যাকোব আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোকে উচ্চমূল্য দিয়েছিলেন
যাকোব আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলোকে উচ্চমূল্য দিয়েছিলেন
যাকোবের জীবন শত্রুতা এবং চরম দুর্দশার জন্য উল্লেখযোগ্য। তার যমজ ভাইয়ের প্রচণ্ড ক্রোধ যাকোবকে নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য পালাতে বাধ্য করে। তিনি যে-মেয়েকে ভালবাসেন তাকে পাওয়ার পরিবর্তে, প্রথমে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে প্রতারিত হন এবং অবশেষে তার চার জন স্ত্রী হয় আর এর ফলে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। (আদিপুস্তক ৩০:১-১৩) ২০ বছর ধরে তিনি এমন একজন ব্যক্তির জন্য কাজ করেন, যিনি তাকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগান। তিনি একজন দূতের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করেন এবং এর ফলে স্থায়ীভাবে ক্ষতি ভোগ করেন। তার মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়, তার ছেলেরা এক বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড ঘটায় এবং তিনি তার প্রিয় পুত্র ও স্ত্রীকে দুঃখজনকভাবে হারিয়ে চোখের জল ফেলেন। দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বৃদ্ধ বয়সে অন্য দেশে যেতে বাধ্য হয়ে তিনি স্বীকার করেন যে, তার দিন “অল্প ও কষ্টকর” হয়েছে। (আদিপুস্তক ৪৭:৯) এই সমস্ত কিছু সত্ত্বেও, যাকোব হলেন একজন আধ্যাত্মিকমনা ব্যক্তি যিনি ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করেন। তার বিশ্বাস কি ভুল জায়গায় স্থাপিত? যাকোবের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শুধু কয়েকটা বিবেচনা করে কোন শিক্ষাগুলো শেখা যেতে পারে?
তার ভাইয়ের থেকে অনেক আলাদা
তার ভাইয়ের সঙ্গে সংঘাত ঘটার কারণ ছিল, যাকোব আধ্যাত্মিক সম্পদগুলোকে উচ্চমূল্য দিয়েছিলেন কিন্তু এষৌ সেগুলোকে অবজ্ঞা করেছিলেন। অব্রাহামের কাছে করা প্রতিজ্ঞাত চুক্তির বিষয়ে যাকোব আগ্রহী ছিলেন এবং ঈশ্বর উত্তরাধিকারী হিসেবে তাকে যে-পরিবার দিয়েছিলেন, সেই পরিবারের যত্ন নেওয়ার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তাই, যিহোবা তাকে ‘প্রেম করিতেন।’ যাকোব ছিলেন “শান্ত [“নির্দোষ,” NW]” যে-শব্দ নৈতিক উৎকর্ষতাকে প্রকাশ করে। বিপরীতে, এষৌ তার আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের প্রতি এত কম আগ্রহ দেখিয়েছিলেন যে, এক সামান্য বিষয়ের বিনিময়ে তিনি সেটা যাকোবের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ঐশিক অনুমোদন সহকারে যাকোব যখন যেটা তার ছিল, সেটা দাবি করেছিলেন এবং তার ভাইয়ের জন্য নির্ধারিত আশীর্বাদ তিনি লাভ করেছিলেন, তখন এষৌ প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে ওঠেন। এরপর যাকোব তার প্রিয় সমস্তকিছু ফেলে চলে যান কিন্তু পরবর্তী সময়ে যা ঘটেছিল, তা নিশ্চিতভাবেই নিরুৎসাহবোধ জাগিয়ে তোলে।—মালাখি ১:২, ৩; আদিপুস্তক ২৫:২৭-৩৪; ২৭:১-৪৫.
এক স্বপ্নের মাধ্যমে ঈশ্বর যাকোবকে দেখিয়েছিলেন যে, দূতেরা স্বর্গ এবং পৃথিবীর মধ্যেকার একটা সিঁড়ি দিয়ে অথবা ‘পাথরের সোপানশ্রেণীর’ (পাদটীকা, NW) সাহায্যে উঠছে আর নামছে এবং বলেছিলেন যে, তিনি যাকোব ও আদিপুস্তক ২৮:১০-১৫.
