সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অতুলনীয় আনন্দ!

অতুলনীয় আনন্দ!

জীবন কাহিনী

অতুলনীয় আনন্দ!

বলেছেন রেজিনাল্ড ওয়ালওয়ার্ক

“যিহোবার কাজে পূর্ণ-সময় মিশনারি হিসেবে সেবা করে যে-আনন্দ আমরা পেয়েছি, সেটার সঙ্গে এই জগতের কোনো কিছুরই তুলনা করা চলে না!” হিজিবিজি করে লেখা এই নোটটি ১৯৯৪ সালের মে মাসে আমার স্ত্রীর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন পর, তার ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে আমি পেয়েছিলাম।

আইরিনের কথাগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার সময়, পেরুতে মিশনারি হিসেবে যে-৩৭টি আনন্দপূর্ণ, পরিতৃপ্তিদায়ক বছর আমরা কাটিয়েছি, তা মনে পড়ে যায়। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের বিয়ের পর থেকে আমরা এক অমূল্য খ্রিস্টীয় সঙ্গ উপভোগ করেছি আর সেই সময় থেকে আমার কাহিনী শুরু করাটা হবে উপযুক্ত।

আইরিন, ইংল্যান্ডের লিভারপুলে যিহোবার সাক্ষিদের একজন হিসেবে বড় হয়ে উঠেছিল। তারা ছিল তিন বোন আর সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার বাবাকে হারিয়েছিল। এরপর তার মা উইনটন ফ্রেজার নামে এক ভদ্রলোককে বিয়ে করেন আর সিডনি নামে তাদের একটা ছেলে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগেই পরিবারটি নর্থ ওয়েলসের ব্যাংগরে চলে যায়, যেখানে ১৯৩৯ সালে আইরিন বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। সিডনি এক বছর আগে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন, তাই আইরিন তার সঙ্গে অ্যাংলেসি দ্বীপ সহ ওয়েলসের উত্তর উপকূলের পাশে, ব্যাংগর থেকে কারনারভন পর্যন্ত অগ্রগামী—পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক—হিসেবে সেবা করেছিল।

সেই সময় আমি লিভারপুল থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রানকর্ন মণ্ডলীতে পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে সেবা করছিলাম, আজকে যেভাবে বলা হয়ে থাকে। এক সীমা অধিবেশনে আইরিন আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে যে প্রচার করার জন্য সে কিছু এলাকা পেতে পারে কি না, কারণ সে কিছুদিন রানকর্নে তার বিবাহিতা দিদি ভিরার সঙ্গে থাকবে। যে-দুসপ্তা আইরিন আমাদের এখানে থেকেছিল, তখন আমাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং পরে আমি বেশ কয়েকবার ব্যাংগরে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আইরিন যখন আমার দেওয়া বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়েছিল, তখন আমি কত আনন্দিতই না হয়েছিলাম!

রবিবারে ঘরে ফিরে এসে আমি সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিয়ের পরিকল্পনা করতে শুরু করি কিন্তু মঙ্গলবারে আমার কাছে একটি টেলিগ্রাম আসে। “আমি খুবই দুঃখিত যে, এই টেলিগ্রাম তোমাকে কষ্ট দেবে,” তাতে লেখা ছিল। “আমি আমাদের বিয়ে বাতিল করছি। পরের চিঠিতে বিস্তারিত জানাচ্ছি।” আমি প্রচণ্ড এক ধাক্কা খেয়েছিলাম। কী এমন হল?

পরদিনই আইরিনের চিঠি আসে। সে আমাকে বলে যে, সে ইয়র্কশায়ারের হর্সফোর্থে হিলডা প্যাজেটের সঙ্গে অগ্রগামীর কাজ করতে যাচ্ছে। * সে জানায় যে, যেখানে রাজ্য ঘোষণাকারীদের বেশি দরকার সেখানে গিয়ে সেবা করার জন্য অনুরোধ করা হলে সে তাতে রাজি আছে বলে ১২ মাস আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। সে লিখেছিল: “আমার জন্য এটা যিহোবার কাছে করা একটা অঙ্গীকারের মতো আর আমি মনে করি যে, যেহেতু তোমার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগেই আমি তাঁর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, তাই আমাকে অবশ্যই সেটা রাখতে হবে।” যদিও আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম কিন্তু আমি তার নীতিনিষ্ঠা দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম এবং উত্তর জানিয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলাম: “তুমি যাও। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব।”

