সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

আমরা আমাদের কার্যভারে লেগে ছিলাম

আমরা আমাদের কার্যভারে লেগে ছিলাম

জীবন কাহিনী

আমরা আমাদের কার্যভারে লেগে ছিলাম

বলেছেন হারমান ব্রুডার

আমার বাছাই করার বিষয়টা ছিল সহজ: হয় পাঁচ বছরের জন্য ফরাসি বাহিনীর প্রাক্তন বিদেশি সৈনিক দলে কাজ করা নতুবা মরোক্কোর জেলের অন্তরীণে থাকা। আমি কীভাবে এইরকম বিপজ্জনক অবস্থায় পড়ি, তা আমাকে বলতে দিন।

 আমি ১৯১১ সালে, ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক তিন বছর আগে, জার্মানির অপেনু শহরে জন্মগ্রহণ করি। আমার বাবামা, ইয়োজেফ ও ফ্রিডা ব্রুডারের মোট ১৭ জন ছেলেমেয়ে ছিল। আমি তাদের ১৩তম সন্তান ছিলাম।

সবচেয়ে পুরনো স্মৃতিগুলোর মধ্যে আমার মনে পড়ে যে, আমি আমার শহরের প্রধান রাস্তা দিয়ে সামরিক ব্যান্ডকে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যেতে দেখতাম। এই প্রাণবন্ত কুচকাওয়াজের সুরে আকৃষ্ট হয়ে, আমি সেই গায়কদলের পিছনে পিছনে স্টেশন পর্যন্ত যেতাম, ঠিক যখন আমার বাবা ও অন্যান্য লোকেরা সামরিক পোশাক পরে ট্রেনে ওঠার জন্য প্রস্তুত হতো। ট্রেন ছেড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, কয়েকজন মহিলা প্ল্যাটফর্মের মধ্যেই কান্নায় ভেঙে পড়ে। এর কিছুদিন পরেই, আমাদের পুরোহিত গির্জার মধ্যে একটা দীর্ঘ উপদেশ দেন আর চারজন ব্যক্তির নাম ঘোষণা করেন, যারা জন্মভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা গিয়েছে। “এখন তারা স্বর্গে আছে,” তিনি বুঝিয়ে বলেন। আমার পাশে যে-মহিলা দাঁড়িয়েছিলেন তিনি মূর্ছা যান।

রুশ রণক্ষেত্রে সেবা করার সময় বাবা টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হন। তিনি অত্যন্ত দুর্বল অবস্থায় ঘরে ফেরেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। “কবরস্থানের পাশেই যে-চ্যাপেল রয়েছে সেখানে যাও আর ৫০ বার প্রভুর প্রার্থনা ও হেইল মেরি বল,” পুরোহিত পরামর্শ দেন। “তা হলেই তোমার বাবা সুস্থ হয়ে উঠবেন।” আমি তার পরামর্শ মেনে চলি কিন্তু পরের দিনই বাবা মারা যান। এমনকি একটা ছোট ছেলের পক্ষেও, যুদ্ধ ছিল এক অত্যন্ত বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা।

যেভাবে আমি সত্য পেয়েছিলাম

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে জার্মানিতে কাজ পাওয়া খুবই শক্ত ছিল। কিন্তু, ১৯২৮ সালে স্কুল ছাড়ার পর, আমি সুইজারল্যান্ডের বাজেল শহরে মালীর কাজ জোগাড় করতে পেরেছিলাম।

আমার বাবার মতো, আমিও একজন গোঁড়া ক্যাথলিক ছিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল একজন কাপুচিন সন্ন্যাসী হিসেবে ভারতে কাজ করা। যখন আমার ভাই রিখার্ট—যে ইতিমধ্যেই একজন যিহোবার সাক্ষি হয়ে গিয়েছিল—এই পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানতে পারে, তখন সে বিশেষ করে কেবল আমাকে থামানোর জন্য সুইজারল্যান্ডে আসে। সে আমাকে মানুষের ওপর, বিশেষ করে পাদরিদের বিশ্বাস করার বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করে দেয় আর আমাকে বাইবেল পড়তে এবং কেবলমাত্র এর ওপরেই বিশ্বাস রাখতে উৎসাহ দেয়। এই বিষয়ে সন্দিহান হওয়া সত্ত্বেও, আমি একটা নতুন নিয়ম জোগাড় করি আর তা পড়তে শুরু করি। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারি যে, বেশ কিছু বিষয়ে আমার বিশ্বাস বাইবেলের শিক্ষাগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

