ঐশিক হস্তক্ষেপ আমরা কী আশা করতে পারি?
ঐশিক হস্তক্ষেপ আমরা কী আশা করতে পারি?
সাধারণ কাল পূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে যিহূদার ৩৯ বছর বয়স্ক রাজা হিষ্কিয় জানতে পেরেছিলেন যে, তার এক মারাত্মক অসুখ হয়েছে। হিষ্কিয় এই সংবাদে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়ে তাকে সুস্থ করার জন্য প্রার্থনায় ঈশ্বরকে অনুরোধ করেছিলেন। ঈশ্বর তাঁর ভাববাদীর মাধ্যমে উত্তর দিয়েছিলেন: “আমি তোমার প্রার্থনা শুনিলাম; আমি তোমার নেত্রজল দেখিলাম; দেখ, আমি তোমার আয়ু পনর বৎসর বৃদ্ধি করিব।”—যিশাইয় ৩৮:১-৫.
কেন ঈশ্বর সেই বিশেষ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন? এর কয়েক শতাব্দী আগে ধার্মিক রাজা দায়ূদের কাছে ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন: “তোমার কুল ও তোমার রাজত্ব তোমার সম্মুখে চিরকাল স্থির থাকিবে; তোমার সিংহাসন চিরস্থায়ী হইবে।” এ ছাড়া, ঈশ্বর এও ২ শমূয়েল ৭:১৬; গীতসংহিতা ৮৯:২০, ২৬-২৯; যিশাইয় ১১:১) হিষ্কিয় যখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তখন তার কোনো ছেলে ছিল না। অতএব দায়ূদের রাজকীয় বংশ শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মধ্যে ছিল। হিষ্কিয়ের ক্ষেত্রে ঐশিক হস্তক্ষেপ মশীহের দিকে পরিচালনাকারী সেই বংশকে সংরক্ষণ করার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সাধন করছিল।
প্রকাশ করেছিলেন যে, মশীহ দায়ূদের বংশে জন্ম নেবেন। (যিহোবা তাঁর প্রতিজ্ঞাগুলো পূর্ণ করার জন্য প্রাক-খ্রিস্টীয় যুগে বিভিন্ন সময়ে তাঁর লোকেদের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে মোশি ইস্রায়েলীয়দের মিশরের বন্দীত্ব থেকে মুক্তির বিষয়ে ঘোষণা করেছিলেন: “সদাপ্রভু তোমাদিগকে প্রেম করেন, এবং তোমাদের পিতৃপুরুষদের কাছে যে দিব্য করিয়াছেন, তাহা রক্ষা করেন, তন্নিমিত্তে সদাপ্রভু বলবান্ হস্ত দ্বারা তোমাদিগকে বাহির করিয়া আনিয়াছেন।”—দ্বিতীয় বিবরণ ৭:৮.
একইভাবে প্রথম শতাব্দীতে, ঐশিক হস্তক্ষেপ ঈশ্বরের উদ্দেশ্য এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, দম্মেশকে যাওয়ার পথে শৌল নামে এক যিহুদি ব্যক্তিকে খ্রিস্টের শিষ্যদের ওপর তাড়না করা থেকে থামানোর জন্য তাকে এক অলৌকিক দর্শন দেওয়া হয়েছিল। এই ব্যক্তি যিনি পরে প্রেরিত পৌল হয়েছিলেন তার ধর্মান্তর, বিভিন্ন জাতির মধ্যে সুসমাচার ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।—প্রেরিত ৯:১-১৬; রোমীয় ১১:১৩.
হস্তক্ষেপ কি নমুনা ছিল?
ঐশিক হস্তক্ষেপে কি স্বাভাবিক বিষয় ছিল, নাকি ব্যতিক্রম ছিল? শাস্ত্র স্পষ্টভাবে দেখায় যে, এটা কোনোভাবেই নমুনা ছিল না। যদিও ঈশ্বর তিন জন ইব্রীয় যুবককে জলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে এবং দানিয়েলকে সিংহের খাদ থেকে রক্ষা করেছিলেন ২ বংশাবলি ২৪:২০, ২১; দানিয়েল ৩:২১-২৭; দানিয়েল ৬:১৬-২২; ইব্রীয় ১১:৩৭) পিতরকে হেরোদ আগ্রিপ্প ১ম বন্দি করে রাখলেও তিনি অলৌকিকভাবে কারাগার থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। তবুও, সেই একই রাজা প্রেরিত যাকোবকে হত্যা করেছিলেন আর ঈশ্বর এই অপরাধমূলক কাজটা বন্ধ করার জন্য হস্তক্ষেপ করেননি। (প্রেরিত ১২:১-১১) যদিও ঈশ্বর অসুস্থদের সুস্থ করার আর এমনকি মৃতদের জীবিত করার ক্ষমতা প্রেরিতদের দিয়েছিলেন, তবুও তিনি “মাংসে একটা কন্টক,” যা প্রেরিত পৌলকে কষ্ট দিচ্ছিল সেটা সরিয়ে নেননি, যেটা হয়তো এক শারীরিক ব্যাধি ছিল।—২ করিন্থীয় ১২:৭-৯; প্রেরিত ৯:৩২-৪১; ১ করিন্থীয় ১২:২৮.