তার বংশকে রক্ষা করবেন। “তোমাতে ও তোমার বংশে পৃথিবীস্থ যাবতীয় গোষ্ঠী আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইবে। আর দেখ, আমি তোমার সহবর্ত্তী, যে যে স্থানে তুমি যাইবে, সেই সেই স্থানে তোমাকে রক্ষা করিব, ও পুনর্ব্বার এই দেশে আনিব; কেননা আমি তোমাকে যাহা যাহা বলিলাম, তাহা যাবৎ সফল না করি, তাবৎ তোমাকে ত্যাগ করিব না।”—কতই না আশ্বাসজনক! যিহোবা নিশ্চিত করেছিলেন যে, অব্রাহাম ও ইস্হাককে দেওয়া সেই প্রতিজ্ঞাগুলো যাকোবের পরিবারকে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধ করবে। যাকোবকে জানানো হয়েছিল যে, দূতেরা সেই সমস্ত ব্যক্তির সেবা করতে পারে, যাদের ঈশ্বরের অনুমোদন রয়েছে এবং তাকে ঐশিক সুরক্ষা সম্বন্ধেও নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল। কৃতজ্ঞতা সহকারে, যাকোব যিহোবার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে বলে মানত করেছিলেন।—আদিপুস্তক ২৮:১৬-২২.
যাকোব কোনোভাবেই এষৌর উত্তরাধিকারকে বলপূর্বক অধিকার করেননি। দুই ছেলের জন্ম হওয়ার আগেই যিহোবা বলেছিলেন যে, “জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠের দাস হইবে।” (আদিপুস্তক ২৫:২৩) কেউ কেউ জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘ঈশ্বর যদি যাকোবকে প্রথমে জন্মগ্রহণ করতে দিতেন, তা হলে সেটা কি আরও সহজ হতো না?’ কিন্তু, পরবর্তী সময়ে যা হয়েছিল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ সত্যগুলো সম্বন্ধে শিক্ষা দেয়। ঈশ্বর সেই সমস্ত ব্যক্তির জন্য আশীর্বাদ সংরক্ষিত করে রাখেন না, যারা মনে করে যে সেগুলোর ওপর তাদের অধিকার রয়েছে বরং তিনি তাদের প্রতি অযাচিত দয়া দেখান, যাদের তিনি বাছাই করেন। এই কারণে, জ্যেষ্ঠাধিকার যাকোবের কাছে স্থানান্তরিত হয়েছিল, তার বড় ভাইয়ের কাছে নয়, যিনি সেটার প্রতি উপলব্ধি দেখাননি। একইভাবে একটা জাতি হিসেবে যিহুদিরা, এষৌর মতো ঠিক একই মনোভাব দেখিয়েছিল বলে তাদের জায়গায় আত্মিক ইস্রায়েলীয়দের মনোনীত করা হয়েছিল। (রোমীয় ৯:৬-১৬, ২৪) আজকেও যিহোবার সঙ্গে উত্তম সম্পর্ক কখনোই প্রচেষ্টাহীন উত্তরাধিকারের মাধ্যমে আসে না, এমনকি তা যদি একজন ব্যক্তি কোনো ঈশ্বর-ভয়শীল পরিবার বা পরিবেশের মধ্যেও বড় হয়ে ওঠে। যারা ঐশিক আশীর্বাদগুলো পেতে চায়, তাদের সকলকে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে হবে।
লাবনের দ্বারা অভ্যর্থিত
তার আত্মীয়দের মধ্যে থেকে একজন পাত্রী খোঁজার জন্য পদ্দন্-অরামে পৌঁছানোর পর, যাকোব কুয়োর কাছে লাবনের মেয়ে, তার মামাতো বোন রাহেলের দেখা পান, এবং কুয়োর মুখ থেকে ভারী পাথর সরিয়ে দেন, যাতে রাহেল যে-পশুপাল চরাচ্ছিলেন, সেই পালকে জল খাওয়াতে পারেন। * রাহেল দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে যাকোবের আসার কথা জানান এবং লাবন তাড়াতাড়ি তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। লাবনের পরিবার অব্রাহামের দাসের কাছ থেকে যে-ধনসম্পদ পেয়েছিল, সেই সম্বন্ধে যদি তিনি স্মরণ করে থাকতেন, তা হলে তিনি হতাশ হতেন। কারণ যাকোব খালিহাতে এসেছিলেন। কিন্তু স্পষ্টতই লাবন এমন কিছু দেখেছিলেন, যা তিনি নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারতেন—এক পরিশ্রমী কর্মী।—আদিপুস্তক ২৮:১-৫; ২৯:১-১৪.
