সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

ধন্য সেই ব্যক্তি, যিহোবা যার ঈশ্বর

ধন্য সেই ব্যক্তি, যিহোবা যার ঈশ্বর

জীবন কাহিনী

ধন্য সেই ব্যক্তি, যিহোবা যার ঈশ্বর

বলেছেন টম ডিডার

ইতিমধ্যেই কমিউনিটি হল ভাড়া করা হয়ে গিয়েছিল। কানাডার সাসকাচেয়ানের পোরকিউপাইন শহরে অধিবেশনের জন্য প্রায় ৩০০ জন লোক আসবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। বুধবার থেকে তুষারপাত শুরু হয় আর তা শুক্রবারের মধ্যে প্রচণ্ড তুষার ঝড়ে রূপ নেয়, যেকারণে শুধুমাত্র সাদা তুষার ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ৪০ ডিগ্রিতে নেমে গিয়েছিল। কয়েকটা বাচ্চা সহ মোট আঠাশ জন উপস্থিত হয়েছিল। একজন নতুন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে এটাই ছিল আমার প্রথম অধিবেশন এবং আমি ছিলাম ২৫ বছর বয়সী এক ঘাবড়ে যাওয়া যুবক। কী হয়েছিল তা বলার আগে, আমাকে বলতে দিন যে, কীভাবে আমি এই বিশেষ সেবার সুযোগ উপভোগ করেছিলাম।

 আট ভাইয়ের মধ্যে আমি ছিলাম সপ্তম। প্রথম জন হল বিল, তারপর মেট্রো, জন, ফ্রেড, মাইক ও অ্যালিক্স। আমার জন্ম ১৯২৫ সালে হয়েছিল এবং ওয়েলি হল সবচেয়ে ছোট। আমরা ম্যানিটোবার উক্রেনাতে থাকতাম যেখানে আমার বাবামা, মাইকেল ও এনা ডিডারের একটা ছোট খামার বাড়ি ছিল। বাবা রেলওয়েতে রেললাইন দেখাশোনার কাজ করতেন। শহর থেকে দূরে রেললাইনের ধারের এক ছোট কোয়ার্টার আমাদের বড় পরিবারের জন্য উপযুক্ত না হওয়ায় আমরা খামার বাড়িতে থাকতাম। বাবা অধিকাংশ সময় ঘরে থাকতেন না, তাই আমাদেরকে বড় করে তোলার ভার মায়েরই ছিল। মাঝেমধ্যে তিনি এক সপ্তাহ বা আরও বেশি সময়ের জন্য বাবার কাছে গিয়ে থাকতেন কিন্তু এর আগে তিনি নিশ্চিত হতেন যে আমরা রান্না, তন্দুরে খাবার তৈরি করতে এবং ঘরের অন্যান্য কাজকর্ম করতে শিখে ফেলেছি। আর যেহেতু আমরা গ্রিক ক্যাথলিক গির্জার সদস্য ছিলাম, তাই ছোটবেলায় পাওয়া মায়ের শিক্ষাগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল বিভিন্ন প্রার্থনা মুখস্থ করা এবং অন্যান্য রীতিনীতি পালন করা।