ইয়র্কশায়ারে থাকার সময় আইরিন ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিবেকের দ্বারা চালিত হয়ে যুদ্ধকে সমর্থন না করায় তিন মাসের জন্য জেলে যায়। কিন্তু, ১৮ মাস পর, ১৯৪২ সালের ডিসেম্বর মাসে আমাদের বিয়ে হয়।

আমার ছেলেবেলা

মা ১৯১৯ সালে শাস্ত্রের ওপর অধ্যয়ন * (ইংরেজি) বইয়ের একটা সেট কিনেছিলেন। যদিও বাবা ঠিকই মন্তব্য করেছিলেন যে, মা আগে কখনও একটা বইও পড়েননি কিন্তু মা তার বাইবেলের সঙ্গে এই খণ্ডগুলোকে মনোযোগ দিয়ে পড়ার সংকল্প নিয়েছিলেন। তিনি তা করেছিলেন এবং ১৯২০ সালে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলেন।

আমার বাবা অত কঠোর ছিলেন না আর তাই তিনি কখনও মা যা করতে চেয়ছিলেন, তাতে বাধা দেননি আর এর অন্তর্ভুক্ত ছিল তাদের চারটে সন্তানকে—আমার দুই দিদি গুয়েন ও আইভি; আমার দাদা অ্যালেক ও আমাকে—সত্যে মানুষ করে তোলা। লিভারপুলের স্ট্যানলি রজার্স ও অন্যান্য বিশ্বস্ত সাক্ষিরা রানকর্নে বাইবেল-ভিত্তিক বক্তৃতাগুলো দেওয়ার জন্য যেত, যেখানে খুব শীঘ্রই একটি নতুন মণ্ডলী গড়ে উঠেছিল। আমাদের পরিবার মণ্ডলীর সঙ্গে আধ্যাত্মিকভাবে উন্নতি করে চলেছিল।

গুয়েন তখন চার্চ অফ ইংল্যান্ডে দীক্ষিত হওয়ার শিক্ষাগুলো নিচ্ছিল কিন্তু যখনই সে মায়ের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করে, সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। যখন গির্জার পল্লীযাজক আমাদের কাছে খোঁজ নিতে এসেছিলেন যে কেন সে তার ক্লাসগুলোতে আর যোগ দিচ্ছে না, তখন সেই যাজক অনেক অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, যেগুলোর উপযুক্ত উত্তর তার কাছে ছিল না। গুয়েন প্রভুর প্রার্থনার অর্থ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত সে নিজেই তাকে তা ব্যাখ্যা করেছিল! গুয়েন ১ করিন্থীয় ১০:২১ পদ উদ্ধৃতি করে আলোচনার শেষে এটা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, সে আর কখনও ‘উভয় মেজের অংশী হইতে পারে না।’ আমাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় সেই গির্জার পল্লীযাজক বলেছিলেন যে, তিনি গুয়েনের জন্য প্রার্থনা করবেন ও তার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আবার ফিরে আসবেন কিন্তু তিনি আর কোনোদিন আসেননি। বাপ্তিস্মের পর, গুয়েন শীঘ্রই একজন পূর্ণ-সময়ের সুসমাচার প্রচারক হয়েছিল।

আমাদের মণ্ডলীতে ছোটদের প্রতি যেভাবে মনোযোগ দেওয়া হতো, তা সত্যিই লক্ষণীয় ছিল। আমার মনে আছে আমার বয়স যখন সাত বছর, তখন আমি একজন অতিথি প্রাচীনের বক্তৃতা শুনেছিলাম। এরপর তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম যে, আমি অব্রাহামের বিষয়ে ও তিনি কীভাবে তার ছেলে ইস্‌হাককে উৎসর্গ করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেটা পড়ছিলাম। “পুলপিঠের এক কোণেতে যাও ও সেখান থেকে আমাকে পুরো ঘটনাটা বল,” তিনি বলেছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে আমার প্রথম “জনসাধারণের বক্তৃতা” দিতে পেরে আমি কত রোমাঞ্চিতই না হয়েছিলাম!