কিন্তু তিনি অন্য ভাববাদীদের মৃত্যু থেকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নেননি। (রোমের সম্রাট নিরোর দ্বারা খ্রিস্টের শিষ্যদের ওপর যখন প্রচণ্ড তাড়নার এক ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, তখন ঈশ্বর তা বন্ধ করার জন্য তাতে হস্তক্ষেপ করেননি। খ্রিস্টানদের অত্যাচার করা, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা এবং হিংস্র পশুদের মুখে ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এই বিরোধিতা প্রাথমিক খ্রিস্টানদের অবাক করেনি আর এটা ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে তাদের বিশ্বাসকে একটুও দুর্বল করেনি। কারণ যিশু তাঁর শিষ্যদের সতর্ক করেছিলেন যে, তাদের আদালতে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাদের দুঃখকষ্ট ভোগ আর এমনকি তাদের বিশ্বাসের জন্য মৃত্যুবরণ করার জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে।—মথি ১০:১৭-২২.
ঈশ্বর যেমন অতীতে করেছিলেন, ঠিক তেমনই আজকেও তিনি নিশ্চিতভাবে তাঁর লোকেদের বিপদজনক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে পারেন আর যারা মনে করে যে তারা তাঁর সুরক্ষা থেকে উপকৃত হয়েছে, তাদের সমালোচনা করা উচিত নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রগুলোতে ঈশ্বর হস্তক্ষেপ করেছেন বা করেননি এইরকম বলা বেশ কঠিন। যিহোবার বেশ কিছু বিশ্বস্ত সাক্ষি টুলুজ শহরের বিস্ফোরণে আহত হয়েছিল এবং নাৎসি ও কমিউনিস্ট শিবিরগুলোতে অথবা অন্যান্য দুঃখজনক পরিস্থিতিতে হাজার হাজার বিশ্বস্ত খ্রিস্টান যখন মারা গিয়েছিল, তখন ঈশ্বর সেগুলো থামানোর জন্য হস্তক্ষেপ করেননি। কেন ঈশ্বর তার অনুমোদিত ব্যক্তিদের পক্ষে ধারাবাহিকভাবে হস্তক্ষেপ করেন না?—দানিয়েল ৩:১৭, ১৮.
“কাল ও দৈব”
যখন কোনো আকস্মিক বিপর্যয় ঘটে, তখন যেকেউ আক্রান্ত হতে পারে আর সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ততা তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। টুলুজের বিস্ফোরণ যা থেকে আলাঁ এবং লিলিয়ান রক্ষা পেয়েছিল, সেখানে ৩০ জন লোক মারা যায় এবং শত শত লোক আহত হয়, যদিও এতে তাদের কোনো দোষ ছিল না। ব্যাপক আকারে হাজার হাজার লোক অপরাধের, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর বা যুদ্ধের শিকার হচ্ছে আর তাদের এই দুর্ঘটনার জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করা যায় না। বাইবেল আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রত্যেকের প্রতি “কাল ও দৈব ঘটে।”—উপদেশক ৯:১১.
এ ছাড়া, মানুষ অসুস্থতা, বার্ধক্য এবং মৃত্যুর অধীন। এমনকি যারা ভেবেছিল যে, ঈশ্বর তাদের জীবন অলৌকিকভাবে রক্ষা করেছিলেন বা যারা অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো অসুস্থতা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য তাঁকে কৃতিত্ব দিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তাদেরও মারা যেতে হয়েছিল। অসুস্থতা ও মৃত্যুকে শেষ করা এবং মানুষের চোখ থেকে ‘সমস্ত নেত্রজল মুছাইয়া দেওয়া’ এখনও ভবিষ্যতের বিষয়।—প্রকাশিত বাক্য ২১:১-৪.
