সরাসরি বিষয়বস্তুতে যান

সরাসরি বিষয়সূচিতে যান

মার্টিন লুথার ব্যক্তিটি এবং তার উত্তরাধিকার

মার্টিন লুথার ব্যক্তিটি এবং তার উত্তরাধিকার

মার্টিন লুথার ব্যক্তিটি এবং তার উত্তরাধিকার

 “কথিত আছে যে, ইতিহাসে অন্য যেকোনো ব্যক্তির চেয়ে [মার্টিন লুথার] সম্বন্ধে সবচেয়ে বেশি বই লেখা হয়েছে, তবে তা শুধুমাত্র তার নিজ প্রভু যিশু খ্রিস্ট ছাড়া।” এভাবেই টাইম পত্রিকা বলেছিল। লুথারের কথা ও কাজগুলো সংস্কার সাধন—এক ধর্মীয় আন্দোলন, যেটাকে “মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিপ্লব” হিসেবে বর্ণনা করা হয়—শুরু করতে সাহায্য করেছিল। এভাবে তিনি ইউরোপের ধর্মীয় ভূচিত্রকে পালটাতে ও সেই মহাদেশে মধ্যযুগীয় সময়ের শেষ আনতে সাহায্য করেছিলেন। এ ছাড়া, লুথার এক বিধিবদ্ধ লিখিত জার্মান ভাষার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই যে, তার অনূদিত বাইবেল এখনও জার্মান ভাষায় সবচেয়ে জনপ্রিয়।

মার্টিন লুথার কেমন ব্যক্তি ছিলেন? তিনি কীভাবে ইউরোপীয়দের ব্যাপারে এই ধরনের এক প্রভাব ফেলতে পেরেছিলেন?

লুথার একজন পণ্ডিত হন

মার্টিন লুথার ১৪৮৩ সালের নভেম্বর মাসে জার্মানির ইসলেবেনে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও ছিলেন একজন তামা খনির কর্মী, তবুও মার্টিন যাতে ভাল শিক্ষা পায়, সেই জন্য তার বাবা যথেষ্ট টাকাপয়সা আয় করার ব্যবস্থা করেন। ১৫০১ সালে মার্টিন এরফার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হন। সেখানকার গ্রন্থগারে তিনি প্রথমবারের মতো বাইবেল পড়েন। তিনি বলেছিলেন ‘বইটি আমাকে ভীষণভাবে আনন্দিত করেছিল আর আমি কোনো একদিন সেই ধরনের একটি বই পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করতে চেয়েছিলাম।’

লুথার ২২ বছর বয়সে এরফার্টের অগাস্টিন মঠে ভর্তি হন। পরে তিনি উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং ধর্মশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। লুথার নিজেকে ঈশ্বরের অনুমোদনের অযোগ্য বলে বিবেচনা করতেন এবং মাঝে-মাঝে এক দোষী বিবেকের দ্বারা হতাশ হয়ে পড়তেন। কিন্তু বাইবেল অধ্যয়ন, প্রার্থনা ও ধ্যান করা তাকে ঈশ্বর পাপীদের কোন দৃষ্টিতে দেখেন, সেই সম্বন্ধে ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করেছিল। লুথার উপলব্ধি করেছিলেন যে, ঈশ্বরের অনুমোদন অর্জন করা যায় না। বরং, এটা তাদের অনুগ্রহের দ্বারা দেওয়া হয়, যারা বিশ্বাস অনুশীলন করে।—রোমীয় ১:১৬; ৩:২৩, ২৪, ২৮.

