সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

অন্যদের সেবা করা কষ্ট লাঘব করে

অন্যদের সেবা করা কষ্ট লাঘব করে

জীবন কাহিনী

অন্যদের সেবা করা কষ্ট লাঘব করে

বলেছেন হুলিয়ান আরিয়াস

সময়টা ছিল ১৯৮৮ সাল। আমার বয়স তখন ৪০ বছর এবং আমার পেশাগত ভবিষ্যৎ নিরাপদ বলে মনে হয়েছিল। আমি এক বহুজাতিক কোম্পানির আঞ্চলিক পরিচালক ছিলাম। এই চাকরি সূত্রে আমি একটা দামি গাড়ি, ভাল মাইনে ও স্পেনের মাদ্রিদের কেন্দ্রস্থলে বিলাসবহুল একটা অফিস পেয়েছিলাম। এমনকি সেই কোম্পানি পরোক্ষভাবে এও আভাস দিয়েছিল যে, তারা আমাকে তাদের জাতীয় পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করবে। সেই সময় আমি একটুও বুঝতে পারিনি যে, আমার জীবন পুরোপুরিভাবে পালটাতে চলেছে।

সেই বছরেরই এক দিন আমার ডাক্তার আমাকে জানান যে, মালটিপাল স্ক্লেরোসিস নামে আমার এক দুরারোগ্য রোগ হয়েছে। আমি একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। পরে আমি যখন পড়ি যে মালটিপাল স্ক্লেরোসিস রোগটি একজন ব্যক্তিকে কী করতে পারে, তখন আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। * মনে হয়েছিল যেন সারাটা জীবন আমাকে এক আসন্ন ঝুঁকির মধ্যে বেঁচে থাকতে হবে। কীভাবে আমি আমার স্ত্রী মিলাগ্রোস ও আমার তিন বছরের ছেলে ইসমায়েলের যত্ন নেব? কীভাবে আমরা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করব? আমি যখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, তখন আমার জীবনে আরেক বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটে।

ডাক্তার আমাকে আমার অসুস্থতা সম্বন্ধে বলার প্রায় এক মাস পর আমার সুপারভাইজার আমাকে তার অফিসে ডাকেন এবং জানিয়ে দেন যে, কোম্পানিতে এক “উত্তম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন” লোকের প্রয়োজন। আর ক্ষয়রোগ রয়েছে—এমনকি প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও—এমন কোনো ব্যক্তির মধ্যে এই ধরনের ব্যক্তিত্ব দেখা যায় না। তাই, সেই মুহূর্তেই আমার বস আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। হঠাৎ করে, আমার চাকরি জীবন শেষ হয়ে যায়!

আমার পরিবারের সামনে যদিও আমি নিজেকে সাহসী দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু আমার নতুন পরিস্থিতিগুলো সম্বন্ধে ভেবে দেখতে ও আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে নিজের জন্য নিরালায় ব্যক্তিগত একটু সময় চেয়েছিলাম। আমি বেড়ে চলা হতাশার অনুভূতির সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টা করেছিলাম। যে-বিষয়টা আমাকে সবচেয়ে বেশি আঘাত দিয়েছিল সেটা হল, আমার কোম্পানির চোখে আমি রাতারাতি অকর্মণ্য হয়ে পড়েছিলাম।

দুর্বলতা থেকে শক্তি খুঁজে পাওয়া

আমি খুবই কৃতজ্ঞ যে, এই হতাশাজনক সময়ে শক্তির জন্য আমি কয়েকটা উৎসের ওপর নির্ভর করতে পারি। প্রায় ২০ বছর আগে আমি যিহোবার সাক্ষিদের একজন হয়েছিলাম। তাই, আমার অনুভূতি ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাগুলো সম্বন্ধে আমি আন্তরিকতার সঙ্গে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম। আমার স্ত্রী যিনি একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী সে ছিল শক্তির এক দুর্গ ও সেইসঙ্গে কয়েক জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবদের সমর্থন আমার ছিল, যাদের দয়া ও সমবেদনা অমূল্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।—হিতোপদেশ ১৭:১৭.

