নিদারুণ যন্ত্রণার অগ্নিময় পরীক্ষায় পরীক্ষিত
জীবন কাহিনী
নিদারুণ যন্ত্রণার অগ্নিময় পরীক্ষায় পরীক্ষিত
বলেছেন প্যারেক্লিজ ইয়ানরিস
পুরনো ছোট্ট কক্ষের স্যাঁতসেঁতে অবস্থায় আমার হাড় পর্যন্ত জমে যাচ্ছিল। শুধু পাতলা একটা কম্বল গায়ে দিয়ে সেখানে একা একা বসে আমি তখনও আমার যুবতী স্ত্রীর নিশ্চল চাহনি দেখতে পাচ্ছিলাম, যখন রক্ষীসেনারা দুদিন আগে আমাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। তাকে এবং আমাদের দুই অসুস্থ সন্তানকে ফেলে আসি। পরবর্তী সময়ে আমার স্ত্রী, যে আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল না, আমার জন্য একটা পার্সেল ও চিরকুট পাঠায়, যেখানে লেখা ছিল: “আমি তোমার জন্য এই পিঠাগুলো পাঠালাম আর আমি চাই যে, তুমিও তোমার সন্তানদের মতো অসুস্থ হয়ে পড়।” আমার পরিবারকে দেখার জন্য আমি কি কখনও জীবিত অবস্থায় ফিরে যেতে পারব?
সেটা ছিল খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের দীর্ঘ ও কষ্টকর সংগ্রামের মধ্যে শুধু একটা কাহিনী, যে-কঠিন লড়াইয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল পারিবারিক বিরোধিতা, সমাজ থেকে বিতাড়িত হওয়া, আইনগত যুদ্ধ এবং প্রচণ্ড তাড়না। কিন্তু, কীভাবে এবং কেন আমি এক শান্তশিষ্ট ও ঈশ্বর-ভয়শীল ব্যক্তি হয়েও সেই শোচনীয় অবস্থায় পড়েছিলাম? দয়া করে আমাকে বলতে দিন।
এক দরিদ্র ছেলের বড় স্বপ্ন
আমি যখন ১৯০৯ সালে ক্রীটের স্টাভরোমিনোতে জন্মগ্রহণ করি, তখন সেই দেশ যুদ্ধ, দারিদ্র এবং দুর্ভিক্ষের সঙ্গে লড়াই করছিল। পরবর্তী সময়ে, আমার ছোট চারজন সহদোর ভাইবোন এবং আমি স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জার হাত থেকে কোনোরকমে রক্ষা পাই। আমার মনে আছে যে, বাবামা আমাদের পরপর কয়েক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে আটকে রেখেছিল, যাতে আমরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত না হই।
একজন দরিদ্র কৃষক হিসেবে বাবা খুব ধার্মিক কিন্তু খোলাখুলি মনের মানুষ ছিলেন। ফ্রান্স এবং মাদাগাস্কারে বসবাস করার দরুণ তিনি ধর্ম সম্বন্ধে কুসংস্কারমুক্ত ধারণার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তবুও, আমাদের পরিবার গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার প্রতি অনুগত ছিল, প্রতি রবিবার ম্যাসে যোগ দিত এবং স্থানীয় বিশপের বার্ষিক
পরিদর্শনের সময় তার থাকার জন্য আমাদের ঘর উন্মুক্ত থাকত। আমি একজন ঐকতান-গায়কমণ্ডলীর সদস্য ছিলাম এবং আমার জীবনের স্বপ্ন ছিল যাজক হওয়া।১৯২৯ সালে আমি পুলিশ বাহিনীতে যোগ দিই। বাবা যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন আমার কার্যভার ছিল উত্তর গ্রিসের থেসালনীকীতে। সান্ত্বনা এবং আধ্যাত্মিক আলো পাওয়ার জন্য আমি সন্ন্যাসী এলাকার নিকটবর্তী এথোস পর্বতের পুলিশ বাহিনীর ওখানে আমার বদলি নিশ্চিত করেছিলাম, যে-পর্বতকে অর্থোডক্স খ্রিস্টানরা “পবিত্র পর্বত” হিসেবে সম্মান করত। * সেখানে আমি চার বছর কাজ করি এবং একেবারে কাছ থেকে সন্ন্যাসীদের জীবনযাপন পর্যবেক্ষণ করি। ঈশ্বরের নিকটবর্তী হওয়ার বদলে আমি সন্ন্যাসীদের নির্লজ্জ অনৈতিকতা এবং কলুষতা দেখে মর্মাহত হই। একজন আর্কিম্যানড্রাইট, যাকে আমি সম্মান করতাম, তিনি যখন আমার কাছে অনৈতিক আবেদন করেন, তখন আমি অত্যন্ত বিরক্ত হই। এইধরনের বিভ্রান্তিকর ঘটনা হওয়া সত্ত্বেও আমি আন্তরিকভাবে ঈশ্বরের সেবা করতে এবং একজন যাজক হতে চেয়েছিলাম। এমনকি আমি যাজকের পোশাক পরে একটা ছবি তুলে সেটা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দিয়েছিলাম। পরিশেষে, আমি ক্রীটে ফিরে যাই।
“ও একটা দিয়াবল!”