১৯৩৩ সালের এক রবিবার, আমি জার্মানিতে যখন রিখার্টের বাড়িতে ছিলাম, তখন সে আমাকে এক বিবাহিত দম্পতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যারা যিহোবার সাক্ষি ছিল। আমি বাইবেল পড়ছিলাম তা জানতে পেরে, তারা আমাকে সংকট * (ইংরেজি) নামক একটা পুস্তিকা দেয়। শেষ পর্যন্ত পুস্তিকাটি যখন পড়া বন্ধ করি, তখন প্রায় মধ্যরাত্রি। আমি একেবারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, আমি সত্য পেয়েছি!

বাজেলের যিহোবার সাক্ষিরা আমাকে শাস্ত্র অধ্যয়ন * (ইংরেজি) বইটির দুটি খণ্ড ও সেইসঙ্গে কিছু পত্রিকা ও অন্যান্য সাহিত্যাদি দিয়েছিল। আমি যা কিছু পড়ছিলাম তাতে এতই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, স্থানীয় পুরোহিতের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি এবং তাকে বলি যে, গির্জার রেজিস্টার থেকে আমার নাম যেন কেটে দেওয়া হয়। পুরোহিত ভীষণ রেগে যান আর সাবধান করে দেন যে, আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলার বিপদের সম্মুখীন। আসলে, কোনমতেই আমি আমার বিশ্বাসকে হারাইনি। জীবনে এই প্রথমবার, আমি প্রকৃত বিশ্বাস গড়ে তুলতে শুরু করেছিলাম।

বাজেলের ভাইয়েরা সেই সপ্তাহের শেষে ফ্রান্সের সীমান্তে প্রচার করার পরিকল্পনা করছিল। একজন ভাই আমাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলেছিলেন যে, যেহেতু আমি সবেমাত্র মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছি, তাই আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। নিরুৎসাহিত না হয়ে, আমি প্রচার শুরু করার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করি। আরেকজন প্রাচীনের সঙ্গে আলোচনা করার পর তিনি আমাকে সুইজারল্যান্ডের একটা এলাকাতে কাজ করতে বলেন। রবিবার খুব ভোরে, আমি আমার সাইকেলে করে বাজেলের কাছাকাছি একটা ছোট্ট গ্রামের দিকে রওনা হই, আমার পরিচর্যার ব্যাগে ছিল ৪টে বই, ২৮টা পত্রিকা আর ২০টা ব্রোশার। আমি যখন সেখানে পৌঁছাই তখন অধিকাংশ গ্রামবাসী গির্জায় ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, সকাল ১১টার মধ্যেই আমার পরিচর্যার ব্যাগ খালি হয়ে যায়।

যখন আমি ভাইদের বলি যে আমি বাপ্তিস্ম নিতে চাই, তখন তারা আন্তরিকভাবে আমার সঙ্গে কথা বলে এবং সত্য সম্বন্ধে কিছু মর্মভেদি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। যিহোবা ও তাঁর সংগঠনের প্রতি তাদের উদ্যোগ ও আনুগত্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। যেহেতু তখন শীতকাল ছিল, তাই একজন ভাই আমাকে একজন প্রাচীনের বাড়িতে বাথটাবে বাপ্তিস্ম দেন। আমার মনে আছে যে আমি এক অবর্ণনীয় আনন্দ উপভোগ করেছিলাম আর মনে এক অদম্য শক্তি পেয়েছিলাম। সেটা ছিল ১৯৩৪ সাল।