যাকোব তার ঘটনা ব্যাখ্যা করেন। এটা স্পষ্ট নয় যে, জ্যেষ্ঠাধিকার লাভ করার জন্য তিনি যে-কৌশলতা অবলন্বন করেছিলেন, সেই বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন কি না কিন্তু “সমস্ত বৃত্তান্ত” শোনার পর লাবন বলেছিলেন: “তুমি নিতান্তই আমার অস্থি ও আমার মাংস।” একজন পণ্ডিত ব্যক্তি বলেছিলেন যে, এই বাক্যাংশটাকে এমনভাবে নেওয়া যেতে পারে যে এটা যাকোবকে সেখানে থেকে যাওয়ার জন্য এক উষ্ণ অভ্যর্থনা অথবা সম্পর্কের কারণে লাবন যে তাকে রক্ষা করতে বাধ্য, সেই সম্বন্ধে এক স্বীকৃতি। ঘটনা যাই হোক না কেন, লাবন শীঘ্রই চিন্তা করতে থাকেন যে, কীভাবে তিনি তার ভাগনেকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারেন।
লাবন এমন সব বিষয়ের সূত্রপাত করেন, যেগুলো আগামী ২০ বছরের মধ্যে ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেছিলেন, “তুমি কুটুম্ব বলিয়া কি বিনা বেতনে আমার দাস্যকর্ম্ম করিবে? বল দেখি, কি বেতন লইবে?” যদিও লাবন দয়ালু মামা হওয়ার ভান করেছিলেন কিন্তু তিনি দাসত্ব করার এক চুক্তির মাধ্যমে যাকোবের সঙ্গে তার রক্তের সম্পর্ককে হ্রাস করে দিয়েছিলেন। যেহেতু, যাকোব রাহেলের প্রেমে পড়েছিলেন, তাই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন: “আপনার কনিষ্ঠা কন্যা রাহেলের জন্য আমি সাত বৎসর আপনার দাস্যকর্ম্ম করিব।”—আদিপুস্তক ২৯:১৫-২০.
কনের পরিবারকে কনেপণ দেওয়ার মাধ্যমে বাগ্দান সম্পাদন হতো। পরবর্তী সময়ে, মোশির ব্যবস্থায় ধার্য করা হয়, যে-কুমারী মেয়েকে সতীত্বহানি করা হয়েছে, তার জন্য ৫০ শেকল রৌপ্য পণ হিসেবে দিতে হবে। পণ্ডিত গরডন ওয়েনেম বিশ্বাস করেন যে, এটা ছিল “সর্বোচ্চ পরিমাণ বিয়ের উপহার” কিন্তু অধিকাংশই “খুব কম” ছিল। (দ্বিতীয় বিবরণ ২২:২৮, ২৯) যাকোব সেই মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি। তিনি লাবনকে ৭ বছর কাজ করতে চাওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব দেন। “প্রাচীন বাবিলের সময় যেহেতু ঠিকা মজুররা মাসে অর্ধেক থেকে এক শেকলের মতো আয় করত” (পুরো সাত বছরে ৪২ থেকে ৮৪ শেকল), ওয়েনেম বলে চলেন, “যাকোব রাহেলকে বিয়ে করার বিনিময়ে লাবনকে এক উদার বিবাহ উপহার দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।” লাবন সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করেছিলেন।—আদিপুস্তক ২৯:১৯.