১৯৪২ সালে আমি এক সুন্দরী মেয়ে ফ্রোসিনিকে বিয়ে করি, যে এক সম্মানীয় পরিবার থেকে এসেছিল। বিয়ে আমার যাজক হওয়ার সিদ্ধান্তকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছিল, যেহেতু আমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা অত্যন্ত ধার্মিক ছিল। * আমি সেমিনারীতে অধ্যয়ন করার জন্য এথেন্সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৪৩ সালের শেষের দিকে আমি ক্রীটের ইরাক্লিয়ন পোতাশ্রয়ে উপস্থিত হই কিন্তু এথেন্সের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি না। এর কারণ হয়তো ছিল যে, ইতিমধ্যে আমি আধ্যাত্মিক সতেজতার এক ভিন্ন উৎস খুঁজে পেয়েছিলাম। কী ঘটেছিল?
কিছু বছরের জন্য এক উদ্যোগী প্রচারক ইম্মানূয়েল লিওনুভাকিস, যিনি যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, তিনি ক্রীটের সমস্ত জায়গায় জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত বাইবেলের সত্য শিক্ষা দিতে থাকেন। * কিছু লোক যিহোবার সাক্ষিদের দেওয়া ঈশ্বরের বাক্যের স্পষ্ট বোধগম্যতার দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং মিথ্যা ধর্ম ত্যাগ করে। নিকটবর্তী সিটিয়া শহরে উদ্যোগী সাক্ষিদের একটা দল সংগঠিত হয়। এটা স্থানীয় বিশপকে ক্ষেপিয়ে তোলে, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন বলে প্রত্যক্ষভাবে জানতেন যে, প্রচারক হিসেবে যিহোবার সাক্ষিরা কতটা কার্যকারী। তিনি তার এলাকা থেকে এই “ধর্মবিরোধিতা” দূর করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হন। তার উসকানিতে পুলিশ নিয়মিত সাক্ষিদের টেনেহিঁচড়ে জেলে নিয়ে যেত এবং বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে আদালতের সামনে দাঁড় করাতো।
এই যিহোবার সাক্ষিদের মধ্যে একজন আমার কাছে বাইবেলের সত্য সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেন কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন যে আমি আগ্রহী নই। তাই, তিনি আরও অভিজ্ঞ পরিচারককে আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য পাঠান। আমার রূঢ় মনোভাবের কারণে স্পষ্টতই দ্বিতীয় সাক্ষি ছোট দলের কাছে ফিরে গিয়ে এই মন্তব্য করতে বাধ্য হয়: “প্যারেক্লিজের পক্ষে যিহোবার সাক্ষি হওয়া অসম্ভব। ও একটা দিয়াবল!”