বাইবেলের সত্যের সংস্পর্শে আসা

বাইবেল সম্বন্ধে জানার ব্যাপারে আমার আকাঙ্ক্ষা ছোট বেলায় উদ্দীপিত হয়েছিল। একজন প্রতিবেশী যিনি যিহোবার সাক্ষিদের একজন ছিলেন, তিনি বাইবেল থেকে ঈশ্বরের রাজ্য, আরমাগিদোন ও নতুন জগতের আশীর্বাদগুলো সম্বন্ধে কিছু অংশ পড়ার জন্য নিয়মিত আমাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। তিনি যা বলতেন তাতে মায়ের একটুও আগ্রহ ছিল না কিন্তু সেই বার্তা মাইক ও অ্যালিক্সকে আকৃষ্ট করেছিল। আসলে, তারা যা শিখেছিল তা তাদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে নৈতিক অথবা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সৈন্য দলে যোগ না দিতে পরিচালিত করেছিল। এর কিছু পরেই মাইককে অল্প কিছু সময়ের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ও অ্যালিক্সকে ওন্টারিওতে এক শ্রমিক শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পরে ফ্রেড ও ওয়েলিও সত্য গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আমার বড় তিন দাদা সত্য গ্রহণ করেনি। বেশ কয়েক বছর ধরে এমনকি মা সত্যের বিরোধিতা করেছিলেন কিন্তু পরে যিহোবার পক্ষ নিয়ে তিনি আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। তিনি ৮৩ বছর বয়সে বাপ্তাইজিত হয়েছিলেন। মারা যাওয়ার সময় মায়ের বয়স ছিল ৯৬। এ ছাড়া, মারা যাওয়ার আগে বাবাও সত্যের প্রতি অনুকূল মনোভাব দেখিয়েছিলেন।

আমার বয়স যখন ১৭ বছর, আমি চাকরির খোঁজে এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে উইনিপেগে গিয়েছিলাম, যারা আমাকে বাইবেল অধ্যয়ন করার জন্য সাহায্য করতে পারে। সেই সময়ে যিহোবার সাক্ষিরা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল কিন্তু সভাগুলো নিয়মিত হতো। প্রথম যে-সভায় আমি যোগ দিয়েছিলাম, তা কারও বাড়িতে হয়েছিল। যেহেতু আমি গ্রিক ক্যাথলিক বিশ্বাসে বড় হয়ে উঠেছিলাম, তাই শুরুতে আমি যা শুনেছিলাম, তা খুব অদ্ভুত লেগেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, পাদরিশ্রেণী-গির্জার সাধারণ সদস্য ব্যবস্থা কেন অশাস্ত্রীয় এবং পাদরিশ্রেণী যখন যুদ্ধের প্রচেষ্টার ওপর আশীর্বাদ করেছিল, তখন কেন ঈশ্বর তা অনুমোদন করেননি। (যিশাইয় ২:৪; মথি ২৩:৮-১০; রোমীয় ১২:১৭, ১৮) চিরকালের জন্য বহু দূর এক জায়গায় যাওয়ার চেয়ে পরমদেশ পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে আরও বেশি ব্যবহারিক ও যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল।

এটাই সত্য তা নিশ্চিত হয়ে আমি যিহোবার কাছে নিজেকে উৎসর্গ করি এবং ১৯৪২ সালে উইনিপেগে বাপ্তিস্ম নিই। ১৯৪৩ সালের মধ্যে কানাডায় যিহোবার সাক্ষিদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং প্রচার কাজ আবার পূর্ণ গতিতে শুরু হয়। এ ছাড়া, বাইবেলের সত্য আমার হৃদয়ে আরও গভীর ছাপ ফেলছিল। মণ্ডলীতে একজন দাস হিসেবে সেবা করার ও সেইসঙ্গে জনসাধারণের উদ্দেশে সভা করার অভিযানে অংশ নেওয়ার এবং অনির্ধারিত এলাকায় কাজ করারও সুযোগ আমার হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বড় বড় সম্মেলনে যোগ দেওয়াও আমার আধ্যাত্মিক উন্নতিতে অপরিমেয় অবদান রেখেছে।

যিহোবার প্রতি আমার সেবাকে বিস্তৃত করা

আমি ১৯৫০ সালে একজন অগ্রগামী পরিচারক হিসেবে নাম লেখাই এবং সেই বছরের ডিসেম্বর মাসে আমাকে একজন সীমা অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। টরোন্টোর কাছে চার্লি হেপওয়ার্থ নামে একজন অভিজ্ঞ ও অনুগত ভাইয়ের কাছ থেকে আমি প্রশিক্ষণ লাভ করার এক বিশেষ সুযোগ পেয়েছিলাম। এ ছাড়া, আমার প্রশিক্ষণের শেষ সপ্তাহটি আমার দাদা অ্যালিক্সের সঙ্গে কাটানোর আনন্দ আমার হয়েছিল, যিনি ইতিমধ্যেই উইনিপেগে সীমার কাজ করছিলেন।