কিংডম খামারে কাজ করা

১৯৩৬ সালে আমি শুনতে পাই যে, যিহোবার সাক্ষিরা সুইজারল্যান্ডে একটা জমি কিনেছে। মালী হিসেবে কাজ করার জন্য আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করি। আনন্দের বিষয় হল যে, বার্ন থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে শ্টেফিসবার্গে, কিংডম খামারে কাজ করার জন্য আমাকে আহ্বান জানানো হয়। যখনই সম্ভব হতো খামারের কাজে আমি অন্যদেরও সাহায্য করতাম। সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলার গুরুত্ব সম্বন্ধে বেথেল আমাকে শিক্ষা দিয়েছিল।

বেথেলে থাকাকালীন আমার জন্য একটা স্মরণীয় ঘটনা ছিল, ১৯৩৬ সালে খামারে ভাই রাদারফোর্ডের পরিদর্শন। তিনি যখন আমাদের টমেটোর আকার ও শস্যের ফলন লক্ষ করেন, তখন আনন্দিত হন ও পরিতৃপ্তি প্রকাশ করেন। কত প্রিয় ভাই-ই না তিনি ছিলেন!

আমি যখন মাত্র তিন বছর ধরে খামারে কাজ করছিলাম, তখন একদিন প্রাতরাশের সময় যুক্তরাষ্ট্রে যিহোবার সাক্ষিদের প্রধান কার্যালয় থেকে আসা একটা চিঠি পড়া হয়। সেই চিঠিটায় বিশেষভাবে প্রচার কাজের গুরুত্ব সম্বন্ধে জোর দেওয়া হয় আর যারা বিদেশে অগ্রগামীর কাজ করতে ইচ্ছুক তাদের সকলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইতস্তত না করে, আমি স্বেচ্ছায় কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি। আমার কার্যভার আসে ১৯৩৯ সালের মে মাসে—ব্রাজিলে!

সেই সময়, আমি কিংডম হল খামারের কাছেই, টুন মণ্ডলীর সভাগুলোয় যোগদান করছিলাম। রবিবারে, আমরা কয়েকজন প্রচার করার জন্য আল্পসে যাব, টুন থেকে সেখানে যেতে সাইকেলে দুঘন্টা লাগে। আমাদের দলের মধ্যে একজন ছিল মার্গারিটা শ্টাইনার। হঠাৎ আমার মনে হল: যীশু তাঁর শিষ্যদের দুজন দুজন করে পাঠিয়েছিলেন, তাই নয় কি? আমি যখন কথা প্রসঙ্গে মার্গারিটাকে বলি যে আমাকে ব্রাজিলে কার্যভার দেওয়া হয়েছে, সে তখন বলে যে, যেখানে প্রয়োজন সেখানে কাজ করার ইচ্ছা তারও আছে। ১৯৩৯ সালের ৩১শে জুলাই আমরা বিয়ে করি।

অপ্রত্যাশিত যাত্রাভঙ্গ

১৯৩৯ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে, আমরা ফ্রান্সের লে হাভার থেকে, ব্রাজিলের সানটোসের উদ্দেশে সমুদ্র পথে রওনা হই। যেহেতু দুজনের জন্য তৈরি বার্থগুলো ইতিমধ্যে সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছিল, তাই আমাদের আলাদা আলাদা কেবিনে যাত্রা করতে হয়। যাত্রার সময় সংবাদ আসে যে গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স, জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ৩০জন জার্মান যাত্রীর একটা দল জার্মান জাতীয় সংগীত গেয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখায়। এই ঘটনায় ক্যাপ্টেন এতই বিরক্ত হন যে, তিনি তার পথ পরিবর্তন করেন এবং মরোক্কোর সাফি শহরে জাহাজ ভেড়ান। যেসব যাত্রীদের কাছে জার্মান ভ্রমণ তথ্যগুলো ছিল তাদের নেমে যাওয়ার জন্য পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হয়। এর মধ্যে আমরাও ছিলাম।