কীভাবে লুথার এই উপসংহারে পৌঁছেছিলেন যে, তার নতুন বোধগম্যতাটা সঠিক? প্রাথমিক গির্জার ইতিহাস এবং নতুন নিয়মের মূলগ্রন্থের গবেষণার অধ্যাপক কুর্ট অ্যাল্যান্ট লিখেছিলেন: “তিনি সম্পূর্ণ বাইবেলটির ওপর ধ্যান করেছিলেন এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, এই নতুন আবিষ্কৃত জ্ঞানটি বাইবেলের অন্যান্য উক্তির সঙ্গে তুলনা করে দেখলে টিকে থাকতে পারে কি না এবং তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, সব জায়গায় তিনি সঠিক বলে সমর্থিত হয়েছেন।” সত্যতা প্রতিপাদনের বা পরিত্রাণের মতবাদ, কাজ বা প্রায়শ্চিত্ত দ্বারা নয় কিন্তু বিশ্বাস দ্বারা, লুথারের শিক্ষাগুলোর এক প্রধান স্তম্ভ হিসেবে রয়ে গেছে।

মুক্তিপত্রগুলোর ব্যাপারে ক্রুদ্ধ

ঈশ্বর পাপীদের কোন দৃষ্টিতে দেখেন, এই সম্বন্ধে লুথারের বোধগম্যতা রোমান ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে তার সংঘাত ঘটায়। সেই সময়ে এই বিশ্বাসটি প্রচলিত ছিল যে, মৃত্যুর পরে পাপীদের কিছু সময়ের জন্য শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু বলা হতো, পয়সার বিনিময়ে পোপের অনুমতিতে পাওয়া মুক্তিপত্রগুলোর দ্বারা এই সময়সীমা কমানো যেতে পারে। বিক্রেতাদের মধ্যে ইয়োহান টেটসে, যিনি মেইন্‌জের আর্চবিশপ অ্যালবার্টের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন, তিনি সাধারণ লোকেদের কাছে মুক্তিপত্রগুলো বিক্রি করার লাভজনক ব্যাবসা চালিয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে মুক্তিপত্রগুলোকে ভবিষ্যতের পাপগুলোর জন্য এক ধরনের বিমা-পত্র হিসেবে দেখত।

লুথার মুক্তিপত্রগুলো বিক্রয়ের ব্যাপারে ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে, মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে দরদাম করতে পারে না। ১৫১৭ সালের শরৎকালে, তিনি তার বিখ্যাত ৯৫টি নিবন্ধ লেখেন, যেগুলোতে তিনি গির্জাকে অর্থনৈতিক, মতবাদ সংক্রান্ত ও ধর্মীয় অপব্যবহারের ব্যাপারে অভিযোগ করেন। বিদ্রোহ নয় কিন্তু সংস্কার সাধন করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে চেয়ে লুথার এই নিবন্ধগুলোর কপি মেইন্‌জের আর্চবিশপ অ্যালবার্ট ও বেশ কয়েকজন পণ্ডিত ব্যক্তির কাছে পাঠান। অনেক ইতিহাসবেত্তা ১৫১৭ সাল বা তার কাছাকাছি সময়কে সংস্কার সাধনের সূচনাকাল বলে উল্লেখ করে।

গির্জার ভুল কাজগুলোর জন্য একা লুথারই দুঃখিত ছিলেন না। এক শত বছর আগে চেক ধর্মীয় সংস্কারক ইয়ান হুস মুক্তিপত্রগুলোর বিক্রয়কে নিন্দা করেছিলেন। এমনকি হুসের আগে ইংল্যান্ডের জন উইক্লিফ উল্লেখ করেছিলেন যে, কিছু প্রথা যা গির্জা পালন করে সেগুলো শাস্ত্রসংগত নয়। লুথারের সমসাময়িক ব্যক্তি রোটার্ডামের ইরাজমেস ও ইংল্যান্ডের টিনডেল সংস্কার করার বিষয়ে জোর দিয়েছিল। কিন্তু জার্মানিতে ইয়োহানেস গুটেনবার্গের চলমান মুদ্রাক্ষর ছাপাখানার সাহায্যে, অন্যান্য সংস্কারকের আওয়াজের চেয়ে লুথারের আওয়াজ বেশি জোরে ও ব্যাপকভাবে শোনা গিয়েছিল।