এ ছাড়া, অন্যদের প্রতি এক দায়িত্ববোধও আমাকে সাহায্য করেছে। আমি আমার ছেলেকে ভালভাবে লালনপালন করতে, তাকে শিক্ষা দিতে, তার সঙ্গে খেলা করতে ও প্রচার কাজের জন্য তাকে প্রশিক্ষণ দিতে চেয়েছিলাম। তাই আমি হাল ছেড়ে দিইনি। সেইসঙ্গে আমি যিহোবার সাক্ষিদের মণ্ডলীগুলোর একটাতে একজন প্রাচীন ছিলাম এবং সেখানকার আমার খ্রিস্টান ভাইবোনদের আমার সমর্থনের প্রয়োজন ছিল। আমার যন্ত্রণাকে আমি যদি আমার বিশ্বাস নষ্ট করে ফেলার সুযোগ দিই, তা হলে অন্যদের কাছে আমি কী ধরনের উদাহরণ রাখব?

স্বাভাবিকভাবেই, শারীরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমার জীবন পালটে গিয়েছিল—কিছু ক্ষেত্রে খারাপের দিকে কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও ভালর দিকে। আমি একবার একজন ডাক্তারকে বলতে শুনি: “কোনো রোগ একজন ব্যক্তিকে ধ্বংস করে দেয় না; বরং সেটা তাকে পালটে দেয়।” আর আমি শিখেছি যে, সব পরিবর্তনই নেতিবাচক নয়।

প্রথমত আমার ‘মাংসের কন্টক’ আমাকে অন্য লোকেদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাগুলোকে আরও ভালভাবে বুঝতে ও তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে সাহায্য করেছে। (২ করিন্থীয় ১২:৭) হিতোপদেশ ৩:৫ পদের কথাগুলো আমি আগে কখনও এত ভালভাবে বুঝিনি: “তুমি সমস্ত চিত্তে সদাপ্রভুতে বিশ্বাস কর; তোমার নিজ বিবেচনায় নির্ভর করিও না।” সর্বোপরি, আমার নতুন পরিস্থিতিগুলো আমাকে শিখিয়েছে যে, জীবনে কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ এবং কী প্রকৃত সন্তুষ্টি ও আত্মমর্যাদা বোধ এনে দেয়। যিহোবার সংগঠনে এখনও আমার অনেক কিছু করার আছে। যিশুর এই কথাগুলোর প্রকৃত অর্থ আমি খুঁজে পেয়েছি: “গ্রহণ করা অপেক্ষা বরং দান করা ধন্য [“সুখী,” NW] হইবার বিষয়।”—প্রেরিত ২০:৩৫.

এক নতুন জীবন

আমার রোগনির্ণয় করার কিছু পরেই, আমাকে মাদ্রিদে একটা সেমিনারে আসার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যেখানে খ্রিস্টীয় স্বেচ্ছাসেবকদের শেখানো হয়েছিল যে কীভাবে ডাক্তার ও তাদের সাক্ষি রোগীদের মধ্যে সহযোগিতা গড়ে তোলা যায়। পরে, সেই স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে হসপিটাল লিয়াজোন কমিটিগুলো সংগঠিত করা হয়েছিল। আমার জন্য সেই সেমিনারটা একেবারে সময়োপযোগী ছিল। আমি একটা ভাল চাকরি খুঁজে পেয়েছিলাম, যেটা অন্য কোনো বাণিজ্যিক চাকরির চেয়ে আরও অধিক সন্তুষ্টি এনে দিতে পারত।

আমরা সেমিনারে শিখেছিলাম যে, নতুন গঠিত হসপিটাল লিয়াজোন কমিটিগুলোকে বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করতে হবে, ডাক্তারদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে, এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপনা করতে হবে, এই সব কিছুই সহযোগিতা স্থাপন করার ও সংঘাতগুলো এড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। কমিটিগুলো সাক্ষিদের সেই ডাক্তারদের খুঁজে পেতে সাহায্য করে, যারা রক্ত ছাড়া চিকিৎসা করতে ইচ্ছুক। অবশ্য, একজন অদক্ষ ব্যক্তি হিসেবে আমাকে চিকিৎসা সংক্রান্ত শব্দগুলো, চিকিৎসাশাস্ত্রগত তত্ত্বগুলো এবং হাসপাতালের সংগঠিত ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক কিছু শিখতে হয়েছিল। তবুও, সেই সেমিনারের পর, আমি একজন নতুন ব্যক্তি হিসেবে, এক নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম, যা আমাকে রোমাঞ্চিত করেছিল।