আমি ১৯৩১ সালে ১৫ বছর বয়সে বাপ্তিস্ম নিয়েছিলাম, যে-বছর আমার মা মারা যান এবং একজন ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কাজ শেখার জন্য স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলাম। ১৯৩৬ সালে জনসাধারণ্যে রেকর্ড করা বাইবেল-ভিত্তিক বক্তৃতাগুলো বাজানো হতো আর একজন বয়স্কা বোন আমার দাদাকে ও আমাকে পরিচর্যার এই দিকটিতে ব্যস্ত হতে উৎসাহিত করেছিলেন। তাই অ্যালেক ও আমি একটা সাইকেল কেনার জন্য এবং আমাদের ফোনোগ্রাফটা বহন করতে সাইকেলের সঙ্গে লাগোয়া এক সাইডকার তৈরি করতে লিভারপুলে গিয়েছিলাম। সাইডকারের পিছনে ২ মিটার উঁচু এক টেলিস্কোপিক টিউবের ওপরে লাউডস্পীকার লাগানো হয়েছিল। কারিগর আমাদের বলেছিলেন যে, তিনি এর আগে কখনও এইরকম কিছু তৈরি করেননি কিন্তু সেটা বেশ ভালভাবে কাজ করেছিল! বোনের উৎসাহ এবং আমাদেরকে যে-বিশেষ সুযোগগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেইজন্য অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হয়ে উদ্যমের সঙ্গে আমরা পুরো এলাকা শেষ করেছিলাম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ—পরীক্ষার এক সময়

যুদ্ধের মেঘ যখন ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন স্ট্যানলি রজার্স ও আমি “বাস্তবের মুখোমুখি হোন” শিরোনামের জনসাধারণের বক্তৃতার বিষয়ে ঘোষণা করতে ব্যস্ত ছিলাম, যেটা ১৯৩৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হলে দেওয়ার কথা ছিল। পরে আমি পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত এই বক্তৃতাটি ও সেইসঙ্গে পরের বছরে প্রকাশিত ফ্যাসিবাদ অথবা স্বাধীনতা (ইংরেজি) নামক পুস্তিকা বিতরণ করেছিলাম। দুটো পুস্তিকাই হিটলার শাসিত জার্মানির একদলীয় শাসনের উচ্চাকাঙ্ক্ষাগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে দিয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে, আমি আমার জনসাধারণ্যের পরিচর্যার জন্য রানকর্নে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলাম এবং এর জন্য আমাকে সম্মানও করা হতো। বাস্তবিকই, আমি সবসময় ঈশতান্ত্রিক কাজের অগ্রভাগে ছিলাম বলে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করার জন্য আমি এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম।

আমি যে-কোম্পানিতে কাজ করতাম সেই কোম্পানি শহরের সীমান্তে একটা নতুন কারখানায় বৈদ্যুতিক তার বাঁধার কাজের চুক্তি করেছিল। এটা একটা যুদ্ধাস্ত্রের কারখানা জেনে আমি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, আমি সেখানে কাজ করতে পারব না। যদিও আমার কর্মকর্তারা অসন্তুষ্ট হয়েছিল কিন্তু আমি যার অধীনে কাজ করি তিনি আমার পক্ষসমর্থন করেছিলেন এবং আমাকে অন্য কাজ দেওয়া হয়েছিল। পরে আমি জানতে পেরেছিলাম যে, তার একজন আন্টি আছেন যিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন।

আমার এক সহকর্মী আমাকে প্রচুর উৎসাহ দিয়েছিলেন, যখন তিনি বলেছিলেন: “রেজ, আপনার কাছ থেকে আমরা এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করছি না, যেহেতু আপনি অনেক বছর ধরে বাইবেলের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।” তবুও, আমাকে সতর্ক হতে হয়েছিল কারণ আমার অনেক সহকর্মী আমাকে ঝামেলায় ফেলতে চেয়েছিল।