বিরোধিতার প্রথম অভিজ্ঞতা
আমি আনন্দিত যে, ঈশ্বর আমাকে সেভাবে দেখেননি। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমার ভাই দিমাসদেনিজ, যে দৃঢ়ভাবে বুঝতে পেরেছিল যে যিহোবার সাক্ষিরা সত্য শেখায়, সে আমাকে সমস্ত শোকার্তদের জন্য সান্ত্বনা * (ইংরেজি) পুস্তিকাটি দেয়। এটির বিষয়বস্তু আমার ওপর ছাপ ফেলে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে অর্থোডক্স গির্জায় যোগ দেওয়া বন্ধ করি, সিটিয়ার ছোট্ট দলে যোগ দিই এবং আমাদের নতুন পাওয়া বিশ্বাস সম্বন্ধে আমাদের সহদোর ভাইবোনদের কাছে সাক্ষ্য দিই। তারা সকলে বাইবেলের সত্য গ্রহণ করে। ঠিক যেমনটা আশা করেছিলাম, সেইমতো মিথ্যা ধর্ম ত্যাগ করার বিষয়ে আমার সিদ্ধান্তের জন্য আমার স্ত্রী ও তার পরিবার থেকে আমাকে বিতাড়িত হতে হয় এবং শত্রুতা আসে। কিছু সময়ের জন্য আমার শ্বশুর এমনকি আমার সঙ্গে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেন। ঘরে মতভেদ এবং সবসময়ের দুশ্চিন্তা ছিল। তা সত্ত্বেও, ১৯৪৫ সালের ২১শে মে দিমাসদেনিজ এবং আমি ভাই মিনোস কোকিনাকিসের * কাছে বাপ্তিস্ম নিই।
অবশেষে আমি আমার স্বপ্ন সম্বন্ধে বুঝতে পারি এবং ঈশ্বরের এক প্রকৃত সেবক হিসেবে কাজ করতে শুরু করি! আমি এখনও আমার প্রথম দিন ঘরে-ঘরে প্রচারের কথা স্মরণ করতে পারি। আমার ব্যাগে ৩৫টি পুস্তিকা নিয়ে আমি একা একা বাসে করে একটা গ্রামে যাই। ভয়ে ভয়ে আমি ঘরে-ঘরে প্রচারে যেতে শুরু করি। যতই আমি যেতে থাকি, ততই আমি সাহসী হয়ে উঠতে থাকি। যখন একজন ক্রুদ্ধ যাজক এসে উপস্থিত হন, তখন আমি তার সামনে সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পেরেছিলাম এবং তার সঙ্গে পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার অটল দাবিকে উপেক্ষা করেছিলাম। আমি তাকে বলেছিলাম যে, একমাত্র তখনই আমি চলে যাব যখন পুরো গ্রাম পরিদর্শন শেষ হবে আর আমি ঠিক তাই করেছিলাম। আমি এতটাই খুশি হয়েছিলাম যে, এমনকি আমি বাসের জন্যও অপেক্ষা করিনি কিন্তু ১৫ কিলোমিটার পথ হেঁটেই বাড়ি ফিরেছিলাম।
নির্মম দুর্বৃত্তদলের হাতে
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমাকে সিটিয়াতে আমাদের নতুন গঠিত মণ্ডলীতে আরও দায়িত্ব দেওয়া হয়। গ্রিসে এরপরই গৃহযুদ্ধ লাগে। গোঁড়াপন্থী দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর ঘৃণায় মেতে ওঠে। সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিশপ, স্থানীয় এক গেরিলা দলকে উসকে দেয়, যাতে তারা উপযুক্ত বলে মনে করে এমন যেকোনো উপায়েই যেন যিহোবার সাক্ষিদের হাত থেকে তাদের রেহাই দেয়। (যোহন ১৬:২) গেরিলা দল যখন বাসে করে আমাদের গ্রামে আসছিল, তখন এক বন্ধুসুলভ মহিলা সেখানে তাদের “ঈশ্বর নিযুক্ত” কাজ পালন করার পরিকল্পনার কথা শুনে ফেলেন এবং তিনি আমাদের সাবধান করে দেন। আমরা লুকিয়ে থাকি এবং আমাদের একজন আত্মীয় আমাদের হয়ে কাজ করেন। আমরা বেঁচে যাই।