হাসপাতাল পরিদর্শনগুলো—সন্তুষ্টির এক উৎস

যদিও আমার রোগ আমাকে ধীরে ধীরে এবং অপ্রতিরোধ্যভাবে অক্ষম করে ফেলছিল কিন্তু হসপিটাল লিয়াজোন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্বগুলো বেড়ে যাচ্ছিল। আমাকে যেহেতু অক্ষম ব্যক্তিদের যে-পেনশন দেওয়া হয় তা দেওয়া হতো, তাই হাসপাতাল পরিদর্শনগুলোর জন্য আমার হাতে সময় থাকত। মাঝে মাঝে নিরুৎসাহ হয়ে পড়লেও, এই পরিদর্শনগুলো আমি যতটা আশা করেছিলাম তার চেয়ে সহজ ও অত্যন্ত উপকারজনক প্রমাণিত হয়েছিল। এখন যদিও আমাকে হুইলচেয়ারের সাহায্য নিতে হয় কিন্তু এটা কোনো বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কমিটির একজন সহ সদস্য সবসময় আমাকে সঙ্গ দেন। এ ছাড়া, ডাক্তাররা হুইলচেয়ারের সাহায্যে চলাফেরা করা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে অভ্যস্ত এবং কখনও কখনও তারা অধিক সম্মান দেখিয়ে শোনে, যখন তারা তাদের সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে আমার প্রচেষ্টাকে লক্ষ করে।

গত দশ বছরে, আমি শত শত ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করেছি। কেউ কেউ প্রায় শুরু থেকেই আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক ছিল। ডা. খোয়ান ডুয়ার্টে—মাদ্রিদের একজন হার্ট সার্জন যিনি রোগীর বিবেকের দ্বারা চালিত সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখিয়ে খুশি হন—সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য করতে রাজি হয়েছিলেন। তখন থেকে তিনি স্পেনের বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা সাক্ষি রোগীদের রক্ত ছাড়া প্রায় ২০০টারও বেশি অপারেশন করেছেন। বছর পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, আরও অনেক ডাক্তার রক্ত ছাড়া অপারেশন করতে শুরু করেছে। আমাদের নিয়মিত পরিদর্শনগুলো যদিও কিছুটা ভূমিকা রেখেছে কিন্তু চিকিৎসাশাস্ত্রে উন্নতি এবং রক্ত ছাড়া অপারেশনে ভাল ফলগুলো পাওয়ার কারণেও অগ্রগতি হয়েছে। আর আমরা দৃঢ় নিশ্চিত যে যিহোবা আমাদের প্রচেষ্টাগুলোতে আশীর্বাদ করেছেন।

কয়েক জন হার্ট সার্জন যারা শিশুদের চিকিৎসার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ, তারা যেভাবে সাড়া দিয়েছে তাতে আমি বিশেষভাবে উৎসাহিত হয়েছিলাম। দুবছর ধরে আমরা দুজন সার্জন ও তাদের এনেস্থিওলজিস্টদের নিয়ে গঠিত একটা দল পরিদর্শন করতে যেতাম। আমরা তাদেরকে চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহিত্য দিয়েছিলাম, যেটা ব্যাখ্যা করেছিল যে এই ব্যাপারে অন্যান্য ডাক্তাররা কী করছে। আমাদের প্রচেষ্টাগুলো ১৯৯৯ সালে মেডিক্যাল কনফারেন্স অন ইনফ্যানটাইল কারডিওভাসকুলার সার্জারি-তে পুরস্কৃত হয়েছিল। দুজন সার্জন—ইংল্যান্ডের একজন সহযোগীপ্রবণ চিকিৎসকের নির্দেশনায়—এক সাক্ষি শিশুর ওপর অত্যন্ত জটিল এক অপারেশন করেছিল, যার মহাধমনীর কপাটি বদলাবার প্রয়োজন ছিল। * আমি শিশুর বাবামার সঙ্গে আনন্দিত হয়েছিলাম যখন সার্জনদের একজন অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এসে এই ঘোষণা করেছিলেন যে, অপারেশন সফল হয়েছে এবং পরিবারের বিবেকের দ্বারা চালিত সিদ্ধান্তকে সম্মান দেখানো হয়েছে। এখন এই দুই ডাক্তার স্পেনের সব জায়গা থেকে আসা সাক্ষি রোগীদের নিয়মিতভাবে চিকিৎসা করে থাকে।