ধর্মীয় নীতিবোধের কারণে সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ায় প্রত্যাখ্যানকারী হিসেবে আমার নিবন্ধীকরণ ১৯৪০ সালের জুন মাসে লিভারপুলের আদালতের দ্বারা গৃহীত হয়েছিল, এই শর্তে যে, আমি যেন আমার বর্তমান চাকরিই করে যাই। অবশ্য, এটা আমাকে আমার খ্রিস্টীয় পরিচর্যা চালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল।

পূর্ণ-সময় পরিচর্যায়

যুদ্ধ যখন প্রায় শেষের দিকে, তখন আমি আমার চাকরি ছেড়ে আইরিনের সঙ্গে পূর্ণ-সময়ের পরিচর্যায় যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ১৯৪৬ সালে আমি পাঁচ মিটার লম্বা একটা ট্রেইলার তৈরি করেছিলাম, যেটা আমাদের বাড়ি হয়ে উঠেছিল আর এর পরের বছর আমাদের অ্যালভেস্টনে যেতে বলা হয়েছিল, যেটা ছিল গ্লুসেসটারশায়ারের একটা গ্রাম। এর পর আমরা সাইরেনসেস্টারের প্রাচীন শহর এবং বাথ শহরে অগ্রগামীর কাজ করেছিলাম। ১৯৫১ সালে একজন ভ্রমণ অধ্যক্ষ হিসেবে আমাকে ওয়েলসের দক্ষিণাঞ্চলের মণ্ডলীগুলো পরিদর্শন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল কিন্তু দুবছর হওয়ার আগেই মিশনারি প্রশিক্ষণের জন্য আমরা ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের জন্য রওনা হই।

স্কুলের ২১তম ক্লাস উত্তর নিউ ইয়র্কের দক্ষিণ ল্যানসিংয়ে হয়েছিল আর আমরা ১৯৫৩ সালে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলাম, যা নিউ ইয়র্ক সিটির নিউ ওয়ার্ল্ড সোসাইটি এসেম্বলি হলে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আইরিন ও আমি আমাদের গ্র্যাজুয়েশন দিনের আগে পর্যন্ত জানতাম না যে, আমাদের কোথায় পাঠানো হবে। আমাদের গন্তব্যস্থল পেরু জেনে আমরা কত রোমাঞ্চিতই না হয়েছিলাম। কেন? কারণ আইরিনের সৎভাই সিডনি ফ্রেজার ও তার স্ত্রী মার্গারেট, গিলিয়েডের ১৯তম ক্লাস থেকে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লিমা শাখা অফিসে সেবা করছিল!

আমাদের ভিসার জন্য অপেক্ষা করার সময় আমরা অল্প কিছু সময় ব্রুকলিন বেথেলে কাজ করেছিলাম কিন্তু শীঘ্রই আমরা লিমার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম। আমাদের দশটি মিশনারি কার্যভারের মধ্যে প্রথমটি ছিল পেরুর প্রধান সমুদ্রবন্দর কাইয়াওতে, যা লিমা থেকে একটু পশ্চিমে ছিল। যদিও আমরা স্প্যানিশ ভাষার কিছু মৌলিক বিষয় শিখেছিলাম কিন্তু সেই সময় আমি বা আইরিন কেউই সেই ভাষায় কথা বলতে পারতাম না। কীভাবে আমরা কাজ করব?

প্রচার কাজের সমস্যা ও উপকারগুলো

গিলিয়েডে আমাদের বলা হয়েছিল যে, একজন মা তার ছোট শিশুকে ভাষা শেখান না। বরং, মা যখন তার সঙ্গে কথা বলেন, তখন শিশুই সেই ভাষা শিখে ফেলে। তাই আমাদের যে-পরামর্শটি দেওয়া হয়েছিল তা ছিল: “এখনই প্রচার কাজে বের হোন এবং সাধারণ লোকেদের কাছ থেকে ভাষা শিখুন। তারা আপনাদের সাহায্য করবে।” আমি যখন এই নতুন ভাষাটির ওপর দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করেছিলাম, কল্পনা করুন আমার কী অবস্থা হয়েছিল যখন সেখানে পৌঁছাবার দুই সপ্তাহের মধ্যে আমাকে কাইয়াও মণ্ডলীর পরিচালক অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছিল! আমি সিডনি ফ্রেজারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম কিন্তু তার পরামর্শও গিলিয়েডের মতোই ছিল—তোমাদের মণ্ডলী ও তোমাদের এলাকার লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা কর। আমি এই পরামর্শকে মেনে চলার সংকল্প নিয়েছিলাম।