মেইন্‌জে গুটেনবার্গের ছাপাখানা ১৪৫৫ সালে চালু হয়েছিল। পনেরেশো সালের প্রথমদিকে জার্মানির ৬০টি শহরে ও ইউরোপের অন্যান্য ১২টি দেশে ছাপাখানাগুলো পৌঁছে গিয়েছিল। ইতিহাসে প্রথমবার জনসাধারণকে আগ্রহের বিষয়গুলো সম্বন্ধে তাড়াতাড়ি জানাতে পারা গিয়েছিল। লুথারের অনুমতি ছাড়াই হয়তো, তার ৯৫টি নিবন্ধ ছাপানো ও চারিদিকে প্রচার করা হয়েছিল। গির্জার সংস্কারের বিতর্কিত বিষয়টি এক স্থানীয় বিচার্য বিষয় আর ছিল না। এই মতাবিরোধ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং মার্টিন লুথার জার্মানিতে হঠাৎ করে খুব বিখ্যাত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন।

‘সূর্য ও চন্দ্র’ প্রতিক্রিয়া দেখায়

শতাব্দী ধরে ইউরোপ দুটো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অধিকারে ছিল: পবিত্র রোমীয় সম্রাট ও রোমান ক্যাথলিক গির্জা। লুথারন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন এর প্রাক্তন সভাপতি হ্যান্স লিলয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, “সম্রাট ও পোপ সূর্য ও চন্দ্রের মতো অঙ্গীভূত ছিল।” কিন্তু কে সূর্য ও কে চন্দ্র ছিলেন, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমদিকে দুটো প্রতিষ্ঠানই তাদের ক্ষমতার শিখর পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শীঘ্রই পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছিল।

পোপ লিও ১০ম, লুথারের ৯৫টি নিবন্ধের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন এই হুমকি দিয়ে যে, লুথার যদি সেগুলোকে প্রত্যাহার না করেন, তা হলে তাকে গির্জা থেকে বহিষ্কার করা হবে। সাহসী লুথার হুমকি দেওয়া পোপের সেই মুদ্রাঙ্কিত নির্দেশপত্র জনসাধারণ্যে পুড়িয়ে ফেলেছিলেন এবং আরও কিছু বই ছাপিয়েছিলেন, যেগুলো পোপের স্বীকৃতি ছাড়াই গির্জাকে সংস্কার করতে নৃপতিদের শাসিত রাজ্যগুলোকে উৎসাহ দিয়েছিল। ১৫২১ সালে, লুথারকে পোপ লিও ১০ম গির্জা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। লুথার যখন প্রতিবাদ করেছিলেন যে, এক ন্যায্য শুনানি ছাড়াই তাকে অপরাধী বলে রায় দেওয়া হয়েছে, তখন সম্রাট চার্লস ৫ম সংস্কারকারীকে ওয়ার্মজে সম্রাটের আইনসভার সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৫২১ সালের এপ্রিল মাসে লুথারের উইটেনবার্গ থেকে ওয়ার্মজে যাওয়ার ১৫ দিনের যাত্রা ছিল এক শোভাযাত্রার মতো। জনসাধারণ তার পক্ষে ছিল এবং সব জায়গার লোকেরা তাকে দেখতে চেয়েছিল।

ওয়ার্মজে লুথার সম্রাট, রাজকুমারদের ও পোপের দূতের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। ইয়ান হুস ১৪১৫ সালে কনস্ট্যান্সে একই ধরনের শুনানির মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং তাকে খুঁটিতে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। গির্জা ও সম্রাটের দৃষ্টি যখন লুথারের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল, তখন তিনি তার নিবন্ধগুলো প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেছিলেন যতক্ষণ না তার বিরোধীরা বাইবেল থেকে প্রমাণ করে যে তিনি ভুল। কিন্তু, শাস্ত্রপদগুলো মনে রাখার ব্যাপারে কেউ তার সমতুল্য হতে পারেনি। এডিক্ট অফ উয়র্মস নামের দলিলটি শুনানির ফলাফল দিয়েছিল। এটা লুথারকে অপরাধী বলে ঘোষিত করেছিল এবং তার লেখাগুলোকে নিষিদ্ধ করেছিল। পোপের দ্বারা গির্জা থেকে বহিষ্কৃত এবং সম্রাটের দ্বারা অপরাধী বলে ঘোষিত হওয়ায়, তিনি মৃত্যুর ঝুঁকিতে ছিলেন।