শুরুতে বর্ণিত আমার প্রথম সীমা অধিবেশন, আমার স্মৃতিতে একেবারে গেঁথে রয়েছে। কী হবে সেই সম্বন্ধে স্বাভাবিকভাবেই আমি উদ্বিগ্ন ছিলাম। যাই হোক, আমাদের জেলা অধ্যক্ষ, ভাই জ্যাক নেথান আমাদের সবাইকে ব্যস্ত ও খুশি রেখেছিলেন। যতজন উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে নিয়ে আমরা অধিবেশন কার্যক্রমের সারাংশ করেছিলাম। আমরা অভিজ্ঞতাগুলো বলতে, ঘরে ঘরে উপস্থাপনাগুলো অভ্যাস করতে, পুনর্সাক্ষাৎ করতে ও কীভাবে গৃহ বাইবেল অধ্যয়নগুলো পরিচালনা করতে হয় সেগুলোর নমুনা দেখাতে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা রাজ্যের গানগুলো গেয়েছিলাম। প্রচুর খাবার ছিল। আমরা প্রায় প্রতি দুঘন্টা পর পর কফি ও পেস্ট্রি খেয়েছিলাম। কেউ কেউ বেঞ্চে ও প্ল্যাটফর্মে, আবার কেউ কেউ মেঝেতেই ঘুমিয়েছিল। রবিবারের মধ্যে তুষার ঝড় একটু কমেছিল, তাই জনসাধারণের উদ্দেশে বক্তৃতার জন্য ৯৬ জন উপস্থিত ছিল। এই অভিজ্ঞতা আমাকে কঠিন পরিস্থিতিগুলোকে মোকাবিলা করতে শিখিয়েছিল।

এর পরের সীমার কার্যভার পেয়ে আমি উত্তর আলবার্টা, ব্রিটিশ কলম্বিয়া এবং নিশীথ-সূর্যের দেশ ইউকোন অঞ্চলে গিয়েছিলাম। ডওসান ক্রিক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে এবড়োখেবড়ো আলাস্কা হাইওয়ে দিয়ে হোয়াইট হর্স, ইউকোন (১,৪৭৭ কিলোমিটার দূরত্ব) পর্যন্ত যাত্রা করতে এবং সেই পথ ধরে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ধৈর্য ও সাবধানতার প্রয়োজন ছিল। তুষার ধস, পাহাড়ের পিচ্ছিল ঢালুগুলো এবং তুষারপাতের ফলে সবকিছু অস্পষ্ট দেখা যাওয়ার মতো বিষয় সত্যিই এক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল।