আর সেইজন্য মাঝেমধ্যে হস্তক্ষেপের চেয়ে আরও বিস্তৃত ও ব্যাপক কিছু করতে হবে। বাইবেল একটা ঘটনার কথা বলে, যেটাকে “সদাপ্রভুর মহাদিন” বলা হয়েছে। (সফনিয় ১:১৪) এই ব্যাপক আকারে হস্তক্ষেপের সময়ে ঈশ্বর সমস্ত দুষ্টতা দূর করবেন। মানবজাতিকে নিখুঁত পরিস্থিতিতে অনন্তকাল বেঁচে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে, যেখানে “পূর্ব্বে যাহা ছিল, তাহা স্মরণে থাকিবে না, আর মনে পড়িবে না।” (যিশাইয় ৬৫:১৭) এমনকি মৃতদের আবার জীবিত করা হবে আর এভাবে মানুষের সমস্ত দুঃখজনক ঘটনার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি শেষ হবে। (যোহন ৫:২৮, ২৯) এরপর ঈশ্বর তাঁর অসীম প্রেম ও মঙ্গলভাবের কারণে মানবজাতির সমস্ত সমস্যার পুরোপুরি সমাধান করবেন।
আজকে ঈশ্বর যেভাবে হস্তক্ষেপ করেন
কিন্তু, এর মানে নয় যে ঈশ্বর এই সময়ে তাঁর সৃষ্টি যখন আর্তনাদ করে, তখন তিনি উদাসীনভাবে তা লক্ষ করেন। জাতিগত বা সামাজিক পটভূমি যা-ই হোক না কেন, আজকে ১ তীমথিয় ২:৩, ৪) যিশু এই প্রক্রিয়াকে এই কথাগুলোর মাধ্যমে বর্ণনা করেছিলেন: “পিতা, যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তিনি আকর্ষণ না করিলে কেহ আমার কাছে আসিতে পারে না।” (যোহন ৬:৪৪) ঈশ্বর তাঁর দাসদের দ্বারা পৃথিবীব্যাপী ঘোষিত রাজ্যের বার্তার মাধ্যমে সৎহৃদয়ের লোকেদের তাঁর প্রতি আকর্ষণ করেন।
ঈশ্বর সমস্ত মানুষকে তাঁর সম্বন্ধে জানার এবং তাঁর সঙ্গে এক ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার সুযোগ দিচ্ছেন। (এ ছাড়া, যারা ঈশ্বরের নির্দেশনায় চলতে ইচ্ছুক, তিনি তাদের জীবনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেন। ঈশ্বর তাঁর পবিত্র আত্মার মাধ্যমে তাঁর ইচ্ছাগুলো বোঝার এবং তাঁর চাহিদাগুলো পূরণ করার জন্য ‘তাহাদের হৃদয় খুলিয়া দেন।’ (প্রেরিত ১৬:১৪) হ্যাঁ, তাঁর সম্বন্ধে, তাঁর বাক্য এবং তাঁর উদ্দেশ্যগুলো সম্বন্ধে জানার সুযোগ দিয়ে ঈশ্বর আমাদের প্রত্যেকের প্রতি তাঁর প্রেমপূর্ণ আগ্রহের প্রমাণ দেন।—যোহন ১৭:৩.
পরিশেষে, আজকে ঈশ্বর তাঁর দাসদের অলৌকিকভাবে মুক্ত করে নয় বরং তাদেরকে পবিত্র আত্মা ও “পরাক্রমের উৎকর্ষ” দিয়ে সাহায্য করেন, যাতে তারা যেকোনো পরিস্থিতিই আসুক না কেন, তা মোকাবিলা করতে পারে। (২ করিন্থীয় ৪:৭) প্রেরিত পৌল লিখেছিলেন: “যিনি আমাকে শক্তি দেন, তাঁহাতে [যিহোবা ঈশ্বরে] আমি সকলই করিতে পারি।”—ফিলিপীয় ৪:১৩.
তাই জীবনের জন্য এবং সমস্ত দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত এক জগতে চিরকাল বেঁচে থাকার যে-আশা ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন, সেইজন্য আমাদের প্রতিদিন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। “আমি সদাপ্রভু হইতে যে সকল মঙ্গল পাইয়াছি, তাহার পরিবর্ত্তে তাঁহাকে কি ফিরাইয়া দিব?” গীতরচক জিজ্ঞেস করেছিলেন। “আমি পরিত্রাণের পানপাত্র গ্রহণ করিব, এবং সদাপ্রভুর নামে ডাকিব।” (গীতসংহিতা ১১৬:১২, ১৩) নিয়মিতভাবে এই পত্রিকা পড়া ঈশ্বর যা কিছু করেছেন, করছেন এবং করবেন, সেই বিষয়ে জানতে সাহায্য করবে, যা এখনই আপনার জন্য সুখ নিয়ে আসবে ও ভবিষ্যতের জন্য এক দৃঢ় আশা প্রদান করবে।—১ তীমথিয় ৪:৮.
[৬ পৃষ্ঠার ব্লার্ব]
“পূর্ব্বে যাহা ছিল, তাহা স্মরণে থাকিবে না, আর মনে পড়িবে না।”—যিশাইয় ৬৫:১৭.
[৫ পৃষ্ঠার চিত্র]
বাইবেলের সময়ে, সখরিয়কে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলার . . .
অথবা হেরোদের দ্বারা নির্দোষ শিশুদের নির্দয়ভাবে হত্যা করার সময়ে যিহোবা তাতে বাধা দেননি
[৭ পৃষ্ঠার চিত্র]
সেই সময় খুবই নিকটে যখন আর দুঃখকষ্ট থাকবে না; এমনকি মৃতেরা আবার জীবিত হবে