এরপর ঘটনাগুলোর পরিবর্তন ঘটে, যেগুলো শুধু নাটকীয়ই ছিল না কিন্তু সেইসঙ্গে অপ্রত্যাশিতও ছিল। উইটেনবার্গে ফিরে আসার সময় লুথার স্যাক্সনির পরোপকারী ফ্রেডরিকের দ্বারা ব্যবস্থিত ভান করা অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। এটা লুথারকে তার শত্রুদের নাগালের বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। লুথারকে নির্জন ভার্টবুর্গ প্রাসাদে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, যেখানে তিনি দাড়ি রেখেছিলেন এবং এক নতুন পরিচয় নিয়েছিলেন—ইয়ুনকে ইয়র্গ নামে একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।

সেপ্টেম্বর বাইবেলের বিরাট চাহিদা

পরের দশ মাস লুথার ভার্টবুর্গ প্রাসাদে সম্রাট ও পোপ উভয়ের কাছ থেকে একজন পলাতক হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন। ভেল্টেরবি ভার্টবুর্গ বইটি ব্যাখ্যা করে যে, “ভার্টবুর্গে থাকার সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে ফলপ্রসূ ও সৃজনশীল সময় ছিল।” জার্মান ভাষায় গ্রিক শাস্ত্রের এরাসমাস পাঠ্যাংশের অনুবাদ ছিল তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, যেটা সেখানে শেষ হয়েছিল। ১৫২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুবাদক হিসেবে লুথারের নাম ছাড়া প্রকাশিত এই বইটি সেপ্টেম্বর বাইবেল নামে পরিচিত ছিল। এটার দাম ছিল দেড় গিল্ডার—যেটা একজন দাসীকে দেওয়া এক বছরের বেতনের সমান। তবুও, সেপ্টেম্বর বাইবেলের চাহিদা ছিল বিস্ময়কর। ১২ মাসের মধ্যে দুটো সংস্করণের ৬০০০টি কপি ছাপানো হয়েছিল আর অন্তত ৬৯টি সংস্করণ পরের ১২ বছরের মধ্যে বের হওয়ার অপেক্ষায় ছিল।

১৫২৫ সালে, মার্টিন লুথার ক্যাথারিনা ফোন বোরে নামে একজন প্রাক্তন সন্ন্যাসিনীকে বিয়ে করেছিলেন। ক্যাথারিনা ঘরসংসার এবং তার স্বামীর উদারতার দ্বারা সৃষ্ট চাহিদাগুলো সামলানোর ব্যাপারে দক্ষ ছিলেন। লুথারের পরিবারে শুধুমাত্র তার স্ত্রী ও ছয়টি ছেলেমেয়েই ছিল না কিন্তু সেইসঙ্গে বন্ধুবান্ধব, পণ্ডিত ও শরণার্থীরাও ছিল। পরবর্তী জীবনে লুথার একজন পরামর্শদাতা হিসেবে এমন খ্যাতি লাভ করেছিলেন যে, পণ্ডিতরা যারা তার বাড়িতে অতিথি ছিল তারা তার বক্তব্যগুলো লেখার জন্য কলম ও কাগজ নিয়ে তৈরি থাকত। এই লেখাগুলোকে একত্রিত করে একটা বই তৈরি করা হয়েছিল যেটার শিরোনাম ছিল লুটেরস টিশরেডেন (টেবিলে বলা লুথারের কথা)। কিছু সময়ের জন্য, এটা জার্মান ভাষায় এতটাই বিতরিত হয়েছিল যে, বাইবেলের পরে এটা দ্বিতীয় স্থানে ছিল।