সুদূর উত্তরে কীভাবে সত্য ঢুকে গিয়েছিল, তা দেখে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। একবার ওয়াল্টার লুকোউইজ ও আমি ইউকোন এলাকার সীমান্তের কাছাকাছি আলাস্কা হাইওয়েতে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার লোয়ার পোস্ট গ্রামের কাছাকাছি একটা ছোট্ট কুটীরে গিয়েছিলাম। আমরা জানতাম যে, সেই কুটীরে কেউ না কেউ থাকত কারণ একটা ছোট্ট জানালা দিয়ে পিটপিট করে জ্বলতে থাকা আলো আমরা দেখতাম। রাত প্রায় নটার সময় আমরা দরজার কড়া নেড়েছিলাম। একজন পুরুষ উচ্চস্বরে বলেন আমরা যেন ভিতরে আসি আর তাই আমরা ভিতরে গিয়েছিলাম। এক বৃদ্ধ লোককে তার দোতালা খাটে পা ছড়িয়ে বসে প্রহরীদুর্গ পত্রিকাটি পড়তে দেখে আমরা কতই না আশ্চর্য হয়েছিলাম! আসলে আমরা পত্রিকার যে-সংখ্যাটি অর্পণ করছিলাম সেটার চেয়ে তারটি আরও নতুন সংখ্যা ছিল। তিনি বলেছিলেন যে তিনি বিমানবাহিত ডাকযোগে পত্রিকাগুলো পান। যেহেতু আমরা সেই সময়ে মণ্ডলী থেকে আট দিনেরও বেশি সময় দূরে ছিলাম, তাই আমরা তখনও পত্রিকার নতুন সংখ্যাগুলো পাইনি। সেই ব্যক্তি ফ্রেড বার্গ বলে নিজের পরিচয় দেন আর এমনকি যদিও তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে এটার গ্রাহক ছিলেন কিন্তু যিহোবার সাক্ষিদের সঙ্গে এটাই তার প্রথম সাক্ষাৎ। ফ্রেড আমাদের সেই রাতে থাকতে বলেন। আমরা তাকে শাস্ত্রীয় অনেক সত্য জানাতে পেরেছিলাম এবং অন্য সাক্ষিদের আসার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম, যারা নিয়মিত তার সঙ্গে দেখা করতে সেই পথ দিয়ে যেত।

কয়েক বছর ধরে আমি তিনটি ছোট সীমায় কাজ করেছিলাম। সেগুলো পূর্ব দিকে আলবার্টার গ্র্যান্ডে প্রেয়রী শহর থেকে পশ্চিম দিকে আলাস্কার কোডিয়েক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যেগুলোর মধ্যে ৩,৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব ছিল।

চমৎকার উপায়ে আমি শিখেছিলাম যে, অন্যান্য জায়গাগুলোর মতো দূরবর্তী জায়গাগুলোতে যিহোবার অযাচিত দয়া সমস্ত লোকের জন্য আর ঈশ্বরের আত্মা তাদের মন ও হৃদয়কে প্রেরণা দেয়, যারা অনন্তজীবনের জন্য সঠিক প্রবণতাসম্পন্ন। সেই ধরনের লোকেদের মধ্যে একজন হলেন হেনরি লেপাইন, যিনি ইউকোনের ডাওসন সিটিতে থাকতেন, যেটার বর্তমান নাম ডাওসন। হেনরি এক নির্জন জায়গায় বাস করতেন। তিনি ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সোনার খনির এলাকা থেকে কখনও বের হননি। কিন্তু যিহোবার আত্মা এই ৮৪ বছর বয়সী ব্যক্তিকে সীমা অধিবেশনের জন্য শুধুমাত্র এ্যঙ্কোরেজে যেতেই ১,৬০০ কিলোমিটারেও বেশি পথ যাত্রা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল, এমনকি যদিও তিনি মণ্ডলীর সভাতে কখনও যোগ দেননি। তিনি কার্যক্রমের দ্বারা রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন এবং মেলামেশা করে আনন্দিত হয়েছিলেন। ডাওসন সিটিতে ফিরে যাওয়ার পর হেনরি তার মৃত্যু পর্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন। অনেকে যারা হেনরিকে চিনত তারা ভেবেছিল যে, কী এই বৃদ্ধ লোকটিকে এত দূর যাত্রা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই কৌতূহল আরও কয়েক জন বয়স্ক লোককে সত্য গ্রহণ করতে চালিত করেছিল। এভাবে হেনরি পরোক্ষভাবে এক ভাল সাক্ষ্য দিতে পেরেছিলেন।