এটা আরও দুর্দশা আসার পথ তৈরি করেছিল। মারধর করা এবং ভয় দেখিয়ে বশে আনা ছিল নিত্যকার ব্যাপার। আমাদের বিরোধীরা আমাদের গির্জায় ফিরে যেতে, আমাদের ছেলেমেয়েদের বাপ্তিস্ম দিতে এবং ক্রুশের চিহ্ন করতে জোর করেছিল। একবার তারা আমার ভাইকে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা সে মরে গেছে বলে মনে করেছে, ততক্ষণ পর্যন্ত মারধর করেছিল। এটা দেখা আমার জন্য অনেক কষ্টকর ছিল, যখন আমার দুবোনকে কাপড়চোপড় খুলে নিয়ে তাদের মারধর করা হয়েছিল। সেই সময়ে, গির্জা জোর করে যিহোবার সাক্ষিদের আটজন ছেলেমেয়েকে বাপ্তিস্ম দিয়েছিল।
১৯৪৯ সালে আমার মা মারা যান। যাজক আবার আমাদের কাছে আসেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বৈধ প্রয়োজনগুলো পালন না করার জন্য দোষারোপ করেন। আমাকে আদালতে যেতে হয়েছিল এবং আমি বেকসুর খালাস পেয়েছিলাম। এটা বিরাট সাক্ষ্য দিয়েছিল যেহেতু সেই মামলায় খোলাখুলি আলোচনায় যিহোবার নাম উত্থাপিত হয়েছিল। শত্রুরা যে-বিষয়টাকে “আমাদের জ্ঞান ফিরিয়ে আনার” একমাত্র উপায় বলে মনে করেছিল, সেটা হল আমাদের গ্রেপ্তার করে বন্দিত্বে পাঠানো। এটা তারা ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে করেছিল।
অগ্নিকুণ্ডে
যে-তিনজন ভাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমি ছিলাম একজন। আমার স্ত্রী এমনকি আমাকে স্থানীয় পুলিশ স্টেশনেও দেখতে আসেনি। আমাদের প্রথম বিরতি ছিল ইরাক্লিয়ন কারাগারে। শুরুতে যেমন বলা হয়েছিল, আমি একা ছিলাম এবং হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমি আমার স্ত্রী, যে আমার বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিল না, তাকে এবং দুই সন্তানকে ফেলে আসি। আমি সাহায্যের জন্য যিহোবার কাছে অন্তর থেকে প্রার্থনা করি। ইব্রীয় ১৩:৫ পদে লিপিবদ্ধ ঈশ্বরের কথাগুলো আমার মনে আসে: “আমি কোন ক্রমে তোমাকে ছাড়িব না, ও কোন ক্রমে তোমাকে ত্যাগ করিব না।” আমি যিহোবার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করার প্রজ্ঞা বুঝতে পেরেছিলাম।—হিতোপদেশ ৩:৫.
আমরা জানতে পেরেছিলাম যে আমাদের মাক্রোনিসসে নির্বাসন দেওয়া হবে, যেটা ছিল গ্রিসের আটিকা সমুদ্র উপকূলের এক অনুর্বর দ্বীপ। কাউকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য শুধু মাক্রোনিসসের নাম বলাই যথেষ্ট কারণ সেখানকার বন্দি শিবিরে প্রচণ্ড অত্যাচার করা হতো ও দাস্যকর্ম করানো হতো। সেখানে যাওয়ার পথে আমরা পাইরিয়াসে থামি। যদিও আমাদের হাতে হাতকড়া ছিল কিন্তু আমরা অনেক উৎসাহিত হয়েছিলাম, যখন আমাদের কিছু সহ বিশ্বাসী আমাদের নৌকায় এসে আমাদের আলিঙ্গন করেছিল।—প্রেরিত ২৮:১৪, ১৫.