আমাদের একদিনের জন্য পুলিশ স্টেশনে থাকতে হয় আর এরপর আমাদের সকলকে একসঙ্গে একটা পুরোনো নড়বড়ে বাসের মধ্যে ঢোকানো হয় এবং ১৪০ কিলোমিটার দূরে মারাকাস শহরের একটা জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। কষ্টকর দিনগুলো এরপর থেকেই শুরু হয়। কারাগারে আমাদের কক্ষে অতিরিক্ত ভিড় এবং অন্ধকার ছিল। সর্বসাধারণের শৌচাগার—মেঝের ওপর একটা গর্ত মাত্র—সবসময় বন্ধ থাকত। শোয়ার জন্য আমাদের প্রত্যেককে একটা করে নোংরা বস্তা দেওয়া হতো আর রাতের বেলা ইঁদুর এসে আমাদের পায়ের গোড়ালি কামড়াতো। দিনে দুবার মরচে পরা পাত্রে খাবার দেওয়া হতো।

একজন সামরিক আধিকারিক আমাকে বুঝিয়ে বলেন যে, আমি যদি ফরাসি বাহিনীর প্রাক্তন বিদেশি সৈনিক দলে পাঁচ বছরের জন্য যোগ দিতে রাজি থাকি, তা হলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। এই প্রস্তাব আমি প্রত্যাখ্যান করায় আমাকে এমন এক স্থানে ২৪ ঘন্টা কাটাতে হয়, যেটাকে একটা অন্ধকার গর্ত বলেই বর্ণনা করা যায়। এখানে অধিকাংশ সময়ই আমি প্রার্থনা করে কাটাই।

আট দিন পর, জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে মার্গারিটার সঙ্গে আবার দেখা করার অনুমতি দেন। সে অত্যন্ত রোগা হয়ে গিয়েছিল আর প্রচণ্ড কান্নাকাটি করেছিল। আমি আমার সাধ্যমতো তাকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করি। আমাদের জেরা করা হয় আর এরপর ট্রেনে করে আমাদের কাসাব্লাংকায় স্থানান্তরিত করা হয়, যেখানে মার্গারিটাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আর আমাকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে পোর্ট লয়টির (এখন কেনিট্রা) জেল ক্যাম্পে পাঠানো হয়। সুইস দূতাবাস মার্গারিটাকে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয় কিন্তু সে আনুগত্যের সঙ্গে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে অস্বীকার করে। দুমাস পোর্ট লয়টিতে থাকাকালীন, সে প্রতিদিন কাসাব্লাংকা থেকে আমাকে দেখতে আর আমার জন্য খাবার নিয়ে আসত।

নাৎসি শাসনের সঙ্গে সাক্ষিরা যুক্ত নয় এই বিষয়টার প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশে এক বছর আগে যিহোবার সাক্ষিরা একটা বই প্রকাশ করে, যেটার নাম ছিল ক্রয়েটসুগ গেগেন ডাস্‌ ক্রিসটেনটাম (খ্রীষ্টতত্ত্বের বিরুদ্ধে যুদ্ধ)। আমি যখন জেল ক্যাম্পে ছিলাম, বার্নের যিহোবা সাক্ষিদের শাখা অফিস, ফরাসি কর্তৃপক্ষের কাছে একটা চিঠি লেখে আর তার সঙ্গে ওই বইটির একটা কপি পাঠিয়ে দেয়, এটা প্রমাণ করার অভিপ্রায়ে যে আমরা নাৎসি নই। মার্গারিটাও খুব উত্তম কাজ করেছিল, সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে যাওয়া আর তাদের মধ্যে এই প্রত্যয়কে জাগিয়ে তোলা যে, আমরা নির্দোষ। অবশেষে ১৯৩৯ সালের শেষে, আমাদের মরোক্কো ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়।