এক শনিবার সকালে আমি এক ছুতোর মিস্ত্রির দোকানে গিয়ে তার দেখা পাই। “আমাকে আমার কাজ চালিয়ে যেতে হবে,” তিনি বলেছিলেন, “কিন্তু আপনি দয়া করে বসুন ও আমার সঙ্গে কথা বলুন।” আমি তাকে বলেছিলাম যে আমি তা করব কিন্তু একটা শর্তে: “আমি যখন কোনো ভুল করব, তখন দয়া করে আমাকে শুধরে দেবেন। আমি কিছু মনে করব না।” তিনি হেসে আমার অনুরোধে রাজি হয়েছিলেন। আমি সপ্তাহে দুবার তার কাছে যেতাম এবং দেখেছিলাম যে, আমার নতুন ভাষার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য এটাই ছিল সর্বোত্তম উপায়, ঠিক যেমন আমাকে বলা হয়েছিল।

আমাদের দ্বিতীয় মিশনারি কার্যভার, ইকা শহরে কাকতালীয়ভাবে আমি আরেকজন ছুতোর মিস্ত্রির দেখা পাই এবং কাইয়াওতে করা ব্যবস্থার বিষয়ে তাকে জানিয়েছিলাম। একইভাবে তিনিও আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন, তাই আমার স্প্যানিশ ভাষায় দিন-দিন ভালই উন্নতি হচ্ছিল, যদিও পুরোপুরি দক্ষ হয়ে ওঠার জন্য আমার প্রায় তিন বছর লেগেছিল। এই ব্যক্তি সবসময় ব্যস্ত থাকতেন কিন্তু আমি শাস্ত্রপদগুলো পড়ে ও সেগুলোর অর্থ তাকে বুঝিয়ে দিয়ে একটা বাইবেল অধ্যয়ন পরিচালনা করতে পেরেছিলাম। এক সপ্তাহে আমি যখন তার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখন তার কর্মকর্তা আমাকে বলেন যে তিনি লিমায় আরেকটা নতুন চাকরির জন্য এখান থেকে চলে গেছেন। কিছু সময় পর যখন আইরিন ও আমি সম্মেলনের জন্য লিমায় গিয়ে পৌঁছেছিলাম, তখন আমি আবারও এই ব্যক্তির দেখা পেয়েছিলাম। তিনি তার অধ্যয়ন চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থানীয় সাক্ষিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন জেনে এবং তিনি ও পরিবারের সকলে যিহোবার উৎসর্গীকৃত দাস হয়েছেন দেখে আমি কত রোমাঞ্চিতই না হয়েছিলাম!

একটা মণ্ডলীতে আমরা দেখেছিলাম যে, এক অল্পবয়সী দম্পতি বিবাহিত ছিল না কিন্তু তবুও তারা বাপ্তিস্ম নিয়েছিল। আমরা যখন তাদের সঙ্গে শাস্ত্রীয় নীতিগুলোর বিষয় আলোচনা করেছিলাম, তখন তারা তাদের বন্ধনকে বৈধ করার সংকল্প নিয়েছিল, যেটা তাদের বাপ্তাইজিত সাক্ষি হওয়ার জন্য যোগ্য করে তুলবে। তাই তাদের বিবাহকে নিবন্ধীকৃত করতে সরকারি অফিসে তাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু এরপর আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল কারণ তাদের চারটি সন্তান ছিল ও তাদের কারোরই নিবন্ধন করা হয়নি আর এটা একটা বৈধ দাবি ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম যে, মেয়র কী পদক্ষেপ নেবেন। “আপনাদের বন্ধু এই যিহোবার সাক্ষিরা ভাল লোক বলে বিষয়টা নিশ্চিত করতে চেয়েছে যে, আপনাদের বৈধভাবে বিবাহিত হওয়া উচিত,” মেয়র বলেছিলেন, “তাই আমি প্রত্যেক সন্তানের জন্য আদালতের আদেশ জারি করছি না এবং বিনামূল্যে আইনগতভাবে তাদের নিবন্ধীকৃত করছি।” আমরা কত কৃতজ্ঞই না হয়েছিলাম কারণ এই পরিবার ছিল গরিব এবং কোনো জরিমানা করা হলে তা তাদের জন্য বিরাট বোঝা হতো!