মাক্রোনিসসে জীবন ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো। সৈন্যরা বন্দিদের সঙ্গে সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত খারাপ ব্যবহার করত। অনেক ন-সাক্ষি বন্দি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল, কেউ কেউ মারা গিয়েছিল এবং শারীরিক দিক দিয়ে অক্ষম হয়ে পড়েছিল। রাতের বেলা যাদের অত্যাচার করা হতো, তাদের চিৎকার এবং গোঙানির শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। সেই শীতের রাতে আমার পাতলা কম্বল আমাকে সামান্যই উষ্ণ রাখত।
ধীরে ধীরে সেই শিবিরে যিহোবার সাক্ষিরা সুপরিচিত হয়ে ওঠে কারণ প্রতিদিন সকালে নাম ডাকার সময় সেই নাম উল্লেখ করা হতো। এভাবে আমাদের সাক্ষ্য দেওয়ার অনেক সুযোগ হয়েছিল। আমার এমনকি একজন রাজনৈতিক বন্দিকে বাপ্তিস্ম দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল, যিনি যিহোবার কাছে নিজের জীবন উৎসর্গ করে উন্নতি করেছিলেন।
আমার বন্দিত্বের সময় আমি এমনকি কোনো উত্তর না পাওয়া সত্ত্বেও আমার প্রিয় স্ত্রীকে সবসময় চিঠি লিখতাম। এটা আমাকে তাকে কোমলতার সঙ্গে এবং সান্ত্বনা ও এই নিশ্চয়তা দিয়ে চিঠি লিখতে বাধা দেয়নি যে, এটা এক সাময়িক পরিস্থিতি এবং আমরা আবার সুখী হব।
ইতিমধ্যে আমাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে যখন আরও ভাইয়েরা আসে। অফিসে কাজ করার সময় শিবিরের এক আদেশকারী কর্ণেলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। যেহেতু তিনি যিহোবার সাক্ষিদের সম্মান করতেন, তাই সাহস অর্জন করে আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমরা আমাদের এথেন্সের অফিস থেকে কিছু বাইবেল সাহিত্যাদি গ্রহণ করতে পারব কি না। “সেটা অসম্ভব,” তিনি বলেছিলেন, “কিন্তু এথেন্সে তোমাদের লোকেরা মালপত্র হিসেবে প্যাকেটে করে, সেটার ওপর আমার নাম লিখে পাঠিয়ে দিক না কেন?” আমি অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম! কিছুদিন পরে আমরা যখন পৌঁছানো নৌকা থেকে মালপত্র নামাতে থাকি, তখন একজন পুলিশ কর্ণেলকে স্যালুট করে জানায়: “স্যার, আপনার মালপত্র এসে গেছে।” তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কীসের মালপত্র?” আমি তাদের কাছেই ছিলাম
এবং তাদের কথাবার্তা শুনছিলাম, তাই আমি তার কাছে ফিসফিস করে বলি: “এটা মনে হয় আমাদের, যা আপনার আদেশ অনুযায়ী আপনার নামে পাঠানো হয়েছে।” সেটা ছিল একটা উপায়, যার মাধ্যমে যিহোবা নিশ্চিত করেছিলেন যে, তিনি আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে আমাদের যত্ন নেন।এক অপ্রত্যাশিত আশীর্বাদ —এরপর আরও নিদারুণ যন্ত্রণা
১৯৫০ সালের শেষের দিকে আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি বাড়ি ফিরে আসি—অসুস্থ, বিবর্ণ, অসম্ভব রোগা এবং আমি কোনো অভ্যর্থনা পাব কি না, সেই সম্বন্ধে অনিশ্চিত। আমার স্ত্রী এবং ছেলেমেয়েদের দেখে আমি কত আনন্দিতই না হয়েছিলাম! আরও উত্তম বিষয় হল যে, ফ্রোসিনির বিরোধিতা অনেকটা কমে গিয়েছিল দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। জেলে বসে লেখা সেই চিঠি কার্যকারী প্রমাণিত হয়েছিল। আমার ধৈর্য এবং অধ্যবসায় দেখে ফ্রোসিনি অনেক প্রভাবিত হয়েছিল। এর কিছু পরই তার সঙ্গে আমার দীর্ঘ ও শান্ত আলোচনা হয়। সে বাইবেল অধ্যয়ন করতে রাজি হয় এবং যিহোবা ও তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর বিশ্বাস গড়ে তোলে। আমার জীবনের একটা আনন্দপূর্ণ দিন ছিল ১৯৫২ সাল যখন আমি তাকে যিহোবার এক উৎসর্গীকৃত দাস হিসেবে বাপ্তিস্ম দিই!
