ফিরে আসা সাক্ষিরা ছিল, যেমন এই সাক্ষিরা

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

বর্তমানে এস্থেরের সঙ্গে এবং ১৯৫৫ সালে বার্ন বেথেলে আমাদের বিয়ের দিনে