এই ধরনের ঘটনাগুলো থেকে যে-বিষয়টাতে আমি প্রকৃত সন্তুষ্টি পাই তা হল, আমার খ্রিস্টীয় ভাইবোনদের সাহায্য করতে পারার উপলব্ধি। তারা যখন কোনো হসপিটাল লিয়াজোন কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ করে, সেটা সাধারণত তাদের জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটা। তাদের অপারেশনের দরকার হয় এবং স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তাররা তাদেরকে রক্ত ছাড়া চিকিৎসা করতে ইচ্ছুক হয় না বা অসমর্থ হয়। কিন্তু, ভাইবোনেরা যখন জানতে পারে যে এখানে মাদ্রিদে সবধরনের চিকিৎসা ক্ষেত্রে সার্জনরা রয়েছে যারা সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক, তখন তারা খুব স্বস্তি বোধ করে। আমি দেখেছিলাম যে, হাসপাতালে একজন ভাইয়ের পাশে শুধুমাত্র আমাদের উপস্থিতিই তার চেহারাকে উদ্বিগ্নতা থেকে প্রশান্তির অভিব্যক্তিতে বদলে দিয়েছিল।

বিচারকদের জগৎ ও চিকিৎসাশাস্ত্রগত তত্ত্বগুলো

এ ছাড়া, সম্প্রতিক বছরগুলোতে হসপিটাল লিয়াজোন কমিটিগুলোর সদস্যরা বিচারকদের কাছেও পরিদর্শন করেছে। সেই পরিদর্শনগুলো করার সময় আমরা তাদের পরিবারের যত্ন এবং যিহোবার সাক্ষিদের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা (ইংরেজি) নামে একটা সাহিত্য দিই, যেটা বিশেষ করে রক্তের ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের সিদ্ধান্ত এবং রক্ত ছাড়া চিকিৎসার বিকল্প ব্যবস্থাগুলো যে-প্রাপ্তিসাধ্য, সেই ব্যাপারে সেই আধিকারিকদের জানানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছিল। এই পরিদর্শনগুলো করা খুবই দরকার ছিল ছিল কারণ এক সময় স্পেনে এটা খুব সাধারণ বিষয় ছিল যে, বিচারকরা ডাক্তারদের অধিকার দিত যেন রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে রক্ত দেওয়া হয়।

বিচারকদের চেম্বারগুলো বেশ আকর্ষণীয় হয় এবং আমার প্রথম পরিদর্শনে হুইলচেয়ারে বসে প্রবেশপথগুলোর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় আমি নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে করেছিলাম। আমি আরও অস্বস্তি বোধ করেছিলাম, যখন আমাদের এক ছোট্ট দুর্ঘটনা ঘটে আর আমি চেয়ার থেকে ডিগবাজি খেয়ে হাঁটু গেড়ে পড়ে গিয়েছিলাম। কয়েক জন বিচারক ও উকিল আমার কষ্ট দেখে আমার সাহায্যের জন্য এসেছিল কিন্তু আমি তাদের সামনে লজ্জিত বোধ করেছিলাম।

আমরা কেন পরিদর্শন করতে গিয়েছি, সেই ব্যাপারে যদিও বিচারকরা নিশ্চিত ছিল না কিন্তু অধিকাংশই আমাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিল। প্রথমে যে-বিচারকের সঙ্গে আমি দেখা করেছিলাম তিনি ইতিমধ্যেই আমাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন যে, তিনি আমাদের সঙ্গে আরও বেশি সময় নিয়ে কথা বলতে চান। পরের বার আমরা যখন দেখা করতে যাই, তখন তিনি নিজেই আমার হুইলচেয়ারকে তার চেম্বার পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গিয়েছিলেন ও মন দিয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন। এই প্রথম সাক্ষাতের ভাল ফলগুলো আমার সঙ্গীদের ও আমাকে আমাদের ভয়গুলো কাটিয়ে উঠতে উৎসাহিত করেছিল এবং আমরা খুব শীঘ্রই আরও কিছু ভাল ফল দেখেছিলাম।

সেই একই বছর আমরা আরেকজন বিচারকের কাছে পরিবারের যত্ন বইয়ের একটা কপি রেখে এসেছিলাম, যিনি আমাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেছিলেন ও বইটি পড়ে দেখবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। আমি তাকে আমার টেলিফোন নম্বর দিয়েছিলাম যদি কোনো দরকারে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার তার প্রয়োজন হয়। দুই সপ্তাহ পর, তিনি এই কথা বলার জন্য ফোন করেছিলেন যে, স্থানীয় একজন সার্জন একজন সাক্ষি বোন যার অপারেশনের দরকার ছিল, তাকে রক্ত দেওয়ার অনুমতি চেয়ে তাকে অনুরোধ করেছে। বিচারক আমাদের বলেছিলেন যে তিনি চান আমরা তাকে সমাধান খুঁজে পেতে সাহায্য করি, যেন রক্ত না নেওয়ার ব্যাপারে সাক্ষির মনোবাঞ্ছার প্রতি সম্মান দেখানো যায়। আমাদের অন্য আরেকটা হাসপাতাল খুঁজে পেতে কোনো অসুবিধা হয়নি যেখানে সার্জনরা সফলতার সঙ্গে রক্ত ছাড়া অপারেশন করেছেন। ফলাফল জেনে বিচারক খুব খুশি হয়েছিলেন এবং আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে ভবিষ্যতে তিনি একই ধরনের সমাধানগুলো আশা করবেন।

বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করার সময় প্রায়ই চিকিৎসা সংক্রান্ত তত্ত্বগুলো সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল কারণ আমরা চেয়েছিলাম যে ডাক্তাররা যেন রোগীর অধিকারগুলো ও বিবেকের দ্বারা চালিত সিদ্ধান্তকে বিবেচনা করে। তত্ত্বের ওপর মাদ্রিদের এক সহযোগী হাসপাতাল যে-একটা শিক্ষা কার্যক্রম করছিল, তাতে অংশগ্রহণ করার জন্য তারা আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। এই শিক্ষা কার্যক্রম আমাকে এই ক্ষেত্রের অনেক বিশেষজ্ঞের কাছে আমাদের বাইবেল-ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছিল। এ ছাড়া, এটা আমাকে সেই কঠিন সিদ্ধান্তগুলোকে বুঝতে সাহায্য করেছিল যেগুলো ডাক্তারদের নিতে হয়।

এই কার্যক্রমের শিক্ষকদের একজন, অধ্যাপক দিয়্যাগো গ্রাসিয়া, স্পেনের ডাক্তারদের জন্য নিয়মিতভাবে তত্ত্বের ওপর এক মর্যাদাজনক বিশেষ শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করেন এবং রক্ত নেওয়ার ব্যাপারে জেনেশুনে নেওয়া আমাদের সিদ্ধান্তের দৃঢ় সমর্থক হয়েছেন। * তার সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগের ফলে যিহোবার সাক্ষিদের স্পেনের শাখা অফিস থেকে কয়েকজন প্রতিনিধিকে অধ্যাপক গ্রাসিয়ার পোস্টগ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীদের কাছে আমাদের সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই দেশের সবচেয়ে ভাল ডাক্তার হিসেবে পরিচিত।

বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া

অবশ্য, সহ বিশ্বাসীদের জন্য এই সন্তোষজনক কাজ আমার ব্যক্তিগত সব সমস্যার সমাধান করেনি। আমার রোগ অপ্রতিরোধ্যভাবে বেড়েই যাচ্ছে। কিন্তু, এটা ভাল যে আমার মস্তিষ্ক কাজ করছে। আমার স্ত্রী ও ছেলের প্রতি আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ যারা কখনও অভিযোগ করেনি, তাই আমি এখনও আমার দায়িত্বগুলো করে যেতে পারছি। তাদের সাহায্য ও সমর্থন ছাড়া এটা করা অসম্ভব হতো। আমি এমনকি আমার প্যান্টের বোতাম পর্যন্ত লাগাতে অথবা ওভারকোট পরতে পারি না। আমি বিশেষ করে প্রতি শনিবার আমার ছেলে ইসমায়েলের সঙ্গে প্রচারে গিয়ে আনন্দ পাই, যে হুইলচেয়ারে করে আমাকে ঠেলে নিয়ে যায়, যাতে আমি বিভিন্ন গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলতে পারি। আর এখনও আমি মণ্ডলীর একজন প্রাচীন হিসেবে আমার দায়িত্বগুলো পালন করতে পারি।

গত ১২ বছরে আমার কয়েকটা অপ্রীতিকর মুহূর্ত এসেছে। কখনও কখনও, এটা দেখা যে আমার অক্ষমতা আমার পরিবারের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, প্রকৃত রোগের চেয়ে আমাকে আরও বেশি যন্ত্রণা দেয়। আমি জানি যে, মুখে কিছু না বললেও তারা সত্যিই কষ্ট পায়। অল্পদিন আগে, এক বছরের মধ্যে আমার শাশুড়ী ও আমার বাবা মারা গেছে। সেই বছরই আমি এমন অবস্থায় পড়েছিলাম, যখন হুইলচেয়ার ছাড়া চলাফেরা করতে পারছিলাম না। আমার বাবা যিনি আমাদের বাড়িতে থাকতেন তিনিও আরেক ক্ষয়রোগের কারণে মারা যান। মিলাগ্রোস তার দেখাশোনা করত আর তার মনে হয়েছিল যেন ভবিষ্যতে আমার যা ঘটতে চলেছে সেটাই সে দেখছে।