ব্রাজিলের উদ্দেশে রওনা হওয়ার পরেই আমরা জানতে পারি যে, জার্মান সাবমেরিনগুলো আটলান্টিকের ওপর ভেসে যাওয়া জাহাজগুলোর নির্দিষ্ট পথ আক্রমণ করেছে আর আমরাই ছিলাম তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। আমাদের বাহনটি অর্থাৎ ঝামিক একটা বাণিজ্যিক জাহাজ হওয়া সত্ত্বেও, এর সামনে ও পিছনে বন্দুক ঝোলানো ছিল। দিনের বেলায়, ক্যাপ্টেন এলোপাথারি পথ অবলম্বন করতেন আর অবিরত গুলি ছুড়তে থাকতেন। রাত্রিবেলায় সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হতো যাতে জার্মানরা আমাদের শনাক্ত করতে না পারে। কত স্বস্তিই না আমরা পেয়েছিলাম যখন ইউরোপ ছাড়ার পাঁচ মাসেরও বেশি পর ১৯৪০ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি, অবশেষে ব্রাজিলের সানটস বন্দরে এসে পৌঁছাই!

আবার জেলে

আমাদের প্রচারের প্রথম কার্যভার দেওয়া হয় মন্টেনিগ্রোতে, দক্ষিণ ব্রাজিলের রিও গ্র্যান্ডে ডো সুল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটা শহর। স্পষ্টতই গির্জার কর্তৃপক্ষদের আগে থেকে আমাদের আগমন সম্বন্ধে জানানো হয়েছিল। মাত্র দুই ঘন্টা প্রচার করার পর, পুলিশ আমাদের গ্রেপ্তার করে আর আমাদের বাইবেল উপদেশের ফোনোগ্রাফ রেকর্ডগুলো, আমাদের সমস্ত সাহিত্যাদি আর এমনকি উটের চামড়ার তৈরি যে-ব্যাগ আমরা মরোক্কো থেকে কিনেছিলাম সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে। একজন পুরোহিত আর জার্মান ভাষী একজন পরিচারক পুলিশ স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। পুলিশ প্রধান যখন ভাই রাদাফোর্ডের একটা বক্তৃতা গ্রামোফোনে বাজাচ্ছিলেন—যেটাকে তিনি বাজেয়াপ্ত করেছিলেন—তখন তারা সেটা শুনেছিল। ভাই রাদাফোর্ড অবশ্যই কোন কিছু রাখ ঢাক করে কথা বলছিলেন না! যখন ভ্যাটিকানের বিষয়টি উত্থাপিত হয়, তখন পুরোহিত রেগে আগুন হন ও ঝড়ের গতিতে বের হয়ে যান।

সান্টা মারিয়ার বিশপের অনুরোধে, পুলিশ আমাদের রাষ্ট্রের রাজধানী, পর্তু আলেগ্রিতে স্থানান্তরিত করেন। মার্গারিটা কিছুদিনের মধ্যে মুক্তি পায় আর সে সুইস দূতাবাসের সাহায্য নেয়। দূতাবাস তাকে সুইজারল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। আবারও সে আমাকে ছেড়ে যেতে অস্বীকার করে। মার্গারিটা সর্বদা একজন অনুগত সাথি ছিল। ত্রিশ দিন পর আমাকে জেরা করা হয় এবং ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ আমাদের সামনে বেছে নেওয়ার জন্য একটা বিষয় রাখে: দশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্র ছেড়ে চলে যাও নয়তো “পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাক।” প্রধান কার্যালয়ের উপদেশ অনুসারে, আমরা রিও ডি জানেরিওর উদ্দেশে রওনা হই।

“দয়া করে এই কার্ডটা পড়ুন”