যিহোবার অযাচিত দয়ার প্রাপক

আমি ১৯৫৫ সালে ওয়াচটাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডের ২৬তম ক্লাসে যোগ দেওয়ার এক আমন্ত্রণ পেয়ে উল্লাসিত হয়েছিলাম। এই প্রশিক্ষণ আমার বিশ্বাসকে শক্তিশালী করেছিল এবং যিহোবার নিকটবর্তী হতে আমাকে সাহায্য করেছিল। গ্র্যাজুয়েশন করার পর আমাকে কানাডায় সীমার কাজ করে চলার কার্যভার দেওয়া হয়েছিল।

প্রায় এক বছর আমি ওন্টারিও প্রদেশে কাজ করেছিলাম। এরপর আমাকে আবারও অপূর্ব এলাকা উত্তরে কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। আমি এখনও সেই হাইওয়ের মনোরম দৃশ্যগুলো মনের চোখ দিয়ে দেখতে পারছি, যেটার ধারে পরিষ্কার, উজ্জ্বল হ্রদগুলো এবং বরফে ঢাকা পর্বতশ্রেণী রয়েছে। গ্রীষ্মের সময়ে উপত্যকা এবং তৃণভূমিগুলো রংবেরঙের বুনো ফুলের এক চমৎকার গালিচা হয়ে যায়। বিশুদ্ধ বাতাস ও পরিষ্কার জল। ভল্লুক, নেকড়ে, চমরী গাই, বলগা হরিণ ও অন্যান্য বন্যপশু তাদের নিজেদের অঞ্চলে শান্তভাবে ঘোরাফেরা করতে থাকে।

কিন্তু আলাস্কাতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এসেছিল—শুধুমাত্র পরিবর্তনশীল আবহাওয়ায় নয় কিন্তু বিরাট দূরত্বও। আমার সীমা পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ৩,২০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। সেই সময়ে সীমা অধ্যক্ষের জন্য গাড়ির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্থানীয় ভাইয়েরা স্বেচ্ছায় আমাকে একটা মণ্ডলী থেকে আরেকটাতে গাড়ি করে পৌঁছে দিত। কিন্তু, কখনও কখনও আমাকে ট্রাকের চালক বা পর্যটকদের থামিয়ে তাদের গাড়িতে চড়ে ভ্রমণ করতে হতো।

এই ধরনের এক ঘটনা ঘটেছিল আলাস্কা হাইওয়ের একটা অংশে, আলাস্কার টক জংশন ও মাইল ১২০২ অথবা স্কোটি ক্রিক অঞ্চলের মাঝে। এই দুটো জায়গায় অবস্থিত শুল্ক আদায়ের অফিসগুলো প্রায় ১৬০ কিলোমিটার দূরত্বে ছিল। আমি টকে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আদায়ের অফিস পেরিয়ে গিয়েছিলাম এবং প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত গাড়ি করে যেতে পেরেছিলাম। এরপর কোনো গাড়িই আর আসেনি আর আমি প্রায় দশ ঘন্টা ৪০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ হেঁটে গিয়েছিলাম। পরে আমি জানতে পারি যে শুল্ক আদায়ের জায়গায়টি পেরিয়ে আসার কিছু সময় পর হাইওয়ের এই অংশে সমস্ত যানবাহন অচল হয়ে পড়েছিল, কারণ শুল্ক আদায়ের জায়গায়টি থেকে কিছু দূরে একটা তুষার ধস নেমেছিল। মধ্যরাতের মধ্যে তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ২৩ ডিগ্রিতে নেমে যায় এবং আমি তখনও আশ্রয়ের এক নিকটতম জায়গা থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ছিলাম। বিশ্রাম নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আমি একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি রাস্তার ধারে একটা পরিত্যাক্ত গাড়ি দেখতে পাই, যেটার অর্ধেকটাই বরফ দিয়ে ঢাকা পড়েছিল। আমি ভেবেছিলাম যে যদি সেটার ভিতরে আমি ঢুকতে পারি ও গাড়ির গদির ওপর শুতে পারি, তা হলে সেই ঠাণ্ডা রাত থেকে আমি রক্ষা পাব। দরজাটা খোলার মতো আমি যথেষ্ট বরফ সরিয়ে ফেলতে পেরেছিলাম কিন্তু খোলার পর দেখি যে, গদিগুলো ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে ও কেবল লোহার কাঠামোটা রয়েছে। আনন্দের বিষয় যে, রাস্তা থেকে খুব কাছেই আমি এক খালি কুটীর খুঁজে পাই। কষ্ট করে ঢোকার ও আগুন জ্বালানোর পর আমি কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম নিতে পেরেছিলাম। সকালে আমি পরবর্তী জায়গায় যেতে একটা গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থা করেছিলাম, যেখানে আমি কিছু প্রয়োজনীয় খাবার পেয়েছিলাম ও আমার কেটে যাওয়া আঙুলের যত্ন নিতে পেরেছিলাম।