কিন্তু, এর ভাল দিকটা হল যে আমাদের পরিবার ঐক্যবদ্ধ তাই আমরা মিলিতভাবে সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করি। একটা হুইলচেয়ারের কারণে আমি একজন পরিচালকের চেয়ার ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু সত্যি বলতে কী, এখন আমার জীবন আসলে আরও ভাল হয়েছে কারণ এটা অন্যদের সেবা করার জন্য পূর্ণরূপে উৎসর্গীকৃত জীবন। অন্যদের দান করা নিজের কষ্ট লাঘব করতে পারে এবং প্রয়োজনের সময়ে আমাদের শক্তি জুগিয়ে যিহোবা সত্যিই তাঁর প্রতিজ্ঞা রাখেন। পৌলের মতো, আমি সত্যিই বলতে পারি: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে আমি সকলই করিতে পারি।”—ফিলিপীয় ৪:১৩.

[পাদটীকাগুলো]

^ মালটিপাল স্ক্লেরোসিস রোগটি হল মূল স্নায়ুতন্ত্রের এক ব্যাধি। এটি প্রায়ই ক্রমাগত শরীরের ভারসাম্যতায়, দুপায়ের ব্যবহারে এবং কখনও কখনও দৃষ্টি, কথাবার্তা অথবা বোধশক্তিতে অবনতি ঘটায়।

^ এই অপারেশন রস্‌ প্রণালী নামে পরিচিত।

^ প্রহরীদুর্গ, ফেব্রুয়ারি ১৫, ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৯-২০ দেখুন।

[২৪ পৃষ্ঠার বাক্স]

এক স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি

একজন স্ত্রীর পক্ষে মালটিপাল স্ক্লেরোসিসে আক্রান্ত একজন সঙ্গীর সঙ্গে থাকা খুবই কঠিন—মানসিক, আবেগগত ও শারীরিকভাবে। আমি যা করার পরিকল্পনা করি সেই বিষয়ে আমাকে যুক্তিসংগত হতে এবং ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অহেতুক চিন্তাভাবনা করাকে উপেক্ষা করতে হবে। (মথি ৬:৩৪) কিন্তু কষ্টের মধ্যে জীবনযাপন একজন ব্যক্তির ভাল গুণগুলো প্রকাশ করতে পারে। আমাদের বিবাহ আগের চেয়ে আরও মজবুত এবং যিহোবার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। অন্যেরা যারা একইভাবে কষ্টকর পরিস্থিতিগুলোর মধ্যে রয়েছে, তাদের জীবন কাহিনীগুলোও আমাকে অনেক শক্তিশালী করেছে। হুলিয়ান ভাইবোনদের জন্য করা তার মূল্যবান সেবার জন্য যে-সন্তুষ্টি বোধ করে আমিও তাতে অংশ নিই আর আমি দেখেছি যে, যিহোবা আমাদের কখনও ত্যাগ করেন না যদিও প্রতিটা দিন একটা করে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আসে।

[২৪ পৃষ্ঠার বাক্স]

এক ছেলের দৃষ্টিভঙ্গি

আমার বাবার ধৈর্য ও ইতিবাচক মনোভাব থেকে আমি এক উত্তম উদাহরণ খুঁজে পাই এবং আমি যখন তাকে হুইলচেয়ারে ঠেলে নিয়ে যাই, তখন আমি নিজেকে কার্যকর বোধ করি। আমি জানি যে আমি যা করতে চাই, তা সবসময় করতে পারব না। আমি এখন একজন কিশোর কিন্তু যখন আমি বড় হব, তখন আমি হসপিটাল লিয়াজোন কমিটির একজন সদস্য হিসেবে সেবা করতে চাইব। বাইবেলের প্রতিজ্ঞাগুলো থেকে আমি জানি যে, দুঃখকষ্ট হল ক্ষণস্থায়ী আর এও জানি যে অনেক ভাইবোন আমাদের চেয়েও আরও বেশি কষ্ট ভোগ করছে।

[২২ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার স্ত্রী আমার জন্য শক্তির এক উৎস

[২৩ পৃষ্ঠার চিত্র]

হার্ট সার্জন ডা. খোয়ান ডুয়ার্টের সঙ্গে কথোপকথন

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

আমার ছেলে ও আমি পরিচর্যায় একসঙ্গে কাজ করে আনন্দ পাই