রাহেলের প্রতি যাকোবের প্রেম এতটা গভীর ছিল যে, তার কাছে সাত বছরকে মনে হয়েছিল যেন “এক এক দিন।” এরপর তিনি বড় ঘোমটায় আচ্ছাদিত কনের দাবি করেন কিন্তু এর মধ্যে যে লাবনের চাতুরীর রয়েছে, সেই বিষয়ে একটুও আভাস পাননি। পরের দিন সকালে তিনি যখন দেখতে পান যে, তিনি রাহেলের সঙ্গে নয় কিন্তু তার বোন লেয়ার সঙ্গে ঘুমিয়েছিলেন, তখন তিনি কতটা আঘাত পেয়েছিলেন, তা কল্পনা করুন! যাকোব প্রশ্ন করেছিলেন: “আপনি আমার সহিত এ কি ব্যবহার করিলেন? আমি কি রাহেলের জন্য আপনার দাস্যকর্ম্ম করি নাই? তবে কেন আমাকে প্রবঞ্চনা করিলেন?” লাবন উত্তর দিয়েছিলেন: “জ্যেষ্ঠার অগ্রে কনিষ্ঠাকে দান করা আমাদের এই স্থানে অকর্ত্তব্য। তুমি ইহার সপ্তাহ পূর্ণ কর; পরে আরও সাত বৎসর আমার দাস্যকর্ম্ম স্বীকার করিবে, সেজন্য আমরা উহাকেও তোমাকে দান করিব।” (আদিপুস্তক ২৯:২০-২৭) অসহায় হয়ে এবং ফাঁদে পড়ে যাকোবের সেই শর্তগুলো মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, যদি তিনি রাহেলকে চান।
প্রথম সাত বছরের বিপরীতে পরবর্তী বছরগুলো তিক্ত ছিল। যাকোব কীভাবে লাবনের নিষ্ঠুর প্রবঞ্চনাকে উপেক্ষা করতে পারতেন? আর লেয়ার সম্বন্ধেই বা কী বলা যায়, যিনি এতে সহযোগিতা করেছিলেন? অবশ্য, লেয়া এবং রাহেলের জন্য লাবন যে-অশান্ত ভবিষ্যৎ তৈরি করেছিলেন, সেই ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহই ছিল না। তিনি নিজের স্বার্থ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। আবার লেয়া যখন পর পর চার ছেলের জন্ম দেন কিন্তু রাহেল বন্ধ্যা থেকে যান, তখন ক্রোধের সঙ্গে ঈর্ষার মনোভাবও জেগে উঠে। এরপর রাহেল সন্তানের জন্য মরিয়া হয়ে নিজের দাসীকে বিকল্প মা হিসেবে দান করে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে লেয়াও ঠিক তা-ই করেন। অবশেষে যাকোবের ৪ জন স্ত্রী, ১২ জন সন্তান হয় কিন্তু কোনোভাবেই এক সুখী পরিবার হতে পারেনি। তবুও, যিহোবা যাকোবকে এক বিরাট জাতিতে পরিণত করছিলেন।—আদিপুস্তক ২৯:২৮-৩০:২৪.
যিহোবার দ্বারা সমৃদ্ধি পাওয়া
পরীক্ষাগুলো সত্ত্বেও যাকোব দেখেন যে, ঈশ্বর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী তার সঙ্গে আছেন। লাবনও তা দেখেছিলেন কারণ যাকোব যখন এসেছিলেন, তখন তার যে-সামান্য পশুপাল ছিল, সেগুলোর সংখ্যা তার ভাগনের যত্নে বেড়ে বিশাল হয়েছিল। যাকোবকে পাঠাতে ইতস্তত করে লাবন তাকে আরও কিছু সময় কাজ করার বিনিময়ে বেতন নির্ধারণ করতে বলেন, যেকারণে যাকোব লাবনের পশুপালের মধ্যে যে-অস্বাভাবিক রঙের পশুগুলো জন্মেছিল, সেগুলো তাকে দেওয়ার কথা বলেন। কথিত আছে যে, সেই এলাকার মেষগুলো সাধারণত সাদা এবং ছাগলগুলো কালো বা গাড় বাদামি রঙের ছিল; শুধুমাত্র সামান্য কিছু চিত্রাঙ্গ ছিল। তাই, তাকে অনেক কম বেতন দিতে হবে এটা ভেবে লাবন সহজেই রাজি হয়ে যান এবং অবিলম্বে তার সমস্ত পশুপালকে সেই সমস্ত অস্বাভাবিক রঙের পশুগুলোর সংস্পর্শে আসা এড়ানোর জন্য দূরে সরিয়ে নিয়ে যান, যেগুলো যাকোবের রক্ষণাধীনে থাকে। স্পষ্টতই, তিনি মনে করেছিলেন যে, যাকোব এই চুক্তি থেকে খুব একটা উপকার পাবেন না, নিশ্চিতভাবে তিনি সদ্যজাত ছাগলছানা এবং মেষশাবক থেকে শতকরা ২০টাও পাবেন না, যা সাধারণত প্রাচীনকালে মেষপালকরা বেতন হিসেবে পেত। কিন্তু, লাবনের চিন্তা ভুল ছিল কারণ যিহোবা যাকোবের সঙ্গে ছিলেন।—আদিপুস্তক ৩০:২৫-৩৬.