উত্তরাংশে যিহোবা বৃদ্ধি আনেন

ফেয়ারব্যাঙ্কসে আমার প্রথম পরিদর্শন খুব উৎসাহজনক ছিল। আমরা পরিচর্যায় বিরাট সাফল্য উপভোগ করেছিলাম এবং রবিবারে জনসাধারণের বক্তৃতায় প্রায় ৫০ জন উপস্থিত ছিল। আমরা একটা ছোট্ট মিশনারি হোমে ভেরনর ও লোরেন ডেভিসের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, যেখানে তারা থাকত। লোকেরা সেখানে বক্তৃতা শোনার জন্য রান্নাঘর, শোয়ার ঘর ও হলঘর থেকে উঁকি মেরে দেখতে থাকে। এই ইতিবাচক সাড়া থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, ফেয়ারব্যাঙ্কসে একটা কিংডম হল থাকলে স্থায়ীভাবে প্রচার কাজ করা যাবে। তাই যিহোবার সাহায্যে আমরা বেশ বড় একটা বাড়ি কিনি, যেটা পূর্বে নাচের হল ছিল আর সেই বাড়িটিকে আমরা এক উপযুক্ত জমিতে স্থানান্তরিত করি। একটা কুয়া খোঁড়া হয়েছিল এবং স্নানঘর ও বাড়িটির জন্য একটা উত্তাপ ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছিল। এক বছরের মধ্যে ফেয়ারব্যাঙ্কসে একটা কিংডম হল চালু হয়ে গিয়েছিল। সেখানে একটা রান্নাঘর যুক্ত করার পর, হলটাকে ১৯৫৮ সালে একটা জেলা সম্মেলনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে ৩৩০ জন উপস্থিত ছিল।

আমি ১৯৬০ সালে গ্রীষ্মের সময় যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সমস্ত ভ্রমণ অধ্যক্ষদের জন্য নবায়নী শিক্ষাক্রমে যোগ দিতে নিউ ইয়র্কে যিহোবার সাক্ষিদের বিশ্ব প্রধান কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ি করে গিয়ে এক লম্বা যাত্রা করেছিলাম। আমি যখন সেখানে ছিলাম, তখন ভাই নেথেন নর ও অন্যান্য দায়িত্বশীল ভাইয়েরা আলাস্কাতে একটা শাখা দপ্তর খোলার সম্ভাবনা সম্বন্ধে আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। কয়েক মাস পরে আমরা এটা শুনে আনন্দিত হয়েছিলাম যে, ১৯৬১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর থেকে আলাস্কার নিজস্ব শাখা দপ্তর থাকবে। ভাই এন্ড্রু কে. ওয়াগনেরকে শাখার দায়িত্বগুলো দেখাশোনা করার জন্য কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। তিনি ও তার স্ত্রী ভিরা ২০ বছর ধরে ব্রুকলিনে সেবা করেছিলেন এবং ভ্রমণ কাজেরও অভিজ্ঞতা তাদের ছিল। আলাস্কা শাখা দপ্তরের প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানানো হয়েছিল কারণ এটা সীমা অধ্যক্ষের যাত্রা করার পরিমাণকে কমিয়ে দিয়েছিল এবং তাকে মণ্ডলীর ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোর নির্দিষ্ট প্রয়োজনগুলোর প্রতি বেশি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য সক্ষম করেছিল।