যিহোবার সাক্ষিদের ব্রুকলিন প্রধান কার্যালয় থেকে অ্যালবার্ট ডি. শ্রোডার আমাদের পরিদর্শন করেছিলেন এবং সুপারিশ করেছিলেন, যাতে লিমার আরেক জায়গায় এক নতুন মিশনারি হোম স্থাপন করা হয়। তাই আইরিন ও আমি এবং সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দুজন বোন ফ্রান্সেস ও এলিজাবেথ গুড আর কানাডার এক দম্পতি সান বোরহা জেলায় চলে গিয়েছিলাম। দুই বা তিন বছরের মধ্যে আমরা আরেকটা উন্নতিশীল মণ্ডলী প্রতিষ্ঠা করেছিলাম।

৩,০০০ মিটারেরও বেশি উঁচুতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পার্বত্যাঞ্চল, ওয়ানকাইয়োতে সেবা করার সময় আমরা ৮০ জন সাক্ষিদের নিয়ে গঠিত মণ্ডলীর সঙ্গে মেলামেশা করেছিলাম। সেখানে, আমি সেই দেশের দ্বিতীয় কিংডম হল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। আমি যিহোবার সাক্ষিদের আইনগত প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলাম, কারণ আমরা যে-জমি কিনেছিলাম সেটার ওপর আমাদের আইনত অধিকার স্থাপন করার জন্য তিন বার আমাদের আদালতে যেতে হয়েছিল। এইধরনের কাজগুলো ও সেইসঙ্গে সেই শুরুর বছরগুলোতে অনেক বিশ্বস্ত মিশনারিদের দ্বারা ব্যাপক শিষ্য তৈরির কাজ, এখন আমরা পেরুতে যে-উত্তম বৃদ্ধি দেখতে পারছি, সেটার এক দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেছিল—১৯৫৩ সালে ২৮৩ জন সাক্ষি থেকে আজকে ৮৩,০০০-রেরও বেশি সাক্ষি রয়েছে।

এক দুঃখজনক বিদায়

আমরা আমাদের মিশনারি হোমগুলোতে সহ মিশনারিদের সঙ্গে চমৎকার মেলামেশা উপভোগ করেছি, যেখানে প্রায়ই আমার হোম ওভারসিয়ার হিসেবে সেবা করার বিশেষ সুযোগ হয়েছিল। প্রতি সোমবার সকালে আমরা সকলে একসঙ্গে আমাদের সপ্তাহের কাজ সম্বন্ধে কথা বলে নিতাম ও আমাদের হোমের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বগুলো ভাগ করে দিতাম। যে-কাজটিকে আমরা প্রধান বলে মনে করেছিলাম সেটা হল, প্রচার কাজ আর সেই লক্ষ্য মাথায় রেখে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতাম। আমি এই কথা স্মরণ করে খুশি হই যে, আমাদের হোমগুলোর কোনোটাতেই কখনও বড় রকমের ঝগড়া হয়নি।

আমাদের শেষ কার্যভার ছিল লিমার আরেকটা শহরতলি ব্রিন্‌ইয়াতে। ৭০ জন সাক্ষিকে নিয়ে গঠিত এই প্রেমময় মণ্ডলী দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ১০০ জনেরও বেশি হয়েছিল আর তখন পালোমিনিয়াতে আরেকটা মণ্ডলী গঠিত হয়েছিল। এই সময়ই আইরিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি প্রথমে লক্ষ করেছিলাম যে, সে মাঝে মধ্যে মনে করতে পারত না যে, সে কী বলেছে এবং কখনও কখনও কীভাবে ঘরে ফিরে আসবে, তা মনে করাও তার জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠত। যদিও তাকে ভালভাবে চিকিৎসা করানো হয়েছিল, তবুও তার অবস্থা ধীরে ধীরে আরও অবনতি হয়েছিল।