ঐশিক নির্দেশনায় যাকোব কাঙ্ক্ষিত রঙের বলিষ্ঠ পশুদের বংশবৃদ্ধি করান। (আদিপুস্তক ৩০:৩৭-৪২) পশুর বংশবৃদ্ধি করানোর ক্ষেত্রে তার ধারণা সঠিক ছিল না। কিন্তু, “বৈজ্ঞানিক দিক দিয়ে বলতে গেলে, এক রঙের পশু, যেগুলো চিত্রবিচিত্র করার প্রচ্ছন্ন জিন বহন করে . . . সফলতার সঙ্গে সেগুলোর সংকর প্রজনন করানোর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যেতে পারে,” পণ্ডিত নহূম সারনা ব্যাখ্যা করেন এবং “এই ধরনের পশুগুলোকে [এদের] বর্ণসংকর শক্তির . . . দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।”
ফলাফল লক্ষ করে লাবন, তার ভাগনের যে-পশুগুলো ছিল—রেখাচিহ্নিত, চিত্রবিচিত্র, চিত্রাঙ্গ বা বিন্দুচিহ্নিত—সেই বিষয়ে চুক্তিটা পরিবর্তন করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজ লাভের চেষ্টা করছিলেন কিন্তু লাবন যেভাবেই তার চুক্তিকে রদবদল করে থাকুন না কেন, যিহোবা নিশ্চিত করেছিলেন যাতে যাকোব সবসময় উন্নতি লাভ করে। লাবন দন্তঘর্ষণ করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেননি। যাকোব খুব শীঘ্রই অনেক ধনসম্পদ, পশুপাল, দাসদাসী, উট এবং গাধা সংগ্রহ করে আর তা নিজের ক্ষমতায় নয় কিন্তু যিহোবার সাহায্যে। পরে তিনি রাহেল ও লেয়াকে ব্যাখ্যা করেছিলেন: “তোমাদের পিতা আমাকে প্রবঞ্চনা করিয়া দশ বার আমার বেতন অন্যথা করিয়াছেন; কিন্তু ঈশ্বর তাঁহাকে আমার ক্ষতি করিতে দেন নাই। . . . ঈশ্বর তোমাদের পিতার পশুধন লইয়া আমাকে দিয়াছেন।” যিহোবা যাকোবকে এই নিশ্চয়তাও দিয়েছিলেন যে, লাবন যা কিছু করছিলেন, সেগুলোর সমস্তই তিনি দেখেছেন কিন্তু যাকোবের চিন্তিত হওয়ার দরকার নেই। “তোমার দেশে জ্ঞাতিদের নিকটে ফিরিয়া যাও,” ঈশ্বর বলেছিলেন, “তাহাতে আমি তোমার মঙ্গল করিব।”—আদিপুস্তক ৩১:১-১৩; ৩২:৯.
আদিপুস্তক ৩২:২-১২.