ব্রাজিলের পরিচর্যা ক্ষেত্রে এইধরনের প্রতিকূল ভূমিকা সত্ত্বেও, আমরা কতই না আনন্দিত হয়েছিলাম! হাজার হোক, আমরা বেঁচে ছিলাম, আমাদের ব্যাগগুলো আবার সাহিত্যে পরিপূর্ণ হয়েছিল আর প্রচার করার জন্য আমাদের সামনে সমগ্র রিও ডি জানেরিও ছিল। কিন্তু পর্তুগিজ ভাষার সীমিত জ্ঞান নিয়ে আমরা কীভাবে প্রচার করব? একটা টেস্টিমনি কার্ডের সাহায্যে। “পর ফেভার, লিয়া এস্টে কারটাও” (“দয়া করে এই কার্ডটা পড়ুন।”) এটাই ছিল প্রথম পর্তুগিজ অভিব্যক্তি, যা আমরা প্রচার কাজে ব্যবহার করতে শিখেছিলাম। আর এই কার্ডটা কতই না ফলপ্রসূ ছিল! এক মাসের মধ্যে, আমরা ১,০০০রেরও বেশি বই বিতরণ করেছিলাম। অনেকে যারা আমাদের বাইবেল সাহিত্যাদি নিয়েছিল পরে তারা সত্যকে গ্রহণ করেছিল। সত্যি বলতে কী, আমাদের সাহিত্যাদি যেভাবে কার্যকারী উপায়ে সাক্ষ্যদান করেছিল আমাদের দ্বারা তা করা কখনোই সম্ভব হতো না। এটাই আমাকে আগ্রহী ব্যক্তির হাতে প্রকাশনাগুলো তুলে দেওয়ার গুরুত্ব বুঝতে অনুপ্রাণিত করেছিল।

সেই সময় রিও ডি জানেরিও ছিল ব্রাজিলের রাজধানী আর আমাদের সংবাদ বিশেষ করে সরকারি দপ্তরগুলোতে উত্তমভাবে গৃহীত হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমার অর্থ মন্ত্রী ও সামরিক বাহিনী মন্ত্রীর কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। এই পরিস্থিতিগুলোতে, আমি স্পষ্টভাবে প্রমাণ পেয়েছিলাম যে, যিহোবার আত্মা সক্রিয়।

একবার, রিও শহরের কেন্দ্রে নগর চত্বরে প্রচার করার সময়, আমি বিচারালয়ে ঢুকে পড়ি। একটা ঘরের মধ্যে আমি দেখতে পাই চারদিকে কালো পোশাক পরা কিছু লোক, মনে হয়েছিল যেন সেখানে কোন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলছে। দেখতে কিছুটা আলাদা বলে মনে হয়েছিল এমন এক ব্যক্তির কাছে আমি এগিয়ে যাই আর তার হাতে টেস্টিমনি কার্ডটা দিই। সেটা কোন অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান ছিল না। আসলে আমি আদালতের একটা মামলার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করি এবং আমি একজন বিচারকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তিনি হেসে ফেলেন, দেহরক্ষীদের শান্ত হতে বলেন। তিনি খুব সদয়ভাবে সন্তান * (ইংরেজি) বইটির একটা কপি গ্রহণ করেন এবং কিছু দান দেন। বেরিয়ে আসার পথে, একজন দেহরক্ষী সহজেই চোখে পড়ে এমন একটা বোর্ড দেখায়: প্রোবিদা আ এনত্রাদা ডি পেসোয়াস এসত্রানইয়াস (অপরিচিতদের প্রবেশ নিষেধ)।

আরেকটা ফলপ্রসূ ক্ষেত্র ছিল বন্দর। একবার, আমি একজন নাবিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি আর তিনি সমুদ্রে ফিরে যাওয়ার আগে কিছু সাহিত্যাদি গ্রহণ করেছিলেন। পরে, তার সঙ্গে আমাদের দেখা হয় সম্মেলনে। তার পুরো পরিবার সত্য গ্রহণ করেছে আর তিনি নিজে খুব ভাল উন্নতি করছেন। এটা আমাদের খুব আনন্দ দিয়েছিল।

কিন্তু, সবকিছু এত সহজ ছিল না। আমাদের ছয় মাসের ভিসা শেষ হয়ে যায় আর আমাদের দেশ ছাড়ার সময় এসে পড়ে। আমাদের পরিস্থিতির বিষয় জানিয়ে প্রধান কার্যালয়ে চিঠি লেখার পর, আমরা ভাই রাদারফোর্ডের কাছ থেকে একটা প্রেমময় চিঠি পাই, যেখানে আমাদের ধৈর্য ধরতে উৎসাহ দেওয়া হয় আর কীভাবে আমরা অগ্রসর হব সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। আমাদের ইচ্ছা ছিল ব্রাজিলে থেকে যাওয়া এবং একজন আইনজ্ঞের সাহায্যে অবশেষে আমরা ১৯৪৫ সালে স্থায়ী ভিসা পাই।