দক্ষ অনুবাদক ও ফলপ্রসূ লেখক

১৫৩৪ সালের মধ্যে লুথার তার ইব্রীয় শাস্ত্রের অনুবাদ শেষ করেছিলেন। রচনাশৈলী, ছন্দ ও শব্দসূচিকে ভারসাম্যভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা তার ছিল। এর ফলে একটা বাইবেল অনূদিত হয়েছিল যেটা সাধারণ লোকের জন্য বোধগম্য ছিল। তার অনুবাদ পদ্ধতি সম্বন্ধে মন্তব্য করে লুথার লিখেছিলেন: “মায়ের সঙ্গে তার বাড়িতে, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে রাস্তায় ও সাধারণ লোকের সঙ্গে বাজারে আমাদের কথা বলা আর তারপর কীভাবে তারা কথা বলে, তা মনোযোগ সহকারে শোনা এবং এরপর সেভাবে অনুবাদ করা উচিত।” লুথারের বাইবেল বিধিবদ্ধ লিখিত ভাষার ভিত্তি স্থাপন করতে সাহায্য করেছিল, যেটাকে জার্মানির সব জায়গায় গ্রহণ করা হয়েছিল।

একজন অনুবাদক হিসেবে লুথারের দক্ষতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ছিল একজন লেখক হিসেবে তার পটুতা। তিনি তার সমগ্র কর্মজীবনে প্রতি দুসপ্তাহ অন্তর একটা করে প্রবন্ধ লিখতেন বলে কথিত আছে। এই প্রবন্ধগুলোর কয়েকটা এগুলোর লেখকের মতো বিতর্কযুক্ত ছিল। লুথারের শুরুর লেখাগুলোর রচনাশৈলী ব্যঙ্গাত্মক ছিল কিন্তু তার বয়স হওয়ার সঙ্গে সেগুলো সুমধুর হয়ে পড়েনি। তার পরবর্তী প্রবন্ধগুলো দিন দিন আরও ব্যঙ্গাত্মক হয়ে গিয়েছিল। লেকসিকোন ফুয়ের টেওলোজি উন্ট কিরচে অনুযায়ী লুথারের বইগুলো “তার প্রচণ্ড রাগ” এবং “নম্রতা ও প্রেমের অভাব” ও সেইসঙ্গে “বিশেষ আহ্বানের প্রতি সাড়া দেওয়ার তীব্র অনুভূতি” প্রকাশ করে।

যখন কৃষকদের যুদ্ধ শুরু হয়েছিল এবং নৃপতিদের শাসিত রাজ্যগুলোতে অনেক লোক হত হয়েছিল, তখন এই বিদ্রোহের বিচার সম্বন্ধে লুথারের মত চাওয়া হয়েছিল। কৃষকদের তাদের সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার কি যথার্থ কারণ ছিল? লুথার অধিকাংশ লোকেদের খুশি করার মতো উত্তর দিয়ে সাধারণ লোকের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঈশ্বরের দাসদের তাদের বাধ্য হওয়া উচিত, যারা ক্ষমতায় রয়েছে। (রোমীয় ১৩:১) এক স্পষ্ট বিচারে, লুথার বলেছিলেন যে বিদ্রোহকে বল প্রয়োগ করে দমিয়ে দেওয়া উচিত। তিনি বলেছিলেন, “যে করতে পারবে সে আসুক, বিদ্ধ করুক, আঘাত করুক, মেরে ফেলুক।” হ্যান্স লিলয়ে বলেছিলেন যে, এই উত্তরের জন্য লুথারকে “লোকেদের মধ্যে এই সময় পর্যন্ত থাকা তার অদ্বিতীয় জনপ্রিয়তা” হারাতে হয়েছিল। এ ছাড়া, যে-যিহুদিরা খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদের সম্বন্ধে লেখা লুথারের পরবর্তী প্রবন্ধগুলো বিশেষ করে যিহুদি ও তাদের মিথ্যা সম্বন্ধে প্রবন্ধটি, যিহুদি-বিরোধী হিসেবে লেখককে চিহ্নিত করতে অনেককে পরিচালিত করেছিল।