অবশেষে প্রতারক লাবনের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করে যাকোব বাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করেন। যদিও ২০ বছর কেটে গিয়েছিল কিন্তু তবুও তিনি এষৌকে ভয় পাচ্ছিলেন এবং বিশেষ করে যখন এই খবর পৌঁছেছিল যে, এষৌ চারশত লোক নিয়ে এগিয়ে আসছে। যাকোব কী করতে পারত? আধ্যাত্মিকমনা ব্যক্তি সবসময় ঈশ্বরের ওপর নির্ভর করেন, তিনি বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করেন। তিনি প্রার্থনা করেন, স্বীকার করেন যে, তিনি যিহোবার উদারতা পাওয়ার যোগ্য নন এবং ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞাগুলোর ওপর ভিত্তি করে তাঁর কাছে আবেদন করেন, যাতে তিনি ও তার পরিবার এষৌর হাত থেকে রক্ষা পায়।—এরপর অপ্রত্যাশিত বিষয় ঘটে। একজন আগন্তুক, যিনি একজন দূত ছিলেন, যাকোবের সঙ্গে সারারাত মল্লযুদ্ধ করেন এবং শুধুমাত্র এক স্পর্শে তিনি যাকোবের উরুফলক স্থানচ্যুত করে দিয়েছিলেন। যাকোব দূতকে ততক্ষণ পর্যন্ত ছাড়তে চাননি যতক্ষণ না তিনি প্রথমে তাকে আশীর্বাদ করেন। ভাববাদী হোশেয় পরে বলেছিলেন যে, যাকোব “রোদন ও বিনতি করিয়াছিল।” (হোশেয় ১২:২-৪; আদিপুস্তক ৩২:২৪-২৯) যাকোব জানতেন যে, পূর্বে দূতের উপস্থিতিগুলো অব্রাহামের সঙ্গে করা চুক্তি তার বংশের মাধ্যমে পরিপূর্ণ করার বিষয়ে সম্পর্কযুক্ত। তাই, তিনি প্রাণপণ মল্লযুদ্ধ করেছিলেন এবং আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। এই সময় ঈশ্বর তার নাম পালটে ইস্রায়েল রাখেন, যার অর্থ “ঈশ্বরের সহিত যুদ্ধকারী (অধ্যাবসায়ী),” অথবা “ঈশ্বর যুদ্ধ করেন।”
আপনি কি মল্লযুদ্ধ করতে ইচ্ছুক?
শুধুমাত্র একজন দূতের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করা এবং এষৌর সঙ্গে পুনর্মিলনের মতো সংকটই যাকোবকে কাটিয়ে উঠতে হয়নি। কিন্তু, এখানে যে-ঘটনাগুলো বিবেচনা করা হয়েছে, সেগুলো দেখায় যে তিনি কী ধরনের ব্যক্তি ছিলেন। যেখানে এষৌ তার জ্যেষ্ঠাধিকারের জন্য সামান্য ক্ষুধা সহ্য করতে পারেননি, সেখানে যাকোব আশীর্বাদগুলো পাওয়ার জন্য সারা জীবন সংগ্রাম করেছিলেন, এমনকি দূতের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করেছিলেন। ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী যাকোব ঐশিক নির্দেশনা এবং সুরক্ষা পেয়েছিলেন, এক বিরাট জাতির আদিপুরুষ এবং মশীহের পূর্বপুরুষ হয়েছিলেন।—মথি ১:২, ১৬.
আপনি কি যিহোবার অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য প্রাণপণ করতে, রূপকভাবে বলতে গেলে মল্লযুদ্ধ করতে ইচ্ছুক? যারা ঈশ্বরের ইচ্ছা পালন করতে চায়, তাদের জন্য আজকে জীবন সমস্যা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলোয় ভরা এবং মাঝে মাঝে সঠিক সিদ্ধান্তগুলো নিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু, যিহোবা আমাদের সামনে পুরস্কারের যে-আশা রেখেছেন, তা ধরে রাখার জন্য যাকোবের উত্তম উদাহরণ আমাদেরকে অনেক উৎসাহ দেয়।
[পাদটীকা]
^ এই ঘটনা সেই সময়ের মতোই, যখন যাকোবের মা রিবিকা ইলীয়েষরের উটগুলোকে জল খাইয়েছিলেন। এরপর রিবিকা সেই আগন্তুকের খবর নিয়ে দৌড়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন। লাবন, তার বোন উপহার হিসেবে যে-সোনাদানা পেয়েছিল, সেগুলো দেখে ইলীয়েষরকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দৌড়ে গিয়েছিলেন।—আদিপুস্তক ২৪:২৮-৩১, ৫৩.
[৩১ পৃষ্ঠার চিত্রগুলো]
আশীর্বাদগুলো পাওয়ার জন্য যাকোব সারা জীবন সংগ্রাম করেছিলেন