এক দীর্ঘকালীন কার্যভার

এর আগে অবশ্য, আমাদের ছেলে ইয়োনাতান ১৯৪১ সালে, রূত ১৯৪৩ সালে আর ১৯৪৫ সালে এস্তারের জন্ম হয়। বৃদ্ধিরত পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর জন্য, আমাকে চাকরি নিতে হয়। আমাদের তৃতীয় সন্তান জন্মানো অবধি মার্গারিটা পূর্ণ-সময় প্রচারের কাজ চালিয়ে গিয়েছিল।

প্রথম থেকেই, আমরা পরিবারগতভাবে একসঙ্গে শহরের প্রধান স্থানগুলোতে, রেল স্টেশনগুলোতে, রাস্তায় এবং ব্যবসায়িক এলাকায় প্রচার কাজ করে এসেছি। শনিবার রাতে আমরা প্রহরীদুর্গসচেতন থাক! পত্রিকাগুলো একসঙ্গে বিতরণ করতাম আর এগুলো ছিল বিশেষ আনন্দের মুহূর্ত।

বাড়িতে, প্রত্যেক সন্তানের নিজস্ব দায়িত্ব ছিল। ইয়োনাতানের কাজ ছিল স্টোভ আর রান্নাঘর পরিষ্কার করা। মেয়েদের দায়িত্ব ছিল রেফ্রিজারেটার পরিষ্কার করা, উঠোন ঝাড় দেওয়া ও আমাদের জুতোগুলো পালিশ করা। এটা তাদের সংগঠিত হতে আর নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে কাজ করার গুণ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। আজকে, আমাদের সন্তানেরা কঠোর পরিশ্রমী, যারা তাদের ঘরের উত্তম দেখাশোনা করে, যেটা মার্গারিটা ও আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দেয়।

আমরা এটাও আশা করতাম যে, সভাগুলোতে আমাদের সন্তানেরা যেন উত্তম আচরণ করে। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে, তারা জল খেয়ে নিত ও টয়লেটে যেত। সভার সময় ইয়োনাতান আমার বাঁদিকে, রূত আমার ডান দিকে, তারপর মার্গারিটা আর ওর ডানদিকে এস্তার বসত। এটা তাদের মনোযোগ দিতে এবং খুব অল্প বয়স থেকে আধ্যাত্মিক খাদ্য গ্রহণ করতে সাহায্য করেছিল।

যিহোবা আমাদের প্রচেষ্টাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। আমাদের সবকটি সন্তান বিশ্বস্তভাবে যিহোবাকে সেবা করে চলেছে আর আনন্দের সঙ্গে তারা প্রচার কাজে অংশ নিচ্ছে। বর্তমানে ইয়োনাতান, রিও ডি জানেরিওর নভু মেয়ার মণ্ডলীতে প্রাচীন হিসেবে কাজ করছে।

১৯৭০ সালের মধ্যে আমাদের সন্তানেরা বিয়ে করে নিজেদের ঘরে চলে যায়, তাই মার্গারিটা ও আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, যেখানে প্রয়োজন আছে সেখানে কাজ করব। আমাদের প্রথম জায়গাটা ছিল মিনাস গারেইস রাষ্ট্রের, পোসাস ডি কালডাস, যেখানে সেই সময় ১৯ জন রাজ্য প্রকাশকের একটা ছোট্ট দল ছিল। আমার খুব দুঃখ হয় যখন আমি প্রথম ওদের সভার স্থানটি দেখি—ভূগর্ভস্থ একটা ঘর, কোন জানালা নেই আর অনেক কিছু মেরামতের প্রয়োজন। সঙ্গে সঙ্গে, আমরা কিংডম হলের জন্য একটা ভাল জায়গা খুঁজতে শুরু করি আর কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা এক উত্তম এলাকায় একটা আকর্ষণীয় বিল্ডিং পাই। এটা কতই না এক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল! সাড়ে চার বছর পর প্রকাশকের সংখ্যা বেড়ে ১৫৫ জনে গিয়ে দাঁড়ায়। ১৯৮৯ সালে আমরা রিও ডি জানেরিওর আরারুয়ামায় যাই আর সেখানে নয় বছর সেবা করি। এই সময়ে আমরা দুটো মণ্ডলী প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি।