উত্তরাংশে ১৯৬২ সালের গ্রীষ্মকাল এক আনন্দের সময় ছিল। আলাস্কা শাখা দপ্তরের উৎসর্গীকরণ হয়েছিল এবং আলাস্কার, জুনোতে একটা জেলা সম্মেলন হয়েছিল। জুনোতে নতুন কিংডম হল নির্মাণ করা হয়েছিল এবং হোয়াইট হর্স, ইউকোন ও বিভিন্ন নতুন বিচ্ছিন্ন দলগুলো স্থাপন করা হয়েছিল।

কানাডায় ফিরে আসা

বেশ কয়েক বছর ধরে আমি কানাডার মার্গেরেটা পেট্রেসের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখেছিলাম। তাকে রিটা নামেই সবসময় ডাকা হতো আর সে ১৯৪৭ সালে অগ্রগামী কাজ শুরু করেছিল, ১৯৫৫ সালে গিলিয়েড থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেছিল এবং পূর্ব কানাডাতে অগ্রগামীর কাজ করছিল। আমি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিই আর সে তাতে রাজি হয়। ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হোয়াইট হর্সে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। সেই বছরের শরৎকালের মধ্যে আমাকে পশ্চিম কানাডাতে সীমার কাজের জন্য কার্যভার দেওয়া হয়েছিল এবং সেখানে পরের ২৫ বছর ধরে সেবা করার আনন্দ আমাদের রয়েছে।

স্বাস্থ্যগত কারণগুলোর জন্য ১৯৮৮ সালে আমাদেরকে ম্যানিটোবার উইনিপেগে বিশেষ অগ্রগামী কাজের কার্যভার দেওয়া হয়েছিল। এটার অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রায় পাঁচ বছর ধরে একটা অধিবেশন হলের রক্ষণাবেক্ষণ করা। আমরা এখনও যত দূর সম্ভব শিষ্য তৈরির আনন্দপূর্ণ কাজে অংশ নিই। সীমার কাজ করার সময় আমরা অনেক বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করেছিলাম যেগুলো অন্যেরা পরিচালনা করত। কিন্তু এখন যিহোবার অযাচিত দয়ায় আমরাই তা শুরু করি এবং ছাত্রছাত্রীদের উৎসর্গীকৃত ও বাপ্তাইজিত হতে দেখে অনেক আনন্দ পাই।

আমি দৃঢ়নিশ্চিত যে যিহোবাকে সেবা করা হল জীবনের সবচেয়ে উত্তম পথ। এটা অর্থপূর্ণ ও সন্তুষ্টিজনক এবং এটা প্রতিদিন যিহোবার প্রতি আমাদের প্রেমকে গভীর করে। এটাই প্রকৃত সুখ নিয়ে আসে। আমাদের যেধরনেরই ঐশিক কার্যভার থাকুক না কেন অথবা আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমরা গীতরচকের সঙ্গে একমত, যিনি বলেছিলেন: “ধন্য সেই জাতি, সদাপ্রভু [“যিহোবা”, NW] যাহার ঈশ্বর।”—গীতসংহিতা ১৪৪:১৫.

[২৪, ২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

সীমার কাজে

[২৫ পৃষ্ঠার চিত্র]

ডাওসন সিটিতে হেনরি লেপাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। আমি বাঁয়ে রয়েছি

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

এ্যঙ্কোরেজে প্রথম কিংডম হল

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র]

১৯৯৮ সালে রিটা ও আমি