১৯৫৫ সালে প্রত্যেক যাজককে আমরা এই পুস্তিকার একটা করে কপি দিতে শুরু করি যে, খ্রিস্টীয় জগৎ অথবা খ্রিস্টতত্ত্ব—কোনটা “জগতের আলো”? (ইংরেজি)। আমাকে ও সেইসঙ্গে কয়েকজন সাক্ষিকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যিহোবার সাক্ষিদের বিরুদ্ধে এত মামলা ছিল যে, সেগুলোর সব শোনার জন্য আদালতে এক বিশেষ কার্যক্রমের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। সেইদিন সেই অঞ্চলের আইনগত প্রতিষ্ঠানের সকলে সেখানে উপস্থিত ছিল এবং আদালত যাজকদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। বিশপ অস্থির হয়ে কামরার মধ্যে দিয়ে পায়চারি করছিলেন। একজন যাজক আমার বিরুদ্ধে ধর্মান্তরিত করার দোষ চাপান। বিচারক তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন: “আপনার বিশ্বাস কি এতই দুর্বল যে, একটা ব্রোশার পড়ার মাধ্যমে আপনি ধর্মান্তরিত হয়ে যাবেন?” এই প্রশ্ন যাজককে বাক্রুদ্ধ করে দিয়েছিল। আমি বেকসুর খালাস পেয়েছিলাম এবং কিছু ভাইয়ের ছয় মাসের জন্য জেল হয়েছিল।
এরপর বেশ কিছু বছর ধরে আমাদের আবারও গ্রেপ্তার করা হয় এবং আদালতের মামলা বৃদ্ধি পায়। মামলা পরিচালনা করতে আমাদের আইনবিদকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। আমাকে মোট ১৭ বার আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বিরোধিতা সত্ত্বেও, আমরা নিয়মিত প্রচার কাজ করে গিয়েছিলাম। আমরা আনন্দের সঙ্গে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা মেনে নিয়েছিলাম এবং অগ্নিময় পরীক্ষা আমাদের বিশ্বাসকে পরিশোধিত করেছিল।—যাকোব ১:২, ৩.
নতুন নতুন সুযোগ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা
১৯৫৭ সালে আমরা এথেন্সে চলে আসি। শীঘ্রই আমাকে নতুন গঠিত মণ্ডলীতে সেবা করার জন্য নিযুক্ত করা হয়। আমার স্ত্রীর পূর্ণ-হৃদয়ের সহযোগিতায় আমরা আমাদের জীবনকে সাদাসিধে রেখেছিলাম এবং আধ্যাত্মিক কাজগুলোকে প্রথমে রেখেছিলাম। এভাবে আমরা আমাদের বেশির ভাগ সময় প্রচার কাজে দিতে পেরেছিলাম। কয়েক বছর ধরে, প্রয়োজন রয়েছে এমন বিভিন্ন মণ্ডলীতে যাওয়ার জন্য আমাদের বলা হয়।
১৯৬৩ সালে আমার ছেলের বয়স যখন ২১ বছর, তখন
তাকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য রিপোর্ট করতে হয়। নিরপেক্ষতার কারণে সেনাবাহিনীতে নির্বাচিত সমস্ত সাক্ষিদের মারধর, উপহাস এবং অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। আমার ছেলেরও এইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তাই, আমি তাকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রতীক হিসেবে মাক্রোনিসসের কম্বল দিই, যাতে সে আগের আনুগত্য রক্ষাকারীদের উদাহরণ অনুসরণ করে। যে-ভাইদের হাজিরা দিতে বলা হয়, তাদের সামরিক আদালতে বিচার করা হয় এবং তারা সাধারণত দুই থেকে চার বছরের সাজা পায়। মুক্ত হওয়ার পর তাদের আবারও ডাকা হয় এবং সাজা দেওয়া হয়। একজন ধর্ম-প্রচারক হিসেবে আমি অনেক জেলখানা পরিদর্শন করতে পেরেছিলাম এবং আমার ছেলের ও সেইসঙ্গে অন্যান্য বিশ্বস্ত সাক্ষিদের সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার ছেলেকে ছয় বছরেরও বেশি সময় জেলে রাখা হয়েছিল।যিহোবা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলেন
গ্রিসে ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, রোড্জ দ্বীপে আমার অস্থায়ী বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়। এরপর ১৯৮৬ সালে ক্রীটের সিটিয়াতে প্রয়োজন দেখা দেয়, যেখানে আমি আমার খ্রিস্টীয় ক্যারিয়ার শুরু করি। প্রিয় সহ বিশ্বাসী, যাদের আমি ছোটবেলা থেকে চিনতাম, তাদের সঙ্গে আবারও সেবা করার সেই দায়িত্ব পেয়ে অনেক আনন্দিত হয়েছিলাম।
আমার পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি হিসেবে আমি মোট ৭০ জন আত্মীয়কে অনুগতভাবে যিহোবাকে সেবা করতে দেখে আনন্দিত। আর সংখ্যা দিন-দিন বেড়েই চলছে। কেউ কেউ প্রাচীন, পরিচারক দাস, অগ্রগামী, বেথেল কর্মী এবং ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করছে। ৫৮ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমার বিশ্বাস নিদারুণ যন্ত্রণার অগ্নিময় পরীক্ষার মধ্যে পরীক্ষিত হয়েছে। আমার বয়স এখন ৯৩ বছর এবং পিছনে ফিরে তাকালে যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমি কোনো দুঃখবোধ করি না। তিনি তাঁর প্রেমময় এই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়ার জন্য আমাকে শক্তি দিয়েছিলেন: “হে বৎস, তোমার হৃদয় আমাকে দেও, তোমার চক্ষু আমার পথসমূহে প্রীত হউক।”—হিতোপদেশ ২৩:২৬.