আমাদের কার্যভারে লেগে থাকার পুরস্কার

১৯৯৮ সালে, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা ও সেইসঙ্গে সন্তানদের কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা আমাদের রিও ডি জানেরিওর, সাও গোনসালুতে নিয়ে এসেছিল। এখনও আমি সেখানে মণ্ডলীর একজন প্রাচীন হিসেবে কাজ করছি। আমরা আমাদের সাধ্যমতো প্রচার কাজে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। মার্গারিটা নিকটস্থ সুপারমার্কেটে সাক্ষ্য দিয়ে খুব আনন্দ পায় এবং মণ্ডলী বিবেচনার সঙ্গে আমাদের ঘরের কাছেই কিছু এলাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে, যেটা আমাদের স্বাস্থ্য অনুসারে প্রচার করা সহজ করে তুলেছে।

মার্গারিটা ও আমি এখন ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যিহোবার একজন উৎসর্গীকৃত দাস। ব্যক্তিগতভাবে আমরা অভিজ্ঞতা লাভ করেছি যে, ‘কি আধিপত্য সকল, কি উপস্থিত বিষয় সকল, কি ভাবী বিষয় সকল, কি পরাক্রম সকল, কি উর্দ্ধ স্থান, কি গভীর স্থান, কি অন্য কোন সৃষ্ট বস্তু, কিছুই আমাদের প্রভু খ্রীষ্ট যীশুতে অবস্থিত ঈশ্বরের প্রেম হইতে আমাদিগকে পৃথক করিতে পারিবে না।’ (রোমীয় ৮:৩৮, ৩৯) আর এটা দেখা কতই না আনন্দের বিষয় যে, “আরও মেষ” একত্রিত হচ্ছে, যাদের এক নিখুঁত পৃথিবীতে, ঈশ্বরের সুন্দর সৃষ্টিগুলোর দ্বারা পরিবেষ্টিত পরিস্থিতিতে অনন্ত জীবনের অপূর্ব আশা রয়েছে! (যোহন ১০:১৬) ১৯৪০ সালে যখন আমরা রিও ডি জানেরিওতে আসি, তখন সেখানে ২৮ জন প্রকাশক সমেত মাত্র একটা মণ্ডলী ছিল। আজকে সেখানে প্রায় ২৫০টা মণ্ডলী আর ২০,০০০রেরও বেশি রাজ্য প্রকাশক আছে।

অনেক সুযোগ এসেছিল, যখন আমরা ইউরোপে আমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারতাম। কিন্তু যিহোবার কাছ থেকে আসা আমাদের কার্যভার ছিল এখানে অর্থাৎ ব্রাজিলে। আমরা কতই না আনন্দিত যে, আমরা সেই কার্যভারে লেগে ছিলাম!

[পাদটীকাগুলো]

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর ছাপানো হয় না।

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর এটা ছাপানো হয় না।

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর এটা ছাপানো হয় না।

[২১ পৃষ্ঠার চিত্র]

সুইজারল্যান্ডের শ্টেফিসবার্গের কিংডম খামারে ১৯৩০ দশকের শেষের দিকে (আমি একেবারে বাঁয়ে)

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগে, ১৯৩৯ সালে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

কাসাব্লাংকায় ১৯৪০ এর দশকে

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

পরিবারগতভাবে প্রচার করা

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

বর্তমানে নিয়মিত পরিচর্যায় অংশ নিচ্ছি