লুথারের উত্তরাধিকার

লুথার, ক্যালভিন ও জুইঙ্গলির মতো ব্যক্তিদের দ্বারা উদ্দীপিত সংস্কার সাধন প্রটেস্টান্ট মতবাদ নামে এক নতুন ধর্ম গঠন করতে পরিচালিত করেছিল। প্রটেস্টান্ট মতবাদকে দেওয়া লুথারের প্রধান উত্তরাধিকার ছিল বিশ্বাস দ্বারা সত্যতা প্রতিপাদনের বিষয়ে তার মুখ্য শিক্ষা। জার্মানির নৃপতিদের শাসিত রাজ্যগুলোর প্রত্যেকটা হয় প্রটেস্টান্ট নতুবা ক্যাথলিক বিশ্বাসকে সমর্থন করত। প্রটেস্টান্ট মতবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং স্ক্যানডিনেভিয়া, সুইটজারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডে লোকেদের সমর্থন পেয়েছিল। আজকে এর লক্ষ লক্ষ অনুসারী রয়েছে।

অনেকে যারা লুথারের সবকটা বিশ্বাসকে সমর্থন করে না, তারাও তাকে অনেক শ্রদ্ধা করে। প্রাক্তন জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, যেটার সীমান্তে ইসলেবেন, এরফার্ট, উইটেনবার্গ ও ভার্টবুর্গ অন্তর্ভুক্ত, সেটা ১৯৮৩ সালে লুথারের ৫০০তম জন্ম বার্ষিকী পালন করেছিল। এই সমাজতন্ত্রী প্রদেশটা তাকে জার্মানের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এ ছাড়া, ১৯৮০-র দশকের একজন ক্যাথলিক ধর্মশাস্ত্রবিদ লুথারের প্রভাব সম্বন্ধে সারাংশ করে বলেছিলেন: “লুথারের পরে আসা কোনো ব্যক্তিই তার সমান হতে পারেনি।” অধ্যাপক এল্যান্ড লিখেছিলেন: “প্রতি বছর মার্টিন লুথার ও সংস্কার সাধন নিয়ে অন্তত ৫০০টি নতুন প্রকাশনা প্রকাশিত হয়—আর সেগুলো প্রায় বিশ্বের সমস্ত প্রধান প্রধান ভাষায় প্রকাশিত হয়।”

মার্টিন লুথারের তীক্ষ্ম বুদ্ধি, অসাধারণ স্মরণশক্তি, বাক্যের জ্ঞান ও ফলপ্রসূ কাজের নীতি ছিল। এ ছাড়া, তিনি অধৈর্য ও ধৃষ্ট ছিলেন এবং তিনি যেটাকে ভণ্ডামি হিসেবে দেখতেন, সেটার প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতেন। ১৫৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলেবেনে যখন তিনি মৃত্যু শয্যাশায়ী ছিলেন, তখন বন্ধুবান্ধবরা লুথারকে জিজ্ঞেস করেছিল যে, তিনি অন্যদের যেসমস্ত বিশ্বাস সম্বন্ধে শিখিয়েছিলেন, সেগুলোর প্রতি তিনি নিজে দৃঢ় ছিলেন কি না। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন “হ্যাঁ।” লুথার মারা গিয়েছেন কিন্তু এখনও অনেকে সেই বিশ্বাসে বিশ্বাসী।

[২৭ পৃষ্ঠার চিত্র]

লুথার মুক্তিপত্রগুলো বিক্রয়ের বিরোধিতা করেছিলেন

[সৌজন্যে]

Mit freundlicher Genehmigung: Wartburg-Stiftung

[২৮ পৃষ্ঠার চিত্র]

লুথার তার নিবন্ধগুলো প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করেছিলেন যতক্ষণ না তার বিরোধীরা বাইবেল থেকে প্রমাণ করে যে তিনি ভুল

[সৌজন্যে]

From the book The Story of Liberty, ১৮৭৮

[২৯ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]

ভার্টবুর্গ প্রাসাদে লুথারের কামরা, যেখানে তিনি বাইবেল অনুবাদ করেছিলেন

[সৌজন্যে]

দুটো ছবিই: Mit freundlicher Genehmigung: Wartburg-Stiftung

[২৬ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

From the book Martin Luther The Reformer, ৩rd Edition, published by Toronto Willard Tract Depository, Toronto, Ontario

[৩০ পৃষ্ঠার চিত্র সৌজন্যে]

From the book The History of Protestantism (Vol. I)