[পাদটীকাগুলো]
^ ১৯৯৯ সালের ১লা ডিসেম্বর প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ৩০-১ পৃষ্ঠা দেখুন।
^ গ্রিক অর্থোডক্স গির্জার যাজকরা বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিল।
^ ইম্মানূয়েল লিওনুভাকিসের জীবন কাহিনীর জন্য ১৯৯৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রহরীদুর্গ পত্রিকার ২৫-৯ পৃষ্ঠা দেখুন।
^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত কিন্তু এখন আর প্রকাশিত হয় না।
^ মিনোস কোকিনাকিসের আইনগত বিজয়ের জন্য ১৯৯৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রহরীদুর্গ (ইংরেজি) পত্রিকার ২৭-৩১ পৃষ্ঠা দেখুন।
[২৭ পৃষ্ঠার বাক্স]
মাক্রোনিসস বিভীষিকাময় এক দ্বীপ
১৯৪৭ থেকে ১৯৫৭ সাল, এই দশ বছর অনুর্বর এবং নির্জন দ্বীপ মাক্রোনসিস ছিল ১,০০,০০০রেরও বেশি বন্দির বাসস্থান। এদের মধ্যে অনেক বিশ্বস্ত সাক্ষি ছিল, যাদেরকে তাদের খ্রিস্টীয় নিরপেক্ষতার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তাদের নির্বাসিত করার প্ররোচক ছিল মূলত গ্রিক অর্থোডক্স পাদরিবর্গ, যারা যিহোবার সাক্ষিদের কমিউনিস্ট বলে মিথ্যা অভিযোগ করেছিল।
মাক্রোনিসসে যে-“সংশোধন” করা হতো, সেই সম্বন্ধে গ্রিক এনসাইক্লোপিডিয়া পাপিরোস লারুস ব্রিটানিকা বলে: “নিষ্ঠুর অত্যাচারের পদ্ধতি, . . . জীবনযাপনের অবস্থা, যা সভ্য জাতির জন্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং লোকেদের প্রতি রক্ষীদের খারাপ আচরণ . . . গ্রিস ইতিহাসের জন্য এক লজ্জাজনক বিষয়।”
কিছু সাক্ষিদের বলা হয়েছিল যে, যতদিন পর্যন্ত না তারা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ত্যাগ করবে ততদিন পর্যন্ত তারা কখনোই ছাড়া পাবে না। তবুও, সাক্ষিদের নীতিনিষ্ঠা অটল ছিল। এ ছাড়া, কিছু রাজনৈতিক বন্দি যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ফলে বাইবেলের সত্যকে নিজের করে নিয়েছিল।
[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
দণ্ডসংক্রান্ত মাক্রোনিসস দ্বীপে মিনোস কোকিনাকিস (ডান দিক থেকে তৃতীয়) এবং আমি, (বাঁ থেকে চতুর্থ)
[২৯ পৃষ্ঠার চিত্র]
ক্রীটের সিটিয়াতে, যেখানে আমি ছোটবেলায় সেবা করেছিলাম, সেখানে একজন সহ সাক্ষির সঙ্গে কাজ করার সময়