দুঃখের বিষয় যে, ১৯৯০ সালে আমাকে ইংল্যান্ডে ফিরে আসার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, যেখানে আমার দিদি আইভি সদয়ভাবে তার বাড়িতে থাকার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়। চার বছর পর, আইরিনের যখন প্রায় ৮১ বছর বয়স, তখন সে মারা যায়। আমি পূর্ণ-সময় পরিচর্যা চালিয়ে যাচ্ছি, একজন প্রাচীন হিসেবে আমার শহরের তিনটি মণ্ডলীর মধ্যে একটিতে সেবা করছি। কখনও কখনও আমি ম্যানচেস্টারের স্প্যানিশ দলকে উৎসাহিত করার জন্য সেখানেও যাই।

আমি সম্প্রতি এক উৎসাহজনক অভিজ্ঞতা লাভ করেছি, যেটার শুরু কয়েক দশক আগে হয়েছিল, যখন আমি আমার ফোনোগ্রাফ চালিয়ে গৃহকর্তাদের কাছে পাঁচ মিনিটের প্রচারের ভূমিকা বাজিয়ে শোনাতাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, একটা ছোট্ট স্কুলপড়ুয়া মেয়ে তার মায়ের পিছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বার্তা শুনছিল।

এই মেয়েটি পরে কানাডাতে চলে গিয়েছিল এবং তার একজন বান্ধবী যে এখনও রানকর্নে থাকে ও এখন একজন সাক্ষি, সে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। সেই মেয়েটি সম্প্রতি লিখে জানিয়েছে যে, দুজন সাক্ষি তার বাড়িতে এসেছিল আর সেই অভিব্যক্তিগুলো তারা ব্যবহার করেছে, যেগুলো অপ্রত্যাশিতভাবে তাকে সেই কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, যা সে পাঁচ মিনিটের রেকর্ডে শুনেছিল। সত্যের সমষ্টিকে উপলব্ধি করে সে এখন যিহোবার একজন উৎসর্গীকৃত দাসী এবং সে তার ধন্যবাদ সেই যুবক ব্যক্তিকে জানাতে বলে, যে প্রায় ৬০ বছরেরও বেশি আগে তার মায়ের ঘরে গিয়েছিল! সত্যিই, আমরা কখনও জানি না যে সত্যের বীজগুলো কখন শিকড় বিস্তার করবে ও বেড়ে উঠবে।—উপদেশক ১১:৬.

হ্যাঁ, আমি গভীর কৃতজ্ঞ মনে যিহোবার মূল্যবান সেবায় যে-জীবন কাটিয়েছি তা চিন্তা করি। ১৯৩১ সালে আমার উৎসর্গীকরণের সময় থেকে, আমি কখনও যিহোবার লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করা বাদ দিইনি। যদিও আইরিন ও আমার কোনো সন্তান হয়নি কিন্তু আমি ১৫০ জনেরও বেশি আধ্যাত্মিক ছেলেমেয়ে পেয়ে খুবই খুশি, যারা সকলে আমাদের স্বর্গীয় পিতা যিহোবাকে সেবা করছে। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ঠিক যেভাবে প্রকাশ করেছিল, আমাদের বিশেষ সুযোগগুলো সত্যিই এক অতুলনীয় আনন্দের বিষয়।

[পাদটীকাগুলো]

^ “আমার বাবামায়ের পদচিহ্ন অনুসরণ করে,” হিলডা প্যাজেটের জীবন কাহিনী, যা ১৯৯৫ সালের ১লা অক্টোবর প্রহরীদুর্গ এর ১৯-২৪ পৃষ্ঠায় পাওয়া যায়।

^ যিহোবার সাক্ষিদের দ্বারা প্রকাশিত।

[২৪ পৃষ্ঠার চিত্র]

মা, ১৯০০ দশকের প্রথম দিকে

[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

বাঁদিকে: ১৯৪০ সালে, ইংল্যান্ডের লিডসে হিলডা প্যাজেট, আমি, আইরিন এবং জয়েস রোলি

ওপরে: আইরিন ও আমি আমাদের ট্রেইলার ঘরের সামনে

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৫২ সালে, ওয়েলসের কারডিফে একটা জনসাধারণের বক্তৃতার বিজ্ঞাপন